ছয় আঙ্গুলওয়ালা যুবকের করতলে কোনো রেখা নেই

শ্যামসন বুড়ন

“আমি পূর্বপুরুষহীন, উত্তরপুরুষহীন, স্ত্রী-বিহীন কিন্তু গভীরভাবে প্রত্যাশী পূর্বপুরুষের, উত্তরপুরুষের এবং স্ত্রীর ভালোবাসার।”(২১ জানুয়ারি ১৯২২, ফ্রাঞ্জ কাফকার দিনলিপি থেকে উদ্ধৃত)

গনক বসে আছে গ্রীন রোডে বনফুল মিষ্টান্ন কো. লি. দোকানের পাশে। ফুটপাতে চাদর বিছিয়ে বসা। সামনে পেপার বিছানো। সেখানে বিভিন্ন রকমের পাথর, গাছগাছড়া, মানুষের মাথার খুলি, বিভিন্ন রকমের মানুষের ছবি, একটি বাঁধানো হাতের জ্যামিতিক ক্যালকুলেশন ও একটা আতস কাচ। প্লাস্টিকের বয়ামের মধ্যে বিভিন্ন সাইজের তাবিজ। পলিথিনের প্যাকেটে রয়েছে কালো তাগা ও আজমির শরিফের (বলা হয়) লাল সুতা-দড়ি। দীর্ঘ সময় এসব কাজ-কারবার, আয়োজন দেখে-দেখে যুবক আচানক প্রশ্ন ছুড়ে মারে:
-ভাই, হাত দেখাতে রেট কত?
-নরমাল পঞ্চাশ। তুলা রাশি হলে একশ। নরম মাখনের মতো ‍উত্তর দেয় আলখেল্লা পরা স্পেশাল পারসন দরবেশ গনক।
-নরমালে ডিসকাউন্ট নাই?
-নাই। তবে আপনার জন্য আছে। পঁচিশ টাকা।
-ক্যান? আমি স্পেশাল ক্যান? হাত তো এখনও দেখাই নাই। টাকাও নাই। আমার জন্য এত দরদ ক্যান?
-আপনার ডান হাতে ছয়টি আঙ্গুল, সেই জন্য!
-তো কী? হাত না দেইখ্যাই আঙ্গুল দেখলেন কখন?
-বাবা, আমি অন্ধ মানুষ। মন কইছিল, তাই কইলাম। ঠিক কইছি কি?
-হ।আন্দাজে কইছেন। মিলা গেছে। কিন্তু হাত দেখেন কেমনে? আপনি না অন্ধ?
-হ। দেখিনা তো! আতস কাচ নিয়া দেখার অভিনয় করি। তারপর মন যা চায়, হুড়মুড় কইরা বইল্লা দেই।মিইল্লা যায়।মানুষ টাকা দেয়।
-কী কন আপনি?
-বিশ্বাস না হইলে চেক কইরা দেহেন? আমার চোখ দেহেন? যুবক বুড়া মিয়ার কাছে গিয়ে চোখের দিকে তাকায়। সত্যিই তো অন্ধ! তবে হাত দেখে কী করে? একটু টেস্ট করা যেতে পারে। যুবক ডান হাত মেলে ধরে গনকের সামনে।
-আচ্ছা, আমার হাতটা দেখেন তো? দেখি কেরামতি কতদুর? গনক আতস কাচ নিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে যুবকের হাত দেখে। ডানে-বামে, আঙ্গুল, নখ, তালু উল্টা-পাল্টা করে, চাপাচাপি করে, আদর করে, আতস কাচ উপর-নিচ করে। তারপর গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাচ রেখে সরাসরি তাকায় যুবকের দিকে।এবং গম্ভীর স্বরে বলেন:
-বাবা, আপনার ডান হাতে ছয়টি আঙ্গুল। হাতে কোনো রেখা নেই!
-কী বলেন? রেখা তো ছিল। হাত দেখানোর আগেও ছিল। আপনি হাত স্পর্শ করার পর দেখি নাই। গেল কোথায়? মুছে দিলেন না-কি?
-রেখা থাকলে তো মুছে যাবে? রেখাই তো কোনো কালে কোনো দিন ছিল না! হবেও না। সাদা রেখাহীন ফকফকা তালু। সাথে ছয়টি আঙ্গুল। এটাই আপনার পরিচয়, বাবা।
-কী বলেন? আপনি কি পাগল? দরবেশ না-কি জাদুকর?
-আমি এক অন্ধ বৃদ্ধ, বাবা।
-তো বাবা, আমার হাতে রেখা নাই। আমার ভবিষ্যৎ কী? আমার ভাগ্য কী? আমার সমস্যা কী? যুবক এক নিশ্বাসে পরপর তিনটি প্রশ্ন ছুড়ে মারে। ভয়ার্ত চোখে অন্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আশায়। অন্ধ গনক তাকিয়ে থাকে সরাসরি যুবকের চোখের গভীরে। এভাবে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে-থাকার পর যুবকের হাতে হাত রেখে অন্ধ গনক পরম মমতায় বলতে শুরু করে যুবকের অতীত, বতর্মান ও ভবিষ্যৎ…।

শোনো বাবা, তুমি যখন মায়ের গর্ভে, তখন তোমার হাতের রেখায় তোমার ভাগ্য লেখার কথা ছিল। কিন্তু আল্লাহপাক তোমার হাতে তোমার ভাগ্য লেখে নাই। সেটা সে নিজের হাতেই রেখে দিয়েছে! ফলে, তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে তুমি বন্দি! আর, মায়ের পেটের মধ্যে থাকলে নবজাতক হাত মুঠ করে থাকে। তুমি হাত খুলে রেখেছিলে! যে তোমার মা, সে তোমার মা। কিন্তু তুমি যাকে বাবা বলে ডাকো, সে তোমার বাবা না। তোমার বাবা হলো, তোমার মায়ের প্রেমিক! তুমি রা্ষ্ট্রবিজ্ঞানে এমফিল করছো, কিন্তু বেকার। তোমারও প্রেম ছিল। সাক্ষী কিন্তু রমনা পার্কের রেন্ড্রী গাছের লগে বাদুড়গুলা! সত্য কি-না কও? গনক বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করে:
-তুমি তোমার অরিজিনাল বাবারে খুঁজতাছো। হারায় গেছে যে প্রেমিকা, তারে খোঁজো ধুলাবালির মধ্যে হারায়ে-যাওয়া সোনামুখী সূচের লাহান। চাকরি খুঁজতাছো, পাইতাছো না। খালি খুঁজতাছো, আর খুঁজতাছো…।
-কী?
-মৃত্যুকে!
-মানে?
-মানে, তুমি এদের খুঁইজ্জা পাওয়ার পর আত্মহত্যা করার প্লান করতাছো।
-আপনি এত কথা জানলেন কেমনে? আপনার লগে আগে তো পরিচয় হয় নাই। আর, আমার হাতে তো কোনো রেখা নাই। বললেন কীভাবে? আপনি কি সৃষ্টিকর্তা? রেখায় কি লেখা থাকে? না-কি লেখা থাকে শুধু রেখার মধ্যে?
-বাবা, তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। সব প্রশ্নের উত্তর কি মানুষ জানে? দাও, পঁচিশ টাকা। তোমার সময় শেষ।

যুবক পঁচিশ টাকা ছুড়ে দিয়ে মুখ কালো করে হাঁটতে থাকে। গ্রীনরোড থেকে ফার্মগেট। ফার্মগেট থেকে তেজগাঁও রেল স্টেশন। রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে যুবক। যুবক মানে একটা রক্ত-মাংসের কংকাল। যার কোনো অতীত নেই, বতর্মান নেই, নেই ভবিষ্যৎ। যার একটা আঙ্গুল বেশি। এই বেশিটুকু নিয়েই সে বেঁচে আছে। এই অতিরিক্ত আঙ্গুলটিকে একবার সরতার মধ্যে রেখে কেটে ফেলতে চেয়েছিল। সে পারে নাই, শুধুমাত্র মায়ের বাঁধার কারণে। সেই মা মারা যাওযার পর নকল বাবার সংসারে একদলা থুতু ফেলে আসল বাবাকে খোঁজা। রমনা পার্কে দিনের বেলা ঘুমিয়ে-থাকা বাদুড়গুলিকে বার বার প্রশ্ন করা।- খুঁজে পেয়েছো, অবরাকে? যুবক হাঁটছে ট্রেন লাইন ধরে ধীরে-ধীরে। মগবাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে সে। একা-একা কথা বলছে। এ কেমন রেখাহীন জীবন? সবার না-কি সবকিছু আগেভাগেই লেখা থাকে। আমার তো কিছুই লেখা নাই। কোথায় লেখা আছে আমার জীবন?

সিদ্ধেশ্বরীতে অবরাদের বাড়ি। অবরা তো ব্লেড দিয়ে কেটে-কেটে যুবকের হাতে কিছু একটা লিখে দিতে পারতো অথবা পারে। অবরা কি হঠাৎ চলে আসবে?

ট্রেনটি আসছে দ্রুতগতিতে। ভবিষ্যৎ দেখার জন্য যুবকটি বসে পড়ে লাইনের উপরে…।