আলকাতরা কী কালো? তার চে কালো ষাড় গরুটি। বাড়ি তার কুষ্টিয়ার খাজা নগরের রশিদ ব্যাপারির চাতালে। চাতালের খড়, খুদ, চাল, খৈল; কিশোরীদের মত পুষ্টিকর কচি ঘাস আর পশু চিকিৎসক পরান ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এ গরুর যখন পূর্ণ যৌবন-তখন তার নাম দেয়া হয় “বাদশা”। বাদশা বাদশাই। যেমন তার শৈল্পিক শিং তেমন তার চোখ। গায়ের চামড়া প্রিয়াংকা চোপড়ার মত মসৃন। মোটা লম্বা লেজ দিয়ে যখন মশা-মাছি-পাখিকে বারি মারে; তখন কুকুর-বেড়ালও বাদশার লেজে লোভনীয় জিভ দিয়ে চাটা দিয়ে পলায়!
বাদশার পূর্বপুরুষ রাজস্থানীয়। ফলে, তার হাম্বা হাম্বা ডাকের মধ্যেও এক ধরনের সুর-তাল-লয় আছে। সবচে দেখার ও লোভনীয় অঙ্গ হচ্ছে তার দু’পায়ের মাঝে। পিরিয়ডের সময় আশে-পাশের দেশাল গাভীগুলি বিপুল উৎসাহ-উদ্দিপনায় গর্ভবতি হতে আসে। আসে স্বেচ্ছায় ধর্ষিত হতে! আসে বাদশার প্রজন্ম যেন কুষ্টিয়ার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পরে, সে আশায়। কিন্তু রশিদ ব্যাপারির কড়া নির্দেশ। “বাদশার” কাছে কোন গাভী যেতে পারবে না। অনেক কষ্ট, অনেক সাধের বাদশা। তার কোন ফটোকপি হবে না, হতে দেয়া যাবে না। সে হবে গ্রীক-মিশরীয় পুরুষদের মতো! মাঝে মাঝে বাদশার কাজের মেয়ে যুবতি সুমাইয়া বাদশাকে সানসিল্ক স্যাম্পু দিয়ে গোছল করানোর সময় হাত দিয়ে বাদশার নিম্নঅঙ্গকে স্যাম্পু মাখায়। তাতে বাদশাও মজা পেয়ে ফুলে ফেপে ওঠে। সুমাইয়ার সালোয়ার ভিজে যায় আত্নসুখে! কিন্তু এ গোপন সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না।
রশিদ ব্যাপারী ট্রাক ঠিক করে। কোরবানীর ঠিক সাত দিন আগেই গাবতলির গরুর হাটে চলে আসে ফটোকপিহীন কুষ্টিয়ার রাজাধিরাজ “বাদশা”। আসার সাথে সাথেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পরে বাদশাকে দেখার জন্য। বাদশাকে নিয়ে টিভিতে লাইভ সম্প্রচার করে সব কটি টিভি চ্যানেল। দেশের সব সংবাদপত্রে ঝড় ওঠে। কে এই বাদশা? কী তার পরিচয়? কী তার রুপ? তার দেহের কোন কোন অঙ্গ-প্রতঙ্গ সুন্দর? বাকানো শিং দুইটি সাজানো, গলায় চিনকাগজের মালা। মুখে বাঁধা দড়ি ধরে বাদশার সাথে টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেয় রশিদ ব্যাপারী। বাদশার জন্ম ইতিহাস, খাদ্য তালিকা, যত্ন-আত্তি, কুমারত্ব ও সর্বশেষ তার কোন ফটোকপি নেই, নেই নকল, নেই শংকর প্রজন্ম। বাদশা বাদশাই। অতএব, এক দাম এক রেট।
– ভাই কত?
– দশ লাখ!
২.
