বরিশাল শহরে তখনো চারটি সিনেমা হল। জগদীশ পরবর্তীতে কাকলী, নুরমহল পরবর্তীতে অভিরুচী, সোনালী এবং বিউটি। শহরটা বড় নয়। এক দৌড়ে এফোঁর-ওফোঁর করা কোন কিশোরের কাছে বেশী সময়ের নয়। কিশোরকালে আমাদের কতিপয় বন্ধুদের এ অভ্যাসটা বেশ ছিলো। সে বয়সে সিনেমা দেখার সুযোগ না হলেও সিনেমা হলের সামনের বিরাট চিত্রশিল্পকর্ম দেখতে আমার খুবই ভালো লাগতো। মাঝে মধ্যে দেখতাম সুদর্শন এক শিল্পী খাকি রংয়ের হাপ-পেন্টুল পরে বাঁশের তৈরী বিরাট ঝুলন্ত মইয়ের উপর বসে এক মনে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের বিশেষ ভঙ্গিমার ছবি আঁকছেন। সিনেমা চিত্র-শিল্পের নিচের নামটিও আমাদের মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো ‘চিত্ত হালদার ’। তখন কোন এক কারণে বুকটা গর্বে ভরে উঠতো। সে বয়সে চিত্রশিল্পী চিত্ত হালদার সম্পর্কে তেমন কিছু অতিরিক্ত জানার কৌতুহল আমার মধ্যে দানা বাঁধেনি। তবে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বাসায় যাওয়ার সৌভাগ্য হলে আমি তাঁর অসংখ্য মডেল ও রিলিফ স্কাপচারের প্লাস্টার অফ প্যারিস-এ তৈরী সাঁচগুলো দেখে এক অজানা আকর্ষণ ও মায়াজালে জড়িয়ে পড়ি – আজ এরই কিছুটা অভিব্যক্তি … ‘এক আশ্চর্য ভাস্কর্য শিল্পী চিত্ত হালদার।’
১৯৩৬ সালে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনারীদের সেন্ট এ্যান হাসপাতালে জন্ম গ্রহণ করেন এই শিল্পী। তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে যখন পড়তেন তখন ২৫পয়সা বৃত্তি পেতেন যা তার বাবা ধুতি পরে অত্যন্ত গর্বের সাথে উত্তোলন করতেন। এরপরে তিনি বরিশাল বি, এম স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন করেন, পরবর্তীতে বি, এম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। আট ও কালচারের উপর প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা তাঁর ছিল না। ছোটবেলা থেকে নিজে নিজেই শিল্পের কারিগর হয়ে ওঠেন। রঙ সাজানোর খেলায় মত্ত থাকতেন;- যিনি কুকুরের লেজ কেটে তুলি আর আলতার সহযোগে ঘরের দেয়ালে এঁকেছিলেন জীবনের প্রথম চিত্রকলা। এবং নিজেই বুঝেছিলেন, এ পথ যে তাঁরই আরাধ্য। ইংরেজী বইয়ের সংগ্রহশালা ছিল তাঁর দারুন। যে বইগুলো এখনও তাঁর স্ত্রী পরম যত্নে, মমতায় বাক্সবন্দী করে রেখেছেন।
বরিশাল শহরে ছোট্ট একটি ছবি বাঁধাইয়ের দোকান ছিল তাঁর। ছবি বাঁধাইয়ের পাশাপাশি শিল্পচর্চা করতেন তিনি। একসময় এই ঘরটিই স্টুডিওতে পরিণত হয়। পোর্ট্রেইট পেইন্টিং থেকে শুরু করে সিনেমার পোস্টার পর্যন্ত নানারকম ফরমায়েসী কাজের পাশাপাশি তৈরী হচ্ছিল ছোট ছোট ভাস্কর্যের মডেল। যদিও তা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে স্থাপত্যের রূপ পায়নি। সময়ে এসব সংরক্ষণ না হওয়ায় এখন আর কোথাও কোনও নিদর্শন নেই। কেবল পরিত্যক্ত গুপ্তধনের মত রয়ে গেছে তাঁর অসংখ্য মডেল ও রিলিফ স্কাপচারের সাঁচ। প্লাস্টার অফ প্যারিস-এ তৈরী এই সাঁচগুলো এখন তাঁর মধ্যম কন্যা ভায়লেট হালদারের তত্ত্বাবধানে বরিশালস্থ বাড়িতে সংরক্তিত আছে। এছাড়াও সংরক্ষিত আছে বেশ কিছু পেইন্টিং, বিখ্যাতদের পোর্ট্রেইট, বইয়ের প্রচ্ছদ, চিঠিপত্র ইত্যাদি।
