(General will in political theory, a collectively held will that aims at the common good on common interest. Rousseau-The Social Contract, 1762)
খ.খ। ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটেই ইচ্ছাকৃতভাবে তার কুৎসিত কন্ঠে গান গাইতে শুরু করলো। “পাক সার জামিন সাদ বাদ।” গান শেষ হতেই এক ফু দিয়েই হেরিকেনের লাল আলোটুকু নিভিয়ে ফেলে। ঢাকার খবর জানার জন্য বিবিসি, আকাশবাণী শোনা শেষ। এক হাতে ছোট্ট রেডিও, অন্যহাতে লাল-সবুজ কাপড় নিয়ে দোকানের তালা লাগায়। এবার বাড়ি ফেরার পালা।
কাটপট্টি রোডের খ.খ মানে খলিল খলিফাকে চেনে বরিশাল শহরের সব মানুষ। ঝালকাঠির লুঙ্গি সেলাই থেকে সুচিত্রা সেনের মতো ব্লাউজের বাহারী হাত রয়েছে খলিলের। কিন্তু একটা জিনিষ সে কখনো বানায় নাই। আজ রাতে তা বানাতে হবে। তাই, হাতে লাল-সবুজ কাপড়। বাড়িতে আছে কাঁচি, স্কেল, আর একটা পুরাতন সিঙ্গার হাত সেলাই মেসিন। সেটার সদব্যবহার খলিফার বেগম করে। সাংসারিক প্রয়োজনে অথবা প্রতিবেশীর অনুরোধে। বেগম ভাত নিয়ে বসে আছে কিন্তু খলিফার ভাত খাওয়ার সময় নেই আজ রাতে। সকালেই মালামাল ডেলিভারী দিতে হবে। মহিউদ্দিন স্যার, সেরনিয়াবাদ স্যার লোক মারফৎ অগ্রিম টাকা পাঠিয়েছে। মালামাল নিয়ে সব ঢাকায় যাবে। খ.খ বুকের মধ্যে এক তীব্র উত্তেজনা। তার করা কাজ, মালামাল ঢাকায় যাবে।
কালিবাড়ি রোডে আসতেই দিলিপ বাবু স্যারের সাথে মুখোমুখি। দিলিপ বাবু ব্যাপ্টিষ্ট মিশন স্কুলের বাংলার স্যার। নিরীহ-গরীব-ভদ্র-সভ্য-নম্র মানুষ বলেই সন্মানের পরিমানটা অন্যদের চেয়ে একটু বেশীই পায়। কালিবাড়ি রোডে একই পাড়ায় থাকে। দিলিপ বাবুর সাদা পাঞ্জাবী, পায়জামা, মহিলাদের ড্রেস সবই খ.খ-র হাতেই তৈরী। তবু এত রাতে খ.খ দিলিপ বাবুকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। ভয় পেয়ে লুকিয়ে ফেলে লাল-সবুজ কাপড়। মিউনিসিপ্যালেটির লালচে মৃদ আলোতে দেখা যায় খ.খ-র বগলে একটি রেডিও, অন্যহাতটি পিছনে। অন্যদিকে, দিলিপ বাবু ময়লা ধুতি আর তিল পরা পাঞ্জাবী পরে চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে আছে। দু’জন দু’জনের চোখে চোখ রাখে। সদর রোড দিয়ে সাপের মতো চলে যায় এক একটি পাকি পুলিশের গাড়ি। দেশের অবস্হা ভালো না। কিছু একটা হতে যাচ্ছে। সবাই জানে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। নিঃস্তব্দতার সংস্কৃতি ভর করছে পুরো দেশ জুড়ে। আবার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে চলছে মনের ভিতরে থাকা একটা পাথর পেন্ডুলাম। খ.খ ধরা পরে গেছে-এই ভয়ে মাথা নিচু করে থাকে। দিলিপ বাবু ধরা পরে গেছে-এই ভেবে হাত কচলায়। দু’জনের এই নিরব শারীরিক, সাংকেতিক ভাষা ভাঙ্গে পুলিশের সাইরেন। মূহুর্তেই এক ঝটিকায় দিলিপ বাবু খ.খ-কে নিয়ে ঢুকে পরে কালিবাড়ির মন্দিরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুলিশের গাড়ি চলে যেতেই দিলিপ বাবু গলা খাকারী দেয়। খ.খ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। ডান হাতে লুকিয়ে থাকা লাল-সবুজ কাপড়গুলি এবার সামনে আসে। হাত কচলাতে কচলাতে দিলিপ বাবু কন্যাদায়গ্রস্হ পিতার মতো বলে-
-খলিল?
