হরতন, ইস্কা, চিড়ে। গুনে-গুনে তিনটা টেক্কা নাটুকে কায়দায় সামনে নামিয়ে রাখল নুরুইল্যা। নুরুইল্যা মানে নুরহক, নুরু। নামের আশ্চর্য বিভাজনের মতো জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বিভাজিত হতে-হতে যে মানুষগুলো ক্রমাগত ঠোকর খায় বাস্তবতার দেয়ালে – তাদেরই একজন সে। বস্তির উঠতি মাস্তানদের মধ্যে হঠাৎ একটু নামডাক কামিয়ে ফেলায় সবাই ইদানীং বেশ সমীহ করে চলে নুরুকে। বিপদে-আপদে আসে, কাউকে ঠেঙ্গাতে হলেও ডাক পড়ে তার। মোটা সলতেয় জ্বালানো কুপির আলোয় চকচক করে উঠল নুরুর চোখদুটো। বিছানো গামছায় রাখা স্তূপীকৃত টাকাগুলো এখন তার। ফরিদ, নাসের, টিটু প্রতিদিনের মতো মাল টেনে খেলতে বসলেও এতক্ষণে নেশা কেটে গেছে সবার। ফরিদের চোখে-মুখে প্রতিহিংসার আগুন:
– ‘খবরদার কইতাছি, নুরু, ট্যাকায় হাত দিবি না।’
– ‘দিলে কী করবি তুই?’
– ‘খুনাখুনি অয়া যাইবো কইলাম।’
বলতে-বলতে পকেট থেকে চকচকে ক্ষুর বের করে ফরিদ, মুহূর্তে ফরিদকে সজোরে লাথি মেরে ধরাশায়ী করে তার পিঠে উঠে বসে নুরু। হাতের ক্ষুর কেড়ে নিয়ে চেপে ধরে গলায়।
– ‘কান খুইলা শুইন্যা রাখ, হালার পুত, এইহানে তগো রোয়াবের দিন শ্যাষ। অহন হব চলবো এই নুরুইল্যার কথামতো। তর ট্যাকায় থুক দিলাম যা ফোট।’ কুয়াশায় ঢাকা সারিসারি ঝুপড়ি ঘরগুলোর পাশ দিয়ে পাসপোর্ট অফিসের দিকে এগিয়ে যায় ওরা। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় তিনটি ছায়ামূর্তিকে আসতে দেখে ডাস্টবিনের নেড়িকুত্তাগুলো কিছুক্ষণ কাঁইকুঁই করে আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। একা ঘরে চুপচাপ বসে থাকে নুরু। পাশের কোনো একটা ঝুপড়িতে মরদ তার মাগীরে পিটায়। এখানে এটাই নিয়ম:
– ‘আল্লাহ গো, আমার কী হইল গো, বান্দির বাচ্চা, তোর মতো ভাতারের গায়ে মুতি। ওরে আমারে মাইরা ফালাইলোরে।’ গলির মুখে আগুন পোহাতে থাকা পোলাপানগুলোর মধ্যে একবার হাসির রোল ওঠে। খ্যাঁকখ্যাঁক করে কাশতে থাকে হামিদের বাপ বুড়ো। ভিক্ষার টাকায় খাওয়াই জোটে না তার আবার চিকিৎসা। বাপ-মার তাণ্ডবে নাবালক বাচ্চাগুলো ট্যাঁট্যাঁ করে চ্যাঁচায়। এই চ্যাঁচানোতে কখনো শেষ হয় না ক্ষুদ-পিপাসার কাব্য। খুব বড় একটা চালান আসবে আজ রাতে। দুজন পুলিশ এসে দাঁড়ায় ঝুপড়ির দরজায়। ফিসফিসিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর চলে যায়। পুলিশগুলোর বাতেলা আর ভাল্লাগে না। শালার পুরা কাঁপঝাঁপ। ব্যাবসা যত বাড়ে – অগো খাইখাই স্বভাবও তত বাড়ে। সত্যি ব্যাবসা অনেক বেড়েছে নুরুর। এমনকি ওস্তাদও এখন তার সাথে টক্কর মারতে সাহস পায় না। ফরিদ্যা আবার গিয়া ভিড়ছে ওস্তাদের দলে। তালতলার মোড়ে ঠ্যাক দিয়া আর পোষায় না অর। দুজন একলগে পান চা খিলায় আর সারাক্ষণ কী সব যুক্তি করে। করুকগা, হ্যায় তো আর এই ব্যাবসা বেশিদিন করব না। ট্যাকাপয়সা কিছু জমলে সিএনজি অটো কিনব তারপর বাসা ভাড়া কইরা রেশমীরে লইয়া উঠব হেইখানে। সারাদিন অটো চালাইয়া বাসায় ফির্যা গপসপ করব রেশমীর লগে। তার আগে একখানা কাম আছে। অরে বিয়া করন লাগব। বিয়া না করলে হ্যায় যাইব ক্যান তার লগে?
মেশিনের একটানা বোঁ-বোঁ শব্দে মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে রেশমীর। গা গুলিয়ে বমি আসে। হাতের কাজ ফেলে সে একদৌড়ে ছুটে যায় বাথরুমের দিকে। ফ্লোর সুপারভাইজার আলতাফ মিয়া কটকটে চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ওয়াক-ওয়াক করে একগাদা টক স্বাদের থুথু ফেললো রেশমী। হাতে-মুখে পানি দিল। বয়সে অল্প হলেও শরীরের ঘটনাগুলি বুঝতে বাকি থাকে না। ক্যান যে হেইদিন গেছিল নুরুল্যার ঘরে? অহন মাইনষে হুনলে কী কইবো? কউক যা-ই ইচ্ছা, মাইনষে অরে থাকনের জায়গা দিছে, খাওন দিছে, আগলাইয়া রাখছে জিসমের ভিতর? হবতে করছে ওই নুরু। ফাজিল পোলাপাইনরা বস্তির ব্যাবাক মাইয়াগো পিছে লাগে, রেশমীরে দ্যাখলে পিঠ দিয়া খাঁড়ায়। অরা জানে নুরু রেশমীরে বিয়া করব। সত্যই করব? যদি না করে? সক্কলে তহন আঙুল তুইল্যা দেহাইবো ওই যে ছেনাল যায়, ছেনাল মাগী। কিন্তুক এত কিছুর পর নুরু যদি কিছু চায় – কেমনে নিষেধ করব রেশমী, ও যে অরে খুব ভালোবাসে।
– ‘রেশমী, এদিকে শোন।’
পেছন থেকে ডাকল আলতাফ মিয়া। তারপর সবার চোখের আড়ালে স্টোররুমের ভেতর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তর না অ্যাডভান্স বেতন লাগব, আমি ম্যানেজার সাবরে কইয়া রাখছি, কাম শ্যাষে আমার লগে আইস- ব্যবস্থা কইরা দিমু নে।’
ওভারটাইমের জন্য একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল। এক শিফটে কাজ করলে ওভারটাইম ছাড়া পোষায় না। আলতাফ মিয়ার পেছন-পেছন অফিস রুমে গিয়ে ঢুকল রেশমী। অফিস টাইম শেষ হয়েছে অনেক আগেই। ফাঁকা রুমটা পেরিয়ে লম্বা একটা প্যাসেজ দিয়েকনফারেন্স রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল তারা দুজন।
– ‘এইহানে এট্টু খাঁড়া, আমি ম্যানেজার স্যারের লগে কথা কইয়া আইতাছি।’ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে রেশমীকে ভেতরে যেতে বলল সে।
– ‘আপনে যাইবেন না। ’
– ‘তুই যা, আমি সব বইলা আসছি।’ খুব সন্তর্পণে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল রেশমী। ক্ষুধার্ত শকুনের মতো খ্যাঁকখ্যাঁক শব্দে হেসে উঠল আলতাফ মিয়া। কনফারেন্স রুমের দরজা ততক্ষণে ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।
– ‘কী রে, কী হইছে, আমারে ক, এত কানতাছস ক্যা?’ নুরু বলল, রেশমীর পিঠে হাত বোলাতে-বোলাতে।
– ‘আমগো ম্যানেজার কাইল রাইতে আমারে…’
– ‘আমারে কী…?’ রেশমীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল নুরু।
– ‘আমি তার হাতে-পায় ধইরা কত কানলাম, প্যাটের বাইচ্চাডার দোহাই দিলাম, হুনল না।’ যা বোঝার বুঝে ফেলেছে নুরু। সাইক্লোন শুরু হয়ে গেছে ওর ভেতর, চোখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরুচ্ছে। রেশমীর ফুঁপিয়ে ওঠা শরীরটাকে দুহাতে জড়িয়ে ভারি গলায় বলল সে, ‘ম্যানেজারের ঠিকানাটা দে।’
