জমিদার বাড়ির চিলেকোঠার পলেস্তরা খসে পড়া দেয়াল শেওলায় সবুজাভ রঙ নিয়েছে।মাকড়সা নিপুণভাবে যে জাল বুনেছে তা যেন আজকের যুগের অন্তর্জালেরই নকশা। যদিও অন্তর্জালিকা দৃশ্যমান কিছু নয়। যেখানে একাধিক টিকটিকি সতর্কতার সাথে বিচরণ করছে। কক্ষময় বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে অতি পুরাতন আসবাব। কোন চেয়ারের একটি পা, একটি হাতল ভাঙা, কোনটির চারটি পা’ই ভাঙা, কোনটির দুটি হাতলই উধাও। চিলেকোঠাটি যে সত্যিই পরিত্যক্ত তা জানান দেয় এই ভাঙা আসবাবপত্র। তবুও এই পরিত্যক্ত চিলেকোঠাটিতেই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে একজোড়া কপোত কপোতী – যেন পরিত্যক্ত চিলেকোঠায় বুনবে তাদের সম্ভাবনাময় জীবনের স্বপ্ন। চিলেকোঠার পৌরানিক কাঠের দরজার খুব কাছেই আনমনে হেঁটে বেড়াচ্ছে একাকী দাঁড়কাক। এত কাছাকাছি এই কাক দেখে বিস্মিত নয়, বরং হেসে উঠল দুজনেই – ‘বাজপাখী’ নয় কাক। পরক্ষণেই বোধহয় দুজনেই আবৃতি করল কবিতাটি মনে মনে।
” একদিন একটি বাজপাখীকে খুব কাছাকাছি দেখে
বিস্ময়ে দুজনা দুজনার চোখে চোখ রেখেছিলাম আলগোছে
সেই অবেলায় একলা ঘরের গোপন কপাটটি
খুলে গেল বলে মনেহল বেলাজে
শিহরিত নিকুঞ্জে তোমাকে আবিষ্কার করতে দেরী হয়নি বলে
বড় বেশী ভালবেসেছি তোমায়
তবুও একদিন সব কিছু বলা হবে বলে
অপেক্ষা করছি আমি তুমি অলিখিত সন্ধিতে।”
কতক্ষণ ভাষাহীন ছিল তারা বলতে পারে না কেউই। কখন যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল, তারা টেরই পেলো না। খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে তাদের একটু শীতলতা দিতে চাইল বোধহয়। কিন্তু ভালবাসার উষ্ণতার নেশায় গায়ে মাখল না তারা সে বৃষ্টির শীতল-পেলব। তখনও তারা দুজনে মিলে বুনে চলেছে একটিই স্বপ্ন। বিধাতা মনেহয় মুচকি হাসলেন; এই ভেবে যে, দুজনের দুটি স্বপ্নই আছে। কেবল স্বপ্ন দুটির সঙ্গম এক।
অলিখিত নয়, লিখিত সামাজিক সন্ধি হলো। এরপরে হাটল তারা কতকটা পথ। কখনও সমূদ্র সৈকতে, কখনো নদীর কিনারা ধরে। কখনো আবার ধুধু প্রান্তরে। কখনো নদীর ময়লা আবর্জনা সরিয়ে সরিয়ে নদী পার হয়েছে। কখনো ক্লান্ত হয়েছে ধুধু প্রান্তরে হাঁটতে গিয়ে। পাহাড়ে গিয়েছে আনন্দে আকাশ ছুঁয়েছে। ক্রোধ প্রশমনে গিয়েছে বিশাল সমুদ্রের কাছে। কখনো কেঁদেছে! কত কথা বলা হয়েছে। কত সুখ, কত দুঃখ, কত আনন্দ, কত অভিমান। তবু সব কথা কী বলা হয়েছে? বলা হয় নি! সব কথা শোনা হয় না। অনেক কথাই রয়ে যায়, বলা কথার ফাঁকে ফাঁকে। অনেক কথাই গুমরে মরে, নিভৃতে কাঁদে। ছোট ছোট কথা বলা হয়। বড় কথারা অব্যক্ত থেকে যায়। অলিখিত সন্ধির কথা সবটুকু বলা হয় না লিখিত সন্ধির জীবন যাপনে। সব কথা না বলা জীবন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে দম্পতি। নিজ নিজ স্বপ্নের পাখীরা ডানা ঝাপটায়। হয়ত অনেক কথাই দ্রোহে পরিণত হয়। আর এই দ্রোহই উদ্ভুদ্ধ করেছে আলাদা স্বপ্ন দেখার।