শিল্প আর আর্থিক দৈনতা নাকি সহাবস্থানে থাকে। চিত্ত হালদারের জীবনে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এরপর যা হওয়ার তাই হল, সাঁচ থেকে তৈরী হতে থাকলো ছোট ছোট ভাস্কর্য, শুরু হল বিপণন। কাজের নেশায় এতটাই মত্ত থাকতেন, ঘরে যে চাল নেই সে কথাই ভুলে যেতেন তিনি এমনকি সারাদিন পেটে কিছু না পড়লেও তিনি আঁচ করতে পারতেন না খেয়েছেন কিনা। সহধর্মিনী ঝর্ণা হালদারের অগাধ প্রশ্রয় তাঁর শিল্পচর্চার পথকে সুগম করে দেয়। এক সময় অভাবের তাড়নায় চলে আসেন ঢাকায়।
একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মলোটভ ককটেল
১৯৭১ সালে এই শিল্পীর আরও একটি পরিচয় পাওয়া গেল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুব সংঘের কর্মীরা বরিশাল ধর্মরক্ষিণী সভাকক্ষে শুরু করল দেশীয় অস্ত্র গোলাবারুদ তৈরীর গোপন ঘাঁটি। দু-একদিনের মধ্যেই সংগ্রহীত হল গোলা-বারুদ। বরিশালের বণিকদের দোকান, স্কুল কলেজের সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে সংগ্রহীত হল পয়ম জনীয় কাঁচামাল। তৈরি করা হল মলোটভ ককটেল, এসিড বোমা, হাত বোমা, ভাসমান মাইন। তৎকালীন আওয়ামী নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও মেজর জলিল পরিদর্শন ও পরীক্ষা করে উৎসাহ দিলেন। এসব গোলা-বারুদ চাঁদপুর, খুলনার গল্লামারী যুদ্ধে সাফল্য অর্জনে সহায়তা করেছিল। ধর্মরক্ষিনীর গোলা-বারুদ তৈরি কারখানার সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন ভাস্কর্য শিল্পী চিত্ত হালদার। তাঁর সাথে সহযোগিতায় ছিলেন এনায়েত হোসেন মিলন, হেলালুদ্দিন, কচি, মিন্টু বসু, মাহতাব, ফরিদ খান, বিমল প্রমূখ। নেপথ্যে কর্মীদের মধ্যে ছিলেন এস এম ইকবাল, ডা. এস সি রায়, হারেচ খান, নজরুল ইসলাম চুন্নু।
যুদ্ধ শেষ। তার হাতে পরম বিশ্বস্ততায় আবার উঠে আসে আসে শিল্পকর্মের সরঞ্জাম। বিশ্ব চরাচর ভুলে গিয়ে তাঁর বিখ্যাত শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে জাতীয় যাদুঘরে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন সবাই। সাফল্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঈর্ষান্বিত হননি কখনো। নিমগ্ন হয়েছিলেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
কিন্তু এত ধকল শরীরে সইবে কেন? লিভার অব সিরোসিসে সেই যে আক্রান্ত হয়ে বিছানা নিলেন আর উঠলেন না। ১৯৭৮ সালের ১৯শে জুলাই এই নিভৃতচারী শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। রেখে গেলেন তিন কন্যা আর সারা জীবনের সুখ দুঃখের সাথী স্ত্রী ঝর্ণা হালদারকে। যিনি পরবর্তিকালে স্বামীর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে ব্রতী হয়েছিলেন।
ঢাকা যাদুঘর
