মানুষ বুকের কুঠুরিতে বর্ষপঞ্জি বেঁধে বেঁচে থাকে না, মানুষ বেঁচে থাকে তার আপন মনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে। সেই স্রোত সেই সময় যদি তার জন্মের আগেও হয় তবুও সময়টা তারই। এখানে কোনো মহাজনের খবরদারি চলে না…
যতই “পাস্ট ইজ পাস্ট” বলি না কেন
বয়স যত বাড়তে থাকে মানুষ তত স্মৃতিতে ডুব দিয়ে সুখ খোঁজে। বয়স না বাড়লেও খোঁজে —যদি বর্তমান সময়ের জীবনযাপনের অধিকাংশটাই ভরে ওঠে ভোগবিলাসপণ্যসর্বস্বতায়, বিদ্বেষ-বিভেদে, রঙচঙে আচার-ব্যবহার আনুষ্ঠানিকতায় । বর্তমানের অগাধ ঐশ্বর্যও যখন মানুষকে সুখী করতে পারে না তখন অতীতের আধপেটা খেয়ে থাকা দিন তাকে ভরিয়ে তোলে গোপন আনন্দে। আবার সমৃদ্ধ অতীতের স্মৃতি কখনো কখনো ভুলিয়ে দেয় বর্তমানের অভাব-দারিদ্র্য। অতীত হলো বর্তমানের সত্যিকারের ভিত্তি, তার অস্তিত্ব এতটাই দৃঢ় যে —ম্লান করে দিতে পারে বর্তমানকেও । এই মৌসুমী জলবায়ুর দেশে মানুষের মন বড্ড নরম, আবেগাপ্লুত হতে বিলম্ব হয় না … সেই আবেগ মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে নিয়ে যায় অতীতে …
আসলে এই কেনাবেচার যুগে সুখ কোথায় ?
বর্তমান যখন পণ্যসর্বস্ব, অসুস্থ প্রতিযোগিতার… ভবিষ্যৎ যখন শঙ্কার, অনিবার্যভাবে অনিশ্চিত …
তখন সুখ খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে অতীতে , তার রঙে-রূপে-মায়ায় স্নাত হতে পারলে তপ্ত বুকে ফল্গুধারা যায় …
আজ ডুব দিয়েছি স্মৃতির আষাঢ়- শ্রাবণে, সেই বুকভরা ঝড়- বৃষ্টিতে , সেই অভাব-আনন্দ- সমৃদ্ধির মায়াবী দিনকালে …
মনে হয় এই তো সেদিন, ঠাকুরদা বড় গরুর গাড়ি ভরে ছন কিনে আনালেন রান্নাঘরের চাল ছাওয়াতে হবে বলে। সারাবছর আমাদের বাড়িতে কাজ করা লোকটা গরুর গাড়ি উঠোনে রেখে দামড়া দুটো বেঁধে সোজা এসে মাকে বললেন – ” বৌমা জল দাও, চা বানাও, ম্যানত হয়ে গেছে গো বাপু, ওসব পরে নামাচ্ছি …”
সামনে ঝড়-বৃষ্টির সময় — গোয়ালের খুঁটি, ঢেকিঘরের ছাবড়া, ধানঘরের পেছন বারান্দার খুঁটি সবই পাল্টাতে হবে। পাশের পাড়া থেকে লোক ডেকে বাঁশঝাড় থেকে গোটা ছয়-সাত বাঁশ কাটা হলো, সেগুলো চাঁছা-ছোলা হলো। বাজার থেকে কামারে পেরেক, তারকাঁটা, গুনো তার কেনা হলো। সারা সপ্তাহ ধরে বাঁশ কাটার শব্দ, পেরেক ঠোকাঠুকি… লোকে কাজ করতেন আর ঠাকুরদা রেডিও চালিয়ে দিয়ে উঠোনে গাছের ছায়ায় চেয়ারে বসে তাদারক করতেন … সব কাজ হয়ে গেলেও ঠাকুরদার কাজ বেড়েই যেত। গওড়া বাঁধা, উঠোন যাতে মাটি ধুয়ে না যায় সেজন্য আড় করে ঠ্যাকনা দেওয়া, তারপর গরু বাঁধা খুঁটি, কাপড় শুকোনো আড়, জ্বালানি কাঠ রাখা মাচা, মই বানানো আরও কত কাজ করাতেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। বাঁশ কম পড়তো, আরও কাটতে হতো…এখন সেসব দিন নেই, ইটের দেয়ালের ঘরে শুয়ে ঘুমের ঘোরে আজও সেই শব্দ পাই।
