নারী-পুরুষ সম্পর্ক : জেনেটিক প্রভাব — দ্বিতীয় অধ্যায়

রঞ্জনা বিশ্বাস

সঙ্গী নির্বাচনে জেনেটিক প্রভাব

মানুষের জন্ম, পরিবেশ ও আচরণগত কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর এই সকল বৈশিষ্ট্যের  সাহায্যে সে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয় ও বেঁচে থাকে। চার্লস ডারউইন ঊনবিংশ শতকে মানুষের এই বেঁচে থাকা প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক নির্বাচন তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন যে, মানুষ অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে সংযুক্ত এবং মানুষের আচরণের অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয় প্রবৃত্তি দ্বারা। এই ধারাবাহিকতায় মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমসও জানান  আমাদের আচরণের বড় একটি অংশ প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত। এটি পূর্ব ভাবনাপ্রসূত নয় এবং পূর্ব শিক্ষা ছাড়াই এর প্রকাশ ঘটে। এপ্রসঙ্গে উইলিয়াম জেমস ১৪টি প্রবৃত্তির কথা উল্লেখ করেন। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রবৃত্তি হচ্ছে জন্মগত প্রবণতা।এটি প্রকাশে পূর্বাভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। আধুনিক মানুষের সহজাত আবেগের আদর্শ সম্পর্কে গবেষণার ফলে নতুন নতুন তথ্য আমাদের সামনে আসছে। দেখা যাচ্ছে,  মানুষের ব্যবহারের মধ্যেও প্রচুর বৈপরীত্য রয়েছে। অনেক সময় এটা সনাক্ত করা কঠিন যে; কোনটি মানুষের সহজাত আচরণবা প্রবৃত্তিগত আর কোনটি অর্জিত আচরণ। মানব শিশুর হাঁটা শেখা, খাদ্য গ্রহণ করা, বাচনিক শিক্ষা অর্জন প্রভৃতি করতে হয় অনুশীলনের মাধ্যমে। অন্যদিকে যৌন আচরণ সংযুক্ত রয়েছে প্রাকৃতিক চাহিদার ওপর। সন্দেহ নেই সহজাত আবেগের কারণেই সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি মোড হচ্ছে যৌন নির্বাচন । এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায এক লিঙ্গের মানুষ অন্য লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে  আন্তঃসম্পর্কীয় নির্বাচনে অংশ নেয় এবং একই লিঙ্গের সদস্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক যৌন অ্যাক্সেসের জন্য প্রতিদ্বন্দিতা করে। এই প্রতিদ্বন্দিতা সৃষ্টি হয় নারী পুরুষের  পারস্পারিক চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে। আর সন্দেহ নেই যে, বহু যুগের এই চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েই নারী গড়েছে পুরুষের মনভূমি আর পুরুষ গড়েছে নারীর মানস। আর তাই  অবচেতনেই তারা উভয়েই তাদের নির্বাচিত সঙ্গীকে উদ্দেশ করে বলতে পারে- 

শিল্পী আমি, আমি কবি,
তুমি আমার আঁকা ছবি,
আমার রচা কাব্য তুমি, আমার রচা গান।

যৌন নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণত, নারীদের দ্বারা নির্বাচিত হওযার জন্য পুরুষেরা তাদের শারীরিক ফিটনেস প্রদর্শন করে। প্রাণীকুলে একমাত্র পুরুষেরাই নিজেকে বিকশিত করে আর অসাধারণ ও অতুলনীয়রূপে নিজেকে উপস্থাপন করে থাকে। এই ধারাবাহিকতায় তাদের সর্বাঙ্গসুন্দর চরম প্রচেষ্টাগুলি যৌন বৈশিষ্ট্যে যৌন দ্বৈততা তৈরি করে, যেমন- ময়ূরের পেখম, সিংহের কেশর, হরিণের সিং প্রভৃতি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে প্রথম ও প্রধান প্রবৃত্তি হলো বেঁচে থাকা, টিকে থাকা। এই আকাক্সক্ষা তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে বলেই নিজের জিনকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রেখে যেতে চায় মানুষ।আর তাই সে চায় চূড়ান্ত জৈবস্বাচ্ছন্দ্য। সে চায় কমপক্ষে প্রজননক্ষম বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে। ঠিক একারণেই মানুষ চায় নিজের জন্য এমন  সঙ্গী নির্বাচন করতে যে কিনা শিশুটির নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হবে ,বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। যদিও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মোদ্দা কথা হচ্ছে যোগ্যতমের টিকে থাকা। কিন্তু চার্লস ডারউইন দেখলেন যে, প্রকৃতিতে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে  টিকে থাকা সম্ভব নয়।

বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন

অথচ সেই বৈশিষ্ট্যগুলি দিব্যি টিকে আছে! এর কারণ কী হতে পারে? তিনি বলেন, এর কারণ- এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিপরীত লিঙ্গের যৌন সঙ্গীর দ্বারা আদৃত হয়ে আসছে। অর্থাৎ এই বৈশিষ্ট্যগুলি বিপরীত লিঙ্গের মনের মধ্যে গড়ে তুলেছে এমন এক অভিরুচি যার কারণে তার অন্তর্লোককে বহির্জগতের ছন্দে আন্দোলিত করে। সে গেয়ে ওঠে-

পারিব না কি যোগ দিতে এই ছন্দে রে,
খসে যাবার, ভেসে যাবার
ভাঙবারই আনন্দে রে।

নারীর মধ্যে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টির যে মৌল প্রেরণা, যা তার চিরন্তন অভিলাষ তার জন্ম হয় পুরুষের এই বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখেই। আর এটি চলছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাকের পর শতক। এ প্রসঙ্গে ডারউইন সবচেয়ে আকর্ষনীয় উদাহরণ দিলেন ময়ূরের পেখম দিয়ে। যদি ভারী পেখম ছাড়া ময়ূরী প্রকৃতিতে দিব্যি টিকে থাকতে পারে তা হলে ময়ূরের পেখম দরকার কী জন্য? এই দীর্ঘ পেখম ময়ূরকে বেঁচে থাকার জন্য বা প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য কি কোনো বাড়তি উপযোগিতা দেয়? দেয় না। বরং দীর্ঘ পেখম কোনো কোনো সময় ময়ূরের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাকে ব্যহত করে। শিকারীর হাত থেকে পালাতে এই পেখম অনেক বেশি ঝুঁকি তৈরি করে থাকে। তা হলে কেন এই পেখম? ডারউইন বললেন, এটা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিযার ক্ষেত্রে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং ময়ূরের পেখম টিকে আছে মূলত ময়ূরীর পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে। লম্বা ও সুদৃশ্য পেখম যে ময়ূরের আছে তাকে স্বাস্থ্যবান ও ভালো জিনের নির্দেশক হিসেবে মনে করে ময়ূরী। ফলে দীর্ঘ, সুদৃশ্য ও উজ্জ্বল রঙের পেখম বিশিষ্ট ময়ূর নির্বাচিত হয় তার পছন্দের যৌন সঙ্গী হিসেবে। একই ভাবে প্রাণী জগতে হরিণের শিং, সিংহের কেশর, ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাক, কোকিলের গান সবই যৌন নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য। মেটিং সিলেকশনের এই মায়াবী খেলা চলে প্রায় সব প্রাণীর মধ্যে। স্তন্যপায়ী সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই দেখা যায় নারীর তুলনায় পুরুষ সাধারণত অনেক বড় এবং বলশালী হয়। পুরুষেরা প্রায়শই নারীর মনোযোগ পেতে লিপ্ত হয় শক্তি পরীক্ষায়। হরিণ তার প্রজনন ঋতুতে শৌর্য বীর্যের পরিচয় দিতে শিঙের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এই লড়াইয়ে কোনো কোনো হরিণে তাদের সুদৃশ্য শিং হারায়। তবু সে এই লড়াইয়ে প্রতিবার লিপ্ত হয়। সে এই প্রেরণা পায় বিপরীত লিঙ্গের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতার মধ্য দিয়ে।