-জ্বে স্যার।
-কাল ঢাকা যাব। স্কুলের লাইব্রেরীর জন্য কিছু বইপত্র কিনতে। সদরঘাটে। নর্থবুক হলে, নওরোজ কিতাবিস্তানে। বই-র অর্ডার পোষ্টে পাঠিয়েছি। রেডি আছে। শুধু টাকা দিয়েই বই নিয়ে রওনা দেব।
-জ্বে স্যার। বই পড়া ভালো কাম। আমারতো সময় নাই। আমি বিবিসি আর আকাশবাণী শুনি। দ্যাশের অবস্হা ভালো না! তয়, স্যার বাড়ি যাই। কাম আছে।
-কী কাম?
-মানে, মানে স্যার এই একটু জামাকাপড় সেলাই করতে হবে। আর্জেন্ট অর্ডার। কাল খুব সকালেই ডেলিভারী দিতে হবে।
-জয় বাংলার পতাকা? আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ অর্ডার দিসে?
-আপনি জানেন স্যার! খ.খ. বুকের মধ্যে যেন প্রাণ ফিরে এল। যাক, স্যারকে বিশ্বাস করা যায়। কে কখন কোন দিক দিয়া ফাসায় দেয়, কে জানে? বাংলা স্যার ভালো মানুষ। দ্যাশের সব খবর রাহে, তাইলে।
-খলিল ভাই? ভাই আমার?
-জ্বে স্যার।
-আমার একটা অনুরোধ, মানে উপকার না করলেই যে নয়! আর্জেন্ট অর্ডার।
-জ্বে স্যার বলেন। এই খলিলইল্যা হারা জীবন আপনাগো বাড়ির পোষাক বানাইছে। এহন আপনি একটা পোষাক বানাইবেন। এইডা রাখতে পারুম না, এইডা কেমনে ভাবলেন স্যার?
-তয় কমু? বলেই দিলিপ স্যার খ.খ-র হাত দুটি চেপে ধরে। বলে-কথা না দেয়া পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি নাই। শক্ত হাতে হাত চেপে ধরে যেটা বলে-জানতো খলিল ভাই। আমি এক দরিদ্র বাংলা মাস্টার। কয় টাকা আর বেতন পাই? টিউশনি, রং চা, মোল্লার মুড়ি – এইতো আমার জীবন। তয়, এবার একটা শখ হইছে। মরার আগে একটা পোষাক পরুম। আইজ রাইতেই তুমি বানাবা। ওইডা পইরা ঢাকা যামু। মাপ তো তুমি জানোই, জানো না?
-জ্বে স্যার।
-কাপড়ের দামটা বেতন পাইলেই দিমু। খালি মজুরী দিমু কাইল। জীবনে তো একটাই শখ। এই পোষাকটা পইরা কাইল ঢাকা যামু। ঢাকা থিকা যদি ফেরৎ না আহি, তয় তোমার বৌদির কাছ থিকা কাপড়ের দামডা নিও। এহন কও, কাইল দিতে পারবা তো?
-জ্বে স্যার। একটা সাদা পাঞ্জাবী। একটানে লম্বা একটা সেলাই। চাইরডা পকেট। খলিলের হাতে এইডা চাইর ঘন্টার কাম। মাপ মুখস্ত। পাইয়া যাইবেন স্যার। রকেটে যাইবেন তো? আমার ছ্যামড়াডা পাঞ্জাবিডা ইস্টিমার ঘাডে দিয়া আইবো। টাকা-পয়সার কতা কইয়া লজ্জা দেন ক্যান স্যার? খইল্যা খলিফা কি আপনাগো পর মানুষ? এহন যাই স্যার। রাইত বাড়তাছে। দ্যাশের অবস্হা কেমন ঠেহেন স্যার? পুলিশের গাড়ি সদর রোড দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর যাচ্ছে। পাতিশিয়াল ও বেওয়ারিশ কুত্তার গলা ফাটানো আর্তনাদ বা শোকার্ত ডাকে মা কালীও নড়ে চড়ে ঠিকঠাক দাড়িয়ে থাকে মন্দিরের ভিতরে। খ.খ বাড়ি যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগে আদাব দিয়ে বলে; হারা রাইত জয় বাংলার পতাকা সেলাই করুম। তারপর আপনার পাঞ্জাবি। দুপুরের মধ্যেই পাইয়া যাইবেন স্যার।
-খলিল ভাই?
-জ্বে স্যার। পাঞ্জবি না!
-তয়?
-মুজিব কোট।
খ.খ ছিটকে পড়ে। আতংকিত চোখে চেয়ে থাকে দিলিপ স্যারের দিকে। সারা রাইত জয় বাংলার পতাকা বানাইয়া, তারপর মুজিব কোট, তারপর কোট পইড়া স্যার ঢাকা যাবে-অসম্ভব! অসম্ভব স্যার। এত অল্প সময়ে এটা সম্ভব না। তাছাড়া, কোটের কাপড়ও আমার কাছে নাই। স্যার যাই?
