ডিসেম্বরের এই শীতের দুপুরগুলি খুব মজার। হলুদ হলুদ উষ্ণ রোদগুলি গায়ে মেখে, ভাতঘুম যে শান্তির তৃপ্তি এনে দেয়, তা ক’জনে বোঝে। এই মুহুর্তগুলি বেশ উপভোগ করে নীল। নীল শুয়ে আছে লেপের মধ্যে বাংলা দ-এর মত। চোখ ভর্তি ঘুম ঘুম ভাব, কিন্তু মনে ঘুম নেই। সব কিছু শুনে সে, আবার ঘুমায়ও সে। রান্না ঘরের হাড়ি পাতিল মাজার শব্দ, বাথরুমে পানি পরার টপ টপ, টিভিতে বাংলা সিনেমার গান, ঠাকুমার সরতা দিয়ে সুপারি কাটার শব্দ, কিংবা বাবার পেপার উল্টানোর খস খস শব্দ সবই শুনে সে। আবার ঘুম। মনে হয় কত দিন ঘুমায় না নীল। দিবাস্বপ্ন দেখে। পাহাড়ের চূড়া থেকে পরছে তো পরছে’ই। ধপাস! ধর মর করে ওঠে নীল। মা ডাকছে,
-উঠ, তোর চিঠি।
-আমার চিঠি? নীল অবাক হয়ে ঘুম ঘুম চোখে যে চিঠি দেখে, সেটা একটা বইয়ের প্যাকেট বলে মনে হয়। উপরে নীলের ঠিকানা। প্রেরকের নাম: ভোলানাথ, ঢাকা। এই নামে তো কাউকে চেনে না নীল। খুব তাড়াতাড়ি, বড্ড বেশি আশা-কৌতুহল নিয়ে প্যাকেটটি খোলে নীল। ও মা, ভেতরে তো কোন চিঠি নেই। শুধু একটা স্পাইরাল বাইন্ডিং করা দামি নোট বুক। নোট বুকটি খুব যত্ন করে লাল কালিতে কেউ একজন লিখেছে। কিন্তু কোন নাম নেই, স্বাক্ষর নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, নোট বুকে কোন তারিখও নেই। এরকম অদ্ভুত ব্যাপার দেখে নীল ভয় পেয়ে যায়। কোন রহস্যময় কিছু ঘটতে যাচ্ছে নাকি? লেখাগুলি বাংলায়। আর্ট কলেজের ছাত্রদের মত সুন্দর হাতের লেখা কিন্তু লেখাগুলি পড়া যাচ্ছে না কেন?
-নীল রেডি হয়ে নে, আমি রেডি। মা তাড়া লাগায়।
নীল লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। চুল বাঁধে। ওড়না ঠিক করতে করতে আবারও নোট বুকটি পড়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারছে না। কী মনে করে, খোলা নোটবুকটি টেবিলের উপর রেখে যখন চোখে কাজল টেনে নিচ্ছিল, তখনই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ভেসে উঠে একটি লেখা। “প্রথম দর্শন দিবস”! নীল মুহূর্তের মধ্যে চমকে উঠে এই রহস্যময় লেখার জন্য। পুরো ব্যাপারটি তখনই বোধগম্য হয়, যখন নীল নোট বুকের প্রথম লেখাটি আয়নার সামনে ধরে। তার মানে ভোলানাথ বাবু উল্টো করে তার লেখাগুলি লিখেছে, যা শুধু আয়নার সামনে বসে পড়তে হবে। নীল পড়তে শুরু করে; আজ আমাদের প্রথম দর্শন দিবস।
-চল, আমি একদম রেডি। মা সেজে গুজে চলে এসেছে।
-মা, তুমি যাও। আমি যাব না।
-ও মা, সেকি? ওরা কী ভাববে বলতো?
আজ নীলের কাজিনের গায়ে হলুদ। অথচ নীল যাবে না, তা কীভাবে সম্ভব? মা, বাবা, ও ঠাকুমা রিকোয়েস্ট করে। শুধু পায়ে ধরা বাকি এখন। কিন্তু নীলের এক কথা, সে যাবে না।
-মা, তুমি গিয়ে বলবে বাথরুমে পড়ে গিয়ে আমি কোমরে ব্যথা পেয়েছি। সে জন্য আসতে পারিনি।
-মিথ্যে কথা বলব? তুই দিব্যি সুস্হ্য মানুষ, আমি মা হয়ে এত বড় একটা মিথ্যে বলব?