আর সব প্রাণীর মতোই মানুষও প্রাণী জগতের বিশেষ একধরনের প্রাণী। তাই প্রাকৃতিক কারণেই সেও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বংশ বিস্তার ঘটাবে। আর তাই তাদের ক্ষেত্রেও যৌন নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ। কেননা এর মাধ্যমেই তো সে নিজের জিনকে উৎকৃষ্ট প্রজন্মের মধ্যে চালিত করার প্রয়াস পাবে। এ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষেরও রয়েছে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য, যা অন্যের চোখে সৌন্দর্য বলে বিবেচিত হয়। এই সব বৈশিষ্ট্য  বিবর্তনের মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কে প্রোগ্রাম করা থাকে এবং তা উভয়ের জন্য যৌন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এক ধরনের যোগ্যতার নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। নারী পুরুষ তাদের নিজেদের জন্য যোগ্য সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই নির্দেশককে মানদন্ড হিসেবে মেনে নেয়।

এক্ষেত্রে নারী পুরুষ নির্বিশেষে তার সঙ্গী নির্বাচনের বেলায় প্রতিসম মুখ (symmetical) ও গড়পরতা চেহারাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বিজ্ঞানীরা বলেন, এর কারণ হলো বংশানুগত বৈচিত্র্য বা জেনিটিক ডাইভার্সিটি। যৌন নির্বাচনে জেনেটিক ডাইভার্সিটি যত বেশি হবে তত বেশি পরবর্তী প্রজন্ম রোগ প্রতীরোধে অধিকতর সমক্ষমতা লাভ করবে । শুধু তা-ই নয়  প্রতিকূল পরিবেশে তারা সহজে অভিযোজিত হবার ক্ষমতাও অর্জন করবে। আবার দেখা গেছে, যে পুরুষ যুদ্ধে যত বেশি সফল ও সহিংস তার প্রতি নারীদের আগ্রহ সর্বাধিক। তাই যে পুরুষের পেশী যত বলিষ্ট নারীরা আজো তাকেই পছন্দের তালিকায় প্রথমে ঠাঁই দেয়। মানুষকে এক সময় বিপদসংকুল পরিবেশে টিকে থাকতে দরকার পরেছে যুদ্ধের। এ লড়াই পশুর সঙ্গে মানুষের যেমন ছিল তেমনি ছিল গোত্রের সঙ্গে গোত্রের। সন্দেহ নেই এই লড়াইয়ে  টিকে গেছে তারা-ই যারা যত বলিষ্ট আর সহিংস। ডারউইনের মতে ‘অধিকতর যোগ্যতমেরা।’ পুরুষ দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্য দিয়ে এসেছে বলে স্বভাবে সে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি সহিংস। এই সহিংসতার মধ্য দিয়ে সে নিজ নিজ গোত্রকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। নিরাপত্তা পেয়েছে নারী ও শিশু। ফলে নারীরা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সব সময় সাহসী পুরুষকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। আমরা একটু খেয়াল করলে দেখব, আমাদের সমাজে নারীরা কোনো কোনো সময় পুরুষের সহিংস আচরণকে উস্কে দিচ্ছে এবং সমর্থন করছে। এই সমর্থনের পিছনে কাজ করে তার পূর্ব পুরুষের মস্তিষ্ক।

কিন্তু তাই বলে কি প্রতিসম মুখের বৈশিষ্ট্য যাদের নেই কিংবা যাদের বীরত্ব দেখাবার ক্ষমতা নেই তারা কি বসে থাকবে হতাশ হয়ে? মোটেই না। তারাও তখন অন্যান্য প্রাণীর মতোই নিজস্ব গুণ নিয়ে হাজির হয়। তারাও অংশ নেয় প্রতিযোগিতায়। তারা নারীর মন পেতে শিষ দেয়, গান গায়, গুহার দেওয়ালে এঁকে রাখে বিচিত্র সব চিত্রকর্ম, কেউ বা নাচে অংশ নেয়। এদের হয়তো দাপট না থাকতে পারে দর্প ঠিকই থাকে।

পুরুষের সহিংসতাই যে কেবল নারীর পছন্দের কারণ তা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী তার সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয় নাচ-গানকেও। এই সময়েও এমন সব আদিবাসী ট্রাইবের দেখা মিলবে যেখানে পুরুষেরা নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় আর সেখানে দর্শক কেবল নারী। পুরুষের নাচ দেখে নারীরা একসময় তাদের জন্য সঠিক যৌন সঙ্গী নির্বাচনের কাজটি করত বলে প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। The Royal society Journal Biologe letters. এ ২০১০ সালে একটি গবেষণা উপস্থাপন করেন একদল গবেষক যার শিরোনাম `male dance moves that catch a woman’s eye’। এই গবেষণা পত্রে দেখানো হয়েছে  সুন্দর ভাবে নাচতে পারা সুস্বাস্থ্য ও উচ্চ প্রজননক্ষমতাকে নির্দেশ করে।  গবেষণার জন্য কিছু পুরুষকে নির্বাচন করা হয় নাচার জন্য। এরা কেউই পেশাদার নৃত্য শিল্পী ছিলেন না। নির্বাচিত পুরুষেরা  সাধারণ ড্রামের তালে তালে নাচেন। এই নাচের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করে  কম্পিউটারের মাধ্যমে এনিমেডেট কার্টুন করা হয়। এই কার্টুনগুলো আবার কিছু নারীকে দেখতে দেওয়া হয় এবং দেখে রেটিং করতে বলা হয়। রেটিং এর স্কোর নির্ধারন করা হয় ১—৭ এর মধ্যে। দেখা গেল নারীরা বেশি নজর রেখেছেন নৃত্যরত পুরুষের গলা, ধর আর মাথার দিকে। হাত পায়ের দিকে তাদের কোনো খেয়ালই ছিল না! এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল- চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষও অন্যান্য প্রাণীদের মতো প্রেম নিবেদনের সময় নির্দিষ্ট ধরনের দেহ ভঙ্গি প্রকাশ করে কিনা তা যাচাই করা। অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে এইসব অঙ্গভঙ্গি তাদের বয়স-স্বাস্থ্য-প্রজনন ক্ষমতা ও হরমোনের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য নির্দেশ করে থাকে। গবেষণায় প্রমাণ মেলে – যে সব পুরুষ এই নাচের প্রতিযোগিতায় নারীদের কাছ থেকে উচ্চ রেটিং পেয়েছেন তাদের রক্তের বায়োক্যামিকাল পরীক্ষা করে দেখা গেছে তাদের শারিরীক ফিটনেস অপেক্ষাকৃত উত্তম। তা হলে দেখা যাচ্ছে যে নারীর মৌল উদ্দেশ্য যখন উত্তম জিনের মাধ্যমে নিজের বংশগতি টিকিয়ে রাখা তখন যোদ্ধা পুরুষের চেয়ে একজন নতর্ককে তুচ্ছ মনে করার কোনো কারণ নেই।

নারীর সঙ্গী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এরপর বাকি থাকে গান। নারীরা পুরুষের ভরাট কণ্ঠের গান অধিক পছন্দ করে। গমগম করা মাদকতাপূর্ণ কণ্ঠ নারীকে পুরুষটি সম্পর্কে তার হরমোন ও তার প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সটিক তথ্য নির্দেশ করে। আর তাই পুরুষটি যতই সুরেলা কন্ঠে মিনতি করুক- ‘আমায় নহে গো ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান’ তখন নারী কিন্তু ঠিকই টের পেয়ে যায় গানে গানে এই মিনতি মূলত গানকে ভালোবাসার জন্য নয় গানের শিল্পীটিকেই ভালোবাসার অনুরোধ। একই ভাবে মানুষের মধ্যে চিত্রকর্ম, কবিতা লেখা, প্রভৃতিও যৌনতার নির্বাচনের সহায়ক বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে বিপরীত লিঙ্গের কাছে। কেননা উন্নত মস্তিষ্ক প্রসূত এই সব বৈশিষ্ট্যের ধারক মানুষটি, সন্দেহ নেই, উন্নত জিনের বাহক হিসেবেই নির্দেশিত হয়েছে নারীর কাছে । আর নারী তাই  এগুলোকে তার যোগ্যতম সঙ্গী বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হিসেবে মনে করে এসেছে আদিকাল থেকে। মনোবিজ্ঞানী জেওফ্রি মিলার বলেছেন, মানুষের এত গুরুত্বপূর্ণণ  বৈশিষ্ট্যগুলোকে কেবল উপজাত হিসেবে চালিয়ে দেওয়াটা খুবই দুর্বল ব্যাখ্যা। তিনিও এগুলোর ব্যাখ্যায় যৌন নির্বাচনের দ্বারস্থ হয়েছেন।  তিনি বলেন, কবি এজন্য কবিতা লেখে না যে, কবিতা বোধ তার পূর্বপুরুষের মস্তিষ্কে দেয়াল চিত্রের মতো অতিরিক্ত শৈল্পিক কিছু হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল। বরং এজন্য লেখে যে, মানুষ সঙ্গী হিসেবে কাব্য রসিককে অধিকতর পছন্দ করে। ম্যাট রিডলীও মনে করেন, শৈল্পীক সৃজনশীলতা যেমন- সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কণ, রসজ্ঞান, ক্রীড়া নৈপুণ্য, মননশীল ক্রিয়াকর্ম সবই যৌন নির্বাচনেরই ফল। তার মতে মানুষের মস্তিষ্কের আকৃতি বড় হবার কারণই হলো যৌন নির্বাচনের চাপ। অতিরিক্ত যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে গিয়ে মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি তাপ খরচ করে। জেও ফ্রি মিলার যুক্তি দেন যে, সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কণ, নাচ, প্রভৃতি মননশীল ক্রিয়া কর্ম নারীর কাছে যোগ্যতার নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এজন্যই নারীদের মস্তিষ্কও এই নির্দেশকগুলিকে বিচার করার ক্ষমতা দিয়ে তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন যে, আদিম পুর্বপুরুষেরা যারা চিত্র শিল্পের সৃষ্টি করত তা তাদের শিকার বা খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো উপযোগিতা দেয়নি। তা সত্ত্বেও ঐসব শিল্পী নারীদের কাছে বাড়তি মনোযোগ পেত কারণ এগুলো কোনো না কোনো প্রজননগত সুবিধা প্রদানের সঙ্কেত দিত। মানুষের শরীরের মোট তাপ ক্ষয়ের বড় অংশই ঘটে মস্তিষ্কে। ফলে ব্যাক্তির মস্তিষ্ক দ্বারা সৃষ্ট সমস্ত সৃজন কর্ম ঐ ব্যক্তিকে উত্তম জিনের বাহক  হিসেবে বার্তা বা সঙ্কেত পাঠায় নারীর কাছে। এই ক্ষেত্রে সৃজন কর্ম হচ্ছে এক ধরনের ইন্ডিকেটর।  আর কোনো নারী যখন পুরুষের পেশীশক্তি ও তার মস্তিষ্কের সৃজন ক্ষমতাকে বিচার করতে সক্ষম হয় তখনই সে গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে –

স্বপন দুয়ার খুলে এসো, অরুণ আলোকে
এসো মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাষ হতে চিরকালের তরে
এসো আমার ঘরে।

যৌন নির্বাচনের কারণেই পুরুষ তৈরি করেছে নিজের শরীর কিংবা গড়ে তুলেছে নারীর মানস – তেমনি নারীও গড়ে তুলেছে নিজের জন্য পুরুষের মন। আর তাই এক লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যগুলো বিপরীত লিঙ্গের কাছে তৈরি করেছে বিশেষ আবেদন ও চাহিদা। নারীর কাছে লম্বা-চওড়া-স্বাস্থ্যবান পুরুষ আকর্ষনীয়। কারণ এক সময় এরাই রক্ষা করতে পেরেছে নিজের গোত্র ও উত্তর পুরুষের জিন। আর সেই আদিম বাস্তবতা আধুনিক মেয়ের মনে আজও জেঁকে বসে আছে তাদের অজান্তেই। তাই বলে কি যৌন সঙ্গী নির্বাচনে পুরুষের পছন্দ অপছন্দের কোনো ভূমিকা ছিল না? যদি না-ই থাকবে তা হলে লেখক-কবি-সাহিত্যিকরা নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় উপমা রূপক আর শব্দের অলঙ্কারে চিরকালীন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করছেন কেমন করে?  রবীন্দ্রনাথই বা তার চেতনার রঙে নারীকে সবুজ সজীব করে তুলবেন কেন? যুগ যুগ ধরে পুরুষও নারীর উজ্জ্বল ত্বক (ফর্সা বোঝাতে নয়), অসাধারণ মুখশ্রী, উন্নত বুক, ক্ষীণ কটি, সুডৌল নিতম্বকে মহার্ঘ বলে মনে করেছে। একসময় বিপদসঙ্কুল জঙ্গলের মধ্যে  নারীকে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হতো পুরুষের সঙ্গে। সেই সময় যখন আগুন আবিষ্কার হয়নি তখন খাদ্য স্বল্পতা ছিল মারাত্মক এক সমস্যা। এলাকায় খাদ্য স্বল্পতা দেখা দিলে বাচ্চাকে টিকিয়ে রাখতে হতো বুকের দুধ খাইয়ে। সেই সময় মানুষকে খাদ্য স্বল্পতার বিরুদ্ধে প্রায় ৯০ ভাগ সময়ই যুদ্ধ করতে হয়েছে । যে নারী এই খাদ্য স্বল্পতার সময় বুকের দুধ খাইয়ে তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কেবল তাদের জিনই টিকে গেছে। আর একারণেই কোনো নারীর বৃহৎ স্তন পুরুষের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে তার প্রজন্মের জন্য অফুরন্ত খাদ্য ভান্ডার হিসেবে। প্রস্তর যুগের এই ধারণা আজও সে তার নিজের অজান্তেই বয়ে নিয়ে বেড়ায় মনের মধ্যে। কোন নারী দেখলেই পুরুষের দৃষ্টি চলে যায় মেয়েটির বুকে, এটা তার অজান্তেই ঘটে থাকে। উন্নত বক্ষের নারীর প্রতি তার স্বযত্ন ও সহজাত কামনার একটাই কারণ। আবার শত্রুর আক্রমণের সময় যে নারী বাচ্চা কোলে নিয়ে দৌড়ে পালাতে সক্ষম হয়েছে সেই নারীই বাঁচাতে পেরেছে তার সন্তান, রক্ষা করতে পেরেছে তার ও তার সঙ্গীর জিন। আর এই রকম পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে নারীর কোমর হয়েছে ক্ষিণ ও নিতম্ব হয়েছে সুদৃঢ়। আর তাই যৌন নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীর সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষের আগ্রহের চিরকালের। তাছাড়া সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষের আগ্রহের আর একটি কারণ বিজ্ঞানীরা বের করেছেন। গবেষণায় তারা দেখেছেন যে, বিগত পাঁচ মিলিয়ন বছরে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বেড়েছে খুব দ্রুতগতিতে। ফলে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সময় তৈরি হয়েছে নানা রকম জন্মসংক্রান্ত জটিলতা। আর এই কারণে আদিম সমাজে ক্ষীণ নিতম্ব বিশিষ্ট মায়েদের মৃত্যুর হার ছিল অবিশ্বাস্য রকম বেশি। বড় মাথাওয়ালা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তারা বেঘোরে প্রাণ হারাতো। টিকি থাকতো কেবল তারা যাদের নিতম্ব ছিল সুদৃঢ়। ফলে সন্তান জন্ম দান ও তাদের টিকে যাওয়ার বিষয়টি পুরুষের মনজগতে একধরনের নির্বাচনী চাপ তৈরি করেছে। এই নির্বাচনী চাপের ফলই হচ্ছে নারী দেহের সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ। পুরুষের চোখে নারীর সৌন্দর্যকে সাংস্কৃতিক ব্যাপার মনে করা হলেও বিজ্ঞানীরা কিন্তু তা মনে করছে না। আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবেন্দ্র সিংহ—তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, নারীর কোমর ও নিতম্বের অনুপাত ০.৬ থেকে ০.৮ এর মধ্যে থাকলে তাকে সর্বজনীন ভাবে আকর্ষণীয় মনে করে পুরুষেরা। অধ্যাপক সিংহের মতে কোমর : নিতম্ব ০.৭ : ০.৮ এই অনুপাতই তৈরি করে মেয়েদের  ক্লাসিক আওয়ারগ্লাস ফিগার।

পারফেক্ট আওয়ার গ্লাস ফিগারের অধিকারী মেরিলিন মনোরো

আর এই ফিগারই পুরুষের মনে তৈরি করে আদিম ও অকৃত্রিম যৌন বাসনা। আর এক গবেষণায় দেখা গেছে, সুডৌল স্তন, সরু কোমর আর সুদৃঢ় নিতম্ব মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা ও উর্ব্বরতা প্রকাশ করে। যৌন উদ্দিপক হরমোন ইস্ট্রোজেনের একটি প্রকরণ, এডস্ট্রাডিঅল ও প্রজেসস্টেরন এর আধিক্য বিশ্লেষণ করে তারা এই সিদ্ধান্তে এসছেন যে  সুডৌল স্তন, সরু কোমর ও সুদৃঢ় নিতম্ব মেয়েদের সর্বোচ্চ উর্বরতা নির্দেশ করে। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর জনস্টোন তার ‘হোয়াই উই ফিল? দ্য সায়েন্স অফ হিউম্যান ইমোশন’ গ্রন্থে বলেন, মেয়েদের কোমর, ও নিতম্বের অনুপাত ০.৭ হলে এন্ড্রোজেন ও এস্ট্রোজেন হরমোনের যে অনুপাত গর্ভধারণের জন্য সবচেয়ে অনুকুল তা সেই অনুপাতকে প্রকাশ করে। এদিকে একজন পুরুষ যখন কোনো নারীকে দেখতে পায়, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় তখন তার মস্তিষ্কের নিওরোট্রান্সমিটার ডোপামিন মস্তিষ্ককে আলোড়িত করে, আনন্দ উদ্দিপনা তৈরি করে। এসময় ফেনাইল থ্যালামাইনের নিঃস্বরন হয় যার কারণে স্মায়ু কোষে তথ্যের আদান প্রদান বেড়ে যায়। সে তখন সঙ্গীকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। আর তখন সে প্রথমেই নজর দেয় নারীর বুক, কটি দেশ ও নিতম্বে। তার কাছে নারীর উচ্চতা কোনো কিছু ম্যাটার করে না। অন্য দিকে নারী হয়তো পুরুষটিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। কারণ নারীটি খুঁজছে এমন কাউকে যে তার এবং ভবিষ্যৎ সন্তানদের নিরাপদে রাখতে পারবে। তাই এই পরীক্ষায় উত্তির্ণ হতে হলে পুরুষকে হতে হবে  সাহসী , শক্তিশালী আর বিশ্বস্ত।  মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড বাস ৩৩টি দেশে সমীক্ষা চালান। তিনি দেখেন যে, সঙ্গী নির্বাচনের সময় ছেলেরা গড়পরতা দয়া বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি প্রত্যাশা করে তারুণ্য ও সৌন্দর্য। অন্য দিকে মেয়েরা গড়পরতা ছেলেদের কাছ থেকে দয়া বুদ্ধিমত্তা আশা করে ঠিকই তবে তার পাশাপাশি সঙ্গীর কাছ থেকে আশা করে ধন সম্পদ আর স্ট্যাটাস। আদিম যুগে যখন কৃষি বিপ্লব বলে কিছু ছিল না তখন মানুষকে শতকরা ৯০ ভাগ সময় ব্যয় করতে হয়েছে খাদ্য স্বল্পতার বিরুদ্ধে। যে পুরুষের খাদ্যাহরণের ক্ষমতা যত বেশি ছিল সেই পুরুষ তার গোত্রের নারীদের কাছে হয়ে উঠত ত্রাণকর্তার মতো। এদিকে ছেলেরা মেয়েদের স্টাটাস নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয় যতটা উদ্বিগ্ন মেয়েরা ছেলেদের স্ট্যাটাস নিয়ে। অধ্যাপক বাস ৬টি মহাদেশের বড় ৫টি দ্বীপপুঞ্জের ৩৭ টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ নিয়ে গবেষণা চালান।  তিনি তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা ১০০৪৭ জন লোকের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখলেন যে, মেয়েরা ছেলেদের আর্থিক প্রতিপত্তিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে। এখনও নারীর মনোজগতে এই প্রভাব অবচেতনে কাজ করে যায়।

অতএব এই কথা বলতে বাঁধা নেই যে, আজকের দিনেও নারী ও পুরুষের সঙ্গী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যে নির্বাচনীয় চাপ তাদের মানস গঠনে ভূমিকা রাখছে তা তাদের পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতার ফল। এই নির্বাচনীয় প্রক্রিয়ায় পুরুষ যদি তার কাঙ্ক্ষিত সঙ্গী পেয়ে যায়, সন্দেহ নেই সেও তখন গেয়ে উঠবে-

হেরিতে তোমার রূপ মনোহর,
পেয়েছি এ আঁখি ওগো সুন্দর।
মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর,
নয়নের সেই সাধ…

এই যুগে জন্ম-মৃত্যু ও বিয়েকে যত সহজে বিধাতার হাতের কারবার বলে নিশ্চিন্ত হতে পারে আদিম সমাজের মানুষ ততটা সহজে  তা পারেনি। আর তাই সে চটজলদি যে  কোনো সঙ্গী নির্বচন করতো না তা আজ প্রমাণিত। সঙ্গীকে নিয়ে সুখে থাকার আকাঙ্ক্ষা তার ছিল না , জীবন নিঙড়ে তার শেষ রসবিন্দু আস্বাদনের চেষ্টাও তার ছিল না। সে কেবল চাইতো পৃথিবীতে তার যোগ্য উত্তরসূরি রেখে যেতে। এটাই ছিল তার মনের চেতন ও অবচেন স্তরের এক মাত্র চাওয়া। আর একারণেই মানুষ যতটা পারা যায় , প্রাণের সবটুকু  শক্তি ও দরদ ঢেলে দিয়েছে তার সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে। সমস্ত ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে সে যোগ্য সঙ্গী খুঁজে নিয়েছে নিজের জন্য আর তাই আজ আমরা তাদের উত্তরসূরি পৃথিবীতে টিকে আছি। 

এদিকে সঙ্গী নির্বাচনেরর ক্ষেত্রে  নয়নের সাধ পুরণ হলেই আমাদের গোত্রমাতারা কাজে লাগাতেন তাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়। জগতে সবচেয়ে বেশি প্রখর হচ্ছে প্রাণীদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়। গন্ধের মাধ্যমে তারা যেমন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আবিষ্কার করে তেমনি  যৌন সম্পর্কের জন্য সঠিক সঙ্গী নির্বাচনের কাজটিও তারা সেরে ফেলে গন্ধের মাধ্যমে। মানুষও প্রাণী জগতের বাইরে নয়। আর তাই সেও সঠিক সঙ্গীর সন্ধান পেলে তার গায়ের গন্ধে মোহিত হয়। যখন নারী তার যৌন সঙ্গী নির্বাচনে দেহের গঠন, মুখের অবয়ব কোনো কিছুই মিলাতে পারছে না তখন সে আকুল হয়ে তার দেহের গন্ধ খোঁজে। আর যদি সে কারো গায়ে সঠিক গন্ধের সন্ধান পেয়ে যায় তখন সেই গন্ধ তার কাছে শুভ এক বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। তার মধ্যে জাগিয়ে তোলে ভাবয়িত্রী কারয়িত্রী শক্তি। সে দ্বিগুণ শক্তি  নিয়ে নিজের বেঁচে থাকাকে নিশ্চিত করার জন্য সেই গন্ধকে অনুসরণ করে। সে গেয়ে ওঠে-

মনোমোহন বন্ধু
আকুল প্রাণে
পারিজাতমালা সুগন্ধ হানে।
 কিংবা সে গেয়ে ওঠে-
বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে এ কি তব হলি খেলা!

বিজ্ঞানীরা দেখেন যে, প্রতিটি প্রাণীর শরীরে মেজর হিস্টোকম্পাট্যাবিলিটি কমপ্লেক্স জিন বা এমএইচসি জিন আছে। এই জিনের মধ্যেই গন্ধের তথ্যাবলী বিশেষ ভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। এই তথ্যাবলী স্বতন্ত্র গন্ধকে পরিবর্তীত করতে পারে। এই গন্ধ পরিবহনের পিছনে কাজ করে ফেরোমোন। এটা এক ধরনের  রাসায়নিক পদার্থ। এই রাসায়নিক ফেরোমোন স্বতন্ত্রভাবে দেহের বাইরে ঘামের সঙ্গে ক্ষরিত হয় যা অনেকটা হরমোনের মতো আচরণ করে। যারা এই ফেরোমোনের গন্ধ গ্রহণ করে এটা তাদের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। এই ফেরোমোন ‘নার্ভ জিরো’ নামের এক ধরনের করোটিক স্মায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে সঞ্চালিত হয়। যার ফলে প্রাণী জগতে সঙ্গী নির্বাচন এবং তার প্রজনন প্রক্রিয়া তরান্বিত হয়। প্রাণীরা এই ফেরোমোনের মাধ্যমে নিজেদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে পছন্দ ও অপছন্দের বার্তা জানিয়ে দেয়।  ডা. জুয়ান এল বোজাট বলেন, কিছু প্রজাতি ঘ্রাণ শক্তির ভিত্তিতে এমএইচসি টাইপের দ্বারা নিজেদের জন্য সম্ভাব্য সঙ্গী খুঁজে পেতে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। মানুষ যেহেতু প্রাণী তাই তাদের মধ্যেও ফেরোমোন নিঃসরণ ও তার গন্ধ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা থাকার কথা।

হিল্ডা ব্রুস ১৯৫৯ সালে ইঁদুর নিয়ে একটি গবেষণা করেন। সেই গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি ইঁদুরের সঙ্গে সঙ্গমের পর নারী ইঁদুর যদি অপরিচিত কোনো ইঁদুরের গন্ধ পায়, তাহলে তার জরায়ুতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপন হওয়ার বদলে তা ঝরে পড়ে। তবে পরিচিত বা চেনা গন্ধ তার ভ্রুণ প্রতিস্থাপনে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। এর অর্থ হলো ফেরোমোন এই ইঁদুরগুলোর ক্ষেত্রে অধিকতর পছন্দের সঙ্গীর মাধ্যমে গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে বা বাতিল করতে সাহায্য করে। ২০০৬ সালে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী লিন্ডা বাক ও তার সহযোগী  ইঁদুর নিয়ে আর একটি গবেষনা করেন সিয়াটলের একটি ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে। তারা গবেষণায় নতুন গ্রাহক প্রোটিন পরিবারের ১৫টি সদস্য সনাক্ত করতে সক্ষম হন। ইঁদুরের নাকে এই ফেরোমোন সনাক্তকারী প্রোটিনগুলো পাওয়া যায়। এই প্রোটিনগুলো ফেরোমোন সনাক্ত করতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বিজ্ঞানী লিন্ডা বাক মানুষের শরীরে ফেরোমোনের উপস্থিতি ও কার্যকারীতা নিয়ে গবেষণা করে দেখেন যে, তিনি ইঁদুরের মধ্যে যে সমস্ত ফেরোমোনের গ্রাহক জিন খুঁজে পেয়েছেন তার মধ্যে অন্তত ছয়টি মানুষের মধ্যে রয়েছে।

হেলেন ফিশার তার ‘এনাটমি অফ লাভ’ বইয়ে জানান যে, ‘পুরুষের গায়ের গন্ধ (ঘাম) মেয়েদের ঋতু চক্রকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। সে জন্যই ছেলেদের ঘামের গন্ধের প্রতি মেয়েদের (অবচেতনে) আকর্ষণ খুব সম্ভবত বিবর্তন জনিত।’

আর এক স্নায়ু বিজ্ঞানী লোয়ান ব্রিজেন্ডিন তার দ্য মেইল ব্রেন বইয়ে জানান, ‘ছেলেরা যখন বয়সন্ধিকালে পৌছায় তখন তাদের শরীর থেকে যে গন্ধ নির্গত হয় তা ফেরোমোন ও এন্ড্রোস্টেনেডিওনের সুষম মিশ্রণ। সহজাতভাবে বা প্রবৃত্তিগত ভাবে মেয়েরা এই গন্ধ পেয়ে যায়।’ তবে মজার বিষয় হলো মেয়েরা এই গন্ধ কিন্তু সাধারণ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পায় না । তারা এই গন্ধটা পায় বিশেষ এক অর্গানের সাহায্যে যার নাম ভোমেরোনাসা সংক্ষেপে ভিএনও। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রাণীরা গন্ধের মাধ্যমে এমএইচসি জিন সনাক্ত করতে পারে। এই এমএইচসি জিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে কোনো প্রাণী গন্ধ শুঁকে নিজের সন্তান বা আত্মীয়দের সঙ্গে সঙ্গম করা থেকে বিরত থাকে। প্রাণীর এই প্রবণতার নাম আন্তঃপ্রজনন পরিহার প্রবণতা। এটি এখন একটি তত্ত্ব হিসেবে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের শাখায় আলোচিত হয়। মূলত আন্তঃপ্রজননের ফলে জীব দেহের ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রতিরোধ করার মধ্য দিয়ে প্রাণীরা এই প্রবণতা প্রকাশ করে। আন্তঃপ্রজননের ফলে মা-বাবার মধ্যে থাকা ক্ষতিকর রিসেসিভ এলিলের অনুপোকারী ট্রেইটগুলো পরবর্তী প্রজন্মে প্রকাশ পায়। হোমোলোগাস ক্রোমোজম জোড়ের নির্দিষ্ট লোকাসে অবস্থানকারী জিন-জোড়ার একটি অপরটির এলিল। এই এলিল দুটি একইধর্মী বা বিপরীত ধর্মী হতে পারে। বিপরীত ধর্মী এলিলের ক্ষেত্রে একটিকে  প্রকট অন্যটিকে প্রচ্ছন্ন এলিল বলা হয়। তাই প্রজননের ফলে জন্ম নেওয়া ভাই বোনের মধ্যে তাদের মা-বাবার রিসিভ এলিলের অনুপোকারী ট্রেইটগুলো প্রকাশের ঝুঁকি প্রায় ফিফটি ফিফটি। আর এই ভাই বোনেরা পরস্পর একই এলিল সম্পন্ন দুটি আলাদা প্রাণী। তাই ঝুঁকি আরো বেড়ে যায় যখন একই এলিল সম্পন্ন দুইটি প্রাণীর মাঝে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। জীব বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেন যে, যদি বাবা মায়ের পরিবারে কোনো জিন বাহিত রোগ থাকে তবে একই রিসেসিভ এলিলে প্রজনন ঘটলে  তা শতকরা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানোর আশংকা তৈরি করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে কনজেটিকাল বার্থ ডিফেক্ট বা জন্মগত সমস্যা। বিজ্ঞানীরা এই ধারাবাহিকতায় আরো দেখেন যে, বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভপাত সমস্যার একটি প্রধান কারণ লুকিয়ে আছে এমএইচসি জিনের সমরূপতার মধ্যে। ফলে কোনো একটি প্রাণী তার নিজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত আর একটি প্রাণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখায় না। গবেষকগণ ঝিঁঝি পোকা নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন যে, নারী ঝিঁঝি পোকা  তার সহদোর বা তার নিজের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন ঝিঁঝি পোকোদের চেয়ে সেই সব ঝিঁঝি পোকাদের সঙ্গে মিলনে উচ্চ পর্যায়ের আগ্রহ দেখায় যাদের সঙ্গে তার এমএইচসি জিনের সম্পর্ক নেই। আর একটি গবেষণায় ক্রাকো ও তার সহকর্মীরা ইঁদুর নিয়ে কাজ করেছিলেন। তারা কিছু বন্য পুরুষ ইঁদুরের জন্য চারটি খোলা খাঁচা বানিয়েছিলেন। এই খাঁচার মধ্যে পুরুষ ইদুরগুলোর জন্য আত্মীয় ও অনাত্মীয় বেডিং রাখা হয়। দেখা গেল পুরুষ ইঁদুরগুলো অসহদোরা ও অনাত্মীয় নারী ইঁদুরের বেডিং এর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। আবার আর একদল বিজ্ঞানী পিকি পেঙ্গুইনদের সাথী পছন্দের ব্যাপারে রোগপ্রতীরোধে জিনের ভুমিকা নিয়ে কাজ করেছেন। তারা ১০টি পেঙ্গুইন বেছে নেন এই জিনের বৈচিত্র বোঝার জন্য। তারা এলোমেলো সঙ্গমের তুলনায় প্রজনন জোড়াগুলির মধ্যে এমএইচসি জিনের বৈচিত্র পরীক্ষা করে দেখন যে, এমএইচসি জিনোটাইপটি প্রজনন সুস্থতার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ১৯৯৭ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বংশানুবিদ ক্যারোল ওবারের গবেষণায় দেখা যায়, একই এমএইচসি জিন বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা সাধারণত একে অপরের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী হয় না।১৯৮০ সালের পর থেকেই এটা মোটামুটি ভাবে স্বীকৃত সত্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, নারীর দৈহিক মানসিক কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকা সত্ত্বেও তাদের সন্তান হচ্ছে না। এর কারণ নারীটির এমএইচসি জিন তার স্বামীর এমএইচসি জিনের কাছাকাছি। এমএইচসি জিনের সমরূপতার কারণে কম ওজনের বাচ্চা যেমন জন্মগ্রহন করে তেমনি ভাবে গর্ভপাতের হারও বাড়ে। ফলে সামাজিক ভাবে এই সমস্যার সমাধানের জন্য অন্যান্য প্রানীর মতোই মানুষ আন্তঃপ্রজনন পরিহার করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন মানুষ সেই আদি কাল থেকেই অবচেতনেই গন্ধের মাধ্যমে এই বিষয়টির সুরাহা করে আসছে। যে কারনে আজ সমাজে অজাচার নিষিদ্ধ।  জীব বিজ্ঞানী ক্লাউস ওয়েডেকাইন্ড ১০০ জন কলেজ ছাত্রের ওপর একটি গবেষণা চালান। তিনি এই ১০০ জন ছাত্রকে আলাদা করে তাদের ২ দিন ধরে সুতির জামা পরিয়ে রাখেন। এই সময় তারা কোনো ঝাল বা কটু স্বাদযুক্ত খাবার খায়নি, ধুমপান করেনি, ডিওডোরেন্ট বা পারফিউম ব্যবহার করেনি, সুগন্ধি সাবান ব্যবহার করেনি। মোট কথা গায়ের গন্ধকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সব ধরনের কাজ থেকে তাদের বিরত রাখা হয়েছিল। এরপর তাদের জামাগুলো সংগ্রহ করে একটি বাক্সে করে পাঠানো হয়েছে আর একদল  অপরিচিত ছাত্রীর কাছে। এই ছাত্রীদের দিয়ে জামাগুলো শোঁকানো হয়। গন্ধ শুঁকে মেয়েরা নিজেদের জন্য একটি জামা বাছাই করে। মেয়েরা নিজেদের জন্য যে জামাটির গন্ধকে সেক্সি বলে বাছাই করলো, দেখা গেল সেই সমস্ত টি শার্টের অধীকারীদের এমএইচসি জিন মেয়েদের নিজেদের এমএইচসি জিন থেকে অনেকটাই আলাদা। আর যাদের এমএইচসি জিন নিজের জিনের কাছাকছি বলে মনে হয় তাদের মেয়েরা নিজেদের ভাইয়ের মতোই মনে করে থাকে।

এদিকে জুরিখের এক বিজ্ঞানী তামারা ব্রাউন তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, মানুষের ডিএনএতে হিউম্যান লিউকোসাই এন্টেজেন (এইচ এল এ) নামে একটি অত্যাবশকীয় উপাদান রয়েছে। এই উপাদানে অর্থাৎ এইচএলএ এর বিন্যাসে যত বেশি বৈচিত্র থাকবে  তত বেশি বাড়বে একে অপরের প্রতি তাদের আকর্ষণ। বিজ্ঞানীরা বলেন এই বৈচিত্রের সন্ধান প্রাণীরা  পায়  কেবল গন্ধের মাধ্যমেই। আর এভাবে সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে অর্জন করে এক ব্যাতিক্রম অভিজ্ঞতা।  এই অভিজ্ঞতা থেকেই কবি  বলেন-

যতই দূরে যেতে চাই, ততই আসি কাছে
আমার গায়ে, তোমার গায়ের গন্ধ লেগে আছে।

তবে অন্যান্য প্রণীরা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে গন্ধের ওপর যত বেশি গুরুত্ব দেয় এই সময় মানুষ ততটা দেয় না। এর কারণ মানুষ তার দৃষ্টি শক্তি, শ্রবনেন্দ্রিয় ও বুদ্ধিমত্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল।

সন্দেহ নাই প্রতিটি নারী চায় তার অস্তিত্বের সাক্ষী রেখে যেতে, প্রতিটি পুরুষ চায় তার অস্তিত্বের প্রমান রেখে যেতে। একারণেই নারী নিজের জন্য সুযোগ্য সঙ্গী খোঁজার এমন একধরণের প্রতিযোগিতায় নামে যে কিনা তার জিনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সকল দায় দায়িত্ব মাথা পেতে নেবে। তাছাড়া যার সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধলে বন্ধ্যাত্বের ভয় নেই, গর্ভপাতের ঝুঁকি নেই কিংবা তার সন্তান জন্মাবে না জন্মগত কোনো সমস্যা নিয়ে এমন সঙ্গীর খোঁজ তো সে করে গন্ধের মাধ্যমে! অপর দিকে পুরুষ চায় এমন সঙ্গী যে তার জিনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সন্তান জন্মদানের সময় প্রাণ হারাবে না। কিংবা সন্তানকে পর্যাপ্ত খাবার দিতে পারবে, সন্তানকে নিয়ে লড়াইয়ে  টিকে থাকতে পারবে। আর তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি সেকালের মানব সমাজে সঙ্গী নির্বাচন প্রক্রিয়া উভয়ের জন্য বেশ জটিল ও সময় সাপেক্ষে ব্যাপার ছিল। যারা মনে করেন আদিম সমাজে মানুষ যত্রতত্র বা হরহামেশা সঙ্গমে লিপ্ত হতো তাদের সে ধারণা একেবারেই ভুল। মানুষ তো দূরের কথা প্রাণী কুলেও উৎসাহব্যাঞ্জক ভাবে এরকম প্রবৃত্তি লক্ষ করা যায় না। সে যা-ই হোক, সঙ্গী নির্বাচনের প্রাথমিক ধাপগুলি অতিক্রমের পর  মানুষের মধ্যে একটি চুম্বনের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করা যায়। চুড়ান্ত সম্পর্ক তৈরির আগের এই চুম্বনটি তাই মানুষের কাছে সম্পর্কের মাহেন্দ্র ক্ষণ বলে বিবেচিত হয়।  এই পর্বে এসে প্রেমিক বা প্রেমিকার মনের অবস্থা কী রকম হয় কবি তা বেশ ভালো ভাবেই উপলব্দি করতে পারেন। কবিগুরু তাই বলেন-

 হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে
 মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ পরে
 তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন
 অধর মরিতে চায় তোমারই অধরে।

 মানুষের এই চিরন্তন ও চিরকালীন আকাক্সক্ষার মধ্যে নিহিত থাকে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টির অভিপ্রায় যার মধ্যে তাদের জিন বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে।আর তাই এই ভাবে অধর স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে সে সনাক্ত করতে চায় যোগ্য জিনের বাহক।

দ্য কিস: শিল্পী আগস্টিন রডিন

মানব সংস্কৃতির মধ্যে চুম্বন হলো ভালোবাসার গভীরতা প্রকাশের একরকম ভাষা। টেক্সাসের এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ভন ব্রায়ান্ট। তিনি তার গবেষণায় উল্লেখ করেন যে, খ্রিষ্ট পূর্ব ১৫০০ বছর আগে ভারতের প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থ বেদে প্রথম চুম্বনের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর এরই ধারাবাহিকতায় সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীন গ্রন্থসমুহে চুম্বনের উল্লেখ রয়েছে। তবে চুম্বন সম্পর্কে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার বর্ণনা রয়েছে বাৎসায়ণ প্রনীত ‘কামসূত্রে’। ড. অতুল সুর ও অন্যান্য পন্ডিতেরা মনে করেন এই গ্রন্থটি খ্রিষ্টের জন্মের এদিক ওদিক দুই এক শতাব্দির মধ্যে রচিত হয়েছে। তবে বাৎসায়নের আগে বৈদিক সংস্কৃত গ্রন্থে চুম্বনকে বলা হয়েছে ‘পরস্পরের আত্মাকে অনুভবের ক্রিয়া’। আর এই ধারণাকে আধুনিকায়ন করে কবিগুরু ‘কড়ি ও কোমল ’কাব্যে চুম্বন নামক একটি কবিতা লেখেন। সেখানে তিনি বলেন-

অধরের কানে যেন অধরের ভাষা
 দোহার হৃদয় যেন দোহে পান করে
 গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
 তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধর সঙ্গমে।

তবে বৈদিক গ্রন্থে চুম্বনকে যতটা আত্মার অনুভব বলা হোক না কেন তার কাছাকাছি সময়েই বাৎসায়ন চুম্বনকে বলেছেন- এটা এমন এক শিল্প যা নারী পুরুষের কামাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে। তাই চুম্বনকে তিনি সঙ্গমের দ্বার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি চুম্বনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নানা রকম চুম্বনের উল্লেখ করেন যেমন- নিমিতক চুম্বন, স্ফুরিতক চুম্বন, ঘট্টিতক চুম্বন, সম চুম্বন, তির্য্যক চুম্বন, উদ্ভ্রান্ত চুম্বন, অবপীড়িতক চুম্বন, আকৃষ্ট চুম্বন, সম্পুটক চুম্বন, রাগোদ্দিপক চুম্বন, প্রতিবোধিক চুম্বন, উদ্দিপক চুম্বন, চলিতক চুম্বন, ইত্যাদি। বাৎসায়নের চুম্বন তত্ত্ব যতই রোমান্টিক মনে হোক না কেন আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেন যে চুম্বন সম্পর্কে বাৎসায়ণ ভুল কোনো কথা বলেন নি। বিজ্ঞানী গর্ডন জি গ্যালোপ  তার গবেষণায় বলেন যে,বিশেষত আমারা চুম্বনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করেছি যেমন, খোলা মুখের চুম্বন,আদ্রতা ও জিহ্বার যোগাযোগ ইত্যাদি। আমরা দেখেছি চুম্বনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যৌন আচরণ, বন্ধন, সম্পর্কের স্থিতিশীলতা ও সঙ্গীকে আকর্ষনের পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে।

এদিকে বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ডি ওয়াল দেখেন যে চুম্বন কেবল মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় অন্যান্য প্রাইমেটদের মধ্যেও এটা প্রবল ভাবে স্বীকৃত।

কিভাবে এই চুম্বন আবিষ্কৃত হলো সেই ব্যাপারে ১৯৬০ সালে প্রাণী বিজ্ঞানী রেমন্ড মারিস জানান, এর উদ্ভব হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাইমেট মায়েদের মধ্যে। তারা খাদ্য সংগ্রহের পর শক্ত খাবারগুলো বাচ্চাকে খাওয়ানোর উপযোগী করার উপায় সম্পর্কে জানত না। তখনও আগুনের ব্যাবহার শুরু হয়নি। তাই বাচ্চাকে সেই খাবার খাওয়ানোর জন্য মা তখন বিশেষ এক পদ্ধতি বের করে। মা সেই শক্ত খাবার নিজের মুখে নিয়ে ভালো করে চিবিয়ে নরম করেন। এই চিবানো খাবার বাচ্চার মুখে মুখ রেখে মা তাকে খাইয়ে দেন। এভাবে খাবার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় প্রেমময় চুম্বনের। খাদ্যের স্বল্পতার সময়গুলোতে মায়েরা যখন খাবার যোগার করতে ব্যর্থ হতো তখন ক্ষুধার্ত সন্তানকে তারা সান্ত্বনা দিতে খাবার খাওয়ানোর ভান করে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াত। আর এভাবেই চুম্বন মানব বিবর্তনের অংশ হয়ে ওঠে। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা বোঝাতে যে চুম্বন সেই চুম্বন ক্রমে ক্রমে বিস্তার লাভ করে প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে। তাই চুম্বন করার ধরন দেখেও গবেষকরা বলে দিতে পারেন সঙ্গীর প্রতি তার মনোভাব। যেমন গালে চুমু খাওয়ার অর্থ – গাঢ় বন্ধুতার প্রকাশ, আবার কপালে চুমু খাওয়ার অর্থ বিশ্বস্ততা ও নির্ভরতার প্রকাশ ইত্যাদি। তবে চুমু যে একধরনের কমিটমেন্ট তা আজ আর কারো কাছেই অজানা নয়। চুম্বন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু তথ্য পেয়েছেন যা বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালযের বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী গর্ডন জি গ্যালোপ জানান যে, চুম্বন যৌন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই প্রথম চুম্বন সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ টেনে দিতে পারে। ভারতবর্ষে নারী-পুরুষ বা প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রথম চুম্বনকে মহার্ঘ্য মনে করে একে স্মৃতির মণিকোঠায় স্থান দেয়। আর সুচতুর প্রেমিক কবি সুযোগ বুঝে তাকে স্মৃতিকাতরা করে তুলতে চায় এইভাবে-

প্রাণে প্রাণে কত কথা কত সম্ভাষণ
মনে কি পরে গো সেই প্রথম চুম্বন?
সে চুম্বন আলিঙ্গন, প্রেম সম্ভাষণ,
অতৃপ্ত হৃদয় মূলে, ভীষণ ঝটিকা তুলে
উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?

তবে কায়কোবাদ বা ভারতীয় নারী পুরুষের কাছে প্রথম চুম্বন যতই মহার্ঘ বস্তু বলে মনে হোক না কেন, গবেষকরা দেখেন যে, অন্তত ৫৯ ভাগ ছাত্র এবং ৬৬ ভাগ ছাত্রীদের ক্ষেত্রে ‘প্রথম চুম্বন’ তাদের সঙ্গীর ব্যাপারে কোনো আগ্রহই সৃষ্টি করতে পারেনি। আর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৬৯ ভাগ পুরুষ এবং ৬৭ ভাগ নারী মনে করেন যে , কেউ একজন গুড কিসার হলেই নতুন সম্পর্ক শুরু হবে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর এই কারণেই কবিকে আক্ষেপ নিয়ে বলতে হয় – ‘কোনো কোনো চুম্বন প্রেমিককে ভিখিরি করে দেয়।’ কবি যতই আক্ষেপ করুন না কেন বিজ্ঞানীরা তা মোটেই আমলে নিচ্ছেন না। তারা  বলেন, সঙ্গী নির্বাচনের মাধ্যমে এমএইচসি জিন যেভাবে সনাক্ত হয় তেমনি ভাবে একটি চুমুও মানসিকভাবে তার সঠিক যৌন সঙ্গী খুঁজে পেতে সাহায্য করে। যদি মহাকবি কায়কোবাদের মতো প্রথম চুম্বন কারো জীবনে ‘ভীষণ ঝটিকা তুলে, উন্মত্ততা আর মাদকতা’ নিয়ে হাজির হয় তা হলে বুঝতে হবে যে এই সেই মানুষ যার এমএইচসি জিন কিংবা এইচএলএ এর মধ্যে তীব্র বৈচিত্র্য আছে এবং এই ব্যক্তিটিই হছে তার জন্য সঠিক যৌন সঙ্গী। আর যদি মনে হয় এই চুম্বন কোনো অর্থই বহন করছে না তা হলে বুঝে নিতে হবে যে সঙ্গীর এমএইচসি জিনের বিন্যাস তার জন্য কম্পিটাবেল নয়। তবে চুম্বনের বিষয়ে নারী পুরুষের মধ্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। পুরুষের তুলনায় মেয়েদের ঘ্রাণ, স্বাদ সনাক্ত করনের তীব্রতা অনেক বেশি থাকে। চুম্বনের সময়  মস্তিষ্ক ঘ্রাণ সংক্রান্ত সংকেত পাঠায়। তাছাড়া চুম্বনের মাধ্যমে চোষনের ফলে মুখের চারপাশের ত্বক, মুখবিবর, ও দন্ত সংলগ্ন ত্বক ও মুখের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি থেকে যে একধরনের রাসায়নিক উপাদান নিঃসৃত হয় তা নিখুত ভাবে সঙ্গীর ফেরোমোন ও হরমোন সম্পর্কিত তথ্যের আদান প্রদান করে। মেয়েদের উর্বরতার সময় তাদের এই কেমোসেন্সরির তাৎপর্য আরো প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে চুম্বনের সময় কেমোসেন্সরির এই ইঙ্গিতগুলি তাদের সঙ্গীদের মূল্যায়নের জন্য মেয়েদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। একারণে দেখা গেছে অধিকাংশ মেয়েরাই চুম্বন ছাড়া সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫২.৮% পুরুষ মনে করে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে চুম্বন কোনো অর্থ বহন করে না। গবেষণায় ৭ জন নারীর মধ্যে এক জন নারীই কেবল জানিয়েছেন তিনি চুমু ছাড়া যৌন সম্পর্ক বিবেচনা করবেন। চার্লস ডারউইন তার যৌনতার নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন যে, প্রকৃতিতে প্রায় সকল মেয়েরাই তার সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে অত্যন্ত হিসেবী, সাবধানী আর খুঁতখুতে হয়। জীব বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাপারটাকে বলা হয় নারী অভিরুচি বা ফিমেল চয়েস। ১৯৭২ সালে বিখ্যাত সামাজিক জীব বিজ্ঞানী রবার্ট ট্রাইভার্স  তার গবেষনায় জানান যে, প্রকৃতিতে বিশেষ করে স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রে সন্তানের জন্ম দেওয়া, লালন পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি শক্তি বিনিয়োগ করে থাকে। গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম দেওয়া ,স্তন্যপান করানোসহ আরো অনেক কিছুতেই মেয়েরা জড়িত থাকে বলে মেয়েদের তুলনামূলক শক্তি খরচ হয় বেশি। জীব বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে প্যারেন্টাল ইনভেস্ট বা অবিভাবকীয় বিনিয়োগ। যেহেতু পুরুষের তুলনায মেয়েরা অভিভাবকীয় বিনিযোগে বেশি জড়িত থাকে তাই যৌন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি খুতখুতে, হিসেবী ও সাবধানী হয়। ডেভিড বাস তার গবেষণায় বলেন, যে, বিবর্তনের যাত্রা পথে যে সব মেযেরো হিসেবী আর সাবধানী ছিল না তারা খুব কমই প্রজননগত সফলতা অর্জন করেছে। যারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যৌন সঙ্গী নির্বাচন করেছে কেবল তারাই সফলভাবে প্রজননগত উপযোগিতা উপভোগ করতে পেরেছে। এ কারণে ট্রাইভার্স বলেন, জীবজগতে প্রজাতির প্রজননগত সাফল্য এবং সফল ভাবে প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার মূলে রয়েছে সেই প্রজাতীর নারীদের সতর্ক সঙ্গী নির্বাচনের অভিরুচি। আর এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় চুম্বন একটি অত্যাবশকীয় মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। তিনি আরো বলেন, মেয়েরা প্রকৃতিগত ভাবে তার সন্তানের ক্ষেত্রে অভিভাবকীয় বিনিয়োগ বেশি করে তাই তারা সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে সঙ্গীর স্বাস্থ্য ও গুণগত অবস্থা যাচাই করতে চায় এবং চুম্বনের মাধ্যমে তারা একধরনের পক্ষপাত মূলক আচরণ করে থাকে। আর এক গবেষণায় গুলজান ও স্টহম্যান দেখতে পান যে, কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ে উভয়ই ‘হাত ধরে রাখা’ ‘আলিঙ্গন’, স্ট্রোকিং, মুখমন্ডলে চুমু, মেসেজ পাওয়া ইত্যাদির চেয়ে ঠোটে চুমু খাওয়াকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, চুম্বন নারীর কাছে এমন এক আশীর্বাদ যা অব্যাক্ত কমিটমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। ব্রুইস ও লিনস্টিড তাদের গবেষণার মাধ্যমে জানান যে, যৌনকর্মীরা প্রায়ই তাদের ক্লায়েন্টদের চুম্বন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় কারণ চুম্বন একটি ‘অন্য ব্যক্তির প্রতি সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা ও ভালোবাসা’ প্রতিফলিত করে। আরনল্ড এবং বালিং মনে করেন, ক্লায়েন্টদের চুম্বন করতে অস্বীকার করা এক ধরণের কৌশল যার মধ্য দিয়ে তারা সেই সব ক্লায়েন্টদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরী করতে সমর্থ হয়।  তবে সামগ্রিক ভাবে দেখা যায় পুরুষের কাছে চুম্বন প্রায়শই যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে সম্পর্ক শর্ট-টার্ম বা লং-টার্ম যাই হোক না কেন  চুম্বনকে এর চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না পুরুষেরা। কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদী সঙ্গীর চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে চুম্বন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, একটি রোমান্টিক চুম্বন এমন একটি কোর্টশীপ স্ট্রাটেজি যা সঙ্গী নির্বাচন, মূল্যায়ন, যৌন উত্তেজনা ও সম্পর্কের বন্ধন বজায় রাখার উপায় বা কৌশল হিসেবে কাজ করে। বিজ্ঞানী কার্টার জানান- চুম্বন যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী এমন এক ক্রিয়া যা নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে অক্সিটোসিনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে যা ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে সাহায্য করে। আর একারণেই  ব্রেক-আপের আগে শেষ বিদায়ের সময়ও ধৈর্য ধরে একটা চুম্বনের প্রত্যাশা করতে চান অভিজ্ঞ কবি। হ্যা, রবার্ট বার্নস এর সেই কবিতা ‘বিদায় চুম্বন’ নামে অনুবাদ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-

একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার
জনমের মতো দেখা হবে নাকো আর
 …
থাকো তুমি থাকো সুখে বিমল শান্তির বুকে
 সুখ প্রেম যশ আশা থাকুক তোমার
একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার। 

একদা আমাদের গোত্র মাতারা যখন কেবল সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা নিয়েই যৌন সঙ্গী নির্বাচন করতো আজ বিবর্তনীয় পথ পরিক্রমায় তা দেহের সীমা অতিক্রম করে মনের বা হৃদয়ের সীমায় উপনীত হয়েছে। তাই সম্পর্ক চূড়ান্ত পরিণতি পাক বা না পাক মানবসত্তা এখন মৃত্যুকে ভয় পায় না। বরং তার আত্মাকে মনের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে সে তার ট্র্যাজিক পরিণামকে থোরাই কেয়ার করে। সে এইখানে এসে প্রেমকে মহোচ্চ স্তরে নিয়ে গিয়ে দেহজ কামনাকে অস্বীকার করে। সে চুম্বনের মধ্য দিয়েও তুচ্ছ, একঘেয়ে, গ্লানিকর এবং মৃত্যুর দিকে ধাবমান জীবনকে ধন্য মনে করে। দেহের আশ্রয়ে যে শান্তি তাকে পরম করে তোলার জন্য সে  বলতে পারে I will show you eternity in a kiss.

চলবে…