বাদশা এখন টক অব দ্যা কান্ট্রি। কান্ট্রির সবাই সাদা-কালো টাকা-পয়সা নিয়ে হাজির হয় গাবতলী। রহিম-করিম-যদু-মধু-থেকে মন্ত্রী ও তার দলীয় চামচারা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এক দাম এক রেট। সবাই যখন বিফল মনরথে বাড়ি ফেরে এবং চানরাতে দাম কমার আশায় বসে থাকে; ঠিক তখনই রাজবাড়ির পাংশা থেকে গাবতলীতে বাস থেকে নামে; পাটের ব্যবসায়ী সৈয়দ এন্ট্রারপ্রাইজের মালিক-সৈয়দ সাব। সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কোমড়ে কাপড়ের থলিতে বাঁধা দশলাখ টাকার বান্ডিলগুলি তুলে দিয়ে, হাসিল পরিশোধ করতেই এক বালিকা নয়া টিভি সাংবাদিকের লাইভ সম্প্রচার করে-
“প্রিয় দর্শক, আমরা অতি আনন্দের সাথে জানাতে চাই, এই মাত্র আমাদের বাদশা বিক্রি হয়ে গেল। বাদশার নতুন মালিক এখন হাসিল পরিশোধ করছেন। আসুন আমরা তার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই”।
-কোথা থেকে এসেছেন?
-পাংশা।
-কত দামে বাদশাকে কিনলেন?
-যে দাম চেয়েছিল, সেই দামে।
-এত টাকা কোথায় পেলেন?
-আল্লাহ পাক দিয়েছেন।
-আপনার নাম?
সৈয়দ সাব উত্তর না দিয়ে অতি যত্নের সাথে বাদশার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ট্রাকে উঠে পড়ে। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ হয়। হতে থাকে এবং এই সব হট্টগোল ও যানজট ঠেলে সৈয়দ সাব ট্রাকে করে বাদশাকে নিয়ে হাজির হয় পাটুরিয়া ঘাটে। ঘাটে বাঁধা সৈয়দ সাবের পাটের ট্রলারে করে বাদশাকে নিয়ে রওনা দেয় পাংশার উদ্দেশ্যে। বাদশার জন্য কচি ঘাস ও খড়ের ব্যবস্থা করে, মাঝি মাল্লারা রাতের খাবারের জন্য পদ্মার নতুন ধরা ইলিশ মাছ ভাজতে শুরু করে। আর, তখনই সৈয়দের গায় ছরছর করে হিসি করে দেয় বাদশা। মনে হয়, বাদশা হাসে । হা হা হা করে। সৈয়দ অবাক হয় কিন্তু ঘাবড়ায় না।
পদ্মার জলে নয়া লাক্স সাবান দিয়ে গোছল করে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসে সৈয়দ। ভোর হতে আর দেরী নেই। অজু করে ফজরের আজান সৈয়দ নিজেই দেয়। তারপর, নামাজ পরে তজবিহ গুনতে গুনতেই ট্রলার এসে পরে সৈয়দের নিজেদের ঘাটে। যে ঘাট দিয়েই পাট ও পয়সা আমদানী-রফতানী করে; সেই ঘাটেই নামে রাজকীয় বাদশা। এই ভোরের ভেতর ভির করে গ্রামবাসী। সবাই বাদশাকে ছুয়ে দেখতে চায়। কত জনের কত কথা। এই না হলে সৈয়দ? সৈয়দ সাবের বৌ গর্ব-সহকারে জোরে জোরে কত কথা বলে অথচ তার বিবাহযোগ্য দুই মেয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলে-
-বাদশার ইয়েটা দেখসস?
