যে সৌন্দর্য ইতিহাসের কথা বলে : দূর্গাসাগর

রবীন ভাবুক

অপরূপ সুন্দরের দেশ মায়াময় বাংলাদেশ। রূপ বৈচিত্র্যে বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে মোহিত করে। শীতের সকালে নিয়মিত মতো বেড়িয়ে পড়ি, উদ্দেশ্য দূর্গাসাগর ভ্রমণ এবং কিছু ফটোগ্রাফি করা। পাখির কিচিমিচির শব্দের মাঝে মাহেন্দ্র গাড়িটি ছুটে চলে সুনশান নিরবতার বুকচিরে কর্কশ শব্দ করে।
এক সময় বরিশালকে প্রাচ্যের ভেনিস বলা হতো। সাগর গর্ভে গড়ে ওঠা বরিশালের প্রাচীন নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। শস্য আর সম্পদে ভরপুর ছিল বাংলার এই দক্ষিণাঞ্চল। যে কারণে এখানকার রাজা এবং জমিদারদের অর্থনৈতিক অবস্হানও ছিল শক্তিশালী, আর এ কারণেই সে সময়ে বর্মিজ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের লুণ্ঠনের শিকার হতে হতো এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের।

প্রাচীন রাজা-জমিদারদের স্মৃতিচিহ্নগুলো আজ বিলুপ্তপ্রায়। তবে এখনো এখানে সেখানে বেশকিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক নিদর্শন সমৃদ্ধ দেশের দক্ষিনাঞ্চলের জেলা বরিশাল। ইতিহাসখ্যাত এই বরিশাল জেলার একটি ইউনিয়ন মাধবপাশা। এখানেই রয়েছে রাজবংশীয় বহু প্রাচীন নিদর্শন।

চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের কীর্তিমান পুরুষ রাজা রামচন্দ্র শ্রীনগর (মাধবপাশায়) চন্দ্রদ্বীপের (প্রাচীন বরিশাল) রাজধানী স্হায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। রামচন্দ্রের সেই রাজত্বের তেমন কিছু এখন আর দেখা না গেলেও খুঁজতে শুরু করলাম রাজবংশীয় কাউকে পাওয়া যায় কিনা।

একটি চায়ের দোকানে বন্ধুকে নিয়ে চা খাওয়া শুরু করলাম। চায়ের দোকানীর কাছে জানতে চাইলাম দূর্গাসাগর দিঘির প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে। কথার ফাঁকে জানতে পারলাম চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশের বংশধর দিলীপ রাজা এখনো এখানে বাস করেন। সাতপাঁচ না ভেবে একটি ইজিবাইকে রওনা দিলাম দিলীপ রাজার খোঁজে। তাঁকে খুঁজে পেতে তেমন সমস্যা হয়নি।

একটি পুরানো বাড়ির সামনে এসে গাড়ির চালক দেখিয়ে দিলেন এটাই দিলীপ রাজার বাড়ি। গাছপালা বেষ্টিত বাগানের মধ্যে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজবংশের বাড়িটি। দেওয়ালের আস্তর-শুরকি উঠে গেছে। অনুমেয় যে, মানুষ বসবাসের কারণে নিয়মিতভাবে এটা সংস্কার এবং রং করা হয় বলে এখনো তেমন বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েনি। বাড়ির সামনেই একটি পুরানো ভাঙা মঠ।

ধীরে ধীরে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। সুনশান নিরবতা। রাজকীয় ভাবগাম্ভীর্যের একটি স্বাদ এখনো এখানে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই পুরানো ঘরানার জানালায় চোখ যায়। রাজবংশের বর্তমান দিলীপ রাজার কণ্যা জানালার কাছে বসে রূপচর্চা করছেন। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়েই চোখের কাজল পড়া শেষ করে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।
মনে মনে ভাবলাম এই মেয়ে যদি শতবছর পূর্বে আসতো, সে তখন রাজকন্যা হিসেবে পরিচিত হতো। তার রাজকন্যার মতো বেশভূষা নেই, কিন্তু তার চাহনি এবং বাড়ির পরিবেশ তাকে এখনো রাজকন্যার মতো করে রেখেছে।