নারী ডেকে নরকে বসালো মুখোমুখি। বলল, তোমাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। আমি নিজেও অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ঘরটা গুমোট হয়ে উঠেছে। চল আমরা আলাদা আলাদা ঘর বাধি। কোন বিরোধ তো নেই আমাদের। নেই কোন বিতৃষ্ণা। নেই কোন বিষদগার। কেবল বড্ড ক্লান্ত । না পাবার ক্লান্তি, দিতে না পারার কষ্ট। সব কথা বলতে না পারার অভিমান। নদীর দুই পাড়ে ছোট্ট দুটি নীড় বেঁধে থাকব আমরা। যখন দেখতে ইচ্ছে করবে নদীর কিনারায় এসে দাঁড়াব। নিমন্ত্রনেও নিষেধ নেই। আর থাকবে চিঠি। চিঠি লিখব আমরা। খেয়া পাড়াপাড়ের মাঝি হবে পত্রবাহক। বৈধ দম্পতির চিঠির বাহক হতে মাঝি নিশ্চয় আপত্তি করবে না। নর জানালার পর্দা সরিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল আকাশের দিকে। প্রতিবেশীর একঝাক পায়রা ঠিক তখনই উড়াল দিল আকাশে। রোদের মধ্যে সাদা উড়ন্ত পায়রাগুলো ঝলমল করে উঠল। নর হয়ত ভাবল ক্যামেরার ক্লিকে এই সুন্দর দৃশ্যটা ধরে রাখতে পারলে মন্দ হতো না। অথবা হয়ত বুনে ফেলেছে কবিতার কয়েক পংতি। কত কঠিন একটি সিদ্ধান্ত তার উত্তরের অপেক্ষায় আছে সেটা যেন তাকে কোনভাবেই বিচলিত করছে না। কিছুক্ষণ পরে জানলা থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল নারীর দিকে। নারীর চিবুক ধরে বলল- ঠিক আছে আমরা একই নদীর দুই পাড়ে বাসা বাধব। তারপর দুজনে দুজনার হাত ধরে বসে থাকল অনেকক্ষন…
দুটি আলাদা গৃহ রচিত হলো। পূর্ন স্বাধীনতায় নিজের নিজের ঘর গুছানো হলো। দুজনেই মেতে থাকল নিজের নিজের ভুবনে। দিন যায়, মাস যায় কিন্তু বছর যায় না। চিঠি আসে, নদীর পারে একটু আসতে পারবে? উত্তর আসে আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় নদীর পাড়ে থাকব আমি। শনিবার পাঁচটা বাজার আধ-ঘন্টা আগেই একজন দাঁড়িয়ে দেখে আরেকজন ইতিমধ্যেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপ্রসস্থ নদীর দুই পাড়ের দুটো মানুষের পরস্পরকে দেখে মন ভরে না। পোশাকটি চেনা যায়, অবয়বটা বোঝা যায়। কিন্তু মুখ দুটি স্পষ্ট নয়। তবুও কেউ ফিরে আসতে পারে না। গোধূলীর রঙে চারিধার সিক্ত। মৃদুমন্দ শীতলতা। নদীর ঢেউ শান্ত। এই শান্ত নদীতেই যেন ভেসে বেড়াচ্ছে দুর্নিবার সাহার কন্ঠ –
“ছুটে চলে কুয়াশাতে
কথা তার যেন টয়-ট্রেন, পাহাড়ে
খুব ভিড়ে একলা রাতে
ছোঁয়া তার কাশ্মীরি শালে, বাহারে
হাত, বরাত, ছলাৎ ছল না
রাত, সোহাগ, পরাগ পেল না, আহারে
চুল, মাশুল সে ভুল ভাঙে নি
তার যাওয়ার বেতার আনেনি, আহারে
মন টা আহারে
মন কেমনের মন্তাজ
মন টা আহারে।”
দিনকয়েক পরে আবার চিঠি আসল। – তোমার হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে করছে। নেমন্তন্ন পেতে পারি? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর
নিয়ে আসল মাঝি দ্বিগুণ বকশি পেয়ে।
– কালকের দিন বাদে পরশুদিন তোমার নেমন্তন্ন। মাঝের একদিন রান্নার প্রস্তুতির জন্য আমার দরকার।
– তুমি পোশাক যাই পর না কেন কপালে টিপ দিও প্লিজ।
নৌনীল শার্টের সাথে জিন্স এবং খয়েরী রঙের টিপ পরে একবাটি পায়েস নিয়ে অতিথী এলো। মেঝেতে মাদুর পেতে খাবার পরিবেশন হলো। ছোট মাছ দিয়ে উচ্ছের পাতলা ঝোল, লাউশাক, টমেটো দিয়ে ষোল মাছ আর ডাল।
বিকেলের চা টা অতিথী নিজেই বানাল । চা খেতে খেতে অতিথী বলল, তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। কেবল রান্নার ক্লান্তি নয় বোধহয়।
– তোমাকেও ক্লান্ত লাগছে। এত সুন্দর করে সেজেছ তারপরেও।
– হ্যাঁ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমরা । মনেহয় আমাদের আবার পথে নামা দরকার চিলেকোঠার সন্ধানে।
– চিলেকোঠাটি কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে?
– সেটি নাহলে অন্যটি পাব। যদি নাই মেলে তবে নিজেদের পুরানো বাসস্থানের কক্ষগুলো থেকেই একটিকে চিলেকোঠা বানিয়ে নেব।
– হ্যাঁ তাই করব। চল বেড়িয়ে পড়ি।
বেড়িয়ে পড়ল দুজনে চেনা পথ ধরেই চিলেকোঠার সন্ধানে।