লোকজীবনে বঙ্গবন্ধুর প্রভাব

রঞ্জনা বিশ্বাস

(গত কিস্তির পর)
অধ্যায় : 

 

লোকসংস্কৃতি লোকজীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতি। একটি সমাজের বিশ্বাস, আচার, প্রথা, ঘটনা, তার নাচ, গান, ছড়া, কবিতা ইত্যাদি সৃষ্টি ও ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করলেও এসব সৃষ্টি সেই সমাজের সকলের সম্পদ বলেই গণ্য হয়ে যায় বলে তা লোকসংস্কৃতি হিসেবে পরিচিতি পায়। পবিত্র সরকার বলেন-‘লোকজীবন যত বহুধা বিস্তারিত, লোকসংস্কৃতি ততটাই বিচিত্র ও জটিল। ’১ [লোকভাষা লোকসংস্কৃতি-পৃ: ৩৪]

বাঙালি সমাজের লোকসংস্কৃতিতে যে প্রবল পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি তা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। গানে, ছড়ায়, কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা যেমন প্রাধান্য পেয়েছে তেমনি এসব গান কবিতা ও ছড়ায় বঙ্গবন্ধু পেয়েছেন লোকবীরের মর্যাদা।  তিনি হয়ে উঠেছেন মহানায়ক, নায়ের মাঝি, কাণ্ডারী, দরদী, বাংলার বাঘ, শাদর্ূল, জনগণের নয়ন মণি, বংশীবাদক কৃষ্ণ।  শুধু কবিতা বা গানেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেন নি। ব্যক্তি জীবনেও তার প্রবল প্রভাব আমরা লক্ষ করি যেখানে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন চূড়ান্ত আরাধ্য।  এসব লোককবির মধ্যে আছেন শেখ সেকেন্দার, আব্দুল হালিম, আব্দুল হান্নান ফকির প্রমুখ।

শেখ সেকেন্দার : গোপালগঞ্জ জেলার কোটালী পাড়ার অদূরে উত্তরপাড়া বুজুর্গকোণা গ্রামের বাসিন্দা শেখ সেকেন্দার। পিতা মফিজউদ্দীন শেখ। সাত বোন আর দুই ভাই-এর মধ্যে তিনি সবার ছোট। এলাকায় তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যতটা পরিচিত ছিলেন তার চেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন ‘নেতাজী’ নামে।  বঙ্গবন্ধুই তাকে এ নামে ডাকতেন।  ১৯৬৯-এর অনেক আগে থেকেই তিনি এলাকায় এ নামে পরিচিতি পান। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন নেতাজী।  কোটালীপাড়ার একমাত্র সরকারি কলেজ, সিকির বাজার পাবলিক ইনস্‌টিটিউশন স্কুল তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে রাধাগঞ্জ, কলাবাড়িসহ বিভিন্ন স্হানে যখন রাজাকার, আলবদর, আলশামস-এর সমন্বয়ে পাকিস্তান মিলিটারি বাহিনী নির্যাতন শুরু করেছে তখন তার গ্রাম বুজুর্গকোণায়ও মিলিটারির স্পীডবোট থেমেছিল। কিন্তু পিচ কমিটির সদস্য সারাফাৎ চৌধুরী বললেন-‘না, শেখ সেকেন্দার আওয়ামী নেতা হলেও ভালো মানুষ।  তার মতো ভালো মানুষ দু’চার দশ গ্রামে নাই।  আর যা করেন তার বাড়িতে আগুন দেয়া ঠিক হবে না।  দরকার হলে আমারে মাইরে ফেলান। ’ সারাফাৎ চৌধুরীর অনুরোধে তার গ্রামে আগুন দেয়নি মিলিটারিরা।  সীতাকুণ্ড গ্রামও বেঁচে যায় তার কারণে।

এই মানুষটি ১৯৭৫-এর পনের আগস্টের পরে মানসিক ভারসাম্য হারান।  কোটালীপাড়ার আহত মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক সেই সময়ের বর্ণনা দেন।  খুব সকালে রেডিওতে মেজর ডালিমের ভাষণ শুনে একবুক কান্না নিয়ে সেকেন্দারের সাথে দেখা করতে যাই।  সেকেন্দার তখন কলেজ মাঠের টিনশেডের একটি ঘরে থাকেন।  খুব ভোরে কলেজ মাঠে গিয়ে দেখি শেখ সেকেন্দার অস্হিরভাবে মাঠে হেঁটে বেড়াচ্ছেন।  আমাকে দেখেই উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে অপলক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে? আমি কান্না ধরে রাখতে পারছিলাম না।  শেখ সেকেন্দার আমার দুই বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিলেন।  কী শুনছি এসব? এসব কী সত্যি? আমি মাথা ঝাঁকালাম-সত্যি।  কারেন্টে শক্‌ খেলেন যেন।  এভাবে তিনি পিছিয়ে গেলেন।  তারপর আমাকে পিছনে ফেলে সেকেন্দার মাঠের পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।  পুকুর পাড়ে পৌঁছে ফের উত্তর দিকে হাঁটতে লাগলেন।  একটু থামলেন, ডান পায়ের চটিটা ছুড়ে ফেলে দিলেন পুকুরের জলে। আবার হাঁটতে লাগলেন। সামনে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিলেন বামপায়ের চটি।  তারপর মাথার চুল খামচে ধরে বসে পড়লেন মাটিতে।’ মুজিবুল হক এবার ছুটে গিয়ে পাশে বসলেন।  কাঁধে হাত রাখলেন।  বন্ধুর হাত অগ্রাহ্য করে তিনি হেঁটে গেলেন সোজা উত্তর দিকে।  সেই থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে বেঁচে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নেতাজী শেখ সেকেন্দার।

মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর তিনি কোনো দিন পায়ে জুতো পরেন নি। যে পোশাক তিনি পরা থাকতেন সেই পোশাকেই তিনি গোসল করতেন তারপর রোদে দাঁড়িয়ে তা শুকাতেন।  তাঁর গলায় ঝুলত প্রমাণ সাইজের বঙ্গবন্ধুর ছবি।  আওয়ামী লীগ অফিসে তিনি চুপচাপ যখন বসে থাকতেন ছবিটি থাকত টেবিলে কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। তিনি খাবার খেতে বসলে বঙ্গবন্ধুর ছবিতে খাবার নিবেদন না করে বা তাঁকে খাবার না দিয়ে নিজে খাবার খেতেন না। বঙ্গবন্ধুকে তিনি বাবা বলে ডাকতেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি অনর্গল ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়ে যেতেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ইংরেজিতে বলে যেতেন।  প্রায়ই তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিতেন।  ঝড়-বৃষ্টি-রোদ মাথায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে আগলে তিনি ঘুরে বেড়াতেন পথে প্রান্তরে গ্রামে গ্রঞ্জে।  পাগল বলে বাচ্চারা তাকে ঢিল ছুড়ত।  যুবকেরা তাকে ভাঙার হাট খালে চুবিয়ে দিত কিন্তু কিছুতেই তিনি হাত ছাড়া করেন নি, কাছ ছাড়া করেন নি বঙ্গবন্ধুর ছবিটি।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একান্ন দিন হাসপাতালে থাকার পর চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে কোটালী পাড়া ফিরে যান। এলাকায় প্রচলিত আছে যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একবার তাঁকে কিছু টাকা দিতে চান। শেখ সেকেন্দার সেই টাকা নিতে অস্বীকার করেন। এতে কষ্ট পান প্রধানমন্ত্রী।  তিনি বলেন, ‘সেকেন্দার ভাই আপনি কী আমার কোনো কথাই রাখবেন না?’ শেখ হাসিনা এর আগে তাকে ঢাকায় রাখতে চেয়েছিলেন।  গাড়িতে উঠেও ছিলেন নেতাজী।  মাঝ রাস্তায় প্রস্রাব করার অজুহাতে নেমে যান এবং উল্টো দিকে দৌড়াতে থাকেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যার মনোকষ্ট অনুভব করে নেতাজী বলেন-‘আমি সেই দিন টাকা ধরব যেদিন টাকায় বাবার ছবি হবে। ’ একথা রাখতেই শেখ হাসিনা তখন দশ টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপেন।  সেই টাকা তিনি নেতাজীকে পাঠিয়ে দিলে নেতাজী সেই টাকা একে তাকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

পায়ের চোট এবং নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে ২০০১ সালে তাকে কোটালী পাড়া স্বাস্হ্য কমপ্লেক্স-এ ভর্তি করা হয়।  অতঃপর ২৪ জানুয়ারি বুধবার দুপুর দুইটায় তাঁর জীবন্মৃত জীবনের চির অবসান হয়। ঐ দিনই তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কোটালী পাড়া শেখ লুৎফর রহমান কলেজের মসজিদের পাশে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।

ছাদেমের মা ও শেখ মুজিব :

শেখ মুজিব হেঁটে হেঁটে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন।  সাথে আছেন রইচ মিয়া, নসু মিয়া, মতিয়ার মাস্টার, আবদুল লতিফ ও আরো অনেকে।  গোপালগঞ্জের ঘোষেরচর গ্রাম, মুজিব ভাই গেলেন ছাদেমের মার বাড়ি।  হতদরিদ্র বৃদ্ধা, দোচালা ছনের ঘর।  বৃদ্ধা বললেন, একটু দাঁড়াও বাবা, তারপর হাত ধরে ঘরে টেনে নিলেন, খেতে দিলেন একগ্লাস দুধ আর দিলেন চার আনা পয়সা।

মুজিব আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন।  তিনি আরো কিছু পয়সাসহ ছাদেমের মাকে চার আনা ফেরত দিতে চাইলেন।  বললেন-আমার আর কিছু চাই না।  দোয়াই অনেক।  কিন্তু ছাদেমের মা নাছোরবান্দা।  তিনি পয়সা ফেরত নিলেন না কিছুতেই।  এবার কেঁদে ফেললেন মুজিব…ছাদেমের মায়ের অনুদান নিয়ে নিলেন পরম যত্নে।

শেখ আবদুল আজিজ ও মিয়া ভাই :

গোপালগঞ্জ বিল এলাকা।  নৌকা ছাড়া চলা দুষ্কর।  টাবুরে নায় প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকেন আব্দুল আজিজ, গুরু-শিষ্যের মধুর সম্পর্ক।  একদিন টাবুরেনায় দুজন ফিরছেন।  রাতে শীত পড়ছে।  নায় দুটো বালিশ আর একটা সিঙ্গেল লেপ।  ক্লান্ত আজিজ পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছেন।  মিয়া ভাই অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু তখন লেপটি নিয়ে আজিজের গায় তুলে দিলেন আর নিজে শীত সহ্য করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।  আজিজের ঘুম ভেঙ্গে গেল-নিজের গায়ের লেপটি তিনি পরম শ্রদ্ধায় তুলে দিলেন মিয়া ভাইয়ের গায়ে।  বঙ্গবন্ধু ঘুমাননি তখনও কিন্তু তিনি সেটা বুঝতেই দিলেন না।  সকাল হতেই আজিজ লেপটিকে নিজের গায় দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়ে যেত।  তারপর খেদ ঝরে পড়ত- ‘কেন ঘুমিয়ে পড়লাম?’ বঙ্গবন্ধুর ভালবাসার কাছে হার মেনে শান্তি ছিলো, না আফসোস? তা আর জানা সম্ভব নয়।”

বঙ্গবন্ধুর মা সাহেরা খাতুন ও চাঁন মিয়ার গান :

বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় মেধাবী ছেলে এ. কে. এম চাঁদ মিয়া অর্থাৎ রোকনউদ্দিনের গানের কণ্ঠশিল্পী থাকেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই থাকে বাইরে বাইরে। বঙ্গবন্ধু মানে তো শেখ বাড়ির খোকা, সায়রা খাতুনের খোকা। খোকা গেছে করাচি। মায়ের মন খোকার জন্য উতলা। এদিকে চাঁন মিয়া তখন নিজের পড়া তৈরি করছে। মা সায়রা খাতুন অপেক্ষা করছেন কখন শেষ হবে তার পড়া। পড়া শেষ হলে সায়রা খাতুন এগিয়ে আসেন চাঁন মিয়ার দিকে। জব্বারকে ডাক দেন। বলেন-‘এক গ্লাস দুধ নিয়ে আয়।’ চাঁন মিয়ার দুধ খাওয়া শেষ হলে-খোকার মা অনুরোধ করেন ‘রোকনের লেখা ঐ গানটা একবার গাওনা বাবা।’

চাঁন মিয়া জানে-কোন গানটা।  সে গেয়ে ওঠে-

‘তোরা আয় কে দেখবি খুশিত
নতুন চাঁদ উদয় হইয়াছে।
ঐ দেখ শুক্লপক্ষের চান
শেখ মুজিবুর রহমান মাটি মায়ের বাঙালি সন্তান।
ও আজ বঙ্গভালে উদয় হলরে, সোনার বরণ নীলাকাশে। ’

এই একটি গান তিনি বারবার শুনতে চাইতেন যখন খোকা করাচি বা জেলে থাকত।

এ কে যে ডাকাতরাও তাকে ভয় পায়?

কোটালীপাড়ার রাধাগঞ্জ ও কালিঞ্জির খাল।  এইখানে শুশুকের নাক দেখা যেত।  রাধাগঞ্জ-এর নির্বাচনী সভা শেষে এই খাল দিয়ে ফিরছে শেখ মুজিবের পাঁচটি নৌকা। কালিঞ্জির খাল পার হয়ে বড় খালে পড়বে। নৌকায় তখন ঘুমে অচেতন গফুর পাইক, কাসেম মুন্সি।  আছে রোকনউদ্দিন আর চাঁন মিয়া। হঠাৎ পাঁচ ব্যাটারীর টর্চ জ্বলে ওঠে। ডাকাত সরদার নির্দেশ দিলো নাও ভিড়াতে।  মুজিব ভাই বললেন- “বল, নায়ে শেখ মুজিব আছে। ”

শেখ মুজিবের নাম শুনে ডাকাতরা আর কোন রা’ করল না, সরে পড়ল।

বিধবার আশির্বাদ ও বঙ্গবন্ধু

নির্বাচনী প্রচারণা ও মিটিং-এর জন্য বঙ্গবন্ধু আসেন গোপালগঞ্জের বোড়াশী ইউনিয়নের ভেন্নাবাড়ি গ্রামে। মোহন মিয়া, আফতাফ মেম্বারের বড় ভাই, গ্রামের সব গণ্যমান্যরা মুসলিম লীগার, এস.এম. হলের সাবেক জিএস শাহেদ আলীর বাড়িতে আশ্রয় থাকত তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়। এক মেয়ে নিয়ে সে ভাগ্নেদের বাড়িতে থাকত। বুড়ি মা বলে ডাকত সবাই। একে গরিব, তার উপর স্বামীহীন, আশ্রিত।  গ্রামে কেউ তাকে সাধারণত ধর্তব্য মনে করেন না। কালে ভদ্রে নিকট আত্মীয়রা বেড়াতে এলে ছালাম বা কুশল বিনিময় করে মাত্র।

বঙ্গবন্ধু মিটিং শেষে ফিরছেন এমন সময় এই বুড়ি মাকে তার সামনে দেখতে পান। স্বাভাবিকভাবেই ভোটের জন্য দোয়া চেয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে ছালাম করেন। আবেগাপ্লুত বুড়িমা শেখ মুজিবের মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন-‘বাবা অনেক বড় হও তুমি।  অনেক বড় হও।  তাঁর কণ্ঠ জড়িয়ে আসে আবেগে। ’

বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতাকে বুড়িমার পায়ে হাত দিয়ে ছালাম করতে দেখে সেদিনই তামার পাড়ার লোক আওয়ামী লীগে যোগ দেয়।

বঙ্গবন্ধু ও আব্দুল হালিম

আব্দুল হালিমের বাড়ি বড় ধুশিয়া, উপজেলা ব্রাহ্মণ পাড়া, কুমিল্লা। তাঁর প্রসঙ্গে কথা হয় মু্‌ক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মুস্তফা হোসেন-এর সঙ্গে।  তিনি আব্দুল হালিমকে নিয়ে একটি পোস্ট দেন ফেস বুকে সেখান থেকেই হুবহু তুলে দিচ্ছি লেখাটা।

তিনি “একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের বোঝা বয়ে নিয়ে যেতেন যুদ্ধক্ষেত্রে।  ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তার গ্রাম স্বাধীন হয়ে যায়।  মুক্তিযোদ্ধা ও পালক পিতার বাধা না শুনে বাড়ি রওনা হলেন।  কোনা বন সীমান্ত দিয়ে দেশের ভেতরে ঢোকার কিছু সময় পরই মাইন বিস্ফোরণে ডান পা-টি চলে যায়।  ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্হা করে দেন হালিমকে।  এক সময় কৃত্রিম পা-টি ভেঙ্গে যায়। ভাঙতে ভাঙতে সেটি ১ ফুটের মতো অবশিষ্ট থাকে। সেই ভাঙা পায়ের স্হান হয় তার মাথার কাছে।  ঘরের মেঝেয় পাতা বিছানার বালিশের পাশে একটি পিড়িতে সযত্নে রেখে দিয়েছেন ওটা। ”

মোস্তফা হোসেইন সেটি দেখিয়ে যখন জানতে চান-ওটা কি?
আবেগতাড়িত জবাব-‘বঙ্গবন্ধু’।

উপসংহার

প্রাচীন বাঙালির ‘বঙ্গ’ দেশ বলতে যে সীমারেখা হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নির্ণীত হয়েছিল সেই সীমানায় অসংখ্য জনপ্রবাহের ধারা বিদ্যমান ছিলো।  প্রাচীন ‘বঙ্গ’ দেশের সীমা নির্দিষ্ট হয়েছিলো প্রাকৃতিক সীমা দ্বারা।  শুধু তাই নয় এই প্রাকৃতিক সীমার মধ্যে একটি জাতি ও ভাষার ‘একত্ব- বৈশিষ্ট্য’ গড়ে উঠেছিলো।  প্রাচীন এই বঙ্গদেশের বাঙালির একত্ব বৈশিষ্ট্যই ১৯৭১-এ এসে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটায় এবং পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে এক অখণ্ড ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্যে আবদ্ধ হয়।  সেই থেকে বাংলা ভাষী বাঙালির নিজস্ব ভূখণ্ড হয়ে যায় বাংলাদেশ।  বাঙালিকে এই ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন যে মানুষ তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের সংগ্রামে অংশ গ্রহণ ও ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের যে আকাঙক্ষা তাকে উস্কে দিয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনাসমূহের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ এক অনিবার্য নাম।  কোনো লেখকই ‘বঙ্গবন্ধু’কে পাশ কাটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার কথা ভাবতে পারবেন না।  এমনকি দলীয় সংকীর্ণতা নিয়েও যেসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা আমরা পাই সেখানেও ‘বঙ্গবন্ধু’ অনিবার্য।  কিন্তু ঐতিহাসিক এই চরিত্রের মূল্যায়নের প্রশ্নে এসে তৈরি হয়েছে নানারকম বিতর্ক।  এ বিতর্ক বিভ্রান্ত করছে নতুন প্রজন্মকে।  দলীয় সংকীর্ণতা নিয়ে যেসব লেখক বই লিখেছেন তারা এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনাগুলোতে।  একটি চরিত্র, কিংবা দর্শন মূল্যায়নের প্রশ্নে এ বিতর্ক স্বাভাবিক।  মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫শে মার্চ কালো রাত, ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এম.এ হান্নানের স্বাধীনতা ঘোষণা, ২৭শে মার্চ জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে একই ঘোষণা পুন:পাঠের ঘটনাকে সংরক্ষণ করেছে।  একজন যথার্থ ঐতিহাসিক কারো অবদানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল মানুষের মনে।  ২৫ মার্চের কালো রাত্রির ঘটনা তাকে ত্বরান্বিত করেছে।  কিন্তু
লার মানুষ আগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।  ২৬ মার্চ থেকে তারা আর পিছ-পা হয় নি।

রাশেদ খান মেনন ২৬ বা ২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে ঐতিহাসিক বললেও নির্ধারক ঘটনা বলতে চান না।  কেননা বাংলার মানুষ আগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো।  সেই সিদ্ধান্ত লোককবির কবিতা ও গানে আমরা পাই।  সেই নির্ধারক ঘটনা ৭ই মার্চ, সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু’ পূর্ব পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র নামে উল্লেখ করে বলেন-‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ বাংলাদেশে কোট, কাচারী, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। …তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।  এবং জীবনের তরে রাস্তা-ঘাট যা যা আছে সব কিছু।  আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। ’

অতএব, ২৬ শে বা ২৭শে মার্চের বেতারে ঘোষণা একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।  মানুষের মনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নির্ধারণ যে হয়ে গিয়েছিল তা ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই।  এই সত্যের যথার্থ প্রকাশ লোককবির গান ও কবিতায় আমরা পাই-

“শেখের ডাকে সারা দিয়্যা
মুক্তিযুদ্ধে গেনু। ”

আবার-‘

স্বাধীন বাংলা বলে মুজিব করিল ঘোষণা। ’

কিংবা-

‘৭১-এ শেখ মুজিব দিল বজ্রসারা
বাঙালিরা হইয়া উজ্জীব যুদ্ধে নামলো তারা। ’

অথবা-

‘মুজিবের ডাকে সারা দিয়া বাঙালির সন্তান
মুক্তিফৌজ হইল, যাইয়া হিন্দুস্তান। ’

ইতিহাস রচনায় বুদ্ধিজীবী মহল যেখানে সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছে- মৌখিক ও লৌকিক ইতিহাসে লোককবিগণ সেই সংকীর্ণতার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেছেন।  এ যাবৎ যতগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লোকছড়া, কবিতা ও লোকগানের সন্ধান পাওয়া গেছে তার কোথাও জিয়াউর রহমানকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে দেখা যায় নি।

এমতাবস্হায় মেজর জেনারেল (অব.) এম. এ. মতিনের বক্তব্য- ‘আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে শেখ মুজিব নেতা কিংবা সেনাপতি-তার কোনো দায়িত্বই পালন করেন নি।  ঐতিহাসিক সে দায়িত্ব পালন করেছেন মেজর জিয়াউর রহমান। ’২

অথচ বাঙালির চেতনার জগতে তখন বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালনকারী কাণ্ডারীর নাম পাওয়া যায় না।

তাঁরা মুজিবকে বলছেন- ‘সল্লাহ পোরধান; বলছেন- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৌকার মাঝি হইল। ’

লোককবির বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর পরিচয়টি যেভাবে বিধৃত হয়েছে তা পাঠ করলে- ইতিহাস রচনায় দলীয় সংকীর্ণতা দূর হবে বলেই বিশ্বাস।

ভাট-কবি ইদ্রিস আলীর রচনায় আমরা দেখতে পাই,

‘ওরে মালেক ঠেডা তুমি কেডা কোথায় তোমার বাড়ি
বাপ দাদার নাম নাই পুটকি ভরা দাড়ি।
হইছিলে গভর্ণর নাই খবর বাপের চৌদ্দগোত
যার দাপে এহিয়া কাঁপে ঘরে বইসা মুতে
তুমি তাঁর সাথে পাল্লা দিতে গেলা কেমন করি
যাঁর ঠেলায় নূরুল আমীন হইলে দেশান্তরী
সে যে বঙ্গশাদর্ূল নাই সমতুল নাই সারা বিশ্বে আর
কোথায় গেল চীন মার্কিনের দেওয়া বিপুল হাতিয়ার।

… … … … … … … … … … … … … … …

খেয়ে বাঘের থাপা বাপরে বাপ করছ কেন আজ
চাইসনারে বাংলার দিকে যদি থাকে লাজ। ’

লোক মানসে বঙ্গবন্ধু বাংলার বাঘ যার থাবা খেয়ে-পাকিস্তানীরা বাপ বাপ করে পালিয়েছে।  এই বাঘ-রাওয়ালপিণ্ডির জেলে বন্দি থাকলে কি হবে তার তো থাবা দেবার জন্য পনের কোটি পা ছিলো।

তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যখন বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন, তখন লোককবির বয়ান থেকে আমরা পরিষ্কার হতে পারি যে-

-২৫ শে মার্চের হত্যা যজ্ঞের প্রতিক্রিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেনি।  এর সাথে ২৫শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর এরেস্ট হবার ঘটনা ছিলো বাঙালির ক্ষোভকে মুক্তি সংগ্রামের দিকে ধাবিত করার অন্যতম একটি প্রধান কারণ।  ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশ স্বাধীন করার অর্থ হয়ে যায় দেশকে শত্রু মুক্ত করা নয় বরং বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে, পাকবাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করা।

লোককবির বক্তব্য-

‘আল্লা আমার সহায় আছে
আইসো কমর বান্দি।
ইয়াহিয়া টিক্কা ভুট্টো
যাইবে এবার কান্দি।
ওমাক ক্যারাকাত ফ্যালেয়া
শত্রু দিমু যে খ্যাদেয়া।
বাংলাক স্বাধীন করিয়া
বঙ্গবন্ধুক হামরা এবার
মুক্ত করমো ভাই। । ’

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণ ও আত্মত্যাগই যেখানে প্রধান ভূমিকা রেখেছে সেখানে তাদের উদ্দীপ্ত করার গানে অবদান রেখেছেন লোক কবিরা।  মুক্তিযুদ্ধে মেজর কর্ণেলরা অংশ গ্রহণ করলেও সেখানে রণতুর্য বাজেনি বরং ক্যাম্পে ক্যাম্পে অর্ধ-শিক্ষিত অশিক্ষিত চারণ-কবির গান তাদের উজ্জীবিত করেছে।  আর এসব গানের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ এসেছেন নানাভাবে।  শুধু তাই নয়-মুক্তিবাহিনীকে উৎসাহ দিতে যে সব গণ-সঙ্গীত গীত হত লোক সুরে সেই সব গানের বাণীতে সঙ্গত কারণেই উঠে এসেছেন বঙ্গবন্ধু-

‘বাংলার নামে আজ শপথ নিলাম
মুজিবের নামে আজ শপথ নিলাম
বাংলাকে করবই মুক্ত…’

অথবা-

মুজিবের বাংলায় আজ কোন কথা নয়
সংগ্রাম শুধু সংগ্রাম।’

কিংবা-

বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছে চলো মুক্তিযুদ্ধে
গোলাম হয়ে বাঁচার চাইতে মৃত্যু বহু ঊর্ধ্বে।

অথবা-মায়ের রক্ত বোনের রক্ত ভাইয়ের রক্তকে
ওরে মুক্ত করতে মুজিবরের বঙ্গভূমিকে
বাঙালি তুই দাঁড়া অস্ত্র নিয়া।

অথবা-‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম-মুজিবুর।’

কিংবা- ‘শোন ঐ শোন বাংলাদেশের
শিকল ভাণ্ডার গান,
জয়তু মুজিব।  কোন সে মন্ত্রে
জাগালে লক্ষ প্রাণ। ।’

এভাবে-বিচারগানের কবি আবদুল হালিমের গান-

‘জাতির পিতা মহান নেতা (তাঁরে) ছাড়বি কিনা বল
বন্দিশালার ভাঙব তালা বাঙালি ভাই চলরে চল। ।
শোন বলিরে ভুট্টো মিয়া শেখ সাহেবরে দাও ছাড়িয়া
না হয় থাক সাবধান হইয়া আসিতেছে পাগলা ঢল।’

এভাবে আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই যে-মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ইতিহাস জুড়ে জনপ্রবাহের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ কিংবা ‘বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা’-একটি অভিন্ন চেতনা। লোককবিরা সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে কখনো-মহানায়ক বলেছেন কখনো বলেছেন অবতার।  আর এভাবে লোকসমাজে মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হয়েছে নিরক্ষর ও অর্ধশিক্ষিত-লোককবির মাধ্যমে সেই ইতিহাসে তিনি হচ্ছেন অবতার, সার্বভৌমিক পুরুষ প্রধান।

এ যাবৎ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও ‘বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রিক’ যে সমস্ত গ্রন্হ রচিত হয়েছে তাঁর মান যাচাই-এর ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতিভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা জরুরি বলে আমি মনে করি।  কেননা লোকসংস্কৃতির ব্যাপকতম চর্চাই আমাদের জাতীয় চরিত্র, জাতীয় ঐক্য ও দর্শন নির্মাণে বিশেষ সহায়তা করতে সক্ষম।  মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে বাঙালির মধ্যে যে বিতর্ক যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে মুক্তি দিতে পারে সাংস্কৃতিক অধ্যায়ন।  বাঙালি জাতির ইতিহাসে সংস্কৃতি অর্থাৎ লোকসংস্কৃতি ব্যাপক সময় ও স্থান জুড়ে আছে।  আর এ উদ্দেশ্যে ‘লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ আমার একান্ত ক্ষুদ্র প্রয়াস।

 

 (চলবে)

[সম্পূর্ণ বইটি পেতে যোগাযোগ করুন : রোদেলা প্রকাশনী
যোগাযোগ: ০১৭১১৭৮৯১২৫। মূল্য: ২৫০টাকা।]