মোগল সম্রাট আকবর হচ্ছেন বাংলা সনের প্রবর্তক। ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলা সন চালু হয়েছিল সম্রাটের ক্ষমতা-গ্রহণের ২৯ বছর পর। বাংলা সন আসলে কৃষকদের সন। কৃষকরা এই সনের বিভিন্ন মাসকে ধরে নিয়ে ফসলের বীজ বুনতো এবং ফসল কাটতো। যেহেতু শুরুতে বাংলা সন গণনা করা হতো চান্দ্র বছর ধরে, তাই সম্রাট আকবর দেখলেন খাজনা দিতে গিয়ে মাস ঠিক থাকলেও প্রতিবছর কৃষকরা পিছিয়ে পড়ছেন বেশ কিছুদিন। তিনি দেখলেন, চান্দ্র বছরের মাস প্রতিবছর এগিয়ে গেলেও কৃষকের ফসল তোলার সময়টা এগোচ্ছে না। ফলে আকবরের সভাতেই এ নিয়ে বিতর্ক হয়। বিতর্কের জের ধরে আকবর দায়িত্ব দেন সভাসদ বিজ্ঞ ফতেহ সিরাজীকে। তিনিই হিজরি ৯৯২ সনে (১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে) বাংলা সনকে চান্দ্র বছর থেকে সৌর বছরে উন্নীত ক’রে সমস্যার সমাধান করেন। হিজরি সনের সঙ্গে বাংলা সনের একটি ঐতিহাসিক মিল রয়েছে, অর্থাৎ হিজরি ৯৬৩ থেকে বাংলা সন ৯৬৩ ধরে নিয়ে বাংলা সন গণনা শুরু হলেও এর উৎপত্তি ঘটেছিল আরো অনেক পরে। সূর্য ও চন্দ্রের ওপর নির্ভর ক’রে দুধরনের সন/বছর হিসেবে গড়ে উঠেছে। একটি হচ্ছে, সৌর বছর আর অন্যটি হচ্ছে চান্দ্র বছর। সৌর বছর হচ্ছে ৩৫৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড, আর চান্দ্র বছর হলো ৩৪৫ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড। এতে দেখা যায় যে, চান্দ্র বছর প্রতি এক সৌর বছর থেকে ১০/১১ দিন আগে শেষ হয়। সেই হিসেবে সৌর বছর থেকে চান্দ্র বছর প্রতি ৩৩ বছরে সৌর বছর থেকে ১ বছর এগিয়ে যায়। চান্দ্র বছর হিজরি ৯৬৩ সন থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হলেও বাংলা সন পরবর্তীতে চান্দ্র বছর না থেকে সৌর বছরে রূপান্তরিত হয়। বিখ্যাত `আকবরনামা’য় বর্ণিত আছে যে, ৯৬৩ হিজরি সনের ২ রাবিয়াস সানি, শুক্রবার (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি) মোগল সম্রাট আকবর মসনদে আরোহণ করেন। মোগল সাম্রাজ্যের মসনদে বসার ২৫ দিন পর ষষ্ঠ বিংশতি দিবসে ২৮ রাবিয়াস সানি হতে এলাহী সনের গণনা শুরু হয়। অন্যদিকে বাংলা সনের গণনা শুরু হয় একই হিজরি সনে অর্থাৎ ৯৬৩ সনে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল। তাহলে সম্রাট আকবর হিজরি ৯৬৩ সন থেকে বাংলা সন গণনা শুরু করলেও আমরা কেন বলি যে, বাংলা সনের উৎপত্তি হিজরি ৯৯২ সন অর্থাৎ ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ?
১ বৈশাখ – বাংলা নববর্ষ। নতুন বছরকে বরণ ক’রে-নেয়ার লক্ষ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই নিজস্ব স্বকীয়তায় আলিঙ্গন করে বৈশাখকে। এই নতুন দিনের আগমনে সাঁওতালরা আগাম প্রস্তুতি নেয় বরণ ক’রে-নেয়ার জন্য। মাদল, বাঁশি, বেহালা, করতাল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনায় এবং হাণ্ডি (পচানি) সেবন ক’রে আনন্দে নেচে-গেয়ে স্বাগতম জানায় ১ বৈশাখকে। এলাকার নির্দিষ্ট জায়গায় সমবেত হয়ে যে অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, তাকে সাঁওতালি ভাষায় পাতা (A festival in honour of Mahadeo. Mahadeo – the Hindu Deitz Mahadeo) বলে। অর্থাৎ এটি হিন্দুদের উৎসব। কীভাবে এই সাঁওতাল আদিবাসীরা হিন্দু অভিধায় যুক্ত হয়েছেন? ইতিহাস থেকে জানা যায়, এদেশে আর্যদের আগমনের পূর্ব হতে এ অঞ্চলে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করতো, যাদের বলা হয়েছে অনার্য। ধর্ম বলতে যা বোঝানো হয়ে থাকে, তা হিন্দুধর্ম প্রবর্তনের পূর্বে কোনো ধর্ম না থাকায় আদিবাসীরা মূলত কোনো ধর্মাবলম্বী ছিলেন না। আদিবাসীরা নিজেদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি উৎসবাদি, পার্বণ ইত্যাদি নিজস্ব আঙ্গিকে উদ্যাপন করতো। বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু প্রভৃতি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান যেভাবে তারা কঠোরতার সঙ্গে মেনে চলেছে, কালক্রমে সেগুলোই সামাজিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর্যগণের সামাজিক ব্যবস্থা তাদের চেয়ে শ্রেয়তর হওয়ায় আদিবাসীদের বিভিন্ন দল ও গোত্রের অংশবিশেষ হিন্দুধর্মের প্রতি ধীরে-ধীরে দুর্বল ও আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। হিন্দুধর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি কিন্তু আদিবাসীদের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটে নি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা ক্রমশই হিন্দুধর্মের রীতি-নীতি মান্য করা এবং তাদের ন্যায় পূর্জা-অর্চনা, পার্বণ আয়োজন করতে থাকে এবং এভাবেই স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে (by naruralisarion) তারা নিজেদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে ভাবতে থাকে এবং অপরদিকে হিন্দুগণও আদিবাসীদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী জ্ঞান করতে থাকে। হিন্দুদের সঙ্গে অনেক সময় আদিবাসীদের বিয়ে হয় এবং এভাবেই তারা হিন্দুধর্মে আত্মীকরণকৃত (assimilated) হয়। পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি যে, স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্টের ৯৭ নং ধারায় যে সকল আদিবাসীর কথা (সাঁওতাল, বানিয়া, ভুইয়া, ভূমিজী, ডালু, গারো, গন্দ, হাদি, হাজং, হো, খারিয়া, খারওয়ার, কোচ (ঢাকা বিভাগ), কোরা, মগ (বরিশাল জেলা), মাল ও সুরিয়া পাহাড়িয়া, মেচ, মুণ্ডা, মুণ্ডাই, ওরাঁও এবং তুরী উল্লেখ করা হয়েছে, তারা সকলেই এভাবে হিন্দুধর্মে অন্তর্ভুক্ত (absorbed) হয়েছে এবং যেহেতু তারা সকলে স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশে বসবাস করছে, তাই তাদের সকলেই হিন্দু মিতাক্ষরা আইন দ্বারা শাসিত।
চৈত্রের শেষ দিন অর্থাৎ ৩০ চৈত্রের সারা রাত ওই নির্দিষ্ট জায়গায় সাঁওতাল মেয়েরা সুন্দরভাবে নানা ঢঙে, নানা রকম পোশাকে শালীনতায়/অশালীনতায় এবং রুচিহীন ভাষায় হৈচৈ ক’রে থাকে; তবে বর্তমানে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। মেয়েরা গাছের ফুল, ডাল দিয়ে খোপা সাজায়, কানে ফুল গুঁজে রাখে। এ সময় কেউ-কেউ মন্দ আত্মাকে, কুসংস্কার তাড়াতে ভাঙা হাঁড়ির গোলাকার অংশ, পশুপাখির শুকিয়ে কাঠ হওয়া শরীর এবং খড়ের তৈরি নানা রকম (পুতুল, জীবজন্তুর প্রতিকৃতি) তৈরি ক’রে লাঠিতে শক্ত ক’রে বেঁধে অনুষ্ঠানমুখী হয়। একনাগাড়ে অনুষ্ঠান চলে ১ বৈশাখের প্রথম প্রহর পর্যন্ত। বিকেলে শুরু হয় মেলা। সাঁওতালদের বিশ্বাস এই দিনটি প্রাণভরে উপভোগ করা হলে গোটা বছর আনন্দ-ফুর্তিতে কেটে যাবে। পাতার (বঙ্গাকে) পরই দেবতাকে পুজো উৎসব ক’রে সন্তুষ্টি রাখা হয়। পুজো উৎসর্গ করার পরই দেবতার আত্মাকে একজন সাহসী ব্যক্তির শরীরে মন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করানোর পর তার পিঠে শক্ত লোহার বড়শি দিয়ে তাকে আটকানো হয়। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে লোকটিকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে বিরাট একটি বাঁশের মাথায় বাঁধে এবং বাঁশটি মাটিতে পুঁতে খাড়া ক’রে ঝোলানো অবস্থায় বাঁশের চারদিকে ঘোরানো হয়। মেলার এটিই মূল আকর্ষণ।
পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দেয়ার পর পরই সব বয়সের সাঁওতালদের সমাবেশ ঘটে। বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মেলার জাঁকজমক বৃদ্ধি পায়। অনেক রকম খাদ্যসামগ্রী, শিশু খেলনা এবং যুবক/যুবতীদের দলবদ্ধ উল্লাস মেলাকে আকর্ষণীয় করে। এই সুযোগে কোনো ছেলে যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করতে চায়, তাহলে ওই ছেলেটি তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মেয়েটিকে জোরপূর্বক নিজ বাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য এটির উল্টোটিও কখনো-কখনো ঘটে থাকে। ছেলেকেও ঘটনার শিকার হতে হয়। এসব ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের কমবেশি পূর্ব থেকেই দেখা-সাক্ষাৎ ও জানা-শোনা থাকে। তবে লক্ষণীয় যে, অবশ্যই মেয়েটিকে তুলে-আনার সময় ছেলেটি প্রথমত মেয়েটিকে স্পর্শ করবে। পরবর্তীতে বাড়ি নিয়ে আসার পর মাথায় সিঁদুর লেপন করলেই স্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে থাকে। এরূপ বিয়েকে অর আদের বাপলা (or ader Bapla) বা ‘টেনে নিয়ে বিয়ে’ বলা হয়। সাঁওতাল সমাজ-রীতিতে এ ধরনের বিয়ে স্বীকৃত। মেলায় দু-একটি ঘটনার অবতারণা একেবারেই স্বাভাবিক। সাধারণত সাঁওতালদের মাঝে ‘অর আদের বাপলা’ মেলাকে কেন্দ্র ক’রেই ঘটে থাকে।
পাতা উৎসব কীভাবে শুরু হলো – এ সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত থাকতে পারে। কিন্তু আমি একজন সাঁওতাল খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় যাজকের কাছ থেকে যা জেনেছি, তা হচ্ছে, রাজা নেবুচাঁদনেজারের আমলে তিনি যে এক স্বর্ণময় প্রতিমা নির্মাণ করেছিলেন, তা তিনি বাবিল প্রদেশের দূরা সমস্থলীতে স্থাপন করেন। পরে দেশাধ্যক্ষগণ, মহাবিচারকগণ, ব্যবস্থাপকগণ, কোষাধ্যক্ষগণ, প্রতিনিধিগণ, ক্ষতিপালগণ, অধিপতিগণ প্রদেশসমূহের সমস্ত শাসনকর্তা এবং প্রজাগণ বাদ্যযন্ত্রের শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে স্থাপিত স্বর্ণময় প্রতিমাকে প্রণাম করে। কালক্রমে এই অনুষ্ঠানই না-কি সংশোধিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে চলে এসেছে। ১ বৈশাখের সঙ্গে আদৌ মিল আছে কি-না অনেকের সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক। তবে সাঁওতালরা বর্ষবরণ উৎসবের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থেকে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে উদ্যাপন ক’রে থাকে।
উত্তর বঙ্গের আরেকটি বৃহত্তম আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী উরাঁও। এই জনগোষ্ঠীও নিজস্ব রীতিতে বর্ষবরণ ক’রে থাকে। এদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে ফাগুয়া। ফাগুয়া শব্দটি তুর্কি শব্দ ফাগ থেকে এসেছে। ফাগ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ আবীর। উরাঁওরা উৎসবটি উদ্যাপন করেন ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। তাতে প্রচুর আবীর ব্যবহৃত হয়। আদিবাসী উরাঁওরা ফাল্গুনী পূর্ণিমায় পাহান বা তির্কী গোত্রের লোকজন এই পূজা/অনুষ্ঠান পরিচালনা ক’রে থাকে। পুজোর পুরোহিত সাদা ধূতি প’রে প্রস্তুত থাকেন পুজো দেয়ার জন্য। সাধারণত পুজো বাড়ির বাইরে কোনো এক ফাঁকা জায়গায় আয়োজন করা হয়ে থাকে। অবশ্যই পুজোর জন্য পুজো উপযোগী হয়ে জায়গাটিকে তৈরি করতে হয়। ফাগুয়া বা ফাগুন পুজোতে যে সমস্ত দ্রব্যের প্রয়োজন হয়, সেগুলো হচ্ছে, সিঁদুর, কলা, বাতাসা, তেল, দুধ, বেলপাতা, ধূপ, ফুল, চন্দন দূর্বাঘাস, ঘট, আগরবাতি, আতপ চাল, আমপাতার পল্লব প্রভৃতি। এবার পুজোর জায়গাটিতে তিনটি ভেল্লা গাছ পুঁতে রাখা হয়। এমনভাবে পুঁতে রাখা হয়, যা দেখতে মনে হবে একটি ঘর। ঐতিহ্য অনুযায়ী পুজোর কর্মানুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যায়। পুজো উৎসর্গকারী সেই ঘরের মতো জায়গায় বসে পুজো-অর্চনা ক’রে থাকেন। পুজো শেষ হতে-হতেই ইতোমধ্যে গ্রামের
লোকজনরা নিজ-নিজ বাড়ি থেকে শুকনো খড়ের আঁটি এনে পুঁতে-রাখা গাছের ডালে হেলান দিয়ে রেখে দেন। ডালপালার ওপরেও খড় ছড়ানো হয়। পাশাপাশি পুরোহিত খড়ে-ঢাকা কোনো একটি ডালের নিচে মোরগ বেঁধে রাখেন এবং এই সম্প্রদায়ের লোকজন ঢাক-ঢোল, বাঁশি, করতাল নিয়ে নেচে-গেয়ে উপস্থিত হন। পুজোর প্রথম পর্বে পুরোহিত কোনো একটি ডাল নিয়ে ডানদিক থেকে তিনবার নির্দিষ্টভাবে নির্মিত থান প্রদক্ষিণ করার পর খড়ের আঁটিগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেন। উপস্থিত উৎসুক জনতা এবং বিশ্বাসীরা চিৎকার ক’রে, মনে-মনে বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ ক’রে থাকেন নববর্ষের সকল অকল্যাণ, রোগ-শোক, দুঃখ-বেদনা, যন্ত্রণা যেন দূর হয়। পুজো চলাকালীন ঈশ্বর বা ভগবানের কাছে মনের অপূর্ণ ইচ্ছাপূরণের দাবি জানানো হয়। জ্বালানো আগুন নেভানোর পূর্বেই পুরোহিত বা তার সহযোগীরা পুঁতে-রাখা ডালের গোড়া পরিষ্কার ক’রে বেজোড় কোপে কেটে ফেলেন। ডাল কাটা সম্পন্ন হলে উপস্থিত জনতাকে জানানো হয় ফাগুয়া বা ফাগুন কাটা হয়েছে। খণ্ডিত ডালের একটি অংশ পুরোহিত বা তার সহযোগীরা নিজেদের কাছে রাখেন এবং অপর অংশটি অন্য জায়গায় পুঁতে রাখেন। এরপর আগুনের ছাই কেউ-কেউ কপালে, নাভিতে লাগিয়ে, ঘষে দিয়ে আগামী বছরের শুভ কামনা করেন। রোগ, শোক থেকে বাঁচার জন্যই নিজেদের চিহ্নতে চিহ্নিত ক’রে থাকে। যুবরা ছোট-ছোট কাপড়ের পুঁটলি তৈরি ক’রে কেরোসিন তেল দিয়ে আগুন ধরিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে আনন্দ প্রকাশ ক’রে থাকে, কোলাহলে মুখরিত হয় পুজোর স্থানটি। এই পুজোতে পাহান বা তির্কী গোত্রের যে সকল জামাই থাকে, তাদের বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ ক’রে নিয়ে আসা হয়।
প্রথম পর্বে ঘরের দেবতাকে খুশি ক’রেই অথাৎ শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রিয় মদের গ্লাসে নিজেদের সমর্পণ করে। মদ্যপান ক’রেই নববর্ষকে আলিঙ্গন করে। ফাগুয়া পরবের জন্য প্রত্যেক ঘরেই রাখা হয় মদ, অবশ্য এটির সঙ্গে থাকে পিঠাও। ঘরের দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য কোনো পুরোহিতের প্রয়োজন পড়ে না, নিজেদের মধ্যের যে কোনো প্রবীণ ব্যক্তিই পুজোর কাজটি সমাধা করতে পারেন। এটিকে মপ্তোঃকিতো বলা হয়। যে ঘরে এই পুজো করা হবে, সে-ঘরের কোণ ভালোভাবে লেপে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। তৈরি করা হয় থান। এই থানের সামনে পরিবারের কোনো প্রবীণ ব্যক্তি কুলায় ক’রে কাঁঠাল পাতা ৩টি, তেলের পিঠা ৩টি, এক ঘটি জল এবং এক ভাণ্ড মদ নিয়ে হাজির হন। তিনি পূর্বমুখী হয়ে পুজোর কাজ সম্পন্ন করেন। থানের ওপর রাখা কাঁঠাল পাতায় পিঠাগুলো রেখে দেন এবং পরিবারের অধিকর্তা নিজ এবং পূর্বপুরুষের মঙ্গল কামনা করেন। অতঃপর তিনি মদ ও পানি উৎসর্গ করেন। উৎসর্গীকৃত মদ নিজে পান করেন অথবা পরিবারের অন্য কাউকে প্রদান করেন। পুজো চলাকালীন কেউই মদ বা পিঠা স্পর্শ করতে পারে না। ঘরের নারীরা এই পুজোর মদ পান করতে পারে না, তাদের জন্য এটি নিষিদ্ধ।
উরাঁওদের ফাগুয়া উৎসবের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে শিকার-যাত্রা। যে বাড়িতে পূজা হয়, সে-বাড়ির জামাইদের শিকারে নিয়ে যাওয়া হয়। শিকারে যাওয়ার পূর্বে শিকার-যাত্রা সফল ও ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য ডান্ডা কাট্টা পূজা পরিচালনা করেন গ্রামের একজন বিশেষ পুরোহিত। তীর, ধনুক, লাঠি, ফালা, গজবাং প্রভৃতি নানা ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে শিকার-যাত্রার আয়োজন করা হয়। পূর্বাহ্নেই পুরোহিতকে জানানো হয় যে, তাকে শিকার-যাত্রার পুজো উৎসর্গ করতে হবে। এজন্য তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং রীতি অনুযায়ী চলে-আসা প্রথাগুলো মানতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। যেমন: সেদিন তিনি সকাল থেকে কোনো খাবার খেতে পাবেন না, শুধু জল ছাড়া। তার পরনে থাকবে গেঞ্জি ও ধূতি। পূজার সরঞ্জামগুলো হচ্ছে, তিনটি কাঁঠাল পাতা, সিঁদুর, মুরগির ডিম, ধূপ, আতপ চাল, কুলা এবং কলসপূর্ণ মদ। ঘরে আয়োজিত পুজোতে ডিমটি একটি বাঁশের মাথায় রেখে থানের সামনে রাখা হয়। পুরোহিত মদ পান ক’রে ডিমটি ভেঙে একটি বড় চামচে আতপ চাল মিশিয়ে আগুনে দেন। পূজায় রাখা মদ খাওয়া চলার সময় ডিম ও চাল মিশ্রিত খাবার সামান্য পরিমাণে হাতে-হাতে দেয়া হয়। কখনো বয়োবৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আবার কখনো যুবদের তা প্রদান করা হয়ে থাকে। যখন শিকারে যান, তখন গ্রামের কুয়োতে কাঁটা দিয়ে রেখে চলে যান শিকার-যাত্রীরা। অর্থাৎ শিকার থেকে ফেরত না আসা পর্যন্ত কেউই কুয়ো থেকে জল তুলতে পারবে না। এজন্য শিকারে যাওয়ার পূর্বেই সব কিছুর আয়োজন করতে হয়। সারা দিন শিকারে থাকার পর সন্ধ্যায় তারা প্রত্যাবর্তন করেন। কোনো কারণবশত যদি জীবজন্তু পাওয়া না যায়, তাহলে ঘরে এসে তার উপযুক্ত জবাব বা উত্তর প্রদান করতে হয়। কারণ সবাই উন্মুখ হয়ে থাকেন, শিকার থেকে নিয়ে আসা মাংস আনন্দসহকারে ভাগজোখ ক’রে খাবেন। মনোরথ ব্যর্থ হলে তো অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। কেউ-কেউ গানের মধ্য দিয়ে ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। এ সময় ঘরের লোকজন বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে সান্ত্বনা দিয়ে থাকেন। অপরদিকে শিকার থেকে শিকারি মাংস নিয়ে এলে, আসা মাত্র তাদের ঘটির জল দিয়ে পা ধোয়ানো হয় এবং হাড়িয়া বা মদ তুলে দেয়া হয়। শিকারের মাংস গ্রামের লোকজনের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করা হয়, প্রতিটি ঘরে চলে মাংস-ভোজন, মদপান ও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে হৈ-হুল্লোড়। কয়েকটি পঙক্তি হতে পারে, যেমন:
`সারহুলের চন্দ্রোদয়ে হৃদয় নৃত্য করছে,
ফাগুয়ার চন্দ্রোদয়ে হৃদয় নৃত্য করছে,
পূর্ণিমার চন্দ্রোদয়ে হৃদয় নৃত্য করছে,
চন্দ্রের ক্ষীয়মাণতায় হৃদয় ব্যথাহত হচ্ছে,
নববধূর আগমনে হৃদয় নৃত্য করছে,
দেবর দর্শনে বধূর হৃদয় নৃত্য করছে,
পূর্ণিমার চন্দ্রোদয়ে হৃদয় নৃত্য করছে,
পূর্ণিমার ক্ষীয়মাণতায় হৃদয় ব্যথাহত হচ্ছে।’