গর্ডনে গ্যালো গড

এডওয়ার্ড অশোক অধিকারী

মস্‌মন থেকে মিলিটারি রোড ধরে এগোচ্ছি – ব্রিজ ক্রস্ করে সিটি গন্তব্য। ক্রিমন পার হওয়ার পর পরই এক মহিলার হাতের ইশারায় ব্রেক করলাম। ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ ব্রেক করে সাইড চাইলে যা হয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। কয়েকটা হর্ন খেলাম, গায়ে মাখি নি। মহিলা হন্তদন্ত দরজা খুলে ধপ্পাস্ করে পেছনের সিটে বসে বললো, “গওদোন প্লিজ”। ইস্ট-এশিয়ান এই মহিলার “গওদোন”উচ্চারণ আমার বুঝতে কষ্ট হলো না। বুঝলাম ‘গর্ডন। বুঝলে লাভ হবে কী? এক ট্রাফিক সিগন্যাল যেতেই ফ্যাকাশে চেহারায় অপরাধীর মতোই জিজ্ঞেস করলাম, “আমি নতুন চালক, আজ আমার দ্বিতীয় দিন, তুমি কি দয়া করে আমাকে বলবে, এখান থেকে কোন পথ ধরলে গর্ডনের সহজ নাগাল পাওয়া যাবে?

মিলিটারি রোডের এই জায়গাটা সব সময়ই ব্যস্ত। তার ওপর মহিলার ব্যস্ততা দেখে ম্যাপ দ্যাখারও সাহস পাচ্ছি না। এদিকে আমার পথ না চেনার অজ্ঞতাকে মনে হচ্ছে সহজভাবে নিচ্ছেন না আমার এই নাক বোঁচা খদ্দের। চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। সেই অসভ্য অবয়ব আমার নব্য উইকেন্ড টেক্সি চালকের অন্তরে দ্রিম-দ্রিম হাতুড় পেটা করছে। ভয়, শঙ্কা, সংকোচের এক মিশ্র দহন, যেন বুশ ফায়ার ভেতরে।

এক সময় মহিলা বললো, ঠিক আছে, আমাকে নর্থ সিডনি স্টেশনে নামিয়ে দাও। মরণ আর কী! এখান থেকে নর্থ সিডনি ট্রেন স্টেশনে যেতেও যে আমার খবর হয়ে যাবে। আমি বুঝতে দিলাম না। রোড সাইন দেখে কোনোভাবে ক্যাতরাতে-ক্যাতরাতে নর্থ সিডনি স্টেশনের পাশের এক রাস্তায় এসে কাঁচুমাচু করছি। আমার সম্মানিতা কাস্টমার থামতে বলে, মিটারে ওঠা সাত ডলার নব্বই সেন্টস গুনে-গুনে দিয়ে বিদায় নিলো। ঘটঘট করে হেঁটে সামনের রাস্তা ধরে আমার চোখের আড়াল হলো। এই সার্ভিসে আমি বকশিস আশা করি নি।

টেক্সি স্কুলে তিন মাস ক্লাস করে গণ্ডায়-গণ্ডায় পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছি, রাস্তায় নেমে দেখি সব আউলা-ঝাউলা। নিজেকে ধিক্কার দিলাম। নব্যতাকে তিরস্কার করলাম। বুঝলাম, নতুন-নতুন সব কিছুই টাইট। পুরানো হলে ঢিলেঢালা, সহজ।

গাড়ি পার্ক করাই ছিল। নভেম্বর মাসের শেষ প্রায়। এমনিতেই গরম তার ওপর প্রতিবারই অচেনা কাস্টমার হ্যান্ডেল, অচেনা ডেস্টিনেশন। শরীর ঘেমে যায়। বোতলের পানি অর্ধেক করে ফেললাম। গাড়ির সামনের দুই সিটের কেচকি থেকে স্ট্রিট ডিরেক্টরি বের করে মিলিটারি রোড থেকে গর্ডন যাওয়ার সহজ পথ-পাঠ্যে মনোযোগ দিলাম। ম্যাপ খুলে আমার মাথায় হাত! আমার সামনের রাস্তাই প্যাসিফিক হাইওয়ে। নাক-চোখ বুজে চালালেইতো গর্ডন। হিসাব করে দেখলাম পথও কম না। ২০-২৫ ডলার ভাড়াতো হবেই। কষ্ট পেলাম। ভুলে গেলাম খানিক পরে। ওই রাস্তাতেই আরো কয়েক মিনিট জিড়িয়ে গাড়ি আবার স্টার্ট দিলাম। কিছুটা সামনে এগিয়ে ডানে মোড় নিলাম। সাথে-সাথে একটা হাত জাগলো আমাকে উদ্দেশ্য করে। সেই হাত-জাগা খদ্দেরের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া। সেই একই বোঁচা মহিলা। বাচ্চাদের মতো কয়েক মুহূর্তের জন্য ইনিমিনি মানিমো… করে ফেললাম। থামবো না, না থামবো। যা আছে কপালে, থামলাম। মহিলা দরজা খুলেই সেই আগের সুরে ‘গওদোন’। আমার দিকে তাকাতেই যেন তার বুক কেঁপে উঠলো। মনে হলো এখনোই চিৎকার করে বলবে, বাঁচাও, বাঁচাও! আমাকে আচমকা প্রশ্ন ‘তুমিই কি সেই বালক, যে আমাকে মিলিটারি রোড থেকে তুলে এখানে নামিয়ে দিয়েছিলে?’ আমি ভাবলাম, ‘ইয়েস’বললেই দরজা খুলে জাম্প দেবে। আমার খাড়া জবাব, ‘নো! মোটেই না!’
আবার প্রশ্ন, তুমি কি গর্ডন চেনো?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এক পথ, প্যাসিফিক হাইওয়ে, তুমি কোনো চিন্তাই করো না।