-তোমার কাছে যে কালা কাপড় আছে, তাই দিয়া বানাবা। কালা তেনা আছে? কালা কাপড় দিয়া ব্যানার সেলাই কর না? আছে না? মহিলাগো ব্লাউজ-পেটিকোট-বোরখা কালা কাপড় দিয়া বানাও না?
-জ্বে স্যার। আছে। বানামু। কিন্তু কোটের কাপড় নাই তো।
-লাগবে না। তুমি যেমনে পার, কালা তেনা দিয়া হইলেও মুজিব কোট বানাবা। পারবা না? স্যারের কন্ঠস্বর কেমন যেন রুঢ়-দৃঢ় অথবা বিপ্লবী বিপ্লবী মনে হয়।
-জ্বে স্যার। পারুম। তয় আপনি বাংলার মাস্টার। আপনি একটা দামী কাপড়ের মুজিব কোট পরবেন। সময় নিয়া বানাইবেন। তা না, এত আর্জেন্ট এই সব কঠিন কাজ করা যায়, স্যার?
-সময় নাই খলিল ভাই। সময় প্রায় শেষ! রাইত পোহাইলেই তোমারে জয় বাংলার পতাকা ডেলিভারি দিতে হবে। তোমার হাতে সময় আছে?
-নাই। আবার আপনি মুজিব কোট, মুজিব কোট কইয়া কিছু রাইত খাইয়া ফালাইছেন। সময় নাই স্যার। কাইল কোট পাইবেন। আর আমি যে জয় বাংলার পতাকা আর মুজিব কোট বানাই, আবার জনে জনে কইয়েন না কিন্তু। তয়, যাই স্যার। আপনি সাবধানে বাড়িতে যাইয়েন। ছ্যামড়াডা ইস্টিমার ঘাডে কোট পৌঁছিয়া দেবে। আল্লাহ ভরসা। দিলিপ স্যার খ.খ’র হাত চেপে ধরে। বাংলা স্যারের চোখে আনন্দঅশ্রু!
২.
কালিবাড়ি রোডেই দিলিপ স্যারের আদি নিবাস। মন্দির থেকে বের হয়েই, বাসায় আসতেই দেখে দিপালী রান্না করছে। টেমি বাতির আলোতে যা চোখে পরে তাহলো;- বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরীর আয়োজন। মার্চ মাস অথচ পাটালী গুড়ের গন্ধে রান্না ঘর মৌ মৌ করছে। দিপালী এক হাতে পিঠা বানায়, অন্য হাতে একটি পাটিসাফটা পিঠা দিলিপ স্যারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, কি, কি বলল খ.খ? বলছে কাল দেবে। কিন্তু টাকা-পয়সাতো দিতে পারবো না! বলছি শধু মজুরী দেব। কাপড়ের দাম পরে। দিপালী পিঠা বানানো বাদ দিয়ে উঠে দাড়ায়। রান্না ঘরের শেষ মাথায় ঝুলছে একটি পাটের ছিকা। তার মধ্যে ঝুলছে একটি নৃত্যরত রাধা-কৃষ্ণের ছবি আঁকা পোয়াতি মেয়ের মতো মাটির ব্যাংক। ব্যাংকটি এনে দেয় বাংলা স্যারের হাতে। বলে-ভাংগেন। বাংলা স্যার অবাক বিম্ময়ে চেয়ে থাকে দিপালী’র দিকে। অভাব অনটনের সংসার। মেয়ের সদগতির জন্য দিপালীর সর্বশেষ সঞ্চয়। এ সঞ্চয় ভাংগলে মেয়ের ভাগ্যে কী থাকবে? বাংলা স্যার তিল পরা পাঞ্জাবীর হাতা মুড়িয়ে ব্যাংক হাতে বসে থাকে পাথরের মূর্তির মতো। নিজেকে ব্যর্থ, অসহায় এক কাপুরুষ মনে হয়। সামান্য বাংলা পড়িয়ে একটি সংসার কী চলে? সংসার চলে না, তার মধ্যে আবার নতুন মুজিব কোট বানানোর শখ! লজ্জা-গ্লানিতে মাটির সাথে মিসে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কি করা? একটি পোষাক এক জীবনে পরা হবে না, এটা কি কোন মানুষের জীবন হলো? ঢাকায় যাওয়া-আসা-খাওয়া খরচ স্কুল কৃর্তপক্ষ দেবে কিন্তু