(গত কিস্তির পর)
অধ্যায় :৪
বারবার প্রচলিত ইতিহাসচর্চায় বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় ‘বঙ্গবন্ধু’ একটি অনিবার্য নাম। যাঁকে কেন্দ্রে করে বাঙালির জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রভাবিত হয়েছে এবং গতি পেয়েছে। ইতিহাসে তিনি অবিসংবাদিত এক নেতারূপেই আখ্যাত হন। তাঁকে ইতিহাসবিদগণ বাংলাদেশের রূপকার বা স্হপতি এমন কি বাঙালি জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর ওপর ‘বর্তমানে প্রায় ৬০০টি বই বাজারে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশ থেকে প্রায় ৪০টি বই প্রকাশিত হয়েছে,…বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রায় ৪/৫ হাজার প্রবন্ধ/নিবন্ধ দৈনিক, সাময়িকী ও সংকলন বের হয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থপঞ্জি শিরোনামে সর্বশেষ আবু মো. দেলোয়ার হোসেনের সর্বশেষ সংস্করণে যে বই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বের করেছে তাতে ৪৭০০ বইয়ের তালিকা রয়েছে। আর ১৯৯৮-এ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু চর্চা শিরোনামে কেবল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রণীত গ্রন্হপঞ্জিতে বইয়ের সংখ্যা ১০০০টি।
বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলেই চলে আসে বঙ্গবন্ধুর নাম। মুক্তিযুদ্ধের সব প্রচলিত ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু তাই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। লিখিত ইতিহাসে তথ্যের বিকৃতি বা উপস্হাপনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে যতই ছোট বা হেয় করার প্রয়াস চালানো হোক না কেন, লোকসংস্কৃতি তথা লোকইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে যথার্থ সম্মানের সাথে আবেগের সাথে সংরক্ষণ করছে। সেখানে কোনো বিকৃতির ঠাঁই নেই বরং একজন নেতার চেয়ে অনেক মহান করে উপস্হান করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। লোকসঙ্গীতে, লোকছড়ায়, শ্লোগানে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের দেশপ্রেম, জাতীয় চেতনা। ১৯৭১-এর জনমানসে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন মহানায়ক, জাতীয় চেতনা ও মুক্তির প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ মাসে তাঁর অনুপস্হিতি একবারও অনুভব করেনি মুক্তি পাগল বাঙালি জাতি। অথচ এই নয় মাস তিনি বন্দি ছিলেন-পাকিস্তানের কারাগারে। তবু লোককবিদের প্রতিটি ইভেন্ট বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু অত্যাবশ্যকভাবে উঠে এসেছেন। বারবার লোককবির বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে আমরা সমার্থক হিসেবে দেখতে পাই। যে কারণে বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসচর্চায় মুক্তিযুদ্ধের এমন কোনো বই কল্পনা করা যাবে না যেখানে বঙ্গবন্ধু নেই। তাঁর শত্রুরা যতই সমালোচনা করুন না কেন বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে তারাও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করতে সমর্থ হবেন না।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উন্মেষ তার শুরুও হয়েছিলো ১৯৪৮-এ বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে। ভাষাসৈনিক অলি আহাদ বলেন-“সেদিন (১০ মার্চ) সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছাতেন তা হলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না।”
১৯৪৮-এর ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে তিনি জেলে ছিলেন। জেলের ভেতরে তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ ও বন্দিমুক্তির দাবিতে অনশন শুরু করেন। তাঁর অনশন ও গ্রেফতার এত গুরুত্বপায় যে ২৭ ফেব্রুয়ারি গণদাবির মুখে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গটি খুব কম আলোচিত হয়েছে ইতিহাসে কিন্তু লোককবি এখানে সৎ ও মহৎ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে অধিকাংশ সময় জেলে বন্দি রাখা হয় যাতে আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে। কিন্তু জেলের ভেতরেও তিনি ছিলেন সোচ্চার । এই প্রসঙ্গে লোককবি বলেন-
‘রাজপথ ফেটে পড়ে
মিছিলের ডাক,
ছাত্র-জনতা আঁকে
বাংলা বর্ণের ছক।
নূরুল আমিন গুলি চালায়
মিছিলের’পরে
সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত
শহীদের কাতারে।
শেখ মুজিব ছিলেন তখন
জেলখানায় বন্দি
আন্দোলন চালাতে বলেন
নাই কোনো সন্ধি।।’
৪.১ লোকগানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ
লোকসংস্কৃতির একটি অংশ লোকসাহিত্য। লোককাহিনি, লোকগীতিকা, ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন, হেয়ালি, লোকবিশ্বাস, লোকবক্তৃতা, লোকগাথা, লোকনাম, লোকসঙ্গীত প্রভৃতি লোকসাহিত্যের এক একটি নিদর্শন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে লোকসঙ্গীতে যে সব ধারা বিদ্যমান তার মধ্যে আছে- ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, আলকাপ, গম্ভীরা, মারফতি, মুর্শিদি, জারি, সারি, বাউল, নীলের গান, ভাষার গান, দেশের গান, স্বরাজের গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধের গান, কীর্তন গান, যাত্রাগান, পালাগান, ধুয়াগান ইত্যাদি। এসব লোকগানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি আঙ্গিক হলো দেশের গান। শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের মধ্যে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে তাতে উজ্জীবিত হয়ে লোকমানসে সৃষ্টি হয় দেশ প্রেমমূলক লোকসঙ্গীত। এই ধারার গানগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বরাজেরগান, ভাষার গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধের গান ইত্যাদি। এসব লোকগানের রচয়িতা লোককবি বা লোকশিল্পিগণ। অজ্ঞাত নামা এসব লোককবির গানে আবহমান বাংলার লোকসমাজ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতার পরিচয় আমরা পেয়ে যাই। ‘কোন জাতি উৎকর্ষের কোন স্তরে আছে, তা সে জাতির সঙ্গীতের দ্বারাই পরিমাপ করা যায়’। অর্থাৎ সঙ্গীতের উৎকর্ষ অপকর্ষই জাতির ও জাতীয়তার সাংগঠনিক পরিচয়ের প্রমাণ বহন করে। বাংলাদেশের ইতিহাস যেমন নানাভাবে তার প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে তেমনি লোকগানের মধ্যেও সেই ইতিহাসের প্রাণবহাটি সঞ্চারিত হতে দেখতে পাই। যুগ যুগ ধরে একটি দেশ বা জাতি তার শোষণের নির্যাতন নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তাদের গানে তাই নীল বিদ্রোহ, পলাশীর যুদ্ধ স্মৃতি, তে-ভাগা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনের কথা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া ভাষা আন্দোলন, এগার-দফা, ছয়-দফাসহ মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ লোক গানে ধরা পড়ে যায়।
লৌকিক জীবন নির্ভর সাধারণ সঙ্গীতের একটি সমাজ সচেতনতামূলক গান। এ পর্যায়ে অন্তভর্ুক্ত হয়-গম্ভীরা আলকাপ, হাবুগান ইত্যাদি।
পূর্ব বাংলার মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নেবার দাবিতে যখন রাজপথ উত্তাল তখন আলকাপ গানে লোককবি বলেন-
‘আইউব খানের মার্শাল’ল
ইবলিশ বরাবর
’৫২’র ভাষা আন্দোলন
জিন্নার গায়ে জ্বর।’
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি তার স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন করে। ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসন জারি, ১৯৬৬’র ছয়-দফা কর্মসূচি, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এই সংগ্রামের পথকে প্রশস্ত করেছিলো। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে পাক-বাহিনী ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করার ষড়যন্ত্র শুরু করে যার প্রেক্ষিতে তারা ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট নামে বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত অসংখ্য শহীদের রক্ত, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। ১৯৪৭’র দেশ ভাগের সময় থেকে ১৯৭১-এর দেশ স্বাধীন হওয়া কালীন বাঙালির জাতীয় জীবনে যে সিনেমাটি মঞ্চস্হ হয়েছে তার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এ সময় পূর্ব-বাংলার সমস্ত আশা আকাঙক্ষার মূর্ত প্রতীকে রূপান্তরিত হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ব্যতীত বাংলাদেশের কথা চিন্তা করা যেন অসাধ্য ছিলো। ইতিহাসে, কবিতায়, গানে বঙ্গবন্ধু একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের অধিপতি এমন নন, সমগ্র বাঙালির মননে-সত্তায় বঙ্গবন্ধু অনিবার্য এক মহামানবের নাম। সেই সময় বঙ্গবন্ধু তাই মুক্তিযুদ্ধ এমনকি বাংলাদেশের সমার্থক হয়ে উঠে ছিলেন।
আলকাপ গানের বন্ধনা অংশের ছড়ায়-
“৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কথা
শুনেন যতো শ্রোতা
পিছন দিকে পড়া আছে
আরো কিছু কথা শুনেন যত শ্রোতা।
বাংলাদেশের কথা।
উনিশশো সত্তুর সনে
এ্যাহিয়া খানের নির্বাচন তো দিলো
ম্যালাই সিটে ম্যালাই ভোটে
আওয়ামী লীগ পাস কইরা গ্যালো
এ্যাহিয়া খান ক্ষ্যামোতা দ্যায় না
সল্লাহ করব্যার ধইরলো বায়না।
শেখ মুজিবুর রহমান
এই সল্লাহ পোরধান…।”
জেলখানায় বন্দি হবার পরেও বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে আন্দোলন চালিয়ে যাবার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তাও উঠে এসেছে-আলকাপ গানে-
‘শেখ মুজিব ছিলেন তখন
জেলখানায় বন্দি
আন্দোলন চালাতে বলেন
নাই কোনো সন্ধি।’
পূর্ব-বাংলার প্রাণ ভোমরা যে বঙ্গবন্ধু তা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বেশ ভালো- ভাবেই বুঝতে পেরেছিলো। তাকে বন্দি করতে না পারলে বাঙালিকে ধ্বংস করা যাবে না, এটা বুঝতে পেরে তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে। ইয়াহিয়া, টিক্কা খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো সেই ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক। ভুট্টোই ইয়াহিয়াকে কুমন্ত্রণা দেন বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করার। এই ষড়যন্ত্র ও হৃদয়হীন নিষ্ঠুর বর্বর কুচক্রান্তের বর্ণনা উঠে এসেছে লোকসঙ্গীতে। এসব কাহিনিকে স্মরণ করে রচিত হয় জারি গান। কারবালার শোকাবহ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নৃত্যগীত সহকারে যে কাহিনি পরিবেশিত হয় তাকে সাধারণভাবে জারিগান বা শোক-সঙ্গীত বলে। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে জারিগান ব্যাপক প্রচলিত। জারিগান পরিবেশন মঞ্চে থাকেন একজন বয়াতি, তার সহযোগী গায়েন, একদল নৃত্যশিল্পী-দোহার। মুক্তযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালির শোকাবহ ঘটনাও উঠে এসেছে লোককবি ছোরাব আলীর জারিগানে।
‘ইয়াহিয়ার গৃহবাস
ভুট্টো ক্ষেতে করছে সর্বনাশ
ইয়াহিয়া ভুট্টা খাইয়া
করছে এখন হায় হুতাশ।
ভুট্টো যখন ঢাকায় আইল
ইয়াহিয়ারে বুঝাইল
শেখ মুজিবকে বন্দি কর
বাঙালির প্রাণ কর নাশ।।’
সিরাজগঞ্জের হরিণা গোপাল বাগবাটী গ্রামের গণহত্যা নিয়ে কবি জয়নাল রচনা করেন জারিগান-
‘সেই একাত্তরের মে মাস
মনে পড়ে করুণ ইতিহাস
ও পাকসেনারা করে ঘেরাও বাগবাটী
শত শত লাশ
৩১শে মে মাসে ঘটনা মঙ্গলবারে
পাকসেনারা ভোর পাঁচটায় গণহত্যা করে
ওরে লুটতরাজ আর অগ্নি শিখায়
কালো হয়ে যায় বাতাস।।
এ প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গেছে এমন নয়, যেন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়েই তারা যুদ্ধে গেছে। বিষয়টি উঠে এসেছে এভাবে-
‘শেখের ডাকে সাড়া দিয়্যা
মুক্তিযুদ্ধে গেনু
যুদ্ধ চলাকালীন বাড়ির
খবরটা পাইনু।
আবেদারে রাজাকারে
ধর্ষণ পরে হত্যা করে
এই পৈশাচিক ঘটনাটা
বলতে চোখে আসে বন্যা।’
এভাবেই জারিগানে উঠে এসেছে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আর বর্বর পাকবাহিনি ও তার দোসর রাজাকারদের নির্মম অত্যাচারের শোকাবহ ঘটনা। এই নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ শেখ মুজিব। তার ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মুক্তি পাগল মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শুধু জারিগানেই নয়, বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধকালীন দুর্দশা, দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভিক্ষে না খেতে পাওয়ার করুণ কাহিনি উঠে এসেছে ধুয়াগানে। বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক গান হচ্ছে ধুয়াগান। তবে সারা বাংলাদেশে ধুয়াগান প্রচলিত। এ গান চলে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে ধুয়াগান প্রাণ পায়। ধুয়া গানের মূল উদ্দেশ্য হলো-‘বাতুনী’ বা গোপন তত্ত্বসমূহের উৎঘাটন করা। এই গানের বিষয়বস্তু বা উপজীব্য সাধারণ জীবন-যাপনের অবস্হা হইতে আরম্ভ করিয়া সমাজনীতি, ধর্মনীতি, অধ্যা্ত কথা বিভিন্ন শাস্ত্র কথা, হাস্য-রসিকতা প্রভৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত। মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রেক্ষাপট’ রচিত হয়েছে শুকূর মাহমুদ-এর ধুয়াগানে এভাবে-
‘২৫ শে মার্চে রাত্রিতে শেখ মুজিবুরকে এরেস্ট কইরা
ধইরা নিল আইয়ুব সরকারে,
বন্দি আমার থাইকা মুজিব ডাইকা বলে বাঙালি
তোমরা একিন দেলে থাক সকলি
ঘরে ঘরে দুর্গ এবার হায় গইড়া তোল সকলে।’
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকবাহিনি আর দেশের রাজাকারদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুর জেলবন্দি জীবন ও দেশ স্বাধীনের চিত্র অংকিত হতে দেখি এমন একটি ধুয়াগানে। দেশ স্বাধীন হবার পরেও বঙ্গবন্ধু দেশে না ফিরলে বাংলার মানুষের হৃদয়ে আকুতি ধরা পড়ে এসব গানে-
‘আহারে আল্লাহর নামে দাঁড়াইলাম ভাই
আমি সবার কাছে দোয়াচাই
আমার সমান মুরুখ আর নাই।।
ওরে আল্লা-নবীর নামটি লইয়ে
জয় বাংলা হুমকার মেরে
এবার আমরা স্বাধীন পাইছি ভাই
তবু যাহার জন্যে কাইন্দা মরি
সে তো রয় বিদেশের বাড়ি
তাহার জন্য কান্দিতাছে মুক্তিরা সবাই।।
জেলবন্দি জীবনে বঙ্গবন্ধুর নির্যাতনের করুণ চিত্রটি দেখা যায় লোককবি ছোরাব আলীর ধুয়া গানে উঠে এসেছে এভাবে-
‘আর এদিকে শেখ সাহেবেরে দিয়া জেল ঘরে
ইয়াহিয়া বলে জেল দারোগারে
কাইল সকালে ফাঁসে দাও তারে।
আগে কবরখানা তৈয়ার কর
পরে তারে ফাঁসে মারো
মাটি দিয়া রাখব এই দেশে।
আমার বঙ্গবন্ধু কাইন্দা বলে
মার আমায় এই দেশেতে
তবু আমি বলছি পাছে
আমার মরা লাশটা নিয়া দিয়ো বাংলার বুকে।
আর আমার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আছে
তারা বড় আশা কইরাছে
আমার সনে দেখা করিবে।’
শেষ পর্যন্ত দেশের মুক্তি পাগল মানুষের হৃদয়ের আবেগ ভালোবাসা আর প্রার্থনার জয় হয়। মৃত্যুকে জয় করে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় পা রাখেন। লোককবি ছোরাহাব আলী আবেগে আপ্লুত হয়ে তাকে বাংলার নয়ন মণি উপাধি দেন। গেয়ে ওঠেন-
‘আহারে বাংলার নয়ন মণি আসলেন বাংলাতে
পৌষ মাসের ২৫ তারিখে বেলা ১টা ৪০ বাইজাছে
তখন তিনি আসেন ঢাকাতে।
অধম ছোরাহাব আলী ভাইবা বলে
এতদিন কোথায় ছিলে?
তোমার সোনার নৌকা ডুবল সাগরে।
তুমি ডুবা নায়ের মাঝি হইয়া
সাগর দিয়া যাওনা বাইয়া
বাংলার লোক দেখুক চাইয়া
শেখ সাহেবের ডুবা তরী লাগল কিনারে।’
দেশ স্বাধীন করা মানে শুধু দেশকে শত্রুমুক্ত করা নয়-বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্ত করাও বটে। তাই কবি অনন্ত কুমার দেব গেয়ে ওঠেন-
‘আল্লা আমার সহায় আছে-
আইসো কমর বান্দি
ইয়াহিয়া টিক্কা ভুটো
যাইবে এবার কান্দি।
ওমাক ক্যারকাত ফ্যালেয়া
শত্রু দিমু যে খ্যাদেয়া
বাংলাক স্বাধীন করিয়া।
বঙ্গবন্ধুক হামরা এবার
মুক্ত করমো ভাই।।’
ভাওয়াইয়া গান যেমন আবর্তিত হয় মৈষাল বন্ধুকে কেন্দ্র করে তেমনি বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে যুদ্ধকালীন ভাওয়াইয়া। সেখানে বাংলার বাঘ হলেন বঙ্গবন্ধু। অনন্ত কুমার দেব-এর কণ্ঠে শুনতে পাই-
‘ওরে বাবা নাটুয়া চান
জীবন থাকতে আর না দিম মুই
আজাকারোতে নাম।।
মোক ডাঙ্গায় মোর বাপক ডাঙ্গায়
মোর আরও ডাঙ্গায় ভাই।
কাল্লা ঘুরি দেখং মোর
সুন্দরী বউ নাই।
তওবা তাহের করমু এ্যালো
মোরে বাঁচান জান
আগ পাছ না ভাবিয়া দিবোং
আজাকারোত নাম,
বাংলার বাঘ যে আছে বাঁচি
শেখ মুজিবুর রহমান।
বুঝবার পাইনাই এ্যাই দোষ হইবে
আর না কইম পাকিস্তান।।’
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিজয় গাঁথা নিয়ে রচিত হয়েছে ভাওয়াইয়া। সেখানেও বর্ণিত হয়েছে নির্যাতনের করুণ চিত্র।
‘বিজয়ের এই দিনে ভাইরে
আরে ও ভাইয়া শোনেন সমাচার
কিভাবেতে হইল স্বাধীন
বাংলাদেশ হামার ভাইরে।।
বিখ্যাত ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের রচয়িতা কাছিম উদ্দিনের গানেও বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানাপ্রসঙ্গ। ভাওয়াইয়া যেমন মৈষাল বন্ধুর গান তেমনি ভাটিয়ালি হলো নৌকোর মাঝির গান। মানবিক বেদনা বিষাদ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুখ-দুঃখের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় ভাটিয়ালি গানে। নিঃসঙ্গ মাঝির বোবাকান্না সুর হয়ে মনের রুদ্ধবাতায়ন মুক্ত করে বেরিয়ে আসে নীলাকাশের নৈসর্গিক পরিবেশে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওড়, বাঁওড় বেষ্টিত এক বিশাল ভূ-খণ্ডের নাম ভাটি অঞ্চল। নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিছু অংশ ভাটিঅঞ্চলের অন্তভর্ুক্ত ছাড়া ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশালও ভাটিঅঞ্চল। এ গানের মূল বৈশিষ্ট্য হল-মাঝি, নৌকা, দাড় ইত্যাদি বিষয়ের অবতারণা অবসম্ভাবী। এছাড়া ভাটিগানে পুরুষ মানুষের অর্থাৎ নায়কের দুঃখ-কষ্ট-বিরহ-ব্যথা ও প্রেমই প্রধান হয়ে ওঠে।
মাঝি বিস্তৃর্ণ জলাভূমিতে নৌকা ভাটিতে ছেড়ে দিয়ে অলস হাতে হাল ধরে থাকে। এ সময় তার অখণ্ড অবসর। এই অবসরে মাঝি আপন মনে গেয়ে ওঠে ভাটিয়ালি গান। তালবিহীন দীর্ঘলয়ের এই গানে ফুটে ওঠে তার মাঝি জীবনে সুখ-দুঃখ, কর্ম ও অভিজ্ঞতার কথা : প্রেম-বিরহের কথাও।
এগানে বিষয় ‘বৈচিত্র্য বিশেষ নেই কিন্তু ভাবের গভীরতা ও সুরের মাধুর্য শ্রোতার মনকে আন্দোলিত করে। তাই এ গানের আবেদন এখানেই।
লোকগীতি বা লোকসঙ্গীতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল তার রূপ বা আঙ্গিকের পরিবর্তন। লোকগীতি অনেক সময়ই পরিবর্তনের ধর্মকে স্বীকার করে-সে প্রাচীন রূপ ত্যাগ করে যুগোপযোগী রূপ গ্রহণ করে। ৩৩ লোক মানসের সঙ্গে সংযোগ স্হাপন করাই হল লোকগানের মূল বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যের জন্য সৃষ্টিকর্ম অর্থাৎ তৈরি করা, তা গ্রহণ করা, বর্জন করা আবার সংযোজন করে পরিমার্জিত রূপে গ্রহণ করা অর্থাৎ জবপৎবধঃরড়হ (তৈরি+গ্রহণ+বর্জন+গ্রহণ) লোকগীতির প্রধান ধর্ম। এইভাবে ১৯৭১-এ প্রচলিত ভাটিগানের সুরের আশ্রয়ে তৈরি হয়েছে-১ মুজিব বাইয়া যাওরে…’ নামক গণ-সঙ্গীত।
প্রচলিত গান-‘মাঝি বাইয়া যাওরে অকূল দরিয়ার মাঝে
আমার ভাঙ্গা নাওরে মাঝি বাইয়া যাওরে।’
এর সুরে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে তরুণ কণ্ঠশিল্পি মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের কণ্ঠে প্রচারিত হয়-
‘মুজিব বাইয়া যাওরে নির্যাতিত দেশের মাঝে জনগণের নাওরে-
মুজিব রে…।’
এই জনপ্রিয় গানটির রচয়িতা সরদার আলাউদ্দিন মতান্তরে মোহাম্মদ শফি (বাঙালি)।
গানটি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের জন্য রচিত হলেও শেষ পর্যন্ত এটি বাঙালির আশা-আকাঙক্ষা, তীব্র জীবন বোধ নিয়ে সার্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এটি হয়ে ওঠে বাংলার স্বতঃসিদ্ধ একটি লোকসঙ্গীত।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণে যে আকাঙক্ষা, দেশ রক্ষার ব্রত নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া সৈনিকের যে অদম্য মনোভাব তার প্রেরণা ও উৎসাহ দাতা একজন ‘শেখ মুজিব’। তিনি তাই কারো কাছে জাতির পিতা, কারো কাছে বঙ্গবন্ধু, কারো কাছে ইন্দ্র-চন্দ্র, মহানায়ক, কারো কাছে ভগবান, দেবতা ইত্যাদি অভিধা পেয়েছেন।
লোককবির গানেও তিনি ধরা পড়েছেন-কখনো মাঝি রূপে, কখনও নয়ন মণি রূপে কিংবা চির সম্রাট হিসেবে। মুজিব বাইয়া যাওরে গানটির রচয়িতা কোনো লোককবি না হলেও গানটিতে বিবর্তনের যে রূপ আমরা পাই তাতে এটি লোকগান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ বিবর্তন সম্পর্কে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বলেন-‘…আমার একটা গান আছে “আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে/প্রাণ বিনোদিয়া” আমার লাইনটা ছিল “আর কত কাল রাখব আমার মনরে বহিয়া।” ওরা করে নিয়েছে-“আর কতকাল রাখব যৌবন বুকে পাথর দিয়ারে।” দুম করে তারা তাদের মনের মতন কইরা বদলে নিয়েছে।
এরকম একটি গান, ‘মুজিব বাইয়া যাওরে…’
রচয়িতার একটি স্তবক প্রচলিত গানে পাওয়া যায় না।
শুরুতে একটি স্তবকে গীতিকার লিখেছিলেন-
‘অত্যাচারীর উৎপীড়নে দিক না যতই ব্যথা
সাত কোটি বাঙালির প্রাণে
মুজিব তুমি নেতা রে।।
কিন্তু সর্বাধিক প্রচলিত গানে এই স্তবকটি নেই। বরং বাঙালির পরিবর্তে ‘বাংলার’ এবং ‘নেতার’ পরিবর্তে ‘সম্রাট’ রূপে গীত হয়েছে। অর্থাৎ সাত কোটি বাঙালি বলা হলে যেন আয়তনটা সঙ্কীর্ণ হয়ে যায় কিন্তু ‘বাংলার’ বললে এর ব্যাপ্তি এতটাই প্রকাশ পায় যে, বঙ্গবন্ধুকে সেখানে সম্রাট হিসেবেই বেশি মানায়। শিল্পীর কণ্ঠে তাই শুনি-
‘তুমি বাংলার চির সম্রাট
অন্ধকারের শশী।’
সেই সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লোকসমাজে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে তা ইতিহাসের যুক্তিকে অতিক্রম করে গেছে। সাহিত্যের মুজিব, কবিতার মুজিব, ইতিহাসের মুজিব, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুজিব যতটা যৌক্তিক, যতটা নেতা, যতটা রাষ্ট্র নায়ক, মুক্তিপাগল আমজনতার কাছে শেখ মুজিব তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। তিনি মহানায়ক নন; তিনি ভাঙ্গা নৌকার মাঝি, চিরকালীন সম্রাট, তিনি দুর্যোগের ঘনকালো আকাশে অন্ধকারের শশী বা চাঁদ। বাংলার সমার্থক শব্দ হিসেবে বঙ্গবন্ধু নির্যাতিত মানুষের পথ প্রদর্শক।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানটি-
‘মুজিব বাইয়া যাওরে…
নির্যাতিত দ্যাশের মাঝে
জনগণের নাওরে…’
১. মুজিব রে…
ছলে কলে চব্বিশ বছর
রক্ত খাইলো চুষি
জাতিরে বাঁচাইতে যাইয়া
তুমি হইলা দোষী রে…
২. মুজিব রে…
নিজের জ্বালা হৃদয় কালা
শোকে কালা মুখে
কথায় কথায় চালায় গুলি
বাঙালিদের বুকে রে…
৩. মুজিব রে…
আকাশ কান্দে বাতাস কান্দে
কান্দেরে বাঙালি।
নিপীড়িত মানুষ কান্দে
মুজিব মুজিব বলে রে…
৪. মুজিব রে…
বাঙালিদের ভাগ্যাকাশে
এলো কালো নিশি
তুমি বাংলার চির সম্রাট
অন্ধকারের শশী রে…
অন্যদিকে অজ্ঞাত শিল্পীর কণ্ঠে এই গানটি বদলে যেতে শুনি এভাবে-
মুজিব বাইয়া যাও রে…
নির্যাতিত দ্যাশের মাঝে
জনগণের নাও রে…
(তোমার ভাঙ্গা নাও রে…)
১. মুজিব রে…
ছলে কলে চব্বিশ বছর
রক্ত খাইলো চুষি।
জাতিরে বাঁচাইতে যাইয়া
তুমি হইলে দূষী রে…
২. মুজিব রে…
বাঙালিদের ভাগ্যাকাশে
এলো দুঃখের নিশি
তুমি বাংলার চির সম্রাট
অন্ধকারের শশী রে…
৩. মুজিব রে…
আকাশ কাঁন্দে বাতাস কাঁন্দে
কাঁন্দেরে বাঙালি,
নির্যাতিত মানুষ কাঁন্দে
মুজিব মুজিব বলি রে…
‘লোকগীতি সংহতি চেতনার পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাই শোষক-শাসকের শ্রেণির স্বার্থের পক্ষে এ বিপদজ্জনক।’ আর এ জন্য লোকগানের সুরাশ্রয়ী অনেক গান মুক্তির আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য সেই সময় রচিত হয়েছিলো। সুর, স্বর ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত এ গানগুলো পরিপূর্ণ লোকগানের মর্যাদা না পেলেও বৃহত্তর লোকজীবনের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলো যা মুক্তি-পাগল বাঙালির সংগ্রামকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছিলো। এ গানগুলোকে বলা হয় গণ-সংগীত।
গণসংগীত প্রসঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন-‘স্বদেশ চেতনা যেখানে গণচেতনায় মিলিত হয়ে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতার ভাবাদেশের সাগরে মিশলো সেই মোহনাতেই গণ-সংগীতের জন্ম।’ সলিল চৌধুরীর মতে- ‘শ্রমজীবী মানুষের আশা-আকাঙক্ষা সংগ্রামের সাংগীতিক ইতিহাসই হলো গণ-সংগীত।’ হীরেন ভট্টাচার্য বলেন-‘সাধারণভাবে বলতে গেলে মেহনতি জনগণের আন্দোলনের গানই গণ-সংগীত।’
সাইম রানা বলেন-‘বাংলার কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়, প্রতিবাদ আন্দোলন ও উজ্জীবনে তাদের রচিত ও গৃহীত সামগ্রিক সংগীতই বাংলাদেশের গণ-সংগীত।’
গণ-সংগীতের সংজ্ঞার দিকে লক্ষ রাখলে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়- ‘আন্দোলন শ্রমজীবী মানুষের’-আকাঙক্ষা-শ্রমজীবী মানুষের-অতএব এ আন্দোলনকে বেগবান করতে, এই আকাঙক্ষাকে শক্তিশালী করতে শুদ্ধ ও পরিশীলিত সঙ্গীত সক্ষম নয়। লোক ভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা, লোক সুর যা শ্রমজীবীর হৃদয়কে যতটা স্পর্শ করতে পারে শুদ্ধ ও পরিশীলিত সঙ্গীত ততটা পারে না। আর এ জন্য-মুক্তি-পাগল মানুষকে, সৈনিককে উৎসাহ দেবার জন্য রচিত হয়েছিলো অসংখ্য গণ-সংগীত। সেই সময় চারণ কবি মোসলেম ইয়াহিয়ার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষামূলক গান রচনা করেন। –
মাতুব্বরি বেশি করা ভাল নয়।
অতিরিক্ত হইয়া গেলে, আস্তে তাহা খসে যায়।
ইয়াহিয়ার মাতুব্বরি; ক্ষিপ্ত হইল মিলিটারি
গুলি-গোলা ছোঁড়াছুড়ি, ঘর-বাড়ি জ্বালাইয়া দেয়,
অহংকারীর দস্তখত, দুর্দান্ত সাদ্দাদের মতো
জীবন ভরা স্বপন-সৌধ বেহেস্ত সুদ্ধ গোল্লায় যায়।।
আমজনতার কাছে স্বাধীনতার স্বপ্ন আকাঙক্ষা যতটা গভীর ততটাই গভীর বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার প্রতিফল হিসেবেই যেন স্বাধীনতার ঘোষণা। বিচার গানের কবি আবদুল হালিম গেয়ে ওঠেন-
জাতির পিতা মহান নেতা (তাঁরে) ছাড়বি কিনা বল
বন্দিশালার ভাঙব তালা বাঙালি ভাই চলরে চল।।
শোন বলিরে ভুট্টো মিয়া শেখ সাহেবরে দাও ছাড়িয়া
না হয় থাক সাবধান হইয়া আসিতেছে পাগলা ঢল।
বাংলার লোকসমাজে বঙ্গবন্ধু কলি যুগের অবতার, তিনি হিন্দু এবং বৌদ্ধ, তিনি শিখ এবং শুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়ী চেতনার মহান নেতা হিসেবে লোকসমাজে পূজিত, সম্মানিত। তিনি মুক্তিদাতা হিসেবে এসেছেন বাঙালির ভুল শুধরে দিতে। ইতিহাস শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলতে পারে, বড়জোর মহানায়ক বা জাতির পিতা বলতে পারে কিন্তু অবতার বলার ক্ষমতা কোনো ঐতিহাসিক রাখেন না, এ কেবল লোককবির পক্ষেই সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে সাইম রানা বলেন-‘গ্রাম বাংলার অগ্রদূত জারিয়াল-কবিয়ালদের গানে মুজিব কিভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, তাঁর পরিপ্রেক্ষিত একেবারেই ভিন্ন। তাঁরা সব কিছুর মধ্যে চিরায়ত দর্শন বা ধর্মের ধারাকে প্রতিস্হাপন করেন, এবং যে-কোনো ইতিহাস বা ঘটনাকে পৌরাণিক মানদণ্ডে উপস্হাপন করেন।’ কবিয়াল মোসলেম উদ্দিন গজলের ঢং-এ যখন পরিবেশন করেন-
‘ভাগ্যবর্তী মেয়ে তুমি, মা ভাগ্যবতী মেয়ে,
তোমার বুকে বঙ্গবন্ধু এলো দয়াল রূপ ধরিয়ে।।
ধর্মকে করতে সংস্কার, হরণ করতে ধরণীর ভার।
অবতারি হইয়ে এসো নরাকারে দয়াল আমার
আঁধারে যায় আলোক দিয়ে।।
তোমাকে করিতে উদ্ধার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর,
ঘর-বাড়ি ছাড়িয়ে আজ ২৪ বছর পথে পথে
মহা দুঃখ শিরে লইয়ে।।
২৫ মার্চের রাত ১২ টায় সোনার বাংলায় গুলি চালায়
নির্দয় নিষ্ঠুর হইয়ে দুষ্ট ইয়াহিয়ার ষড়জালে
বঙ্গ বন্ধু থাকলেন বন্দি হইয়ে।’
এই দেশমাতার বুকে বঙ্গবন্ধু মানুষ রূপে নয় অবতার রূপে, দয়াল রূপে এসেছেন। দয়াল ঈশ্বরেরও সমার্থক। যুগ যুগ ধরে অবতারগণ যুগ স্রষ্টাগণ সে রকম মুক্তির বাণী নিয়ে জগতে এসে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেন। বঙ্গবন্ধুও একইভাবে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ ভোগ করেন, কারাবরণ করেন। অবতার না হলে এমন কী কখনও সম্ভব হয়?
আবদুল হালিম বয়াতি বঙ্গবন্ধুকে ঈদের চাঁদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে জেলবন্দি করলে বাঙালির অন্তরে কতটুকু হাহাকার তৈরি হয় তা হালিম বয়াতির গান শুনলেই বোঝা যায়।
১. বাঙালি জাতির পিতা মহান নেতা শেখ মুজিবুর।
বিনা দোষে শেখ সাহেবরে বন্দি করল জেলের ভিতর।
২. কোথায় রইলা বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা থুইয়া
অর্ধনমিত নিশানে তোমার বেদন যাচ্ছি গাইয়া।।
৩. বঙ্গবন্ধুর মহানবাণী ভুলব না
রমনা মাঠে অকপটে করেছিলে কল্পনা।
৪. জাতির পিতা মহান নেতা তুমি যে মহান
তুমি বাংলার শিরোমণি যেমন ঈদের চাঁন।।
৫. মায়ের কান্দনে কাঁন্দে বনের পশু পাখিরে
লাগল পুত্রের শোক কলিজায় রে।।
আর এক লোক শিল্পী মোমতাজ আলী খানের কথায় মোস্তফা জামান আব্বাসীর সুরে গীত একটি গানে বঙ্গবন্ধুকে-মাঝি বলা হয়েছে যিনি হাল ধরে আছেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি টানছে বৈঠা।
জয় বাংলা জয় বাংলা বলে
সব আয় রে বাঙালি
সোনার বাংলা স্বাধীন হইয়াছে।
ময়ূর পঙখি নৌকা মোদের ঠেকছিল চড়ায়
এখন নয়া যুগের বান ডাইকাছে বাংলার দরিয়ায়
এবার সাত কোটি লোকটানছে বৈঠা
বঙ্গবন্ধু হাল ধইরাছে।।
কিংবা অজ্ঞাত কবির লেখা-রবীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া গানে-
ও আমার বাংলাদেশের মাঝি ভাই
জয় বাংলা বলিয়া আইসো
রঙিন পাল উড়াই।।
ও মাঝি ও, ওরে ছয় দাঁড়েতে
নৌকা চলে মুখে আল্লাজী
ওরে বাঁকা নায়ের হাল ধইরাছে
গোপালগঞ্জের মাঝি।।
ও মাঝি ও, গোপালগঞ্জের নায়ের মাঝি
বাংলাদেশের নাইয়া
সে যে সব দুঃখীরে পারকইরা দেয়
জয় বাংলা গান গাইয়া।।
৪.২ লোকছড়া ও কবিতায়
লোক সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান লোকছড়া ও কবিতা। ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের কথা ব্যক্ত হয় লোকছড়ায়। লোকসংগীতে যেমন-মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি বিধৃত হয়েছে তেমনি লোকছড়া ও কবিতায়ও উঠে এসেছে অত্যাচারিত মানুষের মর্মের কথা, স্বাধীনতার আকাঙক্ষার কথা। অজ্ঞাত নামা লোককবিদের রচিত ছড়ায় ও কবিতায় উঠে এসেছে-ক্ষোভ, ১১ দফা, ৬ দফা, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির মুক্তির কথা।
মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে রচিত নিরক্ষর গণ-মানুষের জাতীয় চেতনা জাগানিয়া এই সব ছড়া ও কবিতাও ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্যতা রাখে।
অত্যাচারী শাসক ও শোষক-ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, আইয়ুব খান, আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে নিয়ে রচিত ব্যঙ্গাত্মক লোকছড়া তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। যেমন-
এহিয়ারে ধর
ড়ুর মধ্যে ভর
ড়ু গেলো ভাইঙ্গা
হিয়া দিলো কাইন্দা।।
দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নিজেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন এবং সামরিক শাসন জারি করেন। তার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে এবং ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় যার ফলে ছাত্রদের দাবি মানতে বাধ্য হন। এই সময় স্বৈরশাসক আয়ুব খানকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয় ব্যঙ্গাত্মক লোকছড়া।
আয়ুব খান গরু চোর
বেড়া ভাইঙ্গা দিল দৌড়।
বেড়ায় ছিলো কাঁটা
মারল সবাই ঝাঁটা।
ঝাঁটায় ছিলো বিষ
দেশ ফিরাইয়া দিস।
এভাবে রচিত হয়-
টিক্কা-আইয়ুব খান
কাইটা দিমু কান
কানের মোতা মোটা
ফিক্কা মারো নোটা।
কিংবা – নিয়াজীরে নিয়াজী
তোরে খামু পিয়াজী
তোরে দিমু শিক্ষা
বুড়িগঙ্গায় ফিক্কা।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লোকছড়া গণ-চেতনায় রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বলতে ইতিহাস-টুঙ্গিপাড়া বা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরকে সনাক্ত করলেও লোককবির কাছে তা নয়। লোককবির কাছে শেখ মুজিবের বাড়ি মানে সারা বাংলাদেশ। নির্লজ্জ বেহায়া টিক্কা খান এখানে ভিক্ষা করতে আসে। লোক ছড়ায়-
ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা
য়াল মাছের দাড়ি
ক্কাখান ভিক্ষা করে
খ মুজিবের বাড়ি।
লোকছড়া ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লোককবিরা রচনা করেছেন লোককবিতা। এসব কবিতা অঞ্চল বিশেষ এক এক নামে পরিচিত। সম্প্রতি ‘ভাট-কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে হাসান ইকবালের বইয়ে সংগৃহীত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কিছু ভাট-কবিতা। লোকসাহিত্যের একটি গৌরবোজ্জ্বল ধারা লোককবিতায় স্বদেশ চেতনা বা জাতীয়তাবাদকে মূর্ত হতে দেখতে পাই। লোকগানের মতোই লোককবিতায় ইতিহাস চেতনা ছড়িয়ে গেছে আবেগময় ভাষায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত পঙতি :
