ফেলে আসা দেশ
ফেলে আসা নদী

অজয় কুমার বসু

চলমান জীবন দীর্ঘকাল ধরে দেশদেশান্তর ঘুরিয়ে এনে যখন আমাকে এক জায়গায় থিতু করলো তখন আমি একেবারে একা।
অবশ্য প্রত্যেকই একা, একক অর্থে। যাইহোক,আমি আশি পার করেও সেই শিশুকালের মতোই অস্থির মানুষ। হঠাৎ মনে হলো দীর্ঘ পথচলায় কি-দেখলাম, তার কি কি মনে আছে খুঁজে দেখি। সেই খুঁজতে গিয়ে আটকে গেলাম নদীনালা-খাল-বিল-বাওড় ঘেরা আমার জন্মভূমির দোরগোড়ায়। ফুরায় না সেই অবাক বালকের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের দিনলিপি। তার কিছু একসাথে করে তুলে দিলাম পথচলার নবীন বন্ধুদের।

আমরা দুই ভাই ও দুই বোন। সবারই জন্ম ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৩ -এর মধ্যে— যশোর জেলার তদানীং মহকুমা মাগুরার অধীন সিরিজদিয়া গ্রামে।আমাদের গ্রাম থেকে সাত মাইল দূরে— সেখানে বয়েজ স্কুল (ক্লাস এইট পর্যন্ত), গার্লস স্কুল,থানা,  কোর্টকাছারি, ডাক্তার উকিল, বিরাট SDOর বাংলো। চুয়াডাঙা দিয়ে বয়ে আসা কুমার নদ মিলেছে নবগঙ্গায়। ব্যবসাবাণিজ্যের রমরমা— বিরাট, বিরাট পাট ও দানা শস্যের গুদামঘর। অবশ্যই মারোয়াড়ি গদি। মাগুরা থেকে ইটের বড়ো রাস্তা চলে গেছে ঝিনাইদহ হয়ে একদিকে যশোরে, অন্যদিকে কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গায়। তখন কুরী কোম্পানি,কুণ্ডু কোম্পানির বাস চলে ঐ সব পথে। ঝিনাইদহের পরে দুদিকেই পিচের রাস্তা।

শিয়ালদহ থেকে একটা রেলপথ দমদম বারাকপুর রাণাঘাট দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙ্গা পার করে কুষ্ঠিয়ার পর গোয়ালন্দে গিয়ে শেষ। সেখান থেকে স্টিমারে পদ্মানদী পার হয়ে আবার রেলগাড়ী চড়ে দার্জিলিঙ এর পথে।

ঐ শিয়ালদহ থেকেই আরেকটি রেলপথ বের হয়ে দমদম জংশন থেকে ডানদিকে বেঁকে বারাসত বনগাঁর পথ ধরে যশোর হয়ে খুলনা পৌঁছায়। ব্যস! আর রেলপথ নেই। খুলনা থেকে নদীপথে বিশাল বিশাল একতলা-দোতলা স্টিমার চড়ে বরিশাল, তারপাশা,কীর্তিপাশা ঝালকাঠি যাওয়া । ছোটবেলায় একটা ধাঁধা ছিল-‘ বলো তো কোন জেলায় রেললাইন নেই?’ সমস্বরে চিৎকার -বরিশাল,বরিশাল!

খুলনা নদীবন্দরে বিশাল সব স্টিমার নোঙর করে। অধিকাংশ বড়ো স্টিমার বরিশালের দিকে। আমরা অপেক্ষাকৃত ছোট নদীর পথে ভৈরব -রূপসা(?)-কাটাখাল ধরে চিত্রায় প’ড়ে নড়াইল-রূপগঞ্জে নবগঙ্গা ধরে নলদীনহাটা, শত্রুজিৎপুর পার হয়ে চাউলিয়া স্টিমার স্টেশনের মাটিতে পা দেব। চাউলিয়ার পর আরও প্রায় দশ মাইল উজানে মাগুরা— স্টিমারের শেষ নোঙর ফেলার বন্দর। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় সেই চুয়াল্লিশ-পয়তাল্লিশ সালেই বর্ষার সময় ছাড়া চাউলিয়াই শেষ নোঙর।
খুলনা থেকে নদীপথে গাজীরহাটের কাছে উজানে ডানদিকে একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য সাতমাথা তালগাছ ছিল।

স্টিমার দু-তিন রকমের ছিল —
Paddle engine ওয়ালা দোতলা, screw type propeller-এর দোতলা ও একতলা ।

