কাল গোলাপীর বিয়ে। দশম শ্রেণির ছাত্রী হয়েও স্কুলে যাচ্ছে না প্রায় দুই মাস হতে চললো। গোলাপীর চোখের সামনে পড়ার টেবিল, থরে থরে সাজানো বই – খাতা ভাঁজের সাদা অংশটুকু জুড়ে নিজ হাতে পেন্সিল দিয়ে আঁকা স্বপ্ন। তেমনি একটি ছবি, মুক্ত আকাশে দল বেঁধে পাখিরা উড়ে চলেছে আকাশটাকে ছোঁবে বলে। বুকের ভেতর একটু একটু সাহস সঞ্চয় করে আকাশ জয় করার স্বপ্ন এঁকেছে। এরই মধ্যে বাবা-মা তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতে চাইছে। যার সঙ্গে আগামীকাল গোলাপীর বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে এই এলাকার পরিচিত বখাটে, তার নাম রাজীব; যার কারণে গোলাপীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে গোলাপীকে সে উত্ত্যক্ত করতো। বিশ্রী রকমের বাক্য ছুড়ে দিয়ে প্রেম নিবেদন করতো। চিঠি দিত, না নিতে চাইলে এসিড ছুড়ে মুখ পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিত।
একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে সে গোলাপীর পথরোধ করে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে টানাহেঁচড়া শুরু করে। সেদিন তার শেষ স্কুলে যাওয়া। মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে বিচলিত হয়ে পরিবারের সদস্যরা তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। গ্রাম্য সালিশে বিচার দিয়েও কোনো সুবিচার পায় নি তার পরিবার; বরং উল্টো গোলাপীর চরিত্র নিয়ে কথা ওঠে। গ্রাম্য মাতবরেরা গোলাপীর সাজসজ্জা, পোশাক ও চলাফেরা নিয়ে কদাকার মন্তব্য করে। পরপুরুষ কোনো নারীকে স্পর্শ করলে নারীর শরীর নষ্ট হয়। সমাজ তাকে নষ্ট নারী বলে আখ্যায়িত করে। গোলাপী মানসিকভাবে আহত হয়। আশেপাশের মানুষরাও তাকে ও রাজীবকে নিয়ে কানাঘুষা করে। নানা রকম কুৎসিত মন্তব্যে অস্থির হয়ে অবশেষে ওই বখাটে রাজীবের সাথে বিয়ে ঠিক করে তার পরিবার।
এ বিয়েতে মত নেই গোলাপীর। গোলাপী মানুষ হতে চেয়েছিল, স্বাধীন মানুষ। সমাজ, পরিবার, পাড়াপড়শি কেউই তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা জানতে চায় নি। ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে গোলাপী। কারো দাসত্ব করার জন্য সে জন্মগ্রহণ করে নি। সে শুধুমাত্র আপন বিবেকের দাস। এ অন্যায় তাকে রুখতে হবে। সে পত্রিকার পাতায় পড়েছে তার মতো অগণিত গোলাপীরা অকালে ঝরে যাচ্ছে। কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে, বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে, অনেক কিশোরী মাতা অকালে মারা যাচ্ছে। না, সে এসব যন্ত্রণার শিকার হতে চায় না। দা হাতে নিয়ে বাগান থেকে কিছু ডাল কেটে আনে; তার বান্ধবী সীমা, রুনু ও পুতুলকে সাথে নিয়ে কয়েকটি লাঠি বানিয়ে লুকিয়ে রাখে। আগামীকাল বরযাত্রী এলে তারা এ বিয়ে ভেস্তে দেবে। পিটিয়ে বাড়ি থেকে তাদের বের করে দেবে। এ সাহসের প্রকাশ যদি না করতে পারে তবে তার আর কোনো দিন আকাশ ছোঁয়া হবে না, স্বপ্ন আঁকা ছবিটা সত্যি গল্প হবে না।