হারাধন

জনেশ লোটন রায়


ভোরের পাখিরা যখন কিচিরমিচির শুরু করে – বোনা হাঁসের তা দেয়া বাচ্চা ফোটার আগমুহূর্তে যেমন ডিমে চির ধরে, পূবের আলো তেমন ভোরের সতী অন্ধকারে চির ধরে কেবল সরস প্রকৃতিতে উঁকি দেয়। হারাধন তখন তার ক্রমশই ছোট হয়ে আসা কুঁড়ে ঘর থেকে আড়মোড়া ভেঙে বের হয়ে আসে। গত পনেরো বছর ধরে এটি তার সূর্য ওঠার মতোই নৈমিত্তিক।


ভা
রতের কাঁটাতার সংলগ্ন দর্শনা জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। যেদিকে দুচোখ যায়, চারিদিকের বেশিরভাগ জমিই একসময় ছিল হারাধনের। বড় চৌচালা টিনের সান বাঁধানো ঘর, ভরন্ত বউ, বাড়ন্ত ছেলেপুলে। হারাধন ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সবাই প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ওপারে। তদকালের এপারের অবস্থা এখন তাদের ওপারে। এই কুঁড়ে ঘরটুকু ছাড়া হারানোর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই হারাধনের।


কুঁড়েঘরে হারাধনের একাই রাত কাটে। সাথী তার একমাত্র কেরোসিনের  টেমি বাতি আর এক ব্যাণ্ডের একটি রেডিও। দিনরাত বাজেই চলে – যেন জানান দেয় বাড়ির মালিক বর্তমান।


হারাধন সে দিন বোনা হাঁসের তা দেয়া বাচ্চা ফোটার আগমুহূর্তের চির ধরা ডিমের মতো অন্ধকার ভোরে লাল কুসুমের প্রতীক্ষায় – শেষবারের মতো কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে তামাটে কঠিনপেশীযুক্ত হাত দুটি কোমড়ে রেখে সোজা হয়ে জমিনে দাঁড়ায়। চারিদিক দেখে। আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিক্ষণ ধরেই দেখে। হারাধনের কিছুই হারানোর নেই। এই কুঁড়েঘরটিও এখন অন্যের জমিতে।


হারাধন একটু একটু করে দিগন্তের দিকে এগোয়। তখনও কেরোসিনের শেষ বিন্দুতে সলতে জ্বলছিল, একব্যাণ্ডের রেডিওটি বাজছিলো, কি বাজছিলো, তা বরাবরের মতো হারাধনের চৈতন্যের অনেক উপর দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।