-তোমার যা ইচ্ছে, তাই বল। কিন্তু আমি যাব না।
নীলের মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে আজ আমাদের প্রথম দর্শন দিবস। কীভাবে দর্শন হল? কার সাথে দেখা হল? না, এখনই পড়তে হবে আমাকে। এই সুযোগ। সবাই গায়ে হলুদে যাবে। বাড়ি ফাঁকা। এই ফাঁকে নোট বুকটি পড়া শেষ করতে হবে। যেহেতু আয়নার সামনে বসে পড়তে হবে, সেহেতু দীর্ঘ সময় লাগবে।
-মা, তোমরা যাও। সব অনুষ্ঠান শেষ করে এসো। আমি এখন ঘুমাবো বলতে বলতে নীল দীর্ঘ হাই তোলে।
-তোর হঠাৎ কী হলোরে মা? সেই কুরিয়ারটা আসার পর থেকে দেখি তু্ই পাল্টে গেছিস।
-কে কুরিয়ার করেছে?
-ভোলানাথ।
-ভোলনাথ কে?
-আমার জামাই!
-নীল, তুই কি পাগল হয়ে গেলি? বির বির করতে করতে মা, বাবা, ঠাকুমা চলে যায়। বাড়িতে শুধু আমি আর বইন্যার মা। এই সুযোগ।
-বইন্যার মা, এক ফ্লাক্স স্পেশাল চা বানিয়ে আমার রুমে নিয়ে আসতো।
পর্ব – ২
খেতে খেতে আমি আবার নোট বুকটি আয়নার সামনে ধরি। কেমন ঝাপসা লাগছে। আয়নাটা টিসু দিয়ে মুছে দেই। হা ঠিক আছে। এখন লেখাগুলি আরও স্পষ্ট, ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে। লেখাগুলি ডায়রির মত করে লেখা। প্রতিটা লেখার এক একটা হেডলাইন আছে। আমি প্রথম হেডলাইনটি পড়ি।
আজ আমাদের প্রথম দর্শন দিবস-
সোনাই’র সাথে আমার পরিচয় সেই পূর্বজন্ম থেকে। তাই ওকে চিনতে মোটেই অসুবিধা হয়নি আমার। কলেজে যখন ও পরীক্ষা দিতে আসে, তখন ওকে দেখেই বোঝা গেল ও ভাল নেই। ওর গায়ে জ্বর। ওকে এখন যেকোন মুল্যে সুস্হ্য থাকতে হবে। ফাইনালে তো ফেল করলে চলবে না। পরীক্ষা শেষে আমি এক পাতা নাপা ও হিস্টাসিন প্যাক করে ওকে দিয়ে বলি,
তোমাকে যে কোন মুল্যে সুস্হ্য থাকতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে। তুমি কী সেটা বোঝ? সোনাই অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে। আমার পড়নে নীল জিন্স ও সাদা রংয়ের ফুতুয়া। ও চেয়ে দেখে আমার প্যান্ট, আমার ফুতুয়া সর্বোপরি আমার চোখের দিকে। চোখের মধ্যে চোখ ভর্তি যে কী, তা শুধু আমি বুঝি। মনে মনে বলি,
-ও সোনাই, সোনারে চিনতে পেরেছিস? তোর সাথে আমার পূর্বজনমে দেখা হয়েছিল যে!
