আসলেই মাকে আলাদা করে আমার মনে পড়ে না। শুধু হঠাৎ কোনো চৈত্রের দুপুরে বাইরের জগৎটার মতো বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে ওঠে। জানালায় আমার মায়ের মুখ, হালকা বেগুনি রংয়ের শাড়ি, এলানো ভিজে চুল, পন্ডস স্নো-মাখা মায়াবী উৎকণ্ঠিত মুখ – ছেলেরা এখনো ফিরলো না – এই ঝাঁঝাঁ দুপুরে কোথায় টো-টো করে ঘুরছে!
‘মাকে তো ভুলেই থাকি আমি!’ শুধু শীতের গড়ানো দুপুরে মাকে দেখি লেপের ভেতর পা ডুবিয়ে শুয়ে-শুয়ে শরৎচন্দ্র অথবা বেগম পত্রিকা পড়ছেন। আমরা মাঝে-মাঝে উঁকি মেরে দেখছি – মা ঘুমোলো কি-না! জানালায় বন্ধুদের মুখ – ফিসফাস করে কথা, আজ রুনুদের বাগানে কাঁচা আমের ভর্তা – তাজীদের ছাদে এক্কা-দোক্কার আসর।
সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ে তসবিহ হাতে মাকে হেঁটে বেড়াতে দেখি – গুনগুন করে দোয়া পড়ছেন আর হাঁটছেন। চলবে রাত আটটা পর্যন্ত। তারপর নিচে নেমে আসবেন তিনি। আমিও মাঝে-মাঝে মায়ের সঙ্গে হাঁটি – টুকটাক কথা বলি, গুনগুন করে গান গাই – জীবনানন্দ আওড়াই অথবা ফিসফিস করে মাকে আমার লাল বই – মাও সে তুং-এর বাণী শোনাই, ‘তোমরা হচ্ছো সকাল আটটার সূর্যের মতো। ’
একদিন মনে পড়ে, একবুক শূন্যতা নিয়ে মাকে বলে ফেললাম, ‘মাগো, বুকের ভেতরের কলজেটা তামাক পোড়া পাতার মতো হয়ে আছে, একটু ছোঁয়া পেলেই চুরচুর করে ভেঙে যাবে। ’ অবাক চোখে মা তাকান আমার দিকে – আস্তে করে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে মাথায় সুরা পড়ে ফুঁ দেন। আজও মনে পড়ে মৃদু একটা সুবাস মায়ের বুকে – এত নরম – এত মায়া। খুব মনে পড়ে, ঝুল বারান্দায় শীতল পাটি পেতে বিদ্যুৎহীন সন্ধ্যায় মা শুয়ে আছেন। মায়ের গা ঘেঁষে আমরা গুটিগুটি ৫/৬টি ভাইবোন। কোনো-কোনোদিন ঝুম বৃষ্টি হতো – রাস্তার খুঁটির বিদ্যুতের আলোয় বৃষ্টির অঝোর ধারা – এই অদ্ভুত আলো-আঁধারিতে আমি গাইছি – ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’ – মায়ের চোখে ধারা বইছে।
১১/১২ বছরের আমি ভেবে পেতাম না – গানের কোন মানে বুঝে মা চোখে জল ঝরাতেন। ‘আসলেই মাকে আমার তেমন করে কখনোই মনে পড়ে না। ’ এমনকি আমার মায়ের মৃত্যুদিবসটিও বেমালুম ভুলে থাকি আমি। আমার বোনেরা সারাদিন অপেক্ষা করার পর সন্ধ্যায় যখন ভারি গলায় ফোন দেয় – লজ্জায়-অনুতাপে মরমে মরে যাই আমি।
অথচ এই আমারই দিনে কমপক্ষে দুবার মুক্তি হসপিটালের (পূর্বের এনাম ক্লিনিক) সামনে দিয়ে আসতে-যেতে, দোতলার শেষ মাথায় বারান্দাওয়ালা কেবিনটায় চোখ আটকে যায় – বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। মায়ের শেষ চারটি দিন আমি ছিলাম তার কাছে। একমুহূর্তের জন্যও কাছ-ছাড়া হই নি। অথচ ঠিক সেই দুপুরে সবাই জোর করে বাসায় পাঠালো আমাকে। ক্লান্তি আর উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্নের মতো পড়ে আছি – পড়ন্ত বিকেলে ফোন এল। বিধাতার এ কেমন খেলা – শেষ সময়টায় আমি মায়ের কাছে থাকতে পারি নি। চলে যাওয়ার আগে কিছু কি বলেছিলেন? চোখ মেলে খুঁজেছিলেন কি আমাকে?
আচ্ছন্নের মতো ছুটে গিয়ে দেখছি আমার ছোটভাই পাগলের মতো প্রলাপ বকছে আর হসপিটালের মেশিনপত্র, দরজা-জানালা ভাংচুর করছে – কেউ তাকে থামাতে পারছে না। শোকের কী তীব্র প্রকাশ!
– মা, মাগো, তোমাকে নিয়ে খুব লিখতে ইচ্ছে করে, এক আকাশ সমান স্মৃতি তোমার সঙ্গে আমার। কিন্তু কেমন করে লিখব? সারাদিনের কর্মযজ্ঞে আমার যে তোমাকে একবারও মনে পড়ে না।