– ‘না তুমি ওইহানে যাইবা না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠ রেশমীর। চেঁচিয়ে উঠল নুরু, ‘দে কইতাছি, ওই বানচোতরে আমি খুন কইরা ফালামু।’
– ‘আমি তুমারে অগ কাছে যাইতে দিমু না আমার কসম লাগে, গ্যালে অরাই তোমার ক্ষতি কইরা দিবো। আমার তো সবই গ্যাছে গা। তুমারে আমি হারাইতে চাই না।’ কান্না থামে না রেশমীর। দ্রুততালে গরম নিশ্বাস এসে পড়ে নুরুর গলায়-বুকে।
– ‘তুই তাইলে ঠিকানা দিবি না, ঠিক আছে আমি নিজেই ব্যাডার খোঁজ দ্যাখতাছি।’ তারপর রেশমীর মুখটা দুহাতে অাঁজলা করে তুলে ভেজা চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘তর আর কামে যাওন লাগব না। আমি তোরে বিয়া করমু, হ কাইলকাই করমু, তুই রেডি অইয়া থাইস।’
বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে রেশমী। একটা ঠান্ডা স্রোত মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শিরা-উপশিরায়। নুরুর চোখে তাকিয়ে বলে সে, ‘আমি নষ্ট হইয়া গেছি, তার বাদেও?’
– ‘হ, তর প্যাডে আমার পোলা। আমার তো বাপ-মাও নাই, আমার পালক মা আমারে টোহাইয়া আনছিল সোরাওর্দী হাসপাতালের ডাস্টবিন থেইকা। আমি বুঝি নুরুইল্যা হওনের কী জ্বালা!’ রেশমীকে বুকের ভেতর শক্তভাবে বেঁধে রাখে নুরু। কপালে আলতোভাবে চুমু খায়। সমস্ত বস্তির কোলাহল ততক্ষণে নিশ্চুপ হয়ে গেছে।
লাল টকটকে একটা সিল্কের শাড়ি পরেছে রেশমী। হাতে মেহেদি, পায়ে আলতা, লম্বা মুখে বড়সড় একটা টিপ। নুরুর জন্য অপেক্ষা করছে সে। বেলা যায় তার খবর নেই। একসময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে টিটু।
– ‘রেশমী, রেশমী রে, নুরু খুন হইছে।’ হঠাৎ কেউ যেন গরম সীসা ঢেলে দেয় রেশমীর কানে। অবিশ্বাসী চোখে টিটুর দিকে তাকিয়ে বলে সে, ‘কী কইতাছস তুই, তর মাথা টিক আছে?’
– ‘হ, টিকই আছে আমার মাথা। ফরিদ্যা নুুরুরে খুন কইরা লাশ ফেলাই রাখছে খালের ভিতর। অহন পুলিশ আইসা লাশ লইয়া যাইতাছে।’
রেশমী এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। গলির যেখানে শেষ – সেখান থেকে খালপাড়ে – তারপর রাস্তায়। রাস্তায় অনেক লোক – ছেলে, বুড়ো, মহিলা – সবাই। একটা পুলিশের জিপ – তাতে লাশ তোলা হয়েছে। লোকজনের ভিড় ঠেলে ধীরে-ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে জিপটি।
আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে রেশমী। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে চলন্ত জিপের পেছন-পেছন। সবাই রেশমীকে দেখে, শোনে তার আর্তনাদ – শুধু দেখেন না একজন, যিনি বিরাট, অনন্ত – প্রলয় সৃষ্টি যাঁর কাছে পুতুলখেলার মতোই তুচ্ছ। তিনি সবার অলক্ষে থেকে মিটমিটিয়ে হাসেন। বড় বেশি কঠিন, রহস্যময় তাঁর সেই হাসি।