পোষাকের খরচ তো নয়। দরিদ্র স্কুল মাস্টারের পাজামা-পাঞ্জাবি-স্যান্ডেল-গায়ে চাদর-হাতে কালো ছাতা; এইটুকু ছাড়া অন্য সব কিছুই তো বিলাসিতা! কেন যে দিপালীকে মুজিব কোটের কথা হাউস করে বলতে গেছিল। সেই রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে-ওজনওয়ালা মুল্যবান ব্যাংকটি মাটিতে সাবধানে রেখে চুলা থেকে একটা আম কাঠের আগুন বের করে স্টার সিগারেট ধরিয়ে টান মারে, জোড়ে জোড়ে। বাংলা স্যারের এসব লজ্জা শরম দিপালীর অজানা নয়। বেচারার মাত্র দুটি সাদা পাঞ্জাবি, তাও তিল পরা। একটা ধুয়ে শুকাতে না শুকাতে আরেকটা ধুতে হয়। একটা শখ। একটা স্বপ্ন দেখেছে বাংলা স্যার। তা, যদি এ জীবনে পূরণ না হয়, তবে বেঁচে থেকে লাভ কী? দেশের যে অবস্হা, তাতে কে যে কয়দিন বাঁচে! কে জানে? এসব ভাবতে ভাবতেই দিপালী চুলার পাশে রাখা দা দিয়ে ব্যাংকের মাঝ বরাবর মারে এক বাড়ি। ভেংগে পড়ে ব্যাংক, ভেংগে পড়ে বাংলা স্যার। জিন্না পয়সাগুলি গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায় উঠানে। জিন্নার মুখের উপর হিসি করে দেয় গৃহপালিত বাঘের মতো এক পোষা কুকুর। দিপালী টাকাগুলি গুনে। বাংলা স্যার পয়সাগুলি টুকিয়ে টুকিয়ে ব্যাংকের কাছে রাখে। -কত হলো মোট? দিপালীর রহস্যময় প্রশ্ন এবং ব্যাংক ভাংগার কারণে অপরাধীর মতো চুপচাপ বসে থাকে বাংলা স্যার। নিভু নিভু টেমি বাতির আলোতে বাংলা স্যার দেখে, দিপালীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে এবং আনন্দে ভরে গেছে দু’চোখ। বলে-মজুরী, কাপড়ের দাম; সব হয়ে যাবে।
অন্য একটি বাসায় তখনও জ্বলছে হারিকেন। খ.খ সবুজ কাপড় মেলে ধরে। মাঝে লাল রং-এর গোল সূর্য। সূর্যের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা খুব যত্ন করে কেটে দিচ্ছে। খ.খ-র বৌ জান্নাতুল ফেরদৌস অতি যত্ন সহকারে হাত মেসিন দিয়ে ক্রমাগত সেলাই করে চলছে। সবগুলি পতাকার কাজ শেষ হলে, মাস্টারের জন্য কোটের কাজ ধরতে হবে। উত্তেজনায় খ.খ বারবার কেঁপে উঠছে। জান্নাত যতদ্রুত সম্ভব সেলাই করে যাচ্ছে। খ.খ কাঁদছে! জান্নাত কাঁদছে!! বারবার চোখ মোছে। নাক মোছে। নতুন পতাকা। নতুন দেশ। ওঙ্কারের বেদনা শুরু হয়ে গেছে। পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। চিরদিনের বোকাসোকা চেহারার জান্নাত হঠাৎ করে এক কঠিন প্রশ্ন করে বসে খ.খ-কে। -আচ্ছা, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কী বলবে? খ.খ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জান্নাতের দিকে। জান্নাত চেয়ে থাকে খ.খ-র দিকে। কেরাসিন ফুরিয়ে আসছে। যে কোন মূহুর্তেই নিভে যাবে হেরিকেন। তার আগেই কানে কানে খ.খ বলে ওঠে, তুমি মা হবা। একটা সন্তান প্রসব করবা। এরপর পতাকার উপরই শুয়ে পড়ে নতুন স্বপ্ন দেখা এক খলিফা দম্পতি।
৩.
ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় গাজী ষ্টিমার ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। বিকাল পাঁচটায় বাংলা স্যার আর দিপালী ছোট্ট একটা ব্যাগ হাতে কাটপট্টি রোডে খলিল খলিফার দোকানে হাজির। কিন্তু একি? কোট এখনও রেডি হয় নাই। সেলাই চলছে পুরোদমে। কখনো হাতে, কখনো মেসিনে। দুঃখ ও চিন্তাসহ এক গভীর বেদনা নিয়ে বাংলা স্যার চেয়ে থাকে খ.খ-র দিকে। খ.খ-র চোখ সুই সুতা আর কাপড়ের দিকে। ষ্টিমার ছাড়তে আর পনেরো মিনিট বাকী! চরম হতাশা নিয়ে বাংলা স্যার বলেন, খলিল, আমি বরং ঢাকা চলে যাই। তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম। কিছু মনে কর না।
-কি যে বলেন স্যার। আপনি বৌদিকে নিয়া সোজা রকেটে ওঠেন। ছ্যামড়াডা এক দৌড়ে কোট পৌঁছে দেবে। খলিলের মায়ের কসম! রওনা দেন স্যার। গভীর এক বিষন্ন মুখ, পরাজিত সৈনিকের মতো ম্লান মুখ নিয়ে বাংলা স্যার বের হন দোকান থেকে। দিপালী যাবে না। শুধু ষ্টিমারে স্যারকে বসিয়ে দিয়ে, প্রণাম দিয়ে চলে আসবে।
গাজী একবার হুইসেল দিয়ে ফেলেছে। কাটপট্টি রোড থেকে ষ্টিমারঘাট পর্যন্ত প্রায় এক দৌড়ে চলে এসেছে দুজনে। এসেই দেখে লোকে লোকারণ্য। কাল ৭ মার্চ। সবাই ঢাকা যাচ্ছে। আবদুর রব সেরনিয়াবাদের হাতে খ.খ-র বানানো নতুন পতাকা। একটা বড়সর পতাকা বের করে দিয়ে এক কর্মীকে বলল, ক্যাপ্টেনকে কও, গাজীর একদম সামনে টানাতে কইছে স্যারে। বাংলা স্যার কোন মতে ইলিশ বোঝাই মাছের ঝুড়ির পাশে বসে পড়ে। দিপালী গভীর চিন্তায় চেয়ে আছে বাংলা স্যারের দিকে। স্যার লজ্জায় মাটি নয়, তাকিয়ে থাকে ইলিশ মাছের চোখের দিকে। হায়রে শখ! কাল ৭ মার্চ। একটা মুজিব কোট। হল না! হয় না কোন কিছুই!! এরই মধ্যে এক ফাকে, ভিড়বাট্টা ঠেলে ঢুকে পড়ে এক বালক ওরফে ছেমড়া।
-স্যার, লন আপনার কোট! বাংলা স্যার বিদ্যুতের শক খেয়েছে যেন। তিরিং করে লাফ দিয়ে ওঠে; খুব দ্রুত পড়ে ফেলে কোটটা। কী সুন্দর বানিয়েছে খলিল। কী সুন্দর গাঢ় কালো রং। কী সুন্দর ফিটিং। দিলিপ স্যারের চোখে আনন্দ অশ্রু! হিমালয় জয়ের হাসি। কোটটি পড়ে দিলিপ স্যারের মনে হয়, সত্যিইতো আমিইতো বাংলার মাস্টার। একটা গ্লানি, একটা ভয়, একটা অসহাত্ববোধ কেটে যায় মুহুর্তেই। একটা আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে সমস্ত দেহ-মন-আত্মায়। স্যারের আনন্দ দেখে বালকটিও লাফ দিয়ে বলে ওঠে;-
-জয় বাংলা!
-থাম। দিপালী ধমক মারে। এ্যাই বোতাম ঘর কৈ? বোতাম কৈ?
-আ! তাইতো। কোটে তো বোতাম নাই। ঘরও নাই। আসলে খলিল সাহেব সময় পায় নাই। পাইলে ঠিকই বানাইয়া দিত। না, কি বল দিপালী? কোন সমস্যা না। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি চাঁদপুর যাইয়া সেপটিপিন কিননা নিমু। কি কও তুমি?