পানির তলে পক্ষী/শেখ মুজিবর লক্ষ্মী।
স্বাধীনতার আকুতিতে হাছেন আলী সরকার লেখেন-
“জয় বাংলা জয় বাংলা বলে উড়াব আজ ন্যায় নিশান
ব না আর নত মোরা গাইব এবার স্বাধীন গান।
ত্যের বাণী তুলব ধরে যা হয় তা হবে পরে
কব না আর অন্ধকারে নাম খলাতে পাকিস্তান।”
নরসিংদীর জেলার ভাট-কবি আজিজুল হক তার দীর্ঘ কবিতায় ভাষা আন্দোলন, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর অবদান থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নানা রকম বিষয়-আশয় তুলে ধরেছেন আবেগময় ভাষায়।
১৯৭০-র নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ায়-একাত্তরে শুরু হয় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ।
‘একাত্তরে শেখ মুজিব দিল বজ্রসারা
ঙালিরা হইয়া উজ্জীব যুদ্ধে নামলো তারা।
জিবকে বন্দি করলো মোনাফেক বেইমান
জিবকে বন্দি কইরা নিলে পাকিস্তান
ঙালিরা মুক্তি ফৌজ হইল দলে দলে
ই সব মনে হইলে ভাসি নয়ন জলে।
রত যাইয়া যুদ্ধ শিখায় জেনারেল ওসমানী রে…
রে দারুণ পাকিস্তানি।’
ইতিহাস বর্ণনায় যেমন কোনো তথ্য বিচ্যুতি নেই তেমনি মিথ্যার সাথে আপসের চেষ্টাও নেই লোককবির।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ইতিহাসে যে ছেলে-খেলা, কাদা-খেলা তার কোনো স্হান নেই লোককবির বয়ানে। প্রায় সকল লোককবি স্বীকার করেছেন স্বাধীনতার যে আহ্বান, যে ডাক, যে ঘোষণা তা বঙ্গবন্ধুই দিয়েছেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েই বাঙালি মায়ের দামাল ছেলেরা মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যুদ্ধে। লোককবি বলেন-
‘মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়া বাঙালির সন্তান
ক্তি ফোজ হইলে যাইয়া হিন্দুস্তান।
রত মোদের অস্ত্র দিল আরো দানা পানি রে-
রে দারুণ পাকিস্তানী।’
ভাট-কবি আমির আলী ‘ছয়-দফা’ আন্দোলনের যে বর্ণনা দেন তাতে উঠে এসেছে জনমানসের সজীব চিত্র।
‘ছাত্ররা জ্বইলা উঠে বাঁশের লাঠি লইয়া হাতে
শ্চিমাগোর মাথায় মার, জয় বাংলা স্বাধীন কর।
য়গো ভুট্টোর গালে জুতা মার, বাংলা স্বাধীন কর।
য় দফার এক দফা ছাইড়া দেব না গো
গো ছয় দফাতেই হইল গণ্ডগোল।
রেস্ট কইরে নিয়ে যায় আওয়ামী লীগের বল।’
মুক্তিযুদ্ধের সজীব ও সাবলিল বর্ণনা-
‘গড়ছে মুক্তিসেনা যায় না চিনা বাংলার সন্তান
‘জয় বাংলা’ বলিয়া যত হিন্দু-মুসলমান।
থায় টিক্কার দলে মাইরা চলে সামনে যারে পায়
গল হইয়া গেল মানুষ পাঞ্জাবির জ্বালায়।
হাতে অস্ত্র নিল তৈয়ার হল মুক্তি সেনা নামে
গেরিলা সাজিল দেশে টিক্কা নাহি জানে।।
… … … … … …
যত হানাদাররা ফাঁপর তারা খাইয়া মুক্তির মাইর
গুঁতার চোটে ভাঙছে তাদের বত্রিশ দাঁতের পাইর।’
ভাট-কবির মৌখিক ইতিহাসে রাজাকারের প্রসঙ্গটিও বাদ যায় না।-ইদ্রিশ আলী তাঁর কবিতায় রাজাকারের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করেন এভাবে-
“কে বুঝে সাঁই তোমার লীলা, বাংলাদেশের ১৯ জিলা
ঘটাইল কী হত্যালীলা এহিয়ারাবণ।
রাজাকার কাহাকে বলে, শুনছিনা ভাই কোনো কালে
দেখাইল এই পশুর দলে রাজাকার কেমন।
রাজাকার হয় দেশের ভাই চিনতে কারো বাকি নাই
সোনার বাংলা হৈল ছাই তাদেরি কারণ।
… … … … … …
রাশিয়ায় মার্কসবাদী যে চেতনা ফোকলোরকে একটি সংগ্রাম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে ছড়িয়ে পড়েছিলো তেমনি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনাও ছড়িয়ে পড়েছিলো মুক্তির সংগ্রামে। এই লোকঐতিহ্যের সাহায্যে যত দ্রুত ও কার্যকরভাবে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও প্রবণতা ছড়িয়ে দেয়া যায় খুব সম্ভব আর কোনো মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া যায় না। এ কারণে যুদ্ধ পরবর্তী সময় লোকছড়ার আঙ্গিকে সৃষ্টি হয়েছিলো কালজয়ী কিছু ছড়া; যেমন- সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের-
ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কা
নিয়াজী,
এক টেবিলে খাচ্ছে বসে
পিয়াজি,
গোলাম আজম চা দিচ্ছে
টিক্কা গোঁফে তা দিচ্ছে
‘বাঙালিদের রক্ত খামু
দেখমু জীব;
ঠিক তখনই গর্জে ওঠেন
শেখ মুজিব।’
রাশিয়ায় মার্কস পন্হীরা তাদের সংগ্রামকে ফোকলোরের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা চালান এবং প্রলেতারিয়েত ফোকলোর সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেন। একইভাবে বাংলাদেশে মুক্তযুদ্ধকালীন লোকসংস্কৃতি এবং যুদ্ধ পরবর্তী লোকসংস্কৃতির আঙ্গিকে সৃষ্ট কৃত্রিম সাহিত্য চর্চা অব্যাহত থাকলে বাঙালি জাতি প্রকারন্তরে লাভবান হতো।
ইতিহাস বিকৃতির যে খেলা ১৯৭৫-এর পরে শুরু হয়েছিলো তার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যেত।
(চলবে)