বাদশার যত্ন-আত্তি করার জন্য সৈয়দ সাবের লোকের অভাব নেই। তারপরও বিভিন্ন গ্রামের বিভিন্ন নারী পুরুষ এসে বাদশাকে দেখে যায়, ছুয়ে যায়, আদর করে। এক নিঃসন্তান হিন্দু রমনী সন্তান লাভের আশায় বাদশার ইয়েতে ধান-দুর্বা-কাচা দুধ দিয়ে আদর করতেই, বাদশা লাথি মারে। চিৎকার পারে। দড়ি ছিড়ে পালিয়ে যেতে চায়। সৈয়দ সাব ধমক লাগায় হিন্দু রমনীকে। সৈয়দের বৌ টিপ্পনি কাটে-আমাগো সৈয়দেরটা ধুইয়া পানি খাইয়ো! সৈয়দের মেয়েরা জানালা দিয়ে এ সব দৃশ্য দেখে একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পরে। জানালা দিয়ে বাদশার ছবি তোলে। ভিডিও করে। “আমার বাদশা”- লিখে এফবি-তে আপলোড করে।
বাদশার যেন গরম না লাগে, সে জন্য ডেকোরেশন থেকে বড় বড় ফ্যান ভাড়া করা হয়। মশা যেন কামড় দিতে না পারে, সেজন্য বড় বড় মশারিও টানানো হয়। সামনে সামিয়ানা টানিয়ে কালু কশাই ও পাংশা জামে মসজিদ কাম মাদ্রাসার ছাত্ররা ছুড়ি-কাচি-চাপাতিতে সান দেয়। কখন হবে ভোর? সৈয়দ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই আগে বাদশাকে দেখতে যায়। বাদশাও শুয়ে ছিলো। উঠে দাড়িয়ে হাম্বা রবে ডাক পারে। সৈয়দকে সালাম দিলো নাকি? সৈয়দ আত্মতৃপ্তিতে মিটি মিটি হাসে। গোছল করে, নতুন পান্জাবী-পায়জামা পড়ে। সৈয়দের বেগম আরবের আতর লাগিয়ে দেয়। মেয়েরা আব্বার জুতার ফিতা লাগিয়ে দেয়। ঈদ গাঁ মাঠে সবাই সালাম দেয় সৈয়দকে। সালাম যতটা না সৈয়দকে সন্মান করে, তারচে বেশী বাদশাকে দশলাখে কিনে কোরবানী দেয়ার জন্য। কারণ, তারাও কমপক্ষে এক কেজি করে ভাগ পাবে। চাকুরীরত ইমাম সাহেব নামাজ শুরু হওয়ার আগেই সৈয়দ সাহেবের সাথে বুকে বুক লাগিয়ে মোলাকাত করে। সেও জানে মাদ্রাসার জন্য চামড়া ও মাংশ আজ সৈয়দ সাবই দেবে। দুপুরে ও রাতে ইমাম সাহেব সৈয়দ সাবের স্পেশাল মেজবান। সৈয়দ সাব হাতের সিকো ফাইভ ঘড়ি দেখে। গলা খাকাড়ি দেয়। ইমাম সাহেব বলে, টাইম হইছে। কাতার সোজা করেন। নামাজ শুরু হয়ে যায়। নামাজ শেষে সবাই সৈয়দের সাথে মোলাকাতের জন্য ভিড় জমায়। সৈয়দ কারো সাথে মোলাকাতের জন্য যায় না বরং সৈয়দের সাথে মোলাকাতের জন্য সিরিয়াল লেগে যায়। এবং সবারই একই প্রশ্ন-বাদশার খবর কী? সৈয়দ মিটিমিট হাসে। ঈদ মোবারক বলতে বলতে ইমাম সাহেবকে নিয়ে বাসায় পথে হাটে। হাটে ও সালামের উত্তর দেয়।
বাসায় এসেই শুরু হয় তোড়জোড়। সৈয়দ সাব চেয়ারে বসে থাকে। বৌ-ঝি-মেয়েরা-পাড়া-প্রতিবেশিরা ভিড় করে। ইমাম সাহেবের তদারকিতে দক্ষ কালু কশাই ও মাদ্রাসার ছাত্ররা বাদশাকে বেঁধে ফেলে হোগলার উপর শোয়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাদশাকে বশ করা কী এতই সহজ? বাদশার শক্তির কাছে সবাই নতি স্বীকার করে। সৈয়দ সাব হুকুম করে-
একটু জিরাইয়া লও মিয়ারা। এরপর আবার মল্লযুদ্ধ। একদিকে বাদশা অন্যদিকে ইমাম সাহেব-সহ দশজন। কালু কশাই বাদশাকে বেঁধে ফেলার জন্য পা দুটি শক্ত করে বেঁধে ফেলে। ছোট ছোট হুজুররা আচমকা হ্যাচকা টান দিতেই বাদশা টাল সামলাতে না পেরে বসে পড়ে হোগলার উপর। সেই হিন্দু বৌ-টিও এসেছে কীসের আশায়? বাদশার চোখে চোখ পড়ে বৌটির। বৌটির চোখে জল। সৈয়দের বেগম ঝাঁঝানী মারে-
-কানবি না মাগি!