-চুপ কর তুমি। রাগে ফেটে পরছে দিপালী। আঁচল থেকে টাকা বের করে বালকের হাতে দিয়ে বলে,
-তুই এখ্খুনি একটা ব্লেড, এক ডজন কালো বোতাম আর একপাতা সোনামুখি সুই, একটা কালো চিকন গ্লোব সুতা কিন্না নিয়া আয়। এক দৌড়ে যাবি, এক দৌড়ে আবি। যা… । বালক রেলিংয়ের ফাঁকা দিয়ে বেড় হয়ে ভৌ দৌড়। অন্য দিকে গাজী শেষবারের মতো সিটি দিয়ে ফেলেছে। সিঁড়ি ওঠানো শেষ। দড়ি ছেড়ে দিয়েছে। সামনের দিকে চলতে শুরু করেছে গাজী। বালকের কোন খবর নাই।
-ষ্টিমার ছেড়ে দিয়েছে। দিপালী তুমি নাইম্যা যাও। ঐ যে পাশে নৌকা। ওটায় করে নামো। যাও। সবাই নেমে যাচ্ছে।
-না, আমি যাব না। চাদঁপুর থিককা বোতাম কিননা আমি কোট ঠিক কুরুম। তারপর আমি তোমার সাথে ঢাকায় যামু।
-আরে কী সব পাগলামী করছো। ঔই ছেমড়া আর আসবে না। তোমার টাকা পয়সা নিয়া চম্পট। তুমি নামো। কোটটা হইছে। আর কি? এরই মাঝে রেলিংয়ের পাশ দিয়ে ছুড়ে মারে এক পোটলা।
-স্যার, আপনার বোতাম। নৌকা আর ষ্টিমারের ফারাক একটু একটু করে বাড়তে থাকে। গতি বেড়ে যায় ষ্টিমারের। পোটলা খুলেই দিপালী কাজে লেগে পড়ে। সোনামুখি সুই-র মধ্যে সুতা ঢুকিয়ে বলে,
-কোট খোল। বাংলা স্যার বাধ্যগত ছাত্রের মত কোট খুলে দেয়। দিপালী বোতামের মাপ নেয়। বাংলা স্যারের ব্যাগে পেন্সিল আছে। পেন্সিল দিয়ে বোতামের ঘর আঁকে, মাপ মতো। তারপর আস্তে আস্তে বোতাম ঘর তৈরী করে। বোতাম লাগায়। অন্যদিকে বাংলা স্যার বই-র লিষ্টিটা একবার চোখ বুলায়। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-শরৎচন্দ্র থেকে আধুনিক ভুগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি … দীলিপ স্যার স্বর্গসুখে বা শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন, তা সে নিজেও জানে না এবং জানে না দিপালীও। সে ব্যস্ত কোটের বোতাম লাগাতে।
শেষ বোতাম ঘরটি যখন তৈরী হয়, তখন গাজী চাঁদপুরে নোঙর ফেলেছে। ভোর হয়নি তখনো, তবে রাত শেষ প্রায়। রাতভর বাংলা স্যার চাদর মুড়ি দিয়ে নাক ডাকে। আর দিপালী শেষ বোতামটি লাগিয়ে তাকে ডাকে,
-এই যে স্যার, শুনছেন? চাঁদপুর এসে গেছে। ওঠেন। কোট পড়েন। এই ডাকে ধড়মড়িয়ে ওঠে বাংলা স্যার। কোটের সব কালো বোতাম দেখে খুশি এবং ভয়াবহ আনন্দে জড়িয়ে ধরে দিপালীকে। ডেকের সব মানুষ হেসে ওঠে মাস্টারের এই পাগলামীতে। দিপালী অস্বস্তি বোধ করে। চোখ মুছতে মুছতে বলে, আহ্, ছাড়ো না!
৪.
সূর্য উঠি উঠি করছে। সদরঘাট জামে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে সুরেলা আজান। নরম ভোর আর হালকা কুয়াশা ভেদ করে ঘাটে এসে ভেড়ে জলযান সম্রাট-গাজী ষ্টিমার। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। কেউ আসছে ষ্টিমারে, কেউ আসছে লঞ্চে, কেউ নৌকায়। মানুষ আর মানুষ। কারো হাতে গুর-মুড়ি-চিড়া, কারো হাতে ব্যানার-ফেস্টুন। খালি গা আর পোষাক দেখেই বোঝা যায় সব জনতা এসেছে দূর-দুরান্ত, গাঁও-গেরাম থেকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি ঘরের সন্তান। এসব সন্তানদের মধ্যে একজন দরিদ্র বাংলা মাস্টার, যার গায়ে তিল পড়া পাঞ্জাবি অথচ উপরে চকচকে বাকিতে কেনা মুজিব কোট! সে নেতা নেতা ভাব করে দীপালিকে নিয়ে বীর-র্দপে এগিয়ে যায় নর্থবুক হলের দিকে। রাস্তায় রাস্তায় মিছিলের প্রস্তুতি। এরই ফাকে পেট ভরে খেয়ে নেয় সকালের গরম ভাত। গরম ভাত যতটা না গরম, তারচে বেশি গরম তার গায়ের কোট। কোটের গরমে রক্ত গরম। রক্তের দৌড় শুরু হয়ে যায় শিরা-উপশিরায়। প্রতিটি রক্ত কনিকা, কোষকে-জিনকে বলছে-আজ বঙ্গবন্ধু কিছু বলবে। রক্ত, তুমি প্রস্তুতি নাও।
নওরোজ কিতাবিস্তান লাইব্রেরী প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। বাংলা স্যার টাকা দিতেই এক গাট্টি বই-র বাণ্ডিল এগিয়ে দেয়। দিলিপ বাবু লিস্ট অনুযায়ী মিলিয়ে নেয় বই। রবীন্দ্রনাথ থেকে রসায়ন, রসায়ন থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। তবে, বাংলা স্যারের মুজিব কোট দৃষ্টি কাড়ে দোকানদারের।
-স্যার, জয় বাংলা পরেছেন? দ্যাশের অবস্হা কিন্তু ভালো না! আইজ কিন্তু একটা ফয়সালা হবে। মাগার শ্যাক সাইব যদি…
-বঙ্গবন্ধু বলেন।
-জ্বি স্যার, জ্বি স্যার। আইজ একটা বিশেষ দিন। আমিও এখন দোকান-পাট বন্ধ কইরা রেসকোরসে যামুগা। তয়, এতদূর থিক্কা আইছেন, বই কিনছেন, নতুন কোট পরছেন, আপনার লাইগ্যা একটা বিশেষ উপহার দিতে চাই। না, না পয়সা লাগবে না। ব্যক্তিগত উপহার। বিশেষ দিনের বিশেষ উপহার। যদি আর কোনদিন আপনার লগে দেহা না হয় … চারদিকে যা হুনবার পারছি … খানেরা নাকি রক্তগঙ্গা বহাইয়া দেবে … আবে হালায়, স্যার-বৌদি আইছে। চা দে, বাখরখানি দে তাড়াতাড়ি। বাংলা স্যার বাখরখানিতে কামড় দিতেই ছোট্ট একটা বই বের করে দেয় মালিক। আপনার জন্য আমার শ্রদ্ধার নিদর্শন। নেন স্যার, যদি আর দেখা না হয়!
বাংলা স্যার পকেট সাইজ বইটি হাতে নেয়। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি। ১৯১ পাতার পকেট বুক। প্রকাশনায় ঝিনুক পুস্তিকা, মেরিনা হোটেল কম্পাউন্ড, বোনাস রোড, করাচী-৪, মূল্য-পচাত্তর পয়সা মাত্র। বইটির প্রথম গীত -‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’। বাংলা স্যার পরম মমতায় পকেট বুকটি কোটের বুক পকেটে রাখে। মনে মনে বলে, হে রবীন্দ্রনাথ, আমরা আর কত কাল মাথা নত করে থাকবো? আজ আমাদের মাথা উঁচু করে বাঁচবার ঘোষণা যদি না আসে তবে … বিরবির করে কী বল? দিপালী হাত ধরে টান দেয়। সেই টানেই বেড়িয়ে আসে জনসন রোডের ঘড়িওয়ালা গির্জার সামনে। বাংলা স্যার গির্জার দিকে তাকিয়ে ঘড়ি দেখে। হাতে মেলা সময়। সময় কাটানোর উছিলায় বাংলা স্যার বলে,
-চল শাখারীপট্টিতে। পূজা-টুজা দিয়া চল সদরঘাট যাই। দ্যাশের অবস্হা ভালো না! দেখ না, একটার পর একটা মিছিল যাইতেছে।
-আপনিতো এখন সদরঘাট যাইবেন না। আপনার তো অন্য উদ্দেশ্য আছে।
-মানে? তয় কোথায় যাবো? দিপালী বেশ ভারি গলায় বলে, কোথাও যাইতে হইবে না। মিছিলই আমাদের নিয়া যাবে, যেখানে আমাদের যাওয়ার কথা। বাংলা স্যার অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে দিপালীর দিকে। কেমনে এত বোঝে দিপালী? আমাদের তো সদরঘাট ফিরে যাওয়ার কথা … কিন্তু যখন একথা বলে, ততক্ষণে জিন্না এভিনিউ হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। সামনে মিছিল, পিছনে মিছিল। মিছিলের হাতে হাতে নতুন দেশের পতাকা। হাতে প্লাকার্ড। ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ দিপালী বাংলা স্যারকে খোঁচা মারে;
-দেখছেন?
-হয়। কিন্তু আমার তো অস্ত্র নাই। আছে শুধু বই।
-আপনার বই-ই তো আপনার অস্ত্র!
-মানে?
-মানে আপনি শিক্ষিত মানুষ। আপনি বই পড়েন। পড়ান। আপনি মানুষকে বোঝাবেন-শিক্ষিত করবেন। আপনি মুজিব কোট পরা মাস্টার না?
-হয়, হয় ঠিকই কইছো। ঠিক সময়ে এই মফস্বলের দম্পতি হাজির হয় পিজি হাসপাতালের সামনে। মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ কোথা থিকা আইছে? যার যা কিছু ছিল, সব কিছু নিয়া আইছে। নারী-পুরুষ-শিশু-যুবা-বৃদ্ধ-ফকির-মিসকিন-লাখোপতি-কোটিপতি-ছাত্র-ছাত্রী-মাস্টার। কলরেডিতে বাজছে দেশাত্ববোধক গান, গণসংগীত। চারিদিকে গগণ-বিদারী শ্লোগান। সবার মুখে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। দিপালী পুটলি থেকে ছোট্ট একটা টিফিন বক্স বের করে। বাংলা স্যার হাত বাড়ায়। বলে,
-দেও, খাই কিছু পিঠা। আর হয়তো খাওয়া হবে না! উদাস এবং ভরাট কণ্ঠে বলে বাংলা স্যার। দিপালী চেয়ে থাকে। এ ধরণের অশুভ কথা শুনে অবাক হয় না!