প্রথম কদম ফুল দিবস-
এভাবেই আপনি, তুমি, তুই কিংবা তুই, তুমি করতে করতেই চলছে তো চলছেই। আজ এক আষাঢ়। হঠাৎ দেখি সোনাই’র হাতে একগুচ্ছ কদম ফুল। ভাবছি আমাকে দেবে কিন্তু দেয় না। হাতে নিয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে গন্ধ শুঁকে। ভোরের কুয়াশার মত ফর্সা গালে কদমের পরাগ মাখে। মিট মিট করে হাসে। চা সিংগারা, তর্ক বিতর্ক, কবিতা, নাটক ইত্যাদি এবং সর্বশেষে হাসিনা খালেদার মুণ্ডুপাত করে যখন আমরা রিক্সায় উঠি, তখন ভরা সন্ধ্যা লেগে গেছে। বৃষ্টি আর বৃষ্টি। রাস্তায় হাঁটু-জল জমে গেছে। রাস্তায় জল ও ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ঠেলে যখন সোনাইদের বাসার সামনে পৌঁছি, তখনও বৃষ্টি। বৃষ্টিতে কাক ভেঁজা হয়ে নামতে নামতে সোনাই ফুলগুলি আমাকে দিয়ে বলে,
-বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, শুধু ভোলানাথের জন্য। চিরদিনের জন্য, পরজনম পর্যন্ত। তুমি কি নেবে?
-হা, দাও। এই নেয়ার জন্যইতো সেই পুর্বজন্ম থেকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমি এমনভাবে ফুলগুলি গ্রহণ করি; যেন, একটা নবজাতককে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি। সোনাই বাসায় ঢুকে যায়। আমি ফুলগুলি জড়িয়ে ধরে ফুটপাতে বসে বৃষ্টিতে ভিঁজে ভিঁজে পরিশুদ্ধ হই, অবগাহিত হই নবধারা জলে।
প্রথম পত্র প্রেরণ দিবস-
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী ওকে দেখি না। সোনাই’র জ্বর। প্রায়শই ওর জ্বর হয়। জ্বর হলেই ও আগের চেয়ে আরও বেশি সুন্দরী হয়ে উঠে। আজ আমি ওকে দেখতে গেলাম। দেখি বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি ওর কপালে হাত রাখি। জ্বরে ওর কপাল পুড়ে যাচ্ছে। জলপট্টি দিতে দিতে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। মুখ ভর্তি এক অদ্ভুত পবিত্র সৌন্দর্য! জ্বর হলে ও কেন এবং কীভাবে যে এত রূপবতী হয়ে ওঠে? কে জানে? কখনো সখনো কোন কোন অসুখও নিজেই এক সৌন্দর্যের কারণ হয়ে ওঠে! জলপট্টিতে ও খুব সম্ভব অথবা অবশ্যই আমার স্পর্শে ওর জ্বর কমে আসে।
-ও ভোলা, জ্বরতো মনে হয় ছেড়ে গেল!
-হা, আমি যে তোমার ব্লটিং পেপার। সব জ্বর শুষে নিয়েছি আমি। এখন তুমি দয়া করে ভাল হয়ে ওঠ, প্লিজ।
সোনাই দুর্বল শরীর নিয়ে বালিশে ঠেস দিয়ে বিছানায় বসে। আমি হরলিক্স চামচে করে একটু একটু করে ওর মুখে তুলে দেই।
-মৃত্যুর রং কী জান, ভোলা?
-না
-ধুসর। আমার মৃত্যু হবে ধুসর রংয়ের … কথা শেষ করার আগেই আমি ওর মুখে পানির গ্লাস জোর করে ঠেসে ধরি।
-পানি খাও। মরার আগে পানি খাও। আমার হাতের শেষ পানি। সোনাই খিল খিল করে হেসে ওঠে। এই হাসিটির দাম কত কোটি টাকা, তা বুঝতে বুঝতে ওর হাতে সমর্পণ করি আমার প্রথম পত্রটি।
“ও সোনা, তোকে এক দিন না দেখলে আমার কী হয়? সেদিন বুঝবি, যেদিন তুই আমাকে কোন দিন দেখতে চাইলেও আর দেখতে পাবি না। তোর এবং শুধু তোরই ভোলানাথ”।
প্রথম খুনসুটি দিবস-
ঘটনা সামান্যই। ফোন করতে দেরি করলাম কেন? এই নিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা অভিমান, রাগ, ঝগড়া এবং অবধারিত কান্নাকাটি। সোনাইর অভিযোগ, আমি তাকে ইদানিং অবহেলা করছি। গুরুত্ব দিচ্ছি না। তাকে নিয়ে ভবিষৎতে কী করব, কী করা উচিৎ এসব আলোচনায় আমার মন নেই। আমি যতই বোঝাই, আমি ঠিক আছি, আমি সিরিয়াস; ততই সে অবুঝের মত মুখে যা আসে, তাই বলে।
-সত্যি করে বলতো, তুমি আমাকে বোঝ? বোঝ তুমি?
-তোমার চেয়ে বেশি বুঝি, তোমাকে সোনা।
-মিথ্যে।
-সত্য কী ?
-সত্য তুমি, তোমরা। সব নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তোমাদের সুখ শান্তি, আনন্দ স্ফুর্তি সব কিছুই দিব্যি চলছে। আর আমি? তোমাদের সকলের ইচ্ছে অনিচ্ছের পুতুল। তোমরা যেমন নাচাও আমি তেমনি নাচি। আমি কি নিরেট একটা বারবি ডল? নাকি রক্ত মাংসের গড়া একটা মানুষ?
-তোমার আজ কী হয়েছে, সোনা?
-আমার কিচ্ছু ভালোলাগে নারে ভোলা। সব সময় তোকে হারানোর ভয় কাজ করে। এই বুঝি তুই চলে গেলি। এই বুঝি তোকে হারিয়ে ফেলি। এই ভয়তে ভয়তে মরে যাব আমি!
-তোকে আমি মরতে দিলেতো।
-তোর আগে আমি মরবো, দেখে নিস।
-না, আমি।
-না, আমি।
-আমি, আমি, আমি।
-আমি, আমি, আমি।
এরপর যা হয়, যা হওয়া উচিৎ, যা হতে পারতো কিংবা যতটুকু হওয়া উচিৎ, ঠিক তার চেয়ে কম করে যা হয়, তা আমাদের দুজনের সমস্ত üদয়কে বেেঁধ রাখে একটি শব্দে- যার নাম মায়া!
প্রথম ও শেষ বিচ্ছেদ দিবস-
আজ আমাদের চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে গেল। কেন? আমি নিজেও জানি না। শুধু সোনাই’র একটা কথাই আমাদের মধ্যে সব সম্পর্কটুকু কাঁচের মত ভেংগে গেল। সম্পর্ক কী এতই ভংগুর? সোনাই আমাকে ডেকে নিয়ে আজ যে কথাটা বলল,
-আজ থেকে তোমার সাথে আর কোন দিন দেখা হবে না। সব কিছু শেষ and please don’t distrube me any more and ever!
প্রথম ডিজিটাল দেবদাস দিবস-
এরপর থেকে আমি সম্পূর্ণ অন্য রকম হয়ে যাই। কিন্তু কেউ কিছু বোঝে না। ভিতরে ভিতরে বদলে যাই। সারাদিন বসে থাকি সাইবার ক্যাফেতে। এই ওয়েব থেকে সেই ওয়েবে ঘুরতে ঘুরতে যখন ক্লান্ত হয়ে বেরই, তখন রাত। এখানে ওখানে অর্থহীন যাতায়াত। ঘুরে বেড়াই মেঘের কোলে, ভেসে থাকা এক বালকের সুতা-ছেঁড়া মলিন ঘুড্ডির মত। রাত ভর চা খাই, ঘুম তাড়ানোর জন্য। যদি ঘুম আসে বা ঘুমিয়ে পড়ি তবে সে সমটুকুতো আমি কল্পনায় সোনাইকে দেখতে পাব না। কল্পনায় সোনাই’র সাথে কত কথা বলি। কত নালিশ, কত অভিযোগ, কত দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ-বেদনা, কত হাহাকার, কত ফাটাফাটি গল্প, কত হা-হা-হি-হি। সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছে ঘড়ির কাটার মত কিন্তু ভিতরে ভিতরে মায়া নামক একটি ঘুন পোঁকা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমার প্রতিটা মুহুর্ত; তা শুধু আমি জানি। তুমি কি জানো সোনা?
প্রথম স্বদেশ বিদায় দিবস-
আগামিকাল আমি চিরদিনের জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে চলি যাচ্ছি। রাত দশটার ফ্লাইট- SQ435। প্রথমেই সিংগাপুর। তারপর নিয়তি আমায় কোথায় নিয়ে যায়, কে জানে? তুমি ভালো আছ তো সোনা? যদি না থাক, তবে আমার মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও ভালো থেকো। পরজনমে অবশ্যই তোর সাথে দেখা হবে, জানিস তো? কারণ;- “যত দূরে যাও, ফের দেখা হবে। মানুষ মূলতঃ একা এবং বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক”। সোনা, তুই কি মৃত্যুর মত খুব একা?
পুনশ্চঃ
আমি যদি বিদেশে বসে মারা যাই, তবে আমার লাশটি নয়, আমার হাত দুটি তুই পারলে সংগ্রহ করিস। তুই তো জানিস, আমার ডান হাতের কব্জিতে একটা কাটা দাগ আছে। তুই কেটে দিয়েছিলি। রাগের মাথায় তুই ব্লেড দিয়ে আমাকে একদিন খুন করতে এসেছিলি। মনে আছে তোর? আমি খুন হলে অবশ্য ভালো হত। আর বাম হাতের তালুর উল্টো পিঠে একটি জন্ম দাগ আছে। আমার মৃত মায়ের গর্ভের দাগ। মনে পরে কি তোর? যেখানে তুই তোর প্রথম পবিত্র চুম্বন দিয়েছিলি! সব কী ভুলে বসে আছিস রে, বোকা মেয়ে?
পর্ব – ৩
নোট-বুকটি পড়া যখন নীল শেষ করলো, তখন তার দু চোখ ভরা জল। এই জীবনে এত সে কাঁদেনি। কার জন্য সে কাঁদছে? অজানা অচেনা এক ভোলানাথের নোটবুকটা ওর হৃদয়কে ভেংগেচুরে চুরমার করে দিচ্ছে। এত কষ্ট কখনো পায়নি নীল। আচ্ছা, সোনাই এমন করল কেন? নিজের কাছে নিজেই এই প্রশ্ন করে নীল। কী এমন ঘটনা ঘটেছিল, যার জন্য ভোলানাথ দেশ ছেড়ে সিংগাপুর চলে যাচ্ছে? না এর কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। নীল আবারও এক নিঃশ্বাসে আয়নার সামনে বসে নোটবুকটি পড়ে। তার মানে আজ রাতেই ভোলানাথের ফ্লাইট। এখন রাত একটা বেজে পাঁচ। ফ্লাইট চলে গেছে। কিন্তু এই নোটবুকটি আমাকে কেন পাঠানো হলো? নাকি সোনাইকে পাঠানোর জন্য ভুল করে আমার ঠিকানায় পাঠালো? ভোলানাথ কি তবে সোনাই’র ঠিকানা জানে না? ভোলানাথ কি আমায় চেনে? কিন্তু আমিতো কোন সোনাই, ভোলানাথকে চিনি না। আচ্ছা এমন তো হতে পারে, সোনাই আমার আসে পাশের কোন ফ্লাটে থাকে। কিন্তু এই ফ্লাটের আসে পাশের ফ্লাটে সোনাই নামের কোন মেয়েকে বা কোন বৌদিকে দেখিনি বা চিনিনি। তাহলে ব্যাপারটি কী দাড়ালো? নাকি আমি নিজেই একজন অন্যরকম, অচিহ্নিত, অশরীরি সোনাই!
এই সব অজস্র কেন ভাবতে ভাবতে এবং ভোলানাথের নোটবুকের লেখার অর্থ বুঝতে বুঝতে রাত কখন যে শেষ হয়, কেউ জানে না। ভোর রাতে নীল ভোলার সাথে মনে মনে অথবা স্বপ্নে কথা বলে।
-দেখে নিস ভোলা, একদিন আমি ঠিকই তোমাকে খুঁজে বের করবো।
-কেন?
-তুমি আমার ভেতরটাকে পাল্টে দিয়েছ। বুঝিয়ে দিয়েছ কীভাবে একজন সোনাইকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসতে হয়।
-কিন্তু মেয়ে, তুমি আমাকে কোন দিনও খুঁজে পাবে না।
-কেন?
-কারণ আমি যে মৃত, মরে ভুত হয়ে গেছি যে!
ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে নীল। ভোলার জন্য পরম মমতায় üদয় ভেংগে জেগে ওঠে অন্য এক প্রতিদ্বন্ধি নারীর। সোনাই’র এক অপ্রতিতরোদ্ধ প্রতিদ্বন্ধি, নীল।
নীলের যখন ঘুম ভাংগলো তখন সকাল ন’টা। ঘুম থেকে ওঠে গরম এক কাপ কফি নিয়ে বসে টিভির সামনে। সারারাত ভালো করে ঘুম না হওয়া ও মোচড়ভাংগা কান্নার কারণে চোখে মুখে অন্যরকম এক মায়াময় অস্হিরতা। এই চ্যানেল, সেই চ্যানেল ঘুরতে ঘুরতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজে এসে স্হির হয় চোখ। বিবিসি দেখাচ্ছে, গত রাতে বাংলাদেশ থেকে ছেড়ে আসা সিংগাপুর এয়ারলাইন্স এর একটি বোয়িং ঝছ৪৩৫ ভারত মহাসাগরে ক্রাশ করেছে। সব যাত্রী ও ক্রু মারা গেছে। তবে অলৌকিকভাবে একজন বাংলাদেশী মুমূর্ষ অবস্হায় বেঁচে আছে। তার নাম জানা যায়নি। তবে তার ডান হাতের কব্জিতে কাটা দাগ ও বাম হাতের তালুর উল্টো পাশে একটি জন্ম জড়ুল রয়েছে …
মুহুর্তের মধ্যে নীলের রক্তের মধ্যে এক আতঙ্ক কাজ করে। তাই তো, গতকাল রাতেই তো ভোলানাথের সিংগাপুর যাওয়ার কথা। ওর বর্ণনা অনুযায়ী ওরতো ডানহাতে কাটা দাগ আছে, বাম হাতে আছে জন্ম দাগ! তবে কী ভোলানাথ বেঁচে আছে? এরপর ও মা, মাগো বলে যে চিৎকার করে নীল এবং জ্ঞান হারায় কখন, তা আর মনে করতে পারে না।
পর্ব – ৪
নীল সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের সাথে যোগাযোগ করে। জানতে পারে, একমাত্র যে যাত্রি বেঁচেছিল এবং যার হাতে কাটা দাগ আছে সে মারা গেছে। তবে তার নাম ভোলানাথ নয়। টিকিটে তার নাম … …। তবে নীল বিশ্বাস করে, ছদ্দবেশি ভোলানাথই মারা গেছে!
এরপর দু’বছর নীল এমন কোন জায়গা নেই যেখানে সোনাইকে খোঁজে নি। এমন কি দেশের সব সংবাদ পত্র, ইয়াহু, গুগোল, ব্লগে এবং প্রথম আলোর বন্ধু সভা – যেখানে যেমন প্রয়োজন সোনাইকে খোঁজা যায়, খুঁজেছে। খুঁজেছে শুধু ভোলানাথের মৃত্যুর সংবাদ দেওয়ার জন্য, কিন্তু পায়নি। তবে কি সোনাই নামে কেউ কি নেই?
এরপরের দুই বছরে নীলের ঠাকুমা, বাবা, মারা যাওয়ার পর একান্ত বাধ্য হয়েই এবং বৃদ্ধ মায়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত নীল যাকে বিয়ে করল, সে স্মার্ট-সুন্দর। তবে একটু বয়েসি! একেবারেই সাদামাটা। বলা যায় আটপৌরে বিয়ে। বাসর ঘরে জামাই বাবুটি যখন নীলের আলতা, মেহেদি রাংগানো নরম কোমল হাতটি নিয়ে খেলছিল, ঠিক তখনি নীলের চোখ যায় তার বরের ডান হাতের দিকে।
-দেখি, দেখি, তোমার ডান হাত?
-কেন?
-আহা, দেখি না।
নীল ভালোভাবে ডান হাত, বাম হাত দুটি শক্ত করে ধরে দেখে। ওল্টে পাল্টে দেখে। দেখে সেই ডান হাতের কাটা দাগ, বাম হাতের সেই জন্ম দাগ যেখানে সোনাই চুমু খেয়েছিল! নীল চমকে ওঠে!
-তোমার নাম কি ভোলানাথ?
-না, নাতো।
নীল তার ডান হাত, বাম হাত বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। অঝোর ধারায় কাঁদে আর বলে, -আমার নাম নীল না, সোনাই। আজ থেকে তুমি আমাকে সোনা বলে ডাকবে!
এরপর নীল কখন যে জ্ঞান হারিয়েছে,তা শুধু নতুন জামাই বাবুটিই জানে!