সব কিছু রেডি। বাদশাও প্রস্তুত। ইমাম সাহেব চাপাতিটাকে লম্বা একটা রড দিয়ে ধার দিয়ে সৈয়দ সাবের হাতে তুলে দেয়। সবাই বলেন-আল্লাহ আকবর। আসেন সাব। বিশমিল্লাহ বলে, আল্লাহ পাকের নামে জবেহ করেন। হাতে তুলে দেয় ধারালো একটা চাপাতি। সৈয়দ সাব চাপাতি হাতে বাদশার দিকে এগিয়ে যায়। হিন্দু মহিলাটি হু হু করে কেঁদে ওঠে। সৈয়দ বিরক্ত চোখে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,- তরে চিরদিনের মতো জবাই করুম কিন্তু!
সবাই চেপে ধরেছে বাদশাকে। চাপাতি হাতে সৈয়দ সাব লায়লাহা…….বসিয়ে দেয় বাদশার গলায়। অন্যান্যরা চিৎকার করে বলে-“আল্লাহ আকবর”। কিন্তু মুহূর্তেই সবার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে অর্ধ কাটা গলা নিয়ে দড়ি-কাছি ছিড়ে বাদশা শিং দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত-আহত করে; দে ছুট বাদশা। হিন্দু মহিলাটি চিৎকার করে ওঠে-হায়, ভগবান! সৈয়দা ভাবী কেঁদে ওঠে-ও আল্লা, ও খোদা!
৩.
বাদশা পালাচ্ছে। পালাচ্ছে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি। সৈয়দ বাড়ি থেকে চৌধুরী-তালুকদার-খাঁনদের বাড়ি হয়ে পাল-দাস-ভট্টাচার্য্যিদের বাড়ি হয়ে পুকুরপাড়, খালপাড়, নদীরপাড়। ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল-আমগাছ-তুলশিগাছ-ধানক্ষেত-পাটক্ষেত মাড়িয়ে পাগলা কুত্তার মতো পালাচ্ছে। আধা কাটা গলা দিয়ে ঝড়ছে লাল লাল রক্তের স্রোতধারা। প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে লাল লাল রক্ত, যেমন একদিন মিসরেও ঘটেছিল। ভট্টাচার্যিদের বাড়িতে সোরগোল ওঠে-
-হায় রাম, হায় রাম! হায় ঠাকুর! এ যবনদের হাত থেকে বাঁচাও আমাদের। বলেই গঙ্গাজল দিয়ে ঘর-বাড়ি ধুতে ধুতে, গোবর দিয়ে লেপা শুরু করে বিধবা হরিবালা ভট্টাচার্য্যি। কিন্তু এ পুন্যের কাজটুকু শেষ হওয়ার আগেই আবারও এসে পরে বাদশা। শিং-এর গুতোয় তুলশি গাছটাকে উপরে ফেলে ছুটে পালায়। হরিবালা ঠাকুর ঠাকুর বলেই অজ্ঞান হয়ে পরে। বাদশার পিছন পিছন ছুটছে চাপাতি হাতে কালু কশাই সাথে মাদ্রাসার সব ছাত্রগণ। ছুটছে গ্রামবাসী। পাল বাড়ির মাটির হাড়ি-পাতিল ভেংগেচুড়ে তছনছ করে, ছুটে যায় মসজিদ কাম মাদ্রাসার দিকে। ওখানে ভাংচুর করে ছুটে যায় সৈয়দের কাছারির দিকে। কাছারির মধ্যে টাকা-পয়সা, হিসাবের টালিখাতা রক্তে রক্তে সয়লাব হয়ে পরে। শিং-এর গুতোয় সৈয়দের আরামের কোলবালিশ ফেটে যায়। সাদা সাদা শিমুল তুলা লাল রক্তে সাদা-লাল হয়ে ভেসে বেড়ায় এবাড়ি-ওবাড়ি। বালিশ থেকে তুলার সাথে বেড়িয়ে পরে আসল পুরুষের এক প্যাকেট কনডম! মুহূর্তেই হিন্দু মহিলাটির চোখ পরে সৈয়দের চোখে। চোখে চোখে কথা হয়। সৈয়দা বেগমের চোখে এ প্যাকেট পরার আগেই ছোঁ মেরে তুলে নেয় সে। সেকেন্ডের মধ্যেই চালান হয়ে যায় ব্লাউজের ভিতরে!
দাস পাড়ার জেলেরা এসেছে সৈয়দের কাছে। গরুটিকে ধরার জন্য নতুন এক জেলে পরিকল্পনা। দাসেরা ইলিশ মাছের কারেন্ট জাল দিয়ে জমিতে ঘেরাও দেবে। সবাই গরুটিকে ধাওয়া করে জমিতে নিয়ে যাবে। সাথে সাথেই দাসেরা কারেন্ট জালটি গুটিয়ে গুটিয়ে কাছে এনে জড়িয়ে ফেলবে। তারপর দড়ি দিয়ে বেঁধে আহত অথবা আধা গলা কাটা গুরুটিকে বেঁধে ফেলবে। তারপর হুজুরের যা বিবেচনা। পরিকল্পনা শুনে সৈয়দের মুখমন্ডলে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। গরুর পিছনে ছুটতে ছুটতে নতুন স্যান্ডেল হারিয়েছে। নতুন পাজামা-পানজাবি ছিড়েছে। ঘামে জবজব করছে শরীর। কালু কশাই কুত্তার মত হাপাচ্ছে। গ্রামবাসী রামদা, বর্শা, চাকু, বটি, চাপাতি, টোটা, বল্লম নিয়ে হাজির। শুধু সৈয়দের পারমিশনের অপেক্ষা। সৈয়দ পালদের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। তবে, বাদশাকে জীবিত ধরতে হবে এবং কোরবানী হবে জমির মধ্যেই। সৈয়দ আর হজুর যৌথভাবেই।
৪.
ধান ক্ষেতের মধ্যেই দাসেরা এমাথা ওমাথা গোল করে কারেন্ট জালের ফাঁদ পাতে। গ্রামবাসী আস্তে আস্তে ধাওয়া দিতে শুরু করে গলা কাটা বাদশাকে। বাদশা আসলেই বাদশা। তা না হলে এতক্ষণে অর্ধেক কাটা গলা নিয়ে কাবু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে বাদশাহী ঢং-এ হাটতে থাকে ফাঁদের দিকে। কালু কশাইর হাতে চাপাতি তারপর হজুর, সর্বশেষে সৈয়দ সাব। হজুর দোয়া পড়ছে। আস্তে আস্তে গুরুটি ঢুকে পড়ে পাতা ফাঁদে। দাসেরা জাল গুটায়। হুজুর গরুর পিছনে। সৈয়দ হজুরের পিছনে। দাসেরা জাল গুটিয়ে যতছোট করে ফাঁদ, তত ধীরে ধীরে হাটে গুরুটি। হজুর হাত বাড়িয়ে লেজটি ধরতে গেলেই খায় এক লাথ্থি। ছিটকে পরে হিন্দু মহিলাটির পায়ের সামনে! সৈয়দ আস্তে আস্তে বলে-বাবা, বাদশা। থাম, থাম। সৈয়দ খপ করে ধরে ফেলে গরুর লেজটি। আর তখনই গলা কাটা গুরুটি ওরফে বাদশা সৈয়দকে নিয়ে আকাশে উড়াল দেয় পাখির মত। উড়ালপঙ্খি বাদশা! লেজে ঝুলতে থাকে সৈয়দ। গ্রামের চালে পরছে ফোটা ফোটা রক্ত। কারেন্ট জালওয়ালারা জাল ফেলে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। সৈয়দ সাব গরুর লেজ ধরে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে-মাটির দিকে। লেজ ধরে ঝুলে গরুর পা ধরে বাঁচার সর্বশেষ চেষ্টা করছে আমাদের পাটের ব্যবসায়ী সৈয়দ সাহেব। পালদের, দাসদের, সরকার, চৌধুরী, খাঁন, রহমান, ভট্টাচার্য্যিদের মাথায় পরছে লাল লাল গরম টাটকা রক্ত। সব সাদা কালো মানুষ এক রঙ্গা। লালে লাল হয়ে যায়। এ যেন এক লালের দেশ। লাল রং-এর গ্রাম। গ্রাম ভর্তি সব এক কালারের মানুষ! এক জাত!! শরীরের ভেতরের রক্ত-বাইরের রক্ত মিলে মিশে একাকার হয়ে পরে। সৈয়দের বৌ নামাজে বসে। হুজুর মসজিদে কেয়ামতের আজান দেয়। কালু কশাই নিজের ব্যর্থতার জন্য নিজের চুল নিজেই কেটে ফেলে। শুধু একজন যার ব্লাউজের মধ্যে কনডম, সে ইরি ধানের ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে! সৈয়দকে না দেবতাকে?