-এ পিঠা তোমার জন্য না।
-তয়?
-তুমি, ফুটপাতে বইসা পর। আমি আইতেছি। দিপালী ঢুকে পরে মঞ্চের সামনে। সেখানে চলছে রক্ত গরম করা বক্তৃতা। দিপালী চোখে-চোখ লাগিয়ে কাকে যেন খোঁজে। দিপালী ভিড়ভাট্টা ঠেলেঠুলে, স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় চলে যায় এক নারীর কাছে। পাশে বসে।
-আপা? কবি বেগম সুফিয়া কামাল নরম স্বরে জবাব দেয়, জ্বি, বলো মা।
-আপা, আমি বরিশাল থেকে আইলাম। আপনার প্রতিবেশি। পিঠা লইয়া আইছি। বঙ্গবন্ধুকে দেবেন। কইবেন বরিশালের কালিবাড়ি রোডের দিপালী বানাইছে।
-দেবো। মিটিং শেষ হলেই আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাবো। তখন দেবো। বেঁচে থাকো মা হাজার বছর।
-আমার বাঁচার দরকার নাই আপা। ভগবান যেন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচায় রাখে হাজার বছর! পরম শান্তিতে কবিকে প্রণাম করে দিপালী যখন উঠবে, তখনই কলরেডিতে এক মহামানব বলছে,
‘ভাইয়েরা আমার। আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। ’
মূহুর্তেই পিন পতন নিস্তব্ধতা। চারিদিকের বিশ লক্ষ চোখ তাকিয়ে থাকে একটি হিমালয় পর্বতের দিকে। বাংলা স্যার বুক পকেটে চেপে রাখে রবীন্দ্রনাথকে। হঠাৎ হাত চলে যায় গোপন বুক পকেটে। সেখান থেকে বের হয় খ.খ-র তৈরী ছোট্ট একটা নতুন পতাকা। খলিলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ভিজে উঠে। পতাকাটি একটি লাঠির সাথে বেেঁধ উঁচু করে টানিয়ে রাখে বাংলা স্যার। বারবার তাকায় পতাকার দিকে, বারবার বইগুলির দিকে তাকায়। সেখানে তাকিয়ে আছে কত বিখ্যাত লেখক। কিন্তু সব বিখ্যাত লেখক-কবিগণ-জনগণ আজ যেন কিছু বলতে চায় … …
-সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, হবস, লক, রুশো বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-কার্ল মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-রবি ঠাকুর বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-নজরুল বিরবির করে হাতের ইশারায় বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-বিভূতি-মানিক-তারাশংকর বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-জীবনানন্দ দাশ, বনলতা সেন বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-ইন্দিরা গান্ধি, নেতাজী সুভাষ বসু, জ্যোতিবসু বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-ভুগোল, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-একুশে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২, ৬ দফা বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-লালন, হাসন রাজা, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-অব্বাসউদ্দিন, জসিমউদ্দিন বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-কোরান, গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-অন্নদাশঙ্কর রায় বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-বিবিসি, আকাশবাণী, রেডিও পাকিস্তান বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-তেরশত নদীর বদ্বীপের হাজার বছরের সাত কোটি শোষিত জনগণ বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
-শেখ লুৎফর রহমান, সায়েরা খাতুন, রেণু বলছে; আজ মুজিবুরকে কিছু বলতে হবে।
– এবং এই সব বলাবলি ও বজ্রকণ্ঠের ভাষণের মধ্যেই বাংলা স্যার দেখে পিজি হাসপাতালে ছাদের উপর মেশিনগান তাক করে আছে এক খান সেনা! মূহুর্তেই জীবনানন্দ দাশ চিৎকার করে বলছে;- বাংলা স্যার, দিলিপ বাবু, আপনি মানুষ থেকে সোনালী ডানার চিল হয়ে যান। চিল হয়ে যান। হয়ে যান …
মুজিব কোট পরা একটি সোনালী ডানার চিল খান সেনার মাথার উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। মূহুর্তেই কোথা থেকে হাজির হয় হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি সোনালী ডানার চিল। বোমারু বিমানের মতো উড়তে থাকে খান সেনার মাথার উপর। ততক্ষনে কলরেডিতে ভেসে আসছে একটি কড়া নির্দেশ-“অমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…”।
মুজিব কোট পরা সোনালী ডানার চিলটি শুধু হেসে বলে, হুকুম তামিল করার গ্রীণ সিগনাল আমরা পেয়ে গেছি জনাব!