বুকে আমার অসীম সাহস। এ সাহস যুগিয়েছে স্ট্রিট ডিরেক্টরি। একশ ভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। নাছোড়বান্দা মহিলা আবার আমাকে বললো, ‘একজন ড্রাইভার আমাকে মিলিটারি রোড থেকে তুলেছিল কিছুক্ষণ আগে, সে গর্ডন যাওয়ার পথ চেনে না। সে বলছে, সে নতুন ড্রাইভার। সে দেখতে তোমার দেশের লোকের মতনই। ’আমি বললাম, ‘হতে পারে। আমার দেশী অনেকেই টেক্সি চালায়। দেখতে তো আমারই মতন হবে। তাছাড়া নতুন ড্রাইভার নদীর এপারে এলে যকৃতের মতো প্যাঁচগোচ রাস্তা দেখে দিশেহারা হয়ে যায়। তুমি কিছু মনে করো না। আমি ওর পক্ষ হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। ’

আমার গাড়ি প্যাসিফিক হাইওয়ে ধরে চলছে গর্ডনের পথে। মহিলার সাথে আবার নতুন করে গালগপ্প শুরু করলাম।

আজকের আবহাওয়া ভালো, কিন্তু ভীষণ গরম। এসব টুকটাক কথার ফাঁকে জানলাম, সে জাপানি। আমি জাপানে ছিলাম চার বছর। ভাষাটা বলতে পারি। শুরু করলাম। মহিলা অবাক এবং খুশি। নিজের ভাষায় কথা বলার লোক পেয়ে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলো সে। বুঝলাম, আমার প্রতি তার যে “শার্লোক হোমস-এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা দূর হয়েছে।
হাসি-তামাশায় একটার পর একটা সাবার্ব ক্রস করছি। আমার দৃষ্টি গর্ডন। মনে আছে, গর্ডনের আগের সাবার্ব কিলারা। ম্যাপে তাই দেখলাম। এক সময় কিলারা অতিক্রম করে অভিজ্ঞ চালকের মতো কলার ঝাড়া ভঙ্গিমায় বললাম, এর পরই গর্ডন।
মহিলা আমার সাথে আরো গল্প করতে চাইছে, তাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, এই প্যাসিফিক হাইওয়ে ধরে তাকে নিউ ক্যাসেল নিয়ে গেলেও বিরাগ হবে না।

এক সময় গোল সাইনবোর্ডে গর্ডন লেখা দেখতে পেলাম। আবার অভিজ্ঞ চালকের মতো প্রশ্ন, ‘তুমি গর্ডনের কোথায় নামবে?’ মহিলা বললো, ‘আমি বলবো, তুমি চালাও।’

মনে-মনে ভাবলাম, বাঁচা গেল। কোনো রাস্তার কথা বললে তো আবার ঘামতে হতো আমাকে। এই সুন্দর গাহেক-বিক্রেতার সম্পর্কে আবার ভূমিকম্প, সব চৌচির হয়ে যেত।

গর্ডন স্টেশনের উল্টো দিকে সেন্ট জোন্স এভিনিউতে আমাকে লেফট মারতে বললো। বেশ কিছুটা ভিতরে গিয়ে আমাকে থামতে বললো আমার কাস্টমার। মিটারে উঠা ১৯ ডলার ভাড়া, সে আমাকে দিলো ২৫ ডলার। গাড়ি থেকে বের হলো মহিলা। আমিও পর্বত বিজয়ের ভঙ্গিতে বাইরে বের হলাম। জাপানি কায়দায় বার বার মাথা নত করে ধন্যবাদ জানিয়ে মহিলা বিদায় নিলো।
এই সুন্দর ও স্বচ্ছ সার্ভিসে আমি আমার কাস্টমারকে খুশি করতে পেরেছি।

আমাদের দেশে ব্যবসায় একটা কথা আছে, ‘গাহেক লক্ষ্মী’। ইংরেজরা বলে, ‘Customers are King’ আর জাপানিরা বলে, ‘অকিয়াকসামা খামিসামা’, যার অর্থ, ‘খদ্দের প্রভু বা গড’। আমি আমার গডকেই গর্ডনে পৌঁছে দিলাম। গর্ডন থেকে ফেরার পথে তাই-ই মনে হচ্ছিল।