মেয়েটি তাঁর মায়ের (দিলীপ রাজার স্ত্রী) সাথে সিঁড়িতে এসে জানতে চাইলো আমি কে এবং কী চাই। আমি দিলীপ রাজার স্ত্রীকে বললাম, মাসি-মা আমি দূর্গা সাগর সম্পর্কে কিছু জানতে এসেছি, দিলীপ রাজাকে পাওয়া যাবে কিনা? তার মেয়ে উত্তর দিলেন, তিনি এখন বাড়িতে নেই। তবে অপেক্ষা করলে দেখা হতেও পারে। আমি তাদের অনুমতি নিয়ে কিছু ছবি তুললাম। মেয়েটি পুরানো নকশা করা গ্লাসে দুধ এবং প্লেটে মুড়ি-বাতাসা নিয়ে এসে আমাকে বসতে বললো। নিজেকে কিছুটা সময়ের জন্য রাজকীয় আতিথেয়তায় হারিয়ে ফেললাম।

এর মধ্যে বন্ধুটি চায়ের দোকানে বসে বারবার ফোন দিচ্ছে। অনেক সময় হয়ে গেল দিলীপ রাজার দেখা নেই। অবশেষে রাজবংশের রাজকন্যাই বলতে শুরু করল। তাঁদের রাজবংশ এবং পরগনার বিষয়ে।
চন্দ্রদ্বীপ রাজারা এখানে প্রায় ২০০ বছর রাজ্যত্ব করেছিলেন। মাধবপাশা বিভিন্ন গ্রামে সেসব রাজ-রাজাদের বাসভবনের ভগ্নাবশেষ আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । মাধবপাশার নয়নাভিরাম দূর্গাসাগর দীঘি সেই রাজাদেরই এক কীর্তি । বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ও দক্ষিণবঙ্গের প্রাদেশিক রাজধানী চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের প্রথম রাজা কন্দর্প নারারণ রায়। তিনিই এখানে প্রথম রাজ্য স্হাপন করেন। তাঁরই বংশধর দিলীপ রাজা হলেন রাজবংশের বর্তমান বংশধর। ২০১৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজবংশের ১৬তম ও সর্বশেষ রাজা সতীন্দ্র নারায়ণ রায় (দীলিপ রাজার পিতা) ১১০ বছর বয়সে মারা ইহকাল ত্যাগ করেন।

১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে এই দীঘিটি খনন করেন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যেও পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ণ রায় । বাংলায় বারো ভূইয়ার একজন ছিলেন তিনি । স্ত্রী দূর্গাবতীর প্রতি ভালোবাসার গভীরতা প্রমাণের জন্যই নাকি তিনি রাজকোষ থেকে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে দীঘিটি খনন করান। তাদের বংশধর নিয়ে এবং স্হানীয়ভাবে বসবাস নিয়ে তিনি বলেন, কয়েক দশক আগে যখন রাজ শাসন বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাদের সবাই ভারতে পাড়ি জমায়। পরবর্তীতে তারা আবার নিজ ভূমিতে ফিরে আসে।

বর্তমানে দিলীপ রাজা দূর্গাসাগর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। বিভিন্ন সময়ে তিনি দূর্গাসাগরের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। দিলীপ রাজার মেয়ে জানান, বর্তমান পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন দূর্গাসাগর প্রকল্পের জন্য তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। সেই বরাদ্দ অর্থ দিয়ে দূর্গাসাগরের সংস্কার কাজ করা হবে।

স্হানীয় দাবি রয়েছে, দূর্গাসাগর যেন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। দূর্গাসাগরকে কেন্দ্র করে যেন এখানে আবাসিক হোটেল-মোটেল এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। ইতিহাসের সাথে মিল রেখে, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে এখানে একটি জাদুঘর এবং গবেষণাকেন্দ্র স্হাপনেরও দাবি জানান তারা। তারা বলেন, দীর্ঘিটি সংস্কারসহ পাড়ে পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য পর্যাপ্ত রেস্টহাউস এবং পাখিদের অভয়ারণ্য নির্মান ও দীঘিতে যাতায়াতের জন্য বোডসহ ভাসমান ব্রীজ নির্মিত হলে প্রতি বছর হাজার হাজার দেশিবিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটতো এখানে। এর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেত । পাশাপাশি রক্ষা করা সম্ভব হতো প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন কীর্তি।

স্হানীয়দের কাছে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, কথিত আছে রানী দূর্গাবতী একবারে যতোদূর হাঁটতে পেরেছিলেন ততোখানি জায়গা নিয়ে এ দীঘি খনন করা হয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এক রাতে রানী প্রায় ৬১ কানি জমি হেঁটেছিলেন । রানী দূর্গাবতীর নামেই দীঘিটির নাম করণ করা হয় দূর্গাসাগর দীঘি। তবে এটাও বলা হয়, দূর্গাদেবী প্রজাদের পানির সমস্যা দূর করতে রাজা শিব নারায়ন রায়কে দিয়ে এই দীঘি খনন করিয়েছেন।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী দীঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্হিত। এর ২৭ একর ৩৮ শতাংশ জলাশয় এবং ১৮ একর ৪ শতাংশ পাড় । পাড়টি উওর-দক্ষিনে লম্বা ১,৪৯০ফুট এবং প্রশস্ত পূর্ব-পশ্চিমে ১,৩৬০ ফুট। কালের বিবর্তন ধারায় দীর্ঘিটি তার ঔজ্জ্বল্য কিছুটা হারিয়েছে। দূর্গাসাগরকে পাখির অভয়ারণ্যও বলা হয়। সরাইল ও বালিহাঁসসহ নানান প্রজাতির পাখি দীঘির মাঝখানে ঢিবিতে আশ্রয় নেয় । সাঁতার কাটে দীঘির স্বচ্ছ স্ফটিক জলে । কালে কালে দীঘিটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জেলা বোর্ড ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে এটির সংস্কার করে । স্বাধীনতা উওরকালে ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী আবদুর বর সেরনিয়াবাত দীঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন । এ সময় তিনি তৎকালীন বরিশাল জেলা প্রসাশক নুরু আহাদ খানের সহযোগিতায় দূর্গাসাগর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দীঘির মাঝামাঝি স্হানে অবকাশ যাপনকেন্দ্র নির্মাণের জন্য মাটির ঢিবি তৈরি করা হয়।

দীঘির চারপাশে নারকেল,সুপারি, শিশু, মেহগিনি প্রভৃতি বৃক্ষরোপন করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয় । দিঘির চারপাশে চারটি সুদৃশ্য শানবাধানো ঘাট থাকলেও পূর্ব-দক্ষিন পাশের ঘাট দুটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। পশ্চিম পাড়ে ঘাট সংলগ্ন স্হানে রয়েছে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো । ইচ্ছা করলে ভ্রমনকারীরা এখানে অনুমতি নিয়ে রাত কাটাতে পারে ।

এখানে রয়েছে বেশ বড় আকারের সিমেন্টের প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন ঘাটলা এবং দীঘির মাঝে সুন্দর একটি দ্বীপ যেখানে শীতকালে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। পাখিদের অভয়ারণ্য এই এলাকা। দীঘির পাড়ে সরু রাস্তা, মাঝে মধ্যে বসার বেঞ্চ, ঘন সবুজ বিভিন্ন ধরনের গাছও এই দীঘির সৌন্দর্য বর্ধনে ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া যেসব সৌখিন ব্যক্তি মাছ ধরতে পছন্দ করে, তাদের জন্য এখানে রয়েছে টিকিট কেটে মাছ ধরার ব্যবস্হাও। বলা হয়ে থাকে, এখানে অনেক সময় মাছ শিকারে ৪০ থেকে ৪৫ কেজি ওজনের মাছও ধরা পড়েছে।

প্রতিদিন কোনো না কোনো স্কুল-কলেজ বা যে কেউ এখানে বনভোজনে ছুটে আসে। এছাড়াও পরিবার বা বন্ধুবান্ধন নিয়ে এখানে আসলে মনটা উদার হয়ে উঠে। শুধু তাই নয়, কেউ যদি নিরালায় প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে চায়, তবে তার জন্য এই দূর্গাসাগরই সেরা স্হান।

যেভাবে যাবেন ইতিহাসের সাক্ষীর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে

বরিশাল জেলা শহর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে এই মাধবপাশা ইউনিয়ন । দেশের যেকোনো স্হান থেকেই বরিশাল এসে সেখান থেকে বাসসহ যেকোনো ছোট যান নিয়ে চলে যযাওয়া যায় সেখাসে। সেখানে সরকারি ডাক বাংলোয় বিশেষ অনুমতি নিয়ে না থাকতে পারলে সন্ধ্যার পূর্বে ফিরে আসতে হবে বরিশাল।