ঢাকা যাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অনস্বীকার্য। নিমতলী থেকে যখন শাহবাগে যাদুঘর স্থানান্তরিত হয় তখন যাদুঘরের কোন ফাণ্ড ছিল না। এই যাদুঘরের ফাণ্ড তৈরি তিনি মহামায়ার প্রচুর রেপ্লিকা তৈরি করে দেন, এবং মহামায়ার এই রেপ্লিকা দেশী-বিদেশীদের কাছে বিক্রি করে যাদুঘরের প্রথম ফাণ্ড তৈরি হয়। পরবর্তীতে তিনি যাদুঘরের অনেক কাজ করেছেন বিনামূল্যে। ড. এনামুল হক যাদুঘরে ভাস্কর চিত্ত হালদারকে চাকুরির প্রস্তাব দিলে তিনি তা নাকচ করে দেন। কেননা তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা মানুষ, কারো দাসত্ব ও কোন নিয়ম শৃঙ্খলে বাঁধা পড়তে চাননি।
পটুয়া কামরুল হাসানের ‘পাগলা’
পটুয়া কামরুল হাসান চিত্ত হালদারকে খুব ভালবাসতেন। ডাকতেন ‘পাগলা’ বলে। কামরুল হাসান তাঁর এই পাগলাকে দিয়ে জাতীয় জদুঘরের বেশকিছু কপি ওয়ার্কও করিয়ে নিয়েছিলেন সেসময়ে। সেই কপি ওয়ার্কগুলো এতটাই ভাল হয়েছিল যে, দেশী বিদেশী অনেক পর্যটক তা নিজেদের সংগ্রহে রাখার আগ্রহ প্রকাশ করে। এ সময় কামরুল হাসান তাঁর কপি ওয়ার্কগুলো বিপণনের ব্যবস্থা করে দেন। কামরুল হাসান তাঁর খেরোখাতায় লিখেছিলেন, ‘বেতারে বাংলা সংবাদ হচ্ছে, আমার ডাইভার এসে গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের করল। আমাকে প্রস্তুত হয়ে অফিসে যেতে হবে। এবার চিত্ত হালদার। পাগলা নাই। পটুয়া কামরুল হাসানের স্নেহাস্পদ পাগলা আর নাই। বরিশালের শিল্পানুরাগী সমাজের চিত্ত হালদার কিংবা চিত্তদা আর ইহজগতে নাই। এক রকম বিনা চিকিৎসায় বরিশাল-এর শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাধারণ বিছানায় হিমশীতল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে একজন শিল্পী। আজকের সংবাদে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দুপুরে বাসায় এসে কাগজ খুলতেই চোখে পড়লো। চমকেই উঠলাম না, নিজের কাছে নিজে কি কৈফিয়ত তাই ভাবছি সেই থেকে। আমার আরো আশ্চর্য লাগছে যে, আজ সকালেই গত রাতের স্বপ্নের কথা লিখেছি। যে স্বপ্নে আমার আর একজন শ্রদ্ধাস্পদ এবং প্রিয়জনের পরিবেশ দেখেছিলাম, যিনি গত তিনবছর আগে ইহজগত ত্যাগ করেছেন। শ্রদ্ধাস্পদ প্রবোধদা আর স্নেহাস্পদ চিত্ত হালদার।’
(সুত্র: পটুয়া কামরুল হাসানের খেরোখাতা ২রা অগাস্ট ১৯৭৮। উল্লেখ্য, দৈনিক সংবাদে নিউজটি করেছিলেন সাংবাদিক মানবেন্দ্র বটব্যাল ০২/০৮/১৯৭৮ খ্রি. )
চিত্ত হালদারের মৃত্যুর পরও তাঁর পরিবারের সঙ্গে কামরুল হাসান যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন। বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। সে সময়ে কামরুল হাসানের লেখা কিছু চিঠিপত্রও পাওয়া যায়।