গলা কাটা বাদশা উড়তে উড়তে এক আসমান থেকে দুই আসমানে যেতেই সৈয়দের ভয়তে জান বেরিয়ে যায়। নিচের দিকে তাকিয়ে সে দেখে পাংশাকে, পদ্মাকে। ক্রমাগত সব ছোট থেকে ছোট হতে থাকে সব। জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহুর্তেই অথবা লেজ থেকে হাত ছুটে যওয়ার সময়ই মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে-ও আল্লা, বাঁচাও। ঠিক এই সময়েই গলা কাটা গুরু ফ্যাসফেসে গলায় কথা বলে ওঠে!
-বাঁচতে চাও?
-কে? কে? কে কথা কয়?
-আমি বাদশা!
-হজুর মাফ করেন। বেয়াদপি মাফ করেন। আপনি বাপ। আপনি মা। আপনি সাক্ষাৎ ফেরেসতা! নিচে নামাইয়া দেন হুজুর। সৈয়দ ভয়তে কেঁদে ফেলে।
-মাফ চাও?
-হ।
-তয়, যে পাপ কেউ জানে না, তা স্বীকার করবা? সৈয়দ জান বাচাঁনোর স্বার্থে কাঁদতে কাঁদেতে যা বলে, মোটা দাগে তা হল:
ক). হুজুর, জমি-জিরাত, পাটের ব্যবসা, গুড়ের ব্যবসা সব কিছু আমার না। পার্টনার ছিল। হিন্দু। ভয় দেখাইয়া ওগো দ্যাশে পাঠাইয়া দিছি। আর, সব ভাল কাজ করছি। স্কুল-মাদ্রাসা-মসজিদ-দান-খয়রাত-নামাজ-রোজা-কোরবানী সবই করি। হুজুর এবার নামাইয়া দেন। সবইতো কইলাম। বাদ দেই নাই কিছুই।
-সত্যি কইছো?
খ). না, হজুর মনে পড়ছে। গন্ডগোলের বছর পাটের গুদামে যুবতি মাইয়াগো পাক-বন্ধুদের সাপ্লাই দিয়া কইতাম পাকিস্তান জিন্দাবাদ। ওরা ফুর্তি-ফার্তি করতো। আমি পাহাড়া দিতাম। আমি কিন্তু কিছু করিটরি নাই হজুর। মাবুদ, এবার নামাইয়া দেন। সব সত্যি শেষ। সব পাপ শেষ!
-শেষ?
-শেষ।
-সত্য?
-সত্য!
-তয়, হিন্দু মহিলারে কনডমের প্যাকেটটা লুকাইতে ইশারা দিলি ক্যান?
-হুজুর, মাপ চাই। আপনি অর্ন্তজামি। চারিদিকে চক্ষু আপনার। ভুল হইছে। ফাঁসি দেন!
গলা কাটা বাদশার হা হা হা হাসিতে আসমান কেঁপে ওঠে। শব্দ থেকে শব্দপাত হয়। বিদ্যুৎ চমকায় আকাশে। ভারি বৃষ্টিতে ও বন্যায় ভেসে যায়, ডুবে যায় পাংশা। কোথাও কোন রক্তের দাগ নেই। শুধু সব বাড়ির উপরে লাল পতাকা।
বাড়িতে বাড়িতে, গ্রামে গ্রামে রটে গেছে-সৈয়দ সাহেবকে সয়ং আল্লাহ পাক সাত-আসমানে নিয়া গেছে। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ । একথা শুনে শুধু হিন্দু নারীটি হাসে। কনডমের প্যাকেটটি মাটিচাপা দিয়ে তার উপর একটা তুলশি গাছ লাগিয়ে দিয়ে, সাদা শাড়ি ও আতপ চালের ভাত খেতে শুরু করে সে……!
(গল্পের চরিত্রগুালো নিছক কাল্পনিক। যদি কোন চরিত্রের সাথে সামান্য মিল পান; তবে তা কাকতালিয়। এ গল্পের দায় সম্পূর্ন লেখকের)