শুঁটকি মাছের গুদাম অথবা তাঁর ঘুম ঘুম চোখ

শ্যামসন বুড়ন

পর্ব০১

আলকাতরার মতো কালো অন্ধকার ভেদ করে, দৃপ্ত পায়ে হেঁটে যায় যে – তার নাম হাসান। মহল্লা বা গ্রুপে তাকে যেভাবে ডাকে অথবা পুলিশের খাতায়, সংবাদপত্রের পাতায় তার নাম যেভাবে ছাপে-হিরো হাসান। প্রতিপক্ষের কাছে সে ডাবল এইচ। দুইটা এইচ উপর-নিচ জোড়া লাগালেই মই হয়। তাকে মই বানিয়ে অনেক রথি মহারথি আজ অনেক উপরে। আগে হাত দিয়ে হ্যান্ডশেক করত, এখন মোবাইলের ফ্রিকোয়েন্সিতে কণ্ঠস্বর শেকিং হয় বিপদে পড়লে। পক্ষ এবং প্রতিপক্ষের মুসকিল আসানের জুড়ি মেলা ভার হাসানের। দুই পক্ষই তাকে হিরো হিসেবে মেনে নিয়েছে। আত্মসমর্পণ করেছে শর্তহীনভাবে। করে নি শুধু একজন। তাঁর কাছে সে অ্যান্টি হিরো। তাঁর চোখে সব সময় ঘুম লেগে থাকে। ঘুম ঘুম মায়াবী চোখে হাসানের দিকে তাকিয়ে, হাসানের মাথা খারাপ করে। পাগল করে। পরাজিত করে প্রতিদিন। তবে আজকের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে কীভাবে-তা ভাবতে ভাবতে, অন্ধকার চিরে চিরে, চিপা-চাপার পাশ কাটিয়ে, সে পৌঁছে যায় জায়গামতো। ডেরায়!

 

ডেরা মানে অন্ধকার গুদাম। শুঁটকি মাছের গুদাম। শুঁটকির গন্ধ চারিদিকে। শুঁটকির বস্তার নিচে আরো কিছু বস্তা থাকে। বস্তায় থাকে গাঁজার বড় বড় চালান। চালানে মাঝে মাঝে চালান হয় অস্ত্র। এই বস্তিটি নিয়ন্ত্রণ করে থ্রি-কে গ্রুপ। দলনেতা ট্যারা কামাল। দুই ডেপুটি সাদা কামাল, কালা কামাল। আজ থ্রি-কে মনের সুখে গাঁজা ও অন্ধকার খায়। হাসান গুদামের সামনে এসে পড়ে। ভিতরে অন্ধকারে তিনটি সিগারেটের কিছু আলোর উঠানামা চোখে পড়ে। হাসানের ঘ্রাণশক্তি কুত্তার মতো। সে বুঝতে পারে ভিতরে থ্রি-কে গ্রুপ। অন্ধকারেরও নিজস্ব এক শক্তি ও দৃশ্যময়তা আছে। হাসান ঠিক ঠিক ট্যারা কামালের মাথায় পিস্তল ঠেকায়। ট্যারা কামাল চমকে উঠে। কিছু বলবার, কিছু বুঝবার আগেই হাসান বলে উঠে।

-মালটা বের কর।

ট্যারা কামালের আজ নিশ্চিত মৃত্যু এবং জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভয় কাজ করে। সে বাধ্যগত ছাত্রের মতো মালটা বের করে দেয়। হাসান কালোটার হাতে ছুড়ে মারে মালটা। বলে, সাদাটার মাথায় তাক কর। আমি এক-দুই-তিন কইলে, তুই ওরে ফুটা করবি।

-কী কন, বস? আপনি আমারে মারেন, ওরে মারবেন ক্যান? ওর কী দোষ? ট্যারা আর্তনাদ করে ওঠে। হাসান কালডারে বলে, আমি এক কইলাম কিন্তু! তুই যদি সাদাডারে না ফালাস, তয় ট্যারা শ্যাষ। কালাটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। ট্যারা বেঁচে থাকার আকুতি জানায়। সাদাটার ভয়ে হাত-পা অবশ হয়ে যায়।

-দুই! কালাডার হাত কাঁপে। হাত কেঁপে ওঠে বার বার। সাদাটা কান্নাকাটি শুরু করে।

-কান্দাকাটি বন। তুই মরবি কালাডার হাতে। ট্যারারে মারমু আমি। কালাডারে মারব কালাবাহিনী। সরল অংক। যোগফল শূন্য। তি! হাসান `ন’ উচ্চারণ করার আগেই সাদাটা হাসানের পা জড়িয়ে ধরে। কান্নাকাটি করে।

-বস মাপ করেন। আর কোনো দিন আপনের উপরে টেক্কা মারুম না। আল্লার কসম! আমার আব্বা আম্মার কসম। কসম ভাঙলে এক ফুটা ক্যান, ঝাঁঝড়া কইরা ফালাইয়েন। অবাক বিস্ময়ে ট্যারা চেয়ে থাকে সাদাটার দিকে। কালো চেয়ে থাকে সাদাটার দিকে। হাসান চেয়ে থাকে ট্যারার মাথায় তাক করে রাখা পিস্তলের দিকে। হাসান কিছুক্ষণ সময় নেয়। আশেপাশে, দরজার বাইরে চেয়ে দেখে। কুত্তার ঘেউ ঘেউ ছাড়া, কোথাও কোনো শব্দ নেই। হাসান নাক-মুখ শক্ত করে। পিস্তলটা শক্ত করে ট্যারার মাথায় চেপে ধরে। সাদা শক্ত করে হাসানের পা ধরে রাখে। কালা শক্ত করে সাদার মাথায় টার্গেট করে।

-তিন এর ন বাদ পড়ছে। ন কমু?

-জ্বি না। ন, কওনের কাম নাই। নাকে খত দেই। কন শুরু করি। সাদা বলে।

-তয় বাঁচতে চাস?

-হয়।

-তয় বিস্কুটটা দে?

ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়ে। একজন অন্যজনের, মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সাদাডা জীবনের ভয়ে বা ট্যারার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পকেট থেকে সোনার বিস্কুটটা বের করে দেয়। হাসান ছোঁ মেরে বিস্কুটটা কেড়ে নেয় সাদার হাত থেকে। ট্যারার বিস্ময়ে চোখ ফেটে, চোখ বেরিয়ে আসে। হাসান বিস্কুটটা ট্যারার হাতে দিয়ে দেয়। ট্যারার চোখে তখন প্রশ্নবোধক চিহ্ন বা নির্বোধের মতো হাসানের দিকে চেয়ে থাকে।

-বিস্কুটটা তোমারে উপহার দিলাম। বেইচা জমি কিনবা। ফুলের বাগান করবা। ফুল বেইচা বাঁচবা। আমার কবরে বছরে একবার ফুল দিবা, পারবা না?

ট্যারা হ্যাঁ-না কী বলবে, সেইটা ভাবার আগেই দুচোখ বেয়ে পড়ে জলের ধারা! মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। পা ভেঙে আসছে। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই হাসান এক লাফে গুদাম থেকে বাইরে চলে আসে। এরপর পর পর দুটি গুলির শব্দ ও কুত্তার ঘেউ ঘেউ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না…।

 

পর্ব০২

 

হাসান প্রথমে অন্ধকার চিরে চিরে হাঁটছিল। এরপর দ্রুত লয়ে হাঁটছে। এখন দৌড়াচ্ছে। দৌড় এবং দৌড়। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে দৌড়। হাসান দৌড়াচ্ছে এবং দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যেন রাস্তা থেকে আকাশে উঠে যায়, সে নিজেই তা বুঝতে পারে না। একদম প্লেনের মতো করে যাচ্ছে, মেঘের মধ্য দিয়ে। সাদা নীল মেঘ। ঝিরি ঝিরি মিষ্টি মেঘ। বালক বালিকা মেঘ। বড় মেঘ, ছোট মেঘ, পুরুষ মেঘ, নারী মেঘ। মেঘের রাজ্যে হাসান দেখে সাজানো গোছানো একটি সবুজ গ্রাম। সারি সারি গৃহস্থ বাড়ি। সব বাড়িগুলি মাটির তৈরি। সব যত্ন করে লেপা, আলপনা আঁকা। প্রতিটি বাড়িতে দুধেল শিশুর মতো ফুলের বাগান। চমৎকার সব ফুল। সারি সারি ফলজ গাছ। মিষ্টি ও মায়াবী বাতাস। বাড়ির বাসিন্দারা সব স্বাস্থ্যবান ও সুখী। হাসিখুশি জীবন নিয়ে, জীবনকে নিয়ে খেলেছে সব শিশু-যুবক-যুবতী, বয়স্ক বাসিন্দারা। আহ্‌ জীবন!

 

মেঘের রাজ্যের এই সব সুন্দর ফুলের বাগান, সুখি-স্বাস্থ্যবান-সংসারের মধ্য দিয়ে দৌড়াচ্ছে হাসান। এই দৌড়ের শেষ নেই। শুরু করে ছিল কোথা থেকে? হাসানের তা-ও মনে নেই। কোথায় যাবে? তা-ও জানা নেই। হঠাৎ সামনের এক বাড়ির মধ্য দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে আসে যে, সে ঘুম ঘুম চোখে চেয়ে থাকা সেই মেয়ে। হাসান দৌড়াচ্ছে সেই মেয়েটির দিকে। ক্রমাগত। মুখোমুখি। এরপর এরপর…। হাসান থমকে দাঁড়ায়।

-তুমি?

সে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে অথবা সমর্পিত হয় হাসানের বুকে। ঘুম ঘুম চোখে তার রাজ্যের ঘুম। হাসানের জন্য এতদিন ঘুমায় নি সে, এই ভেবে মেঘের রাজ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে হাসানের বুকে। আবারও গুলির শব্দ! ততক্ষণে হাসান ঘুমিয়ে পড়েছে ঘুম ঘুম চোখের বুকে। মেঘ থেকে বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর। এরপর শুরু হয় রক্তবৃষ্টি। প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা। ক্রমাগত তা রক্তের ধারায় পরিণত হয়ে ঝরতে থাকে…ঝরতে থাকে…।