প্লাস্টার অফ প্যারিসে তৈরি রিলিফ ও মডেল শিল্পকর্ম একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। এ মাধ্যমটি জনগণের কাছে বেশ সমাদৃত। স্বাধীনতা পরবর্তি সময় থেকেই এর কদর বেড়েছে। বর্তমানে কিছুটা কমলেও রাজধানীসহ মফস্বলের বিপণিবিতানগুলোতে এ শিল্পমাধ্যমটি দেখতে পাওয়া যায়। এর শৈল্পীক গুণ এবং পরিস্ফুটন মুহূর্তেই যে কোনও লোককেই আকৃষ্ট করে। তাই বিত্তবান থেকে মধ্যবিত্ত সবার কাছেই রিলিফ ও মডেল ভাস্কর্যের সমান কদর। শিল্পকর্ম হিসেবে একজন শিল্পীর সার্থকতা তো সেখানেই, যদি তার সৃষ্টি জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে। শিল্পকর্মের এই মাধ্যমটি আগেও এদেশে প্রচলিত। তবে একে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে যার অবদান অনেক তিনি শিল্পী চিত্ত হালদার। তার শিল্পকর্মে শুধু দেশীয় উপাদান নয়, ওয়েস্টার্ন আর্টের কালজয়ীদের প্রভাবও লক্ষণীয়। ওয়ার্ল্ড ফেমাস মাইকেল্যাঞ্জেলো, রদ্যা, রাফায়েল প্রমুখ ওল্ড মাস্টাদের প্রভাব তাঁর কাজে লক্ষ্য করা যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, তিনি বিশ্ব-শিল্পকলা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
‘স্বামীর অবদানের স্বীকৃতি চান ঝর্না হালদার’
শিরোনামে সাংবাদিক বিধান সরকার লিখেছেন, ‘ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়ানো ক্ষুদিরামকে দেখে প্রখ্যাত ভাস্কর রাম কিংকরের উক্তি ছিল, হাতে বোমা নেই কেন? একই উক্তি মনে পড়ল এক ভাস্কর্য শিল্পী থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বোমার কারিগর প্রয়াত চিত্ত হালদারের পোর্ট্রেটের দিকে চেয়ে। অনিয়ম, অনাচার আর বৈষম্যরোধে একদিন সৃষ্টি ছেড়ে ধ্বংসে মেতে উঠলে এখন কেন নীরব পানে চেয়ে থাকা! এখনো এই আধিক্য বিদ্যমান। যার বর্ণনা মেলে ঝর্ণা হালদারের কষ্টের দিনগুলির মধ্যে। সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত বলে কিছু পাওয়ার নেই এখন আর। তবে আক্ষেপ আছে স্বামীর অবদানের স্বীকৃতি নিয়ে। তিন যুগ ধরে এ লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে শান্তির খোঁজে ভার তুলে দিয়েছেন সন্তানদের হাতে। শুনি স্বাধীনতা যুদ্ধে এক ভাস্কর্য শিল্পীর বোমার কারিগর হয়ে ওঠার নেপথ্যের ঘটনা আর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ও স্ত্রী-সন্তানদের বেড়ে ওঠার কষ্টের দিনগুলির কথা। কষ্টের অধ্যায় পেরিয়ে আসায় এখন আর চাওয়ার কিছু নেই ঝর্ণা হালদারের। তবে আক্ষেপ আছে মুক্তিবার্তায় যোদ্ধা নাম্বার হিসেবে চিত্ত হালদারের নাম থাকলেও স্বীকৃতি সনদ পায়নি। চলে আসার সময় জিজ্ঞাসা করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেলে গার্ড অব অনার দেয়া হয় তাঁদের সহধর্মিণীরা মারা গেলে কিছুই কি করার নেই? কেননা স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ভাত রেধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠিয়েছেন। ডাকাতের হামলা সয়েছেন আর সন্তনদের নিয়ে কষ্টের কঠিন দিনগুলি পার করেছেন। মনে মনে উত্তর খুঁজি এ প্রশ্নের, সমাধানের দায় রাষ্ট্রের বৈ ভিন্ন কারো নয়।’
( সুত্র: বরিশাল বার্তা, ৯ই মার্চ ২০১৬, ‘মার্চের উত্তাল দিনগুলি’ )
কৃতজ্ঞতা : কন্যা ভায়লেট হালদার, রিঙকু অনিমিখ (সব খবর অনলাইন)