প্রায় সব বাড়ির লোকই ঝড়-ঝঞ্ঝা আসার আগে ঘরের বাঁশ-খুঁটি-চালা পাল্টাতেন। যাদের সামর্থ্য কম তারা অন্যের বাড়ি থেকে বাঁশ চেয়ে আনতেন। তখন দু-একটা বাঁশ চাইলে গরীব মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা খুব কমই ছিল। মানুষ তখনও এত তীব্রভাবে টাকাপয়সা চেনেনি, কথায় কথায় এতো ‘প্র্যাকটিকাল’ হতে শেখেনি…
মোটামুটি সব বাড়িতেই মাটির দেয়াল ছিল। এখনও কিছু বাড়িতে আছে। আমাদের বাড়িতে এখনো তিনটে মাটির দেয়ালের ঘর টিকে আছে । বর্ষা আসার আগে খামচা ধরে উঠে যাওয়া মাটির দেয়াল কোমল হাতে মাটি দিয়ে সমান করতেন বাড়ির মেয়ে-বউরা— এখন যেমন সিমেন্ট দিয়ে প্লাস্টার করে। তারপর সেই মাটি লাগানো জায়গাগুলো শুকিয়ে গেলে সমস্ত দেওয়াল লেপে দেওয়া হতো মিহি মাটির গোলা দিয়ে। মইয়ের উপরে টিনের বালতি রেখে দেয়াল লেপার সেই দৃশ্য প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। শুধু বর্ষার সময় নয়, পুজো-পার্বণসহ, বিয়ে, ঈদ— বলতে গেলে এটা মহিলাদের সারা বছরের কাজ ছিল।
বর্ষার আগে মাটির দেয়ালের চারদিকে চট বা পলিথিন ঝুলিয়ে দেয়া হতো যাতে অতিবৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে না যায়। আমাদের দেশের মাটির ঘরে তখন মাটির মানুষেরা থাকতেন, এখন ইট-বালি-সিমেন্টের ঘরে যেন কংক্রিটের মানুষ তৈরি হচ্ছে।
মেটে টালির ঘর, ছাবড়া দেওয়া ঘর, সবই বর্ষার আগে আলাদা খাতির-যত্ন পেত…
শুধু কি ঘর? —গোয়ালের গরুগুলোর গায়ে যাতে বৃষ্টির জল না পড়ে তার জন্যেও মানুষের আপ্রাণ চেষ্টা থাকতো… আগে গরুগুলো মানুষের কাছে ছিল অনেকটা সন্তানের মত । কেনাবেচা চলতো বটে, তবে বেচার উদ্দেশ্য করে পোষা হতো না। এখনকার মহেশরা পাকা গোয়ালে থাকে, মাথার উপর পাখা ঘোরে, এখনকার মহেশরা ব্যবসার পণ্য ।
বর্ষাকালে মানুষ তখন হাটে যেত সকাল সকাল, ফিরে আসতো সন্ধ্যা নামার আগেই। কাদা রাস্তা বা বন-বাঁদাড়ের অন্ধকারে সাপ-পোকার ভয় তো ছিলই। ব্যাটারির টর্চের প্রচলন থাকলেও সবার হাতে তা ছিল না। তখন বেশিরভাগ মানুষ এই বৃষ্টিকাদার সময়ে খালি পায়ে হাটে যেত। যারা কিছু বেচতে যেত তারা কোমরে শক্ত করে গামছা বেঁধে, হাঁটুর উপরে লুঙি তুলে, মাথায় ঝুড়িভরা আম-কাঁঠাল বা শাক-সবজি নিয়ে পা টিপে টিপে সাবধানে হাঁটতেন। বেশি গরম পড়লে, বিশেষত চৈত্র -বৈশাখে খালি গায়ে হাটে যাওয়া লোক অগন্তি দেখা যেত । এখন নাকি খালি গায়ে থাকা অভদ্রতা। আমাদের চিরকেলে অভ্যেস পা নাচানো— সেটাও নাকি অভদ্রতা, শব্দ করে খাওয়া অভদ্রতা…
মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, এত ভদ্রতার নিয়ম কারা শেখাচ্ছে? কারা তারা ?