দোতলায় স্টিমারের একদম সামনে বিশাল চক্রাকৃতি wheel, পাশে স্ট্যান্ডের উপর রাখা দূরবীণ। স্টিমারের Anglo indian কাপ্তান বা চিটাগাং এর ভোতা মুখের সারেঙ-এর উঁচু চেয়ারের মাথার উপর হাতল ঝোলানো রশি—ইঞ্জিনঘরের সঙ্গে নির্দেশ বা সংকেত পাঠানোর জন্য। সারেং হুইল ঘুরিয়ে দিক নির্দেশ করতেন।গতি নির্ধারিত হতো ইঞ্জিনঘর থেকে ঘন্টাধ্বনি মারফত সারেং-এর নির্দেশ অনুযায়ী। আবার নদীর গভীরতা মাপার জন্য chain-এ বাঁধা লোহার বল নিয়ে একজন ব্যস্ত থাকতো।

বারবার স্টিমার বলতে ভালো লাগছে না, জাহাজ বলাই ভালো। এখানে দুই ধরনের যাত্রী। ডেক মানে একতলা ও দোতলার খোলা পাটাতনের উপর বাক্সপ্যাটরা নিয়ে যাত্রা।
মাঝে মাঝে পিঠে ঠেকনা দেওয়া কাঠের বেঞ্চ। দোতলায় ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাস কেবিন। কেবিনের যাত্রীদের জন্যে ডেকচেয়ার। জাহাজের খোলা ডেকের চারপাশে শক্ত লোহার রেলিং। জাহাজের দুলুনিতে বেসামাল হয়ে কেউ যাতে জলে পড়ে না যায় । উপর-নিচের দুই রেলিংয়েই লালসাদা রঙ করা গোল লাইফ বেল্ট। দোতলায় জাহাজের পিছনে বা পাশে সাদা রঙ করা দু-খানা ছোট্ট নৌকা, লাইফবোট। আকস্মিক জাহাজডুবিতে যাত্রীদের প্রাণরক্ষার্থে। চলমান জাহাজে কেকবিস্কুট জাতীয় কিছু খাবার পাওয়া যেত। আমরা চাউলিয়া থেকে খুলনা যাওয়ার সময় রূপগঞ্জে জাহাজ থেকে নেমে ময়রার দোকানে একপোয়া চিড়ের মধ্যে এক পোয়া ঘন ঘোল বাতাসা-কদমা দিয়ে মেখে নিতাম। সঙ্গে থাকতো এক থাবা তাজা কাচাগোল্লা সন্দেশ। একাধিক ময়রার দোকান যাত্রীদের হাপুশ-হুপুশ শব্দে মুখরিত হয়ে উঠতো। জাহাজ ছাড়ার গম্ভীর নিনাদে হুড়মুড় করে যাত্রীরা ছুটতো জেঠীর পানে। প্রায় সন্ধে লেগে যেত খুলনায় পৌঁছাতে। তারপর বাবার কোনো ব্যবসায়ী প্রাক্তন ছাত্রের বাসাবাড়ীতে রাত্রিবাস ও পরের দিন বরিশাল মেল ধরে কলকাতা— সে অন্য গল্প । আমরা এখনো নদীপথে…

আমিও সেই ৭০—৭৫ বছর আগে ফেলে আসা পথঘাট, হাটবাজার এবং সেই সময়ের মানুষের মুখ,চলাফেরা ও কথাবার্তা যেন দেখতে-শুনতে পাই। আসলে নিঃসঙ্গ মানুষ অতীতের মধ্যে থাকতে তৃপ্তি পায় ।

এখন জাহাজঘাট বা বন্দরের কথা বলি। চাউলিয়া স্টিমারঘাটের লাগোয়া স্টেশনমাস্টারের কোয়ার্টারস্ ছিল। নদীতে কাঠের জেঠী ছিল, জাহাজ থেকে জেঠীতে নামার জন্যে একটা কাঠের বিড দেওয়া লম্বা তক্তা জাতীয় পাটাতন পেতে দেওয়া হতো— যেটা সিঁড়ির মতো কাজ করতো । যাত্রীরা স্টীমার থেকে নেমে টিকিট দেখিয়ে দুদিকে শক্ত কাঠের বেষ্টনী পার হয়ে বড়ো রাস্তায় যাওয়ার অনুমতি পেতো । স্টেশন মাস্টার এর টিকিট ঘরের সঙ্গেই ছিল কলকাতা/খুলনা থেকে আনানো loaf bread, S-biscuit, লালনীল রঙীন কাগজে মোড়ানো chocolate, lozens এর দোকান —বাবা মাঝেমধ্যে স্কুল থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসতেন।

এইসব স্টিমার/জাহাজ কোম্পানির মালিকরা UK-তে সমিতিবদ্ধ ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরা পাততাড়ি গোটালো। বাঙালীর কোনোকালেই পুঁজি ছিল না, তাই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আদমজী, ইস্পাহানী এলো। এরা ভারতের তখনকার TATA, BIRLA-র মতো।ছোটখাটো পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ী নদী ও স্থল যানবাহনের ব্যবসার দখল নিল। জাহাজ বা স্টিমারের বদলে আমদানি হলো বিশাল বিশাল দোতলা MV লঞ্চ।।
১৯৫১ থেকেই আমরা সেই মোটর লঞ্চে খুলনা -চাউলিয়া যেতে লাগলাম। দেড়শো-দুশো মানুষ ধরতো ঐ সব লঞ্চে। নিচে ব্যাকরেস্ট দেওয়া কাঠের দুই- তিন সারি বেঞ্চ। দোতলায় গদি দেওয়া বেঞ্চ। আমরা সঙ্গে মা বা ঠাকুমা থাকলে নিচেই বসতাম। একা বা জ্যাঠার ছেলে আমার দাদা থাকলে দোতলায়। তখন আমি কলকাতায় মামার বাড়িতে থেকে স্কুলে 7,8,9 এবং 10 এর ছাত্র, বড়ো হচ্ছি…

একবার চলন্ত লঞ্চে মাঝিমাল্লারা নদীর মধ্যেই জেলেদের কাছে ইলিশমাছ কিনছে দেখে দাদার মাথায় এলো ওদের সাথেই ইলিশভাত খাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একটু অবাক হলেও মাঝিরা খুশীতে রাজি। কী অপূর্ব ছিল সেই ইলিশ মাছের তেলঝোল আর গরম লাল চালের ভাত।মনে আছে, হাত হলুদতেলে রঙিন হয়ে ছিল সারদিন।

এবার গাধাবোট। ছোট ছোট একতলা স্টিমার আগে আগে চলেছে—পিছনে তিন,চার ছয় খানা গাধাবোট গুটি গুটি করে দুনিয়ার বোঝা বয়ে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে জলে ভাসানো বড়ো বড়ো কাঠের গুড়ির বহর বা বাঁশের বহরের কথা মনে এলো। ঐসব কাঠ/বাঁশ এর বহরের উপর হোগলা বা শণ-এর ছাউনির মধ্যে পাহারাদার লোকজন থাকতো ও রীতিমতো রান্নাবান্না করে খাওয়াদাওয়া করতো। স্বাধীনতার আগে আসাম থেকে ব্রহ্মপুত্র,পদ্মা,মেঘনা হয়ে একেবারে কলকাতা পর্যন্ত যেতো। পরে যখন Mark Twain এর Adventure of Hackleberry Fin পড়েছি আর Hudson River দিয়ে বহমান কাঠের গুড়ির বহরে ঘর বানিয়ে চলার কল্পনায় নিজেকে বসিয়েছি।

( দ্বিতীয় পর্ব পড়তে চোখ রাখুন ‘কীর্তনখোলা’য়)

লেখক পরিচিতি –

অজয় কুমার বসুর জন্ম ১৯৪১ সালে— তৎকালীন ‘যশোহর’ জেলার মাগুরা মহকুমায় । আজ থেকে ৭০-৭৫ আগে বাবার হাত ধরে দেশ ছেড়েছেন। তারপর লেখাপড়া -কর্মজীবন-সংসার সবই পশ্চিমবঙ্গে। সেই কৈশোরে পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে গেলেও এই কাঁদাজলের ঘ্রাণ মাখা দেশ তাঁকে ছাড়েনি।
বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া সেই নদীর পাল তোলা নৌকার মাঝি, হাট-বাজার গ্রাম গঞ্জের সহজ-সরল মানুষ তাঁকে হাত বাড়িয়ে ডাকে। তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরেছেন, অনেক অজানা অচেনা জায়গায় গিয়ে ভ্রমণপিপাসু মনকে আনন্দ দিয়েছেন, ‘কিন্তু এ স্নেহের তৃষা মিটে কার জলে’ ।
তাই কর্মজীবনে নানা ব্যস্ততা থাকার পরও ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে। অবসরে যাওয়ার পর তাঁর ভাবনার সমস্ত এলাকাজুড়ে ফেলে আসা জন্মভূমির রাজত্ব। ৮০ বছর পার করা এই মানুষটি আজও ইন্টারনেট ঘেটে নিজের জন্মভূমির নদী, শহর, গ্রাম, খাল-বিল-বাওড়ের ছবি দেখে চলে যান নিজের ছেলেবেলার স্মৃতির দেশে।
কীর্তনখোলা সাহিত্যপত্রের অনুরোধে তিনি তাঁর স্পষ্ট স্মৃতি পাঠকের জন্য শব্দে- বাক্যে গেঁথেছেন। আমরা ধারাবাহিকভাবে লেখাগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি…