তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়

হেনরী স্বপন

“পৃথিবীর যে কোনো শ্রেষ্ঠ কবির কাব্য পড়লে হৃদয়ে এই বোধ জন্মায়; হৃদয়ে এই অনুভব জন্মাতে পারেন যেই কবি (এবং তৃপ্তির অব্যর্থ পানীয় তিনি সঙ্গে করেই নিয়ে আসেন) তাঁর কবিতাকে সময় ও মৃত্তিকা এসে কখনও ক্ষয় করতে পারে না। ” – কবি জীবনানন্দ দাশের এই উদ্ধৃতি থেকেই আমার জীবনানন্দ ভাবনার এই লেখাটির শুরু অন্তত এই ভেবে যে…

কবিতা কল্পনার নির্মাণ। বোধের অন্তস্তলে স্বপ্ন-কল্পাঞ্চল যুক্ত হয়ে যে কবিতার সৃষ্টি হয়; হুবহু বাস্তবতার অন্ধকারে সেই কাব্যজ্যোৎস্নাও অন্ধকার ভেঙেই ফুটে ওঠে…‘শ্যামলী তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন !’

বোধের পরাবাস্তবতায়ই কবিতার আশ্রয় মেলে ধরে। সেখানে বোধ-স্বপ্ন পেষণের শব্দ হয়ে ওঠে ক্লাসিকাল। শরীর খুঁড়ে সেইসব শব্দচিত্রণের পোট্রেট অাঁকতে হয়। মেঘমল্লার শুনতে হয় বিরহ সেতারের। নির্জনতাই শ্রেয়। কবির চিন্তায় জাগ্রত সময়কে আত্মস্হ করে নেয়ার। প্রকৃত কবির জীবনদর্শন সর্বত্রই যখন সংজ্ঞাহীন-বল্গাহীন আত্মজীবনের দিকে ছোটে। তখন আমরা সেই কবিতায় অন্তত দুদণ্ড শান্তি্ত খুঁজে ফিরি। দূরবাস্তবতার টোটেমে কিংবা প্রহেলিকা যেখানে-মায়া অনুরণিত হয়, যদিও:

“ …মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে,
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;”

আহা! ভালোবাসা নয় কেন? এপিফানি – এই উচ্ছ্বাসে কবির চৈতন্যবোধেও বৈপরীত্যের প্রকাশ ঘটে বলে? অসম্ভব তো কিছুই নয়। সবকিছুকেই নির্মাণের সাথে মিলিয়ে নিতে হয়। কেননা,…চারদিকে জীবনে সমুদ্র সফেন,…

শুধু কল্লোলিত ধ্বনি!বুকের ভেতরে তড়পায়! স্রেফ কবিতার উত্তেজনায় ঘোরাক্রান্ত হয় বলেই কি; আমাদের সমস্ত ভালোবাসা মরে যায়। চিতাকাঠ জ্বলে-জ্বলে ওঠে গহীন অন্তরে।

তবু তো কল্পনা জাগে। দীর্ঘায়িত হয় মন্হনে। বহুবর্ণে-বহুমাত্রিকতায়। আগাগোড়া ঐতিহ্য-অস্তিত্বের প্রিজমে। তবু এই কবিতার মতোই:

“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;…”
এ-ও কি; সেই রোমান্টিকতার প্রভুত্ব! ফ্রান্স-ফরাসি ঐতিহ্য?

প্রস্তরের মুখ মনে পড়ে-মুখশ্রীর অপরূপে। রঁদ্যার ভাস্কর্যের সেইসব নারীর সৌন্দর্যের ধূসর জগৎ হয়ে ওঠে দিগ্বিদিক। অনুভবের প্রবাহে-সংকেত শুধু। যে কবিতায় হৃদয়ের ভাষা থাকে; বিষয়বর্গে বিভিন্ন সেই ভাষার প্রকাশ একেবারেই ভিন্ন হবে। যে পৃথক ভাষা দিয়ে কবির অমোঘ পরিচয় আবিষকৃত হয়। যদিও…“শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।”

যা শুধু গভীর স্বপ্নের ভিতরে অটুট রয় ফরমালিনের আশ্রয়ে। কবিতা কবির ভাবুকতায় সামিল হলে; পার্থিব স্পর্শের আকাঙক্ষায় কবি তখন মেটামরফসিসের অনুভূতিতে উড়ন্ত পাখি হয়ে ফিরে আসতে চাচ্ছেন নিজের জন্মভূমিতে। সর্বকালের এই অনুভূতি নির্মাণ – ! কবির অসম্ভবে নয়। বরং এর বিস্তার এতটাই জন্ম-জন্মন্তের সামগ্রিকতায় উদগ্রীব! যেন এমন আকাঙক্ষার স্বদেশিকতা! যা কেবল বিস্তারিত করে তোলাই অনির্ণেয়-অসম্ভবও। তাই কবিতার এই অর্থময়তাকে পাঠ্য এবং পাঠকের জন্য সিম্বল এই দুইয়ের কনটেন্টে অধিকার করে নেয় কবি-অপরকেও।

এজন্যেই তো কবি পরজন্মের অর্ন্তগত এমন এক বিশেষ অনুভব জাগিয়ে তোলেন:

“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙখচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে হেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়”:

তাহলে মহৎ কবি-কবি প্রতিভা সঞ্চিত করে থাকে নানা স্তরে। সূত্রায়ণের শুদ্ধতাকে সে কেবল আধুুনিকায়নেই নয়; উত্তর আধুনিক অভিধায় নির্দিষ্ট হন সমকালীন কাব্যতত্ত্বে কিংবা শুদ্ধতম-পুরোহিত হন-উপমা উপযর্ুপরী সৌন্দর্যতত্ত্বের নিবন্ধনে। দেরিদা তত্ত্বের বিনির্মাণেও টেক্সকে-কে ডি-কনস্ট্রাক্ট করতে গিয়ে রিভার্সাল ও ট্রান্সফর্মেশন পদ্ধতির অতি জটিল ও সতর্ক যাত্রায় হাজার বছর ধরে-কবির এই পরিভ্রমণ চলছে পৃথিবীর পথে কিংবা ধূসর জগতে…তবুও জীবনের রিফ্লেক্ট শুধু জ্যোৎস্নায় নৈসর্গিক কবিতার মতো যেন এইসব উপমায় উজ্জীবিত কবিও অন্তর্দৃষ্টি মেলে দেখেন:

“জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের উপর
চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ !”

যে আকাশে নক্ষত্রেরা কেবল; শাশ্বত রাত্রির বাসিন্দাই নন। সেখানে কখনও তেড়ে ওঠে; রৌদ্রের গোধূলি-ভোরের সকাল-কুয়াশায় নিভৃত আলোর রোশনাই। বিকিরণ। সেই যে ভিজে রৌদ্রের উত্তাপে বসে কবি লিখছেন, হয়ত হবে কোনো এক কবিতার খসড়া। কিন্তু কবিকে-জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ’দেখিস না কী রকম ইস্পাতের মতো নীলাকাশ।’
তবু কবি কল্পনার সেই আকাশজুড়ে শুধু রং গাঢ়-ফিকে-ধূসর-কিংবা অনেক নীল যেখানে:

‘…থাকে শুধু অন্ধকার; মুখোমুখি বসিবার
বনলতা সেন’

তবে, কে এই সেন বংশের মেয়ে? কবির সর্বাধিক আলোকিত এই নারীর মুখ। যে অন্ধকারে প্রণয়মগ্ন হতে পারে। নিবিড় নৈকট্যে দ্বিধাহীন বসিবার শরীর সাহস আছে যার। যে মুখমণ্ডলে শ্রাবস্তীর সৌন্দর্য স্বপ্নজগতে বিপুল আয়োজনে ফুটে উঠে:

জীবনানন্দ তো কবিতায় উল্লেখের আগেই তাঁর ‘কারুবাসনা’-উপন্যাসের স্মৃতিনির্মিত নায়িকার বর্ণনায়-বনলতা প্রসঙ্গে লিখেছেন; যে উদ্ধৃতি পাঠে বিষয়টি অনেকটাই স্বচ্ছ হয়ে যায়:

“সেই বনলতা-আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত সে। কুড়ি-বাইশ বছরের আগের সে এক পৃথিবীতে,…বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিল। দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চালের বাতায় হাত দিয়ে মা ও পিসিমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললে সে। তারপর অাঁচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকেই আসছিল। কিন্তু কেন যেন অন্যমনস্ক নত মুখে মাঝ পথে গেল থেমে, তারপর খিড়কির পুকুরের কিনারা দিয়ে শামুক গুগলি পায়ে মাড়িয়ে বাঁশের জঙ্গলের ছায়ার ভিতর দিয়ে চলে গেল সে। নিবিড় জামরুল গাছটার নীচে একবার দাঁড়াল, তারপর পৌষের অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ”

জীবন ও কাব্যের অন্বয়ে লেখা এই চরিত্র চিত্রণ হয়েছে ১৯৩৩-এ। জানা যায় ১৯৩৪-এ বনলতা কাব্যের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছিল। এবং ১৯৪২-এ বুদ্ধদেব বসুর উদ্যোগে কবিতা ভবন থেকে ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালা সিরিজে-বনলতা সেন-প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই কাব্যের এই নায়িকা বাংলা সাহিত্যের জায়মান হয়ে ওঠে। সর্বাধিক পাঠ্য-সময় থেকে সময়ান্তর যাত্রায় কবির এই নারীর রহস্য আজও অটুট। যদিও যুগসন্ধির এই যাত্রা এক বিপন্ন বিস্ময়! বহু বিরূপতা-বিদ্রূপের চাপ সয়ে-সয়ে পরাক্রান্ত আজও তাঁর সমস্ত কাব্যের চেতনাজগত-পাঠকের অবচেতন মনীষায় জটিল-জটিলতর মনে হয়। কিন্তু এখন সে একজন শ্রেষ্ঠ কবির উত্তরাধিকারী। কেবল যে খ্যাতির প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে নি আজ পর্যন্ত কেউ। কিন্তু কবি সর্বত্র হৃদয়ের সত্য-উপলব্ধির প্রকাশ করেছেন তাঁর বহু কবিতার নৈসর্গিক ইমপ্রেশান থেকে। যদিও কবির একটিমাত্র গ্রন্থ রূপসী বাংলাই তো পুরো বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারত। এই গ্রন্হের সব লেখাই কবি জীবিত থাকাকালীন লিখেছিলেন। কিন্তু তা প্রকাশিত হয়েছিল মৃত্যুর পর। কেননা, এই বরিশালের স্মৃতিঘেরা বগুড়া রোডের বাড়িতেই কবি যেন ধ্যানস্হ এখনও এই তপোবনে। এজন্যেই এই বাংলার পরে এতটাই পক্ষপাত ফুটে ওঠে তাঁর কাব্য দৃঢ়তায়:

“তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও,
আমি এই বাংলার পরে রয়ে যাব,
দেখিব কাঁঠালপাতা, ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে,
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের…। ”

তাই, চিল-বিল-খাল এই তিনে যদি হয়-বরিশাল! তাহলে এই শহরের উড়ন্ত শঙখচিল আর শালিখ দেখলেই আমি জীবনানন্দকে খুঁজে পাই। কিন্তু কবি খুঁজছেন, অন্য জীবনের অন্য মানে। কেননা, সময়-কাল-প্রকৃতি ও সময়ের মানুষ-মানুষই যেন তার সমস্ত কবিতার প্রয়াস:

“এ-জীবনে আমি ঢের শালিক দেখেছি,
তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়।”

অতএব
পাঠক, আমি সবিনয় নিবেদন করছি যে, কবির জীবনপঞ্জির জরুরি এই সামান্য তথ্য হয়ত আপনিও জানেন; বাংলা কবিতার অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই কবি ১৮৯৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে (১৩০৫ বঙ্গাব্দ ৬ ফাল্গুন, শুক্রবার, মধ্য রজনীতে) জন্মগ্রহণ করেন।

অতঃপর
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর সান্ধ্যভ্রমণের সময় কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে রাস্তা পাড় হতে গিয়ে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন। একাধারে ৮ দিন মৃত্যুযন্ত্রণায় মগ্ন থেকে ২২ অক্টোবর ১:৩৫ মিনিট-মধ্যরাতের নির্জনে (১৩৬১ বঙ্গাব্দ ৫ কার্তিক) শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের রেজিস্টারে কবির ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয়।

কিন্তু, আশ্চর্য কি জানেন?
কবির মৃত্যুও মধ্য রজনীতে হয়েছে এবং সেই দিনটিও শুক্রবার ছিল… এ-ও এক বিস্ময়…