ঝড়-বৃষ্টির সময়ে সামর্থ্য অনুযায়ী অন্তত চার-পাঁচ দিনের শাক-সবজি, চাল -ডাল, তেল-নুন ঘরে রাখার চেষ্টা করতো সবাই। কারণ মাঝে মাঝে এমন বিরতিহীন বৃষ্টি নেমে থাকতো যে, হাটে-ঘাটে বের হওয়া মুশকিল ছিল। সব জোটাতে না পারলেও লোকে চাল -ডাল, একটু পেঁয়াজ, একটু তেল ঘরে রাখতেই হতো, বেকায়দায় পড়লে যাতে অন্তত খিঁচুড়ি রেঁধে খাওয়া যায়। এখনকার রেসিপিওয়ালারাদের বৃষ্টিদিনের খিঁচুড়ির আদিখ্যেতা নয় —বাঙালির খিঁচুড়ি খাওয়ার প্রচলন হয়েছে এরকম অভাবের কারণেই…
বর্ষার সময় সবাই ইলিশ কিনে খেতে পারতেন না, যাদের সামর্থ্য থাকতো তারা এসময় বেশিরভাগ ইলিশ মাছই বেশি কিনতেন — ভাজা ইলিশ, সর্ষে ইলিশ, কাঁচকলা দিয়ে রান্না করা ইলিশ গন্ধ ছড়াতো এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি। শ্রদ্ধেয় অজয় কুমার বসু মহাশয়ের স্মৃতিচারণা থেকে জানতে পারি, ১৯৫০-৬০ এর মাঝামাঝি একসের-দেড়সের ওজনের ইলিশ মৌসুমভেদে দেড় থেকে আড়াইটাকার মধ্যে পাওয়া যেত… “
দক্ষিণাঞ্চলে তখন সস্তায় নোনা ইলিশ পাওয়া যেত, গরীবের পক্ষে সেটা কেনা সহজ ছিল— এখনও পাওয়া যায় তবে দাম অনেক বেশি । আর বর্ষাকালে যেহেতু খালে বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত সেহেতু গরীবেরা বড়লোকের চেয়েও ভালো মাছই খেতেন বলা যায়, শুধু তেল- নুন জোটাতে পারলেই হলো । আবার অনেকে সারাদিন মাছ ধ’রে বিকেলে সেই মাছ বেচে ইলিশ কিনতেন। ছোটবেলায় দেখেছি মাছ ধরে অনেকে পাড়ায় পাড়ায় মাছ বিক্রি করতেন। কইমাছ- ট্যাংরা মাছ- শোল মাছ –বাইনমাছ সহ নানা জাতের ছোট মাছ। বিক্রির সময় মাঝে মাঝে দেখা যেত ওজনের বালাই নেই — “এতগুলো আছে , এত টাকা হলে বেচে দেব” হয়ে গেল কেনাবেচা… তাতে ঠকলেন কি জিতলেন ওসব ভাবনা নেই ।
মানুষের অভাব ছিল, সমৃদ্ধিও ছিল — কিন্তু সবকিছু টাকার পাল্লায় মাপার প্রবণতা ছিল না।
আমাদের সময় রান্নাঘর বা ‘পাকের ঘর’ ছিল— ‘কিচেন’ কী জিনিস বুঝতাম না । বর্ষাকালে ব্যবহারের জন্য কয়েক মাস আগে থেকে জ্বালানি কাঠ-খড়-শুকনো পাতা মজুদ করতে দেখা যেত। কারণ এই কয়েকমাস জ্বালানির জন্য বেশ অসুবিধা হতো। অবস্থাপন্ন বাড়ির লোকেরা কাঠ কিনে লোক দিয়ে চলা করে শুকিয়ে রেখে দিতেন। এজন্য ধনী হোক, গরীব হোক সবার বাড়িতে জ্বালানি মজুদের জন্য বড়সড় একটা ছাবড়াঘর বা চালা থাকতো। বাঁশের মাচা করে তার উপর বিচুলি বা পলিথিন পেতে জ্বালানি সাজিয়ে রাখা হতো, কারণ উই ধরার ভয় আছে।
বৈশাখ থেকে শ্রাবণ এই সময় যে জিনিসটা অতি-অবশ্য গুরুত্ব দিয়ে কিনতে হতো তা হলো -কেরোসিন তেল। তার সঙ্গে হারিকেনের ফিতে, কাচের চিমনি— এগুলো প্রয়োজনমতো কিনতেই হতো৷ কারণ অন্য সময় যেন-তেন, ঝড়-বৃষ্টির সময় এসবের গুরুত্ব বেশিই থাকতো।
বৃষ্টি -বাদলাতে তখন গ্রামে সাধারণত আটটা নয়টার বেশি কারো বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখিনি, কারণ কেরোসিন কিনে সারারাত পোড়ানোর ক্ষমতা সবার থাকতো না। নয়টার মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ।
ছেলেমেয়েরা মোটামুটি আটটা পর্যন্ত পড়তো, কারণ বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদের বিকেল কাটতো ছোটাছুটি করে। ঘুম ভর করতো চোখে, চোখরাঙানি জুটতো প্রতিদিন ।
আষাঢ়-শ্রাবণে কাদা ভেঙে ইশকুলে যাওয়া, ফেরার সময় কাদামাটিতে একাকার হয়ে ফেরা… জুটলে ছাতা, না জুটলে মানকচু বা কলার পাতা দিয়েই কত ছেলেমেয়ে বর্ষাকাল কাটিয়ে দিত। তখন এখনকার মতো ভাঁজ করা ছাতা দেখা যেত না। যাদের বাড়ি থেকে কাঠের হাতলের বড় ছাতা দেয়া হতো —ছোট ছেলেমেয়েরা সেটাতে মোটামুটি এমনভাবে ঢেকে যেত যে— মনে হতো শুধু ছাতা হেঁটে বেড়াচ্ছে। অনেক ছেলেরা ফেরার পথে জামা খুলে বই বেঁধে নিত ভিজে যাওয়ার ভয়ে। আমরা ইশকুলে পড়াকালীন সমগ্র ইশকুল খুঁজলে দুটো-তিনটে বইয়ের ব্যাগ পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ৷ চটি ছিলনা এমন ছেলেমেয়ে অনেক । শিক্ষকদের অনেককে দেখা যেত লুঙ্গি পরে আসতেন । অনেকে দীর্ঘ জল-কাদার পথে ভিজে এসে, ইশকুলে এসে পোশাক পাল্টাতেন। সাধারণ পোশাক সাধারণ চলাফেরা, চাহিদা অত্যন্ত কম… । এখনকার শিক্ষকরা পালচার-ডিসকভার ছাড়া চলতে পারেন না । সেজন্য হয়তো এখনকার মতো তখনকার দিনে বেতন বাড়ানোর জন্য এত আন্দোলন দেখা যায়নি। তাঁরা অল্পে তুষ্ট থাকতেন তো বটেই, সেই শিক্ষাটা সফলভাবে অনেক ছাত্রছাত্রীর মাঝে দিয়ে গেছেন।
এখনকার ইশকুলগুলো যেন দিনে দিনে শোষক, শাসক বা প্রশাসক তৈরির কারখানা হয়ে উঠছে।
আমাদের এদিকে বর্ষাকালে ফরিদপুর অঞ্চল থেকে ছাতা মেরামত করা লোক আসতেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে তারা ছাতা মেরামত করতেন। এক বাড়িতে সব সরঞ্জাম মেলে বসলে আশেপাশের বাড়ি থেকে একটার পর একটা ছাতা আসতে থাকতো। আমি অবাক হয়ে দেখতাম কত রকমের জিনিস লাগে ছাতা সারাতে! আর কী অদ্ভুত নৈপুণ্য তাঁদের হাতে। একটা ভাঙা বাতিল ছাতাকে অল্প সময়ে জোয়ান বানিয়ে ফেলতেন তারা । যে বাড়িতে বসতেন সে বাড়ির মুড়ি- চিড়ে -আম খেতে খেতে কাজ করতেন । দুপুরে অনেকে দুটো ডালভাত যা জোটে খাইয়ে তারপর যেতে দিতেন। এখন খুব মাঝেমধ্যে দু-একজনকে দেখা যায়। এবার তো আষাঢ় চলে গেল, এখনো একজনকেও চোখে পড়েনি…
টিনের চালের ছিদ্র দিয়ে জল পড়লে গৃহস্থের বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। বিছানা ভিজবে, ঘরে জল জমবে, জামাকাপড় ভিজবে আরও কত ঝামেলা। বর্ষাকালে টিনের ছিদ্র সারাই করা লোক পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতেন। যাদের দরকার হতো তারা চাল বা টাকার বিনিময়ে কাজ করিয়ে নিতেন। প্রায় বছর দশেক হতে চললো তাদের দেখি না।
তখনকার সময়ে চারিদিকে পুকুরভরা জল। আর স্নান বলতে তখন পুকুরই সম্বল… মেয়ে-বউদের সোনাদানা স্নান করতে গিয়ে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অল্প জলের সময় যদিও পাওয়া যেত— এই আষাঢ়-শ্রাবণে সে আশা করাই ভুল। তখন একদল লোক আসতেন যারা এই হারানো সোনার গহনা খুঁজে দেওয়ার কাজ করতেন। সাধারণত একটা দলে দুই-তিনজন থাকতেন। পুকুরপাড় থেকে জামা-লুঙি পাল্টে কাছা দিয়ে তারা নেমে যেতেন পুকুরে। বাঁশের মাথায় বাঁধা বড় ঝাঁঝরির মতো একটা টিনের জিনিস আর সঙ্গে একটা লোহার আঁচড়া। সেই আঁচড়া দিয়ে কাদা টেনে টেনে ঝাঁঝরিতে এনে অনুসন্ধান চালাতেন। খুঁজে পেলে একটু বেশি পারিশ্রমিক নিতেন, না পেলে কম। তবে ঠিকঠাক জায়গা বলে দিতে পারলে তারা খুব কম ব্যর্থ হতেন। এখকার স্নান চারদেয়ালে মধ্যে, তাই সেই মানুষগুলোও হারিয়ে গেছে প্রায়… এই তো সেদিন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলেই বসলেন— “পুকুরে মাথা ডুবিয়ে স্নান উঠে গেছে বলেই তো মানুষ এখন এত বেশি স্ট্রোক করছে… “
এই বক্তব্যের সত্যি-মিথ্যে নিয়ে কোনদিন গবেষণা হবে কিনা জানি না, তবে সরল মানুষের মন এমন সরলভাবে অনেক কথাই বলে —যুগে পর যুগ পেরোলে তারপর সেসব কথা চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ খনার বচন— শতাব্দী পেরিয়েও পুরোনো হলো না। এই আম-কাঁঠাল, ফুল-ফসলের দেশ সবই মনে রাখে।
ফিরে যাই বর্ষার গল্পে
আম কাঁঠাল তো এখনো আছে, কিন্তু আগের মতো সেই বড় বড় আমের বাগান কিংবা আমের গাছ এখন তেমন দেখতে পাওয়া যায় না । এই বৃষ্টিতে কত ছেলেমেয়ে ভেজা গাছে উঠে হাত-পা ভাঙতো । তখন মানুষ আমের গাছের বাহারি নাম রাখতেন। যেমন – কালোসিন্দুর, রাঙা সিন্দুর, রসগন্ধা…
বাড়ির মা-ঠাকুমারা বাঁশের তৈরি ডালায়, বা নকশা করা থালা-পাথরে আমসত্ত্ব দিয়ে রোদে মেলে দিতেন। মেঘ এলে সেগুলো আবার তোলো, রোদ উঠলে আবার নামাও, আবার তোলো —আমের সময় এ দৃশ্য প্রতিদিনকার। এখনও দেখা যায় অনেক বাড়িতে… লেখাপড়া শিখেছেন বলে আজকাল মেয়েরা অনেকেই এসব আর করতে চান না। এসব বিষয়ে আগ্রহ নেই অনেকের। আবার আগ্রহ থাকলেও তথাকথিত সচেতন অবিভাবক তাদের নিষেধ করেন পড়ালেখার ক্ষতি হবে বলে।
” একা বেথুন এসেই শেষ করেছে,
আর কি তাদের তেমন পাবে ? “
—— না না, এতবড় ‘নারীশিক্ষাবিরোধী’ কথা বলছি না ( সবাই নয়, ‘অনেকেই’ বলেছি) । যতটুকু চোখে পড়ে —চোখ বন্ধ করলে সেটুকু তো আর মিথ্যে হয়ে যাবে না। প্রসঙ্গ অন্যদিকে সরে যাচ্ছে, আম-কাঁঠালের কথা বলছিলাম—
আমের সময় আমতেল, আমের আচার, আমচুর, আমের টক, আমের চাটনি সবই কমবেশি খাদ্যতালিকায় থাকতো। বাড়ির তৈরি জিনিস, খেয়েদেয়ে বছরশেষেও থেকে যেত, তারপর সেগুলো ফেলে দিয়ে পাত্র পরিষ্কার করে আবার বানানো হতো।
বর্ষাকালের সকালে ফেনাভাত খাওয়ার প্রচলন ছিল, সেই ফেনাভাত সঙ্গে কাঁঠালের বিচি, আলু একসঙ্গে সেদ্ধ করা হতো। সেগুলো ভালো করে সর্ষের তেল মরিচ দিয়ে মাখিয়ে গরম গরম খাওয়া হতো। সঙ্গে বাড়িতে বানানো ঘি… যদিও সবার কপালে ঘি জুটতো না। এখন আর তেমন ফেনাভাত খাওয়ার প্রচলন নেই। কেউ কেউ শখ করে দু-একদিন খান । তবে সেই মোটা কালো পরাঙ্গি, লালঢ্যাপো, কটকতারা, পোড়াবিন্নি চালের স্বাদগন্ধ এখন রূপকথা।
গ্রামের হাটে আম-কাঁঠাল খুব কম দামে বিক্রি হতো । কারণ সবার বাড়িতে কম বেশি ফলের গাছ ছিল । তবে মাঝে মাঝে শহরে কারবার করা ব্যাপারিরা এসে কিনে নিয়ে যেত। সেদিন একটু বেশি দাম পাওয়া যেত।
বর্ষার সময় কাদা রাস্তায় মানুষের কষ্ট হতো বটে, কিন্তু এখনকার মতো কাদা দেখে আঁতকে উঠতেন না কেউ। এরকম ঘৃণা করার ব্যাপারটাই তখন ছিল না । আমরা কলেজে পড়াকালীন বাড়ি থেকে জুতো হাতে করে বড় রাস্তায় গিয়ে পা ধুয়ে জুতো পরে বের হতাম। আবার ফেরার পথে জুতো খুলে হাতে নিতাম। এখন লোকে সামান্য একটু জল-কাদা দেখলে এমনভাবে পা ফ্যালে যেন শ্রীচরণ অপবিত্র হয়ে যাবে। আমরা দেশের মাটি ঘৃণা করতে শিখছি — আমাদের পতন ঠেকায় কে ? সেদিন দেখলাম টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেখাচ্ছে— কোনো এক গ্রামে কাদা রাস্তা থাকার কারণে নাকি ছেলেমেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না…
কী মানুষ ছিল এই দেশে, আর এখন কী মানুষ হয়েছে…
আগেকার দিনে সাধারণত গ্রামে কৃষি কাজের লোক ব্যতীত কাজের লোক রাখা হতে না। অবস্থাপন্ন গৃহস্থরা মাসমাইনে দিয়ে কাজের লোক রাখতেন। অজয় কুমার বসুর তথ্যমতে – দেশভাগের পরবর্তী সময়ে মাসিক ১০-১২ টাকা বেতনে কাজের লোক পাওয়া যেত। অধিকাংশ বাড়িতে যাবতীয় কাজ বাড়ির মহিলারাই করতেন। বর্ষার সময় তাদের কাপড় শুকোনো একটা বিরাট ঝামেলার কাজ। গোয়ালের কাজ, ঘরের কাজ, এঘর থেকে ওঘর যাওয়া — বলা যায় বাড়ির বউ-ঝি’রা ভিজে ভিজেই কাজ করতেন। কাজ করতে করতে কাদায় পা খেয়ে যেত। আর কাপড় শুকোতে অসুবিধা বলে এ-সময়টাতে বাকসো থেকে পুরোনো কাপড় বের করে রাখা হতো। হয়তো সেলাই করা বা মলিন — সেগুলো বর্ষার সময় কাজে লাগানো হতো। পুরুষের ক্ষেত্রেও তাই। অবস্থাপন্ন গৃহস্থরা বর্ষার আগে হাট থেকে বাড়তি লুঙি-গামছা- শাড়ি কিনে রাখতেন। আমাদের অঞ্চলের হাটে পাবনা-কুষ্টিয়া-সিরাজগঞ্জের লুঙ্গি গামছার খুব কদর ছিল। ছেলেবেলায় দেখেছি ২০-৩০ টাকায় গামছা, ৪০-৫০ টাকায় ভালো লুঙ্গি পাওয়া যেত। যুগের হিসেবে এসবের দাম তেমন বাড়েনি। এখনও ৮০ টাকায় একটা ভালো মানের গামছা পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধ পড়লে হয়তো অজয়বাবু মনে মনে হাসবেন -কারণ তিনি আমাকে বলেছিলেন –
” আমার ছেলেবেলা অর্থাৎ ১৯৪৫-৫০ -এ দুধ এক টাকায় চার সের। চালের মণ ৯-১০ টাকা, ধুতিশাড়ি সাড়ে তিন থেকে সাত -আট টাকার মধ্যে “
যারা ক্ষেতমজুর তাদের এই বৃষ্টিবাদলার সময়টা তাদের বেশ অভাবে কাটতো, মাঠ-ঘাট অতিবৃষ্টি বা বন্যায় ডুবে গেলে অভাব আরো তীব্র হতো। অনেকে এ সময়ে নৌকার মাঝিমাল্লার কাজ করতেন। কুমোররা নৌকাভর্তি হাড়ি-সরা ও বিভিন্ন মাটির বাসন নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। অধিকাংশ সময়ে ধানচালের বিনিময়ে সেগুলো বিক্রি হতো।
অভাবী মানুষের ঘরে চাল বাড়ন্ত হলে অনেকে খুদ রান্না করতেন । আর হাটের দিন চালের চালাগুলোতে কমদামি মোটা চালের চাহিদা এসময়টাতে বেড়ে যেত। হাট থেকে ফেরার পথে অনেকে এক- আধ সের চাল কিনে গামছায় পোটলা বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে যেতেন।
বর্ষাকালে হাটে দেশি ছোট মাছের আধিক্য থাকলেও তার দাম ছিল না তেমন। মাছ বেচে চাল-ডাল-আলু-মরিচের পয়সা ঠিকমতো উঠতো না। মাঠে কাজ না থাকলে এই সময়টাতে তারা মাছ ধরে উপার্জন করতে চেষ্টা করতেন, জাত জেলেদের মতো তারা দাম বুঝে মাছ বেচতে জানতেন না, ফলে ঠকে যেতেন। যারা রুই-কাতলা-মৃগেল কিনতেন তারাও সস্তা পেয়ে বাড়তি কিছু ছোট মাছ নিয়ে যেতেন। বড় মাছের কানকোর মধ্যে দড়ি বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নেওয়ার দৃশ্য এখন দেখি না । বড় মাছ কিনলে হাট থেকে বাড়ি পর্যন্ত দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল… পথে লোকে দাম জিজ্ঞেস করবে, ওজন জিজ্ঞেস করবে, তা নিয়ে সন্ধেবেলা চায়ের দোকানে আলোচনা হবে — গর্বের বিষয় বৈকি। তখনকার দেখনদারিটা নেহাৎই একটু সাময়িক উত্তেজনার ফল —এখনকার মতো আগ্রাসী নয়। এখন যেমন হুট করে পনের কেজি ইলিশ কিনে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। এভাবে দু-পাঁচজন কিনলে হাটে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হলো, দাম বেড়ে গেল, গরীবে আর কিনে খেতে পারলো না…
বর্ষায় সময়ে কৃষিকাজের জন্য মাথাল, মাছ ধরা ঘুণি, জাল, পোলো এসব ব্যবসা জমে উঠতো হাটগুলোতে। আমাদের অঞ্চলে জলাভূমি কমে যাওয়ায় এসবের তেমন ব্যবসা নেই। তবে নিচু অঞ্চলে আজও এসবের প্রচলন তেমন কমেনি। দেশি মাছের আকাল পড়ার পর থেকে নতুন প্রজন্ম এসব কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে… তবে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদনে আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যতম।
বর্ষাকালে চারদিকে থইথই জল… বাঙালির চিরন্তন বিনোদনের উৎস যাত্রাগান -পালাগান -কবিগান বন্ধ হয়ে যেত । এসবের জোয়ার অবশ্য আমরা খুব বেশি দেখিনি। শ্রদ্ধেয় অজয়বাবু জানাচ্ছেন বৃষ্টির সময়টাতে
” ঢিমেতালে মহলা / তৈরী হওয়া চলতো”।
‘মহলা’ বলতে বোঝায় যাত্রা বা গানের পূর্বাভিনয় বা পূর্বপ্রস্তুতি।
তখনকার বর্ষাকালের কথা এত সহজে শেষ হবার নয়। সেই মুগ্ধতা, সেই রঙ-রূপ, সেই মমতা খুঁজে পেতে ডুব দিতে হবে অতীতের ভরা জলে।
এত ‘শিকখিতো’ মানুষ তখন ছিল না … এতো রেষারেষি, এতো ‘স্টাটাস মেইনটেইন’ করা, এত বিভেদ তৈরির উপকরণ তখন দেখা যায়নি।
এত পাকা রাস্তাও ছিল না। কাদায় পা পড়লে লোকে বলতো না যে, ” ধ্যা… অ্যা…ত , এখানে মানুষ বাস করতে পারে ? “
এসব দেখেশুনে এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, সব রাস্তা কেন পাকা হতে হবে? এই উগ্র- লেনদেনসর্বস্ব দেখনদারি জীবনযাপন, আগ্রাসী মনোভাব ও পণ্যসংস্কৃতির যুগে জলকাদার স্পর্শ মানুষের খুব দরকার… নইলে পতন অনিবার্য…
শত শত বছর ধরে চলে আসা সেই দৃশ্যগুলো, সেই কাজকর্ম -অভ্যেসগুলো হঠাৎই যেন দশ-পনের বছরের মধ্যে পাল্টে গেল। আমাদের অভ্যেস- রুচি, ওঠাবসা, কথাবলা অনেকটা আকস্মিকভাবে পরিবর্তন হয়ে গেল।
পরিবর্তন নাকি বিকৃতি ?
কোনটা ?
‘ রেখো, মা, দাসেরে, মনে… ‘
… … … …
… … … …
এই লেখাটি সম্পূর্ণ স্মৃতিচারণমূলক — তাই কোনো বইপুস্তকের তথ্য ব্যবহার করতে চাইনি । যতটুকু লিখেছি স্মৃতি থেকে…
আরও সূদুর অতীতের স্পর্শের জন্য সাহায্য নিয়েছি শ্রদ্ধেয় অজয় কুমার বসু মহাশয়ের — যিনি ছোটবেলায় দেশভাগের পর বাবার হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিয়েছেন— তাঁর ছাত্রজীবন-কর্মজীবন সেখানে অতিবাহিত হয়েছে। প্রায় ৮৫ বছর বয়সেও তিনি নিয়মিত নিজের জন্মস্থান,নিজের এলাকার খোঁজখবর রাখেন— সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেলে আসা নদী, মাঠ, গ্রাম-গঞ্জের ছবি দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন । এই বয়সেও তাঁর বুকে জন্মভূমি জীবন্ত ও সজীব হয়ে আছে । সেসব গল্প তিনি আমাকে একের পর বলতে থাকেন— আর আমি মুগ্ধ বালকের মতো শুনে যাই । সূদুর অতীতের স্মৃতির সুরভী পেয়ে চলে যাই সেই মায়াভরা বাঙলায়। তাঁর শারীরিক সুস্থ্যতা ও সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করে আমার এই সামান্য লেখাটি তাঁকে উৎসর্গ করলাম…
৫ ই শ্রাবণ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ ।