১.
বুড়িগঙ্গার ওপারে নওয়াবগঞ্জ। সেখানের একটি গ্রাম হাসনাবাদ। নয় বছর হলো এ গ্রামের বউ হয়েছে রুম্পা। এখন ছয় বছরের একটি মেয়ে আছে তার। স্বামী বেলাল বিদেশ যাওয়ার দু’বছর পরে প্রথমবার দেশে এসেছিল। প্রথমবার দেশে এসে বিয়ের কাজটা সেরে-ফেলা এ অঞ্চলের রেওয়াজ। বেলালও সে-কাজটিই করেছিল। বিদেশে চাকরি-করা মেট্রিক পাশ বেলালের জামাই হিসেবে কদর ছিল এমএ পাশ ছেলের চেয়েও বেশি। রুম্পার অসুস্থ বাবা কন্যা-দায়ভার মুক্ত হয়ে মরবেন বলে ঠিক করলে আইএ পাশ রুম্পার ঘটকের কেরামতিতে বেলালের সাথে বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ের পর রুম্পা শ্বশুরবাড়িতে পেয়েছিল শ্বশুর, শাশুড়ি, জা এবং দুই ননদকে। দুই ভাই মিলে বোনদের বিয়ে দিয়েছে। বোনদের বিয়ের টাকা যোগাড় করতে বেলাল এক ছুটিতে দেশে আসে নি। বিয়ের নয় বছরে দেশে এসেছে মোটে চারবার। রুম্পার ভাসুর দুবাইতে নিজের কাছে পরিবার নিয়ে গেছেন। তার সেই কপাল নেই। মেয়ে হওয়ার পর বেলাল প্রথম দেশে আসে, যখন মেয়ের বয়স প্রায় তিন। মেয়ে তখন বাবা বলতে বুঝতো ফ্রেমে বাঁধানো বেলালের ছবিকে। প্রথম-প্রথম বাবার কাছে যেতেই চাইতো না সে। পরে অবশ্য সারাটা ক্ষণ বাবার কোলে লেপটে ছিল। শেষবার বেলাল দেশে এসেছে, তা-ও প্রায় দুই বছর হয়ে গেল।
শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যু আর ননদদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় রুম্পা এখন ঝুট-ঝামেলাবিহীন। মা-মেয়ের সংসার তার।
২.
নদীগুলির উপর ব্রিজ হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর। হাসনাবাদ এখন আর গ্রাম নেই, অনেকটাই শহর। দু’ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার সদরঘাট পৌঁছনো যায়। ডিশের লাইন, ইন্টারনেট – সব আছে এখানে। বাজারের কাছেই বেলালদের বাড়ি। সারাটা ক্ষণ বাস, টেম্পু, সিএনজি, ইজি বাইকের হর্ন আর রিকশার টুংটাং শব্দ। পাশের বাড়িটি বেলালের একমাত্র ফুপুর।
ফুপুর বাড়িতে আজ ফুপা ছাড়া থাকার কেউ নেই। তিনি মারা গেছেন রুম্পার বিয়ের আগেই। ফুপুর দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলে সাগর ভাই সপরিবারে ঢাকায় আছেন। বড় মেয়ে আমেরিকা আর ছোট মেয়ে থাকেন ইটালি। গত বছর ছেলে পরিবার নিয়ে ঢাকা যাওয়ার সময় বাড়িতে একজন লোক রেখে ফুপাকেও সাথে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হন নি। সানন্দে ছেলেকে পরিবার নিয়ে শহরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আসলে নাতি-নাতনিকে ঢাকার ভালো স্কুলে পড়ানোর বিষয়ে ফুপারও তাগিদ ছিল। তাছাড়া ফুপা তখনও স্থানীয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন। বাবাকে রেখে ভাই পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে গেল দেখে ঝিনুক আপা, মুক্তা আপার অসন্তোষও কম ছিল না। ফুপাই মেয়েদের সামলেছেন।
এখন ঝিনুক আপা, মুক্তা আপা প্রতি সপ্তায় রুম্পাকে ফোন ক’রে বাবার খবর নেন, তাকে দেখে রাখতে অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধে রুম্পাই পাশের গ্রামের ময়নার দাদিকে ফুপার কাজ ক’রে-দেয়ার জন্যে ঠিক ক’রে দিয়েছে। ময়নার দাদি সকালে এসে রান্নাবান্না, ঘরের কাজ ক’রে দিয়ে যায়। এমনিতে ফুফার শরীর যথেষ্ট ভালো। অবসরে যাওয়ার পর বইপত্র, পেপার-পত্রিকা পড়ে, আশে-পাশে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটান তিনি। এই একটি লোককে রুম্পার আশেপাশের মানুষের থেকে অন্যরকম লাগে। বয়স হয়েছে, কিন্তু তিনি এখনো কী পরিপাটি! কথা বলেন কম, কিন্তু সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন, পরামর্শ দেন। তার কথা বলার ধরনটিও সুন্দর। অন্যদের মতো কথায় কোনো আঞ্চলিকতা নেই। সব কিছুতেই রুচির ছাপ স্পষ্ট।
উচ্চশিক্ষা নেয়ার আগ্রহ ছিল রুম্পার। স্বপ্ন দেখতো এমএ পাশ হবে তার স্বামী। অথচ বাবা-ভাই পছন্দ করলো বেলালকে! বেলালের পরিবার তাকে পছন্দ করলো তার গায়ের রঙ ও শান্ত স্বভাবের জন্যে। স্বামীর পরিবারের মানুষগুলো খারাপ ছিল না, যদিও তার ভালো লাগার সাথে তাদের ভালো লাগার ছিল বিস্তর ফারাক। বুদ্ধি আর খাপ খাওয়ানোর গুন দিয়ে সে নিজেকে এ পরিবারের সাথে মানিয়ে নিলেও বেলালের নয়, বেলালের ফুফুর বাড়ির পরিবেশটাই তাকে বেশি টানতো। ফুফুর পরিবারটি আশেপাশের সব পরিবার থেকে অন্য রকম। তার দুই মেয়েরই বিয়ে হয়েছে বিএ পাসের পর। বেলাল বিদেশে চলে গেলে রুম্পা যখন মাঝে-মধ্যে দৈনিক পত্রিকা পড়তে ফুফুদের বাড়ি যেত, তখন প্রায়ই তাদের বইয়ের আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতো। বই দেখতো, লেখকের নাম পড়তো। ফুপা তা লক্ষ ক’রে একদিন বললেন, ‘এখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারো, তবে পড়ার পর জায়গামতো গুছিয়ে রাখবে।’তারপর তার লাইব্রেরির সব ক’টি বাংলা গল্প বই রুম্পা পড়ে ফেলেছে। স্বল্পভাষী ফুপা নতুন বই আনলে শুধু বলতেন, ‘একটা নতুন বই এনেছি। উপরের সেল্ফে রাখা আছে।’
রুম্পা মাঝে-মাঝে আলমারির সব বই ঝেড়ে-মুছে গুছিয়ে রাখতো। ফুপা তাকে এ ব্যাপারে ভালো-মন্দ কোনো দিন কিছু বলেন নি। গত বছর ছেলের পরিবার ঢাকা চলে যাওয়ার পর থেকে রুম্পাকে তার খোঁজখবর নিতে হচ্ছিল। টুকটাক কথাবার্তা তখন থেকেই শুরু। তিনি সব কিছুতেই বড় বেশি সংযত। কথা বললেও যেন দূরেই থেকে যান সব সময়। তার বিষয়ে রুম্পার মনে অনেক কৌতূহল।
– ‘ফুপা, ঝিনুক আপা কাল ফোন করেছিল। আপনার কিছু লাগবে কি-না জিজ্ঞেস করলে আপনি না-কি কিছু বলেন না। তাই আমার কাছে জানতে চাইছিল। কে যেন আসবে আমেরিকা থেকে। আপনার জন্যে কিছু পাঠাবে সেই লোকের হাতে। আমি বলেছি, একটা ভালো টর্চ, শেভিং ফোম, রেজর, মোটা মোজা আর ওনাদের কিছু ছবি। আপনার টর্চটা বেশি ভালো না। রাতবিরাতে কাজে লাগে, আপনি একা থাকেন। শেভিং ক্রিম দেখেছি শেষ হয়ে গেছে, সাবান দিয়ে শেভ করেন, ঠিক আছে না? অন্য কিছু লাগতো?’
– ‘না আর কী লাগবে? যেগুলো বললে ওগুলোও না হলে চলতো। শুধু-শুধু লোকটার বোঝা বাড়ানো।’
– ‘কিছু না হলে চলে ঠিকই, কিন্তু হলে আরো একটু ভালো চলে। তাছাড়া মেয়েরা বাবার জন্যে কিছু পাঠাতে পারলে মনে শান্তি পায়। যাক, আপনি না-কি রাতে রুটি খেতে চেয়েছেন, ময়নার দাদি বলছিল। কেন? শরীর খারাপ?’
– ‘না। শরীর ভালো আছে।’
পরদিন থেকে রুম্পা প্রায়ই রাতে নিজে রুটি বানিয়ে মেয়েকে দিয়ে পাঠিয়ে দিত কিম্বা নিজে গিয়ে দিয়ে আসতো।
এমন কয়েকদিন চলার পর ফুপা বললেন, ‘ময়নার মা-ই তো রুটি বানাতে পারে।’
– ‘কেন আমার রুটি ভালো হয় না?’
– ‘সেটা কথা নয়।’ফুপা আর এ সম্পর্কে কিছু বলেন নি।
সেরাতে ফুপা সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন। খাবার সাজিয়ে তাকে টেবিলে ডাকার জন্যে মুখ তুলতে রুম্পা অবাক হয়ে দেখলো, টিভিতে নয় তিনি তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। চোখে চোখ পড়তে তিনি দৃষ্টি সরালেন না। গভীর কণ্ঠে বললেন, ‘রুম্পা, তুমি দেখতে সবিতার মতো।’রুম্পার মুখে কথা সরলো না। কী বলবে সে, ফুপার আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে কতটুকুই বা তার জানা! ‘সবিতা তোমার মতো ছিল। এমন ছোটখাট গড়ন। এমন মায়াবতী। তবে তার গায়ের রঙটা তোমার চেয়ে একটু বেশি চাপা ছিল। তোমার মতো ক’রে ভালোবাসতো সে আমায়।’এসব কথার উত্তর হয় না। রুম্পা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আপনি খেতে আসেন। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
ফুপা টেবিলে এলে আজ আর রুম্পা ঘরে ফিরে গেল না। তার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো। পরে সব গুছিয়ে রেখে অন্য দিনের মতো বললো, ‘আমি যাই। দরজাটা দিয়ে দিন।’ প্রথমবারের মতো বাড়তি একটি লাইন যোগ করলো, ‘তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বেন, বেশি রাত জাগবেন না।’ফুপা মৃদু হাসলেন।
পরের দিন রুম্পা প্রথমবারের মতো আরেকটি কাজ করলো। সে ফুপাকে ফোন করলো। তিনি বোধ করি একটু অস্বস্তির সাথে বললেন, ‘হ্যালো, কে?’
রুম্পা তার উত্তর না দিয়ে জানতে চাইলো, ‘কোথায় আপনি?’
ফুপা চিনতে পারলেন তাকে।
– ‘নদীর পারে।’
– ‘নদীর পারে একা-একা কী করেন?’
– ‘কিছু না। এমনিই বসে আছি। আমি তো একাই চিরকাল।’
– ‘থাক, আর একা বসে থেকে কাজ নেই। সন্ধ্যা হয়ে এলো। রাতে কী খাবেন?’
– ‘একটা কিছু হলেই হয়।’
– ‘ঠিক আছে। ও আমি বুঝবো।’
ময়নার মাকে আগেই রুটি করতে মানা ক’রে দিয়েছে রুম্পা। এত আগে বানানো রুটি ঠান্ডা হয়ে চামড়ার মতো হয়ে যায়। সেগুলো বুড়ো মানুষটা খায় কী ক’রে?’
রাতে নিজেই রুটি-তরকারি নিয়ে সে ওবাড়ি গেছে। ফুপাকে ডেকে টেবিলে এনেছে।
– ‘আমি একটু আপনার পাশে বসি?’
– ‘বসো। ’মাথা নিচু ক’রে খেতে-খেতে উত্তর দিলেন ফুপা। ‘তুমি আমাকে যত্ন ক’রে খাইয়ে, পাশে বসে সুখ পাও, আমি তোমার যত্ন নিয়ে। দুজনেই সুখের অনুসন্ধান করছি – গন্তব্য এক।’
বড় অদ্ভুত লাগে রুম্পার। এমন কথা জীবনে তার কারো সঙ্গে হয় নি।
– ‘শোনো, আমি তেমন একটা সামাজিক মানুষ নই। মানুষের সান্নিধ্য আমাকে অস্থির করে। আমি আমার একান্ত জগতে অন্য মানুষকে ঠিক নিতে পারি না, তবে তোমার কথা ভিন্ন। তোমার সাথে আমি ভালো অনুভব করি।’
রুম্পার দিনগুলো ঘোরের মধ্যে কেটে যায়, রাতগুলো অস্থিরতায়। মেয়ের কথায় সেদিন তার ভেতরটা নড়ে ওঠে যেন।
– ‘মা, তুমি রোজ সন্ধ্যায় তমিজ দাদারে খাবার দিতে যাও ক্যান?’
– ‘ক্যান? কী হয়েছে?’
– ‘না, আমারে হোম ওয়ার্ক
রাবা না? জলিল স্যার আজকে বকা দিছে। ও হো, আব্বু ফোন করছিল। তুমি মোবাইল নিয়া যাও নাই। আমি ধরছি। কইছি যে, তুমি তমিজ দাদার খাবার দিতে গ্যাছ।’
তবুও রুম্পার ফুপার কাছে যাওয়া কমে না। মেয়েকে সে বিকেলেই পড়তে বসায়। মুখে কিছু না বললেও ফুপা যে তার অপেক্ষায় বসে থাকেন, তা সে বেশ বুঝতে পারে। সেদিন সারা দিন বৃষ্টি পড়েছে। সন্ধ্যায় ফুপার বাড়িতে গিয়ে মনে হলো, আহা, লোকটা হয়ত একটু চা পেলে খুশি হবে। কাঠের চুলায় সে তাড়াতাড়ি দু’কাপ চা বানিয়ে নিয়ে ফুপাকে একটি কাপ ধরিয়ে দিয়ে, তার পাশের সোফায় বসলো আরেকটি কাপ হাতে।
– ‘চুলার পাশে যখন বসে ছিলে, তখন তোমার মুখটা দেখে আমার শিমুল ফুলের কথা মনে পড়ছিল। রঙিন আর পেলব। তবে ও গাছে অনেক কাঁটা। জানো, আমি শিমুল নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম শৈশবে। স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই কবিতা, সেই দিন!’
এসব কথার উত্তর রুম্পার অজানা। তাই কথা খুঁজে না পেয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে ওঠে সে, ‘আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় মরে গেলেই শান্তি পেতাম।’
ফুপা কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন।
– ‘কর্মবিমুখ মানুষই মরে যেতে চায়। মরার কষ্ট অনেক বেশি। বেঁচে যখন থাকতে হবে, তখন একটা লাভলি লাইফ লিড করাই তো ভালো।’
– ‘লাভলি লাইফ কী, সেটাই তো আমি জানি না। কেউ তা আমাকে শেখায় নি।’
– ‘তুমি চাইলে নিজে-নিজে সেটা গড়ে নিতে পারবে। তোমাকে তো বলেছি, পড়াশোনাটা ছেড়ো না। আবার শুরু করো।’
– ‘বেলালকে বলেছিলাম। ও আর পড়াশোনা করতে দেবে না।’
– ‘ঠিক আছে তা না হলে প্রতিদিন বই পড়বে। বই যোগাড় ক’রে পড়া তো কঠিন কিছু না। তখন দেখবে, তোমার নিজের মধ্যে এক আনন্দের জগৎ সৃষ্টি হয়ে গেছে। বাইরের দুঃখ-কষ্ট তোমাকে খুব একটা স্পর্শ করতে পারবে না।’
আহা, শিক্ষিত মানুষের কথা, ভাব কত আলাদা! রুম্পার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
৩.
সেদিন রুম্পা ফুপার পাশে দাঁড়িয়ে তার প্লেটে রুটি-তরকারি তুলে দিচ্ছিল। ফুপা হঠাৎ ক’রে আবার সবিতার কথা তুললেন। মাথা নিচু ক’রে প্রতিদিনকার মতো আপন মনে বলে চললেন, ‘সবিতার বুক ছিল তোমার মতো ফোলা-ফোলা। তার গায়ে সুন্দর একটা গন্ধ থাকতো। আমি যখন তার পাশে বসে থাকতাম, কিম্বা বুকে মাথা রাখতাম, তখন টের পেতাম। তার চুলেও ছিল একটা সুগন্ধ। তোমার গায়েরও একটা গন্ধ আছে। আমার সবিতার কথা মনে পড়ে যায় শুধু।’
ফুপা বিড়বিড় ক’রে কী সব বলতে থাকেন। অস্পষ্ট কথাগুলোর মধ্য থেকে দু’একটা কথা রুম্পা বুঝতে পারে:
– ‘আমাদের পাশের বাড়ির মেয়ে সবিতা। বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছিল। …ইশ, তুমি যদি একটু কম ফর্সা হতে! …আহা, আরো কিছুটা পরে জন্ম নিলে মন্দ হতো না।’
রুম্পা হিম হয়ে বসে থাকে। মনে-মনে লোকটির অন্তর-সাগরের ঠাঁই খোঁজে। কে বিশ্বাস করবে যে, এমন গুরুগম্ভীর লোকটির মনে এত্ত কথা জমা আছে! এত্ত কথা বলতে পারে সে! হঠাৎ চোখ যায়, দেখে, ফুপা মাথা তুলে এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কেমন যেন লাগে তার।
– ‘আপনার শরীর ভালো আছে? চোখ তো দেখি লাল। সন্ধ্যায় হাঁচিও দিলেন কয়েক বার।’
– ‘হ্যাঁ, শরীরটা কেমন যেন লাগছে। কপালে হাত দিয়ে দেখবে জ্বর এলো কি-না? একটু চা খেতে ইচ্ছা করছে। তোমার কি খুব কষ্ট হবে বানাতে?’
– ‘এ কেমন কথা? আপনি হাত ধুয়ে বিছানায় যান। আমি চা আনছি।’
চা নিয়ে ঘরে ঢুকে রুম্পা দেখলো, লোকটা কুকড়িমুকড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে সে তাকে একটা কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিল। নিচু হয়ে কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখতে গেলে ফুপা তাকে সজোরে জড়িয়ে ধরলেন। টাল সামলাতে না পেরে রুম্পা তার পাশে বিছানায় ধপ ক’রে বসে পড়লো। ফুপা কেমন একটা শব্দ ক’রে তাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে তার বুকে মুখটা গুঁজে দিল। রুম্পা নিজেকে সরিয়ে নিতে জোর করতে পারলো না। কিন্তু স্পষ্ট বুঝলো যে, লোকটা তার বুকে মুখ ঘষতে-ঘষতে তাকে সবিতা বানিয়ে ফেলেছেন।
অনেক পরে ফুপার হাত-মুখ শিথিল হলে রুম্পা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভেজা তোয়ালে দিয়ে তার গা, হাত-পা সব মুছিয়ে দিল। প্যারাসিটামল খাওয়ালো একটা। টেবিলে পানির জগ আর গ্লাসে পানি রাখলো। দেয়ালের দিকে মুখ করা ফুপাকে স্বাভাবিকভাবেই বললো, আপনার উঠতে হবে না। ভেতরের দরজাটা খোলা থাক। লাইট জ্বালানো থাকবে। আমি বারান্দার দরজায় তালা দিয়ে যাচ্ছি। টেবিলে চাবি রাখলাম। খারাপ লাগলেই আমাকে ফোন দেবেন। পারবেন তো একা থাকতে?’
রাত নয়টা বেজে গেছে। আহা, মেয়েটাও তো ঘরে একা। রুম্পা ঘরে ফিরলো।
৪.
পরের টানা তিন দিন ফুপা জ্বরে ভুগলেন। রুম্পা ময়নার দাদিকে কিছু করতে দিল না। নিজের সাধ্যমতো সেবা করলো। চার দিনের দিন সে রতন ভাইকে ফোন দিয়ে সব জানালে, তিনি বললেন পরের দিন বাবাকে দেখতে আসবেন। এর মধ্যে অবশ্য আরো দুটো ঘটনা ঘটে গেছে।
ঝিনুক আমেরিকা থেকে রুম্পাকে ফোন করেছে। যে ঝিনুক আপা ফোন দিয়ে দিন-রাত তাকে বলতো, ‘আব্বাকে একটু দেখে রেখো, রুম্পা।’সে কী-না বললো, ‘শোনো রুম্পা, তোমার আর আমাদের বাড়িতে গিয়ে কাজ নেই। ময়নার দাদিই না হয় যা করার করবে। নানান জায়গা থেকে নানান কথা শুনি, নিজের সংসার দেখো আর আমাদেরও মান-সম্মান নিয়ে স্বামীর ঘর করতে দাও। এই বয়সে বুড়ো মানুষটার চরিত্রে যাতে কালি না লাগে, পারলে সেই দিকটা দেখো।’
আরেকটি ফোন পেয়েছে রুম্পা। সেটা ছিল স্বামী বেলালের।
– ‘কালকে সন্ধ্যায় তুমি আবার ফুপুর বাড়ি গেছিলা? সেদিন না কইলাম আর ওই বাড়ি যাবা না। কেন গেছিলা?’
– ‘তমিজ ফুপার জ্বর নামে নাই। অনেক জ্বর ছিল, তাই দেখতে গেছিলাম।’
– ‘তোমার দেখতে যাইতে হবে ক্যান? এত পিরিত কিসের? তার ছেলে, ছেলের বউ ঢাকারতা আইয়া দ্যাখতে পারে না? ঢাকা কি আমেরিকা না-কি? এদিকে আমার মাইয়া রাত্তিরে ঘরে একলা থাকে সেদিকে খেয়াল নাই।’
– ‘বুড়া মানুষটা অসুস্থ, কেউ দেখার নাই। গেলে কী হইছে?’
– ‘কী হইছে, সেটা আমার বোঝা লাগবে না। তোমারে কইছি না যাইতে, তুমি যাবা না। এইটাই আমার শেষ কথা।’
– ‘যদি যাই?
– ‘কী, আবার যাবা? রুম্পা, ভালো কইরা শুইন্যা রাখো, তুমি আর যদি ওবাড়ি যাও, তবে আমার সংসার করতে পারবা না।’
এরপরে আর কোনো কথা চলে না। রুম্পাও কোনো কথা বলে নাই।
সকাল এগারোটা বাজতে না বাজতে ময়নার দাদি বাড়ি এসে হাজির।
– ‘ও বৌ, তুমি যাও নাই আজকে তমিজ মাস্টারের বাড়ি? আমি তোমারে না পাইয়া তোমাগো বাড়ি আইয়া পড়লাম।’
– ‘ক্যান? তুমি জানো না কী-কী করতে হবে?’
– ‘জানি, তয় মাস্টার কইলো, কী রানতে হবে, যেন তোমারে জিগাইয়া নেই। সেই জন্যেই তো আইলাম।’
– ‘ঠিক আছে, তুমি একটা ভাজি করো। আর ফ্রিজে যে মলা মাছ আছে, তা দিয়া বেগুন দিয়া রান্ধো। আর সাথে পাতলা ডাইল। যাও এবার। ওহ, শোনো রতন ভাই আসবে আজকে ফুপারে দেখতে। একটু বেশি কইরা রাইন্ধো।’
৫.
রুম্পা আর ওবাড়িমুখো হয় নি। দুদিন পর সকালে কড়া নাড়ার শব্দে দরজার কাছে যেতেই দেখলো, তমিজ ফুপা দাঁড়িয়ে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল সে। এক সপ্তার জ্বরে লোকটা কেমন দুর্বল হয়ে গেছে! রুম্পা স্থবির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
– ‘রুম্পা, এক কাপ চা খাওয়াবে?’
– ‘আপনি বসেন, আমি আনছি।’
চায়ের সাথে বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো সে।
এই মানুষটা তাদের বাড়িতে খুব কমই এসেছে। তার আসার কারণ বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো রুম্পা মনে-মনে।
উনি খুব ধীরে-ধীরে বিস্কুট আর পানি খেলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।’
রুম্পা সামনের চেয়ারটাতে বসলো।
– ‘জানো, আমি যখন দেখতাম, তুমি সারা বাড়ি দৌড়ে-দৌড়ে কাজ করছো, চুলার পাশে বসে রান্না করছ, কতদিন ভেবেছি, মেয়েটার কাছে গিয়ে একটু বসি। এক কাপ চা বানিয়ে দেই মেয়েটাকে। তারপর চলে আসি। প্রতি চুমুকে মেয়েটার হয়ত আমার কথা একবার ক’রে মনে পড়বে। আচ্ছা, তুমি কি জানো, মানুষ কেন চায়, আরেকজন মানুষ তাকে বিশেষ ক’রে মনে রাখুক?’
রুম্পাকে নিরুত্তর দেখে তিনি নিজে বলে চললেন, ‘না, তোমার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। তুমি পড়াটা চালিয়ে যেও। এটা রাখো। আমি এখন উঠবো।’রুম্পা হাত বাড়িয়ে ফুপার হাত থেকে খামটা নিলো।
ফুপাকে বড় রাস্তার দিকে হেঁটে যেতে দেখে রুম্পা বলে উঠলো, ‘এই ভরদুপুরে ওদিকে কোথায় যান আপনি?’
– ‘এই তো যাই।’পেছনে না ফিরে তিনি সোজা হেঁটে গেলেন।
ফুপা চোখের আড়াল হতে চিঠিটার কথা মনে হলো তার। দৌড়ে ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ ক’রে চোখের সামনে মেলে ধরলো সেটি।
শিমুল (এ নামেই ডাকতে ইচ্ছা হলো তোমাকে),
তুমি আসলেই বেশ ভালো মেয়ে। আমার বুঝতে দেরি হলো এই যা। তবে আমি বললেই তো হবে না, আরো অনেককে বলতে হবে। তারা কীভাবে বলবে? সেটা নিশ্চয়ই তুমি ভাববে।
এখন বলবো আমার কথা। প্রত্যন্ত এক গ্রামেই কেটেছে জীবনের প্রথম বাইশটি বছর। তারপরে তোমাদের হাসনাবাদে আরো তেতাল্লিশটি বছর পার করলাম। আমি আবার আমার সেই গ্রামে ফিরে যাচ্ছি। সেখানে বাকি সময়টা কাটাতে চাই। আমি একা বাস করতে পারি, খুব সেল্ফ সাফিশিয়েন্টও। ওখানে তাই বেশ চলে যাবে। কোনো দিন সামাজিক ছিলাম না। দেখেছোই তো নিজের ভেতরেই সেঁধিয়ে থাকি। অনেকটা শামুক বা কচ্ছপের মতো। এমন একজন মানুষকে তুমি কিছুটা হলেও খুলতে পেরেছো, খোলসের বাইরে এনেছো, এটা আমার জন্যে অনেক পাওয়া। অমূল্য ধনের মতো আমি তা আগলে রাখবো। সেটা যে আমার নির্ভরতা!
কিছুদিন হলো বর্ষা শুরু হয়েছে। বৃষ্টির শব্দ আমার ভীষণ প্রিয়। ডোবার ধারে ছোট্ট কুঁড়ের বারান্দা থেকে দেখবো তার টাপুরটুপুর। দিন ভালোই কেটে যাবে।
তোমার জীবনের কথা আমি ভেবেছি। তা নিরর্থক নয় বরং যথেষ্ট অর্থপূর্ণ। আমাদের চারপাশের অনর্থক সব বিষয়ের মধ্যেই সার্থক কিছু ভালো বিষয় থাকে। কিছু মানুষ সেখান থেকে যা অনন্য, তা বেছে নিতে পারে। তুমি তেমনই একজন মানুষ।
জীবনে আমি খুব কম দিতে পেরেছি মানুষকে। তোমাকেও কিছু দিতে পারলাম না, শুধু কালো কিছু দাগ ছাড়া। তবে এ দাগ উঠে যাবে একদিন। তুমি নিজেকে নিঃস্ব ভেবো না। বিধাতা যা দিয়েছেন তোমাকে, তার যত্ন করো। ভুলে যেও না, আমি তোমাকে সব সময় বই পড়তে বলতাম।
আমি ভালো থাকবো। তুমিও সেই চেষ্টাই করো।
ইতি,
(কী লিখবো, জানি না। তুমি বসিয়ে নিও তোমার যা খুশি।)
বি.দ্র. আমি আমার মোবাইল ফোনটা ফেলে গেলাম। আমাকে ফোনে খুঁজো না।
চিঠিটা বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে রুম্পা। অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির আনন্দে চোখে তার জল জমেছে। জীবনের প্রথম প্রেমপত্র বলে কথা। হয়ত শেষও।