পরকীয়া অম্ল না মধুর

কীর্তনখোলা@নদীডটকম

সোয়াচান পাখি, আমি ডাকি, ডাকি তুমি ঘুমাইছ না-কি? কে এই সোয়াচান পাখি? কাকে ডাকে? কেনই বা ডাকে? শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাঁশির সুরে ডেকেছিল কাকে? বয়সে বড় এক পরস্ত্রী – রাধাকে। এখন এই বিশ্বগ্রামে বাঁশি নেই। আছে আকাশসংস্কৃতি ও মিস-কল – মিস-কল খেলা, যে খেলায় ভেঙে গেছে তিন সন্তানের জনক-জননীর দীর্ঘ দিনের সংসার। কী সেই খেলা?

প্রেম? সে আপনকীয়া হোক আর পরকীয়া হোক – তবুও তো প্রেম, যে প্রেমে মজেছিল বুড়ো বয়সে পিকাসো। রবীন্দ্রনাথের প্রেম কি তার বৌদির জন্য ছিল? পার্বতী বিয়ের পরও কেন মাতাল দেবদাসের কাছে আসে? এ জমানাতেও আসে। তবে এই আসাটির মাধ্যম ভিন্ন। হিন্দি-বাংলা সিরিয়ালে, মাঝরাতের মিসকলে, এসএমএস-এ, নেটে এবং যার সাহসী পরিণতি পেটে। বাজার অর্থনীতি শেখাচ্ছে প্রেম ও যৌনতার বিভিন্ন ছলাকলা। বিষ মেশানো এই কলা খাচ্ছে যারা, তাদের দিককার যুক্তিগুলোর পক্ষে অথবা বিপক্ষে দাঁড়ানোর জন্য দুজন মানুষের ভাবনার বীজ নিচে পত্রস্হ করা হলো। বীজ থেকে বিতর্ক শুরু করা, না করা, পড়া বা পড়েও না পড়ার ভান করার দায়-দায়িত্ব পাঠকের। পাঠকের রায়ই চূড়ান্ত বিচারে সুপ্রিম কোর্টের রায়। অম্ল না মধুর এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে ভুল (ইচ্ছাকৃত) করবেন না যেন!

পরকীয়া অম্ল নয় মধুরই
রুবাইয়া ইসলাম

‘পরকীয়া’ নামটার মধ্যে কেমন যেন নেশানেশা ভাব – অনেকটা বাংলা মদের মতো। গলা দিয়ে নামার সময় জ্বলবে, কিন্তু পেটে পড়ার সাথে-সাথে নিজের সমস্ত সত্তা জুড়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি। আমার কাছে পরকীয়া অম্ল নয় মধুরই মনে হয়। হয়ত বা এটা শুনে অনেকে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে আমায় গালমন্দ করবেন। আবার কেউ বা একমত হবেন। যারা আমাকে চেনেন – তারা বাঁকা চোখে তাকাবেন। করুন গালমন্দ, তাকান বাঁকা চোখে। কী করব বলুন? আমি তো শুধু নিজের মত প্রকাশ করছি, মানবাধিকারও বটে। পরকীয়া যে হচ্ছে না, পরকীয়া যে করছি না তা কে বলতে পারবে, বলুন? কেউ পরকীয়া করে শরীরের টানে, কেউ বা করে হৃদয়ের টানে। দুটোরই কারণ কিন্তু একটি – অতৃপ্তি! আমরা নারীরা কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, বিয়ের পর স্বামী ছাড়া অন্য কারো মুখে প্রশংসা শুনলে আমাদের ভালো লাগে না? অন্যরকম একটি অনুভূতি জাগে না? পরকীয়ায় মানুষ কেন জড়ায়? আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি বলেই বলছি যে, যখন দুজনের মন-মানসিকতা এক হয় না, পাঁচ-দশ বছর সংসার করার পরও যখন শরীরের সম্পর্কটায় কোনো আনন্দ থাকে না, তখনোই একটি নিঃসঙ্গতা চলে আসে। ঠিক সে-সময়ই পরকীয়ায় জড়িয়ে যায় কেউ-কেউ। যারা পরকীয়া করে, তাদের আমি দোষ দেব না। কারণ ভালো লাগা বা ভালোবাসার কোনো বয়স নেই। যে কোনো সময় – যে কোনো বয়সেই প্রেমে পড়তে পারে, ভালোবাসা আসতে পারে। যদি দাম্পত্য জীবনে সুখ না-ই থাকে, তখন পরকীয়া করলে কাকে দোষ দেয়া যেতে পারে?

অতীত-ইতিহাসে তাকালেই দেখা যাবে যে, নারী-পুরুষ পরকীয়ায় জড়িয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর মা কমলার সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজের কথিত যৌন সম্পর্কে পরকীয়ার স্বাদ পাওয়া যায়। রাধা-কৃষ্ণের কথা না-ই বা বললাম। পরকীয়া অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। পরকীয়া থাকুক। যারা পরকীয়া করে – তারা করুক। আমরা যারা দ্বিমত করি, তারা সরে দাঁড়াই। আমাদের তারা থোড়াই কেয়ার করে। বিস্বাদ জীবনে পরকীয়া যদি একটু সুখ দিতে পারে, তবে তা দোষের কী? যদি নতুন করে কারো জন্য ভুলে-যাওয়া কোনো গানের কথা গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি, কারো জন্য প্রথমবারের মতো নীল টিপ পরি, তবে সমস্যা কী? আমাদের জন্য তো পরকীয়া থেমে থাকবে না। যারা করে, তাদের কাছে পরকীয়া তো ডাবর হানি – সবচাইতে উৎকৃষ্টমানের ফুল থেকে তৈরি। তবে তা কেন খাব না? কেউ না খেতে চাইলে, না খাক। কার কী এসে যায় তাতে!


পরকীয়া – অম্ল না মধুর?
কৃষ্ণ চন্দ্র ভট্টাচার্য

‘পরকীয়া’ কথাটির অর্থ যা-ই হোক না কেন, আমার মনে হয় সামাজিক, ধর্মীয় ও প্রথাগতভাবে বিবাহিত একজন পুরুষ বা নারীর সঙ্গে অসঙ্গতভাবে অন্য কোনো নারী বা পুরুষের সম্পর্ককে বোঝায়। মানুষ সাধারণত একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি বা জিনিসে তৃপ্ত হতে চায় না। জীবনের কিছু সময়ে নিজস্ব জিনিসে তৃপ্ত না হয়ে নিত্য নতুন জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয় বা ভোগ-দখল করতে আগ্রহী নয়। সে কারণেই প্রবাদ প্রচলিত ‘পরের পিঠা বড় মিঠা’। সত্যিকার অর্থে পরের পিঠা – মিঠা না হলেও দুর্বলচিত্ত মানুষ নিজের সহজলভ্য জিনিসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, সেক্ষেত্রে বহুভোগ লিপ্সা বা বহুভোগে আগ্রহী পুরুষ বা নারীর মন যে কোনো কারণেই হোক না কেন, অন্য কোনো নারী বা পুরুষ দেখলেই আনচান করে ওঠে তাকে পাওয়ার জন্য। অর্থাৎ নিষিদ্ধ জিনিসে মনুষ্যকুল অনুসন্ধিৎসু। এ অবস্হায় তা পাওয়ার জন হিতাহিত জ্ঞান বিসর্জন দিয়ে নিষিদ্ধ বস্তুর স্বাদ প্রকৃতিগতভাবে গ্রহণে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। যদিও এই পাওয়ার জন্য বহু বাধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিতন্ড্য পার হতে হয় তবু অবুঝ মানুষ তা করে থাকে। মানুষ মাত্র সকলেই স্বীকার করবেন যে অতি প্রাকৃতমনুষ্য হৃৎপিণ্ড মহান স্রষ্টার অমোঘ নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যক্তি কর্তৃক যে কোনো কাজেই বিবেক সাড়া দেয়। স্বাভাবিক কোন কাজে হৃৎপিণ্ড স্হির থাকে। কোন গর্হিত কাজ করলেই বিবেক তথা হৃদপিন্ড অজানা ভয়ে দুরুদুরু করে কেঁপে ওঠে। অর্থাৎ অস্বাভাবিক কম্পন সৃষ্টি করে প্রতিবাদ জানায়। অবশ্য স্বাভাবিকভাবে নিজের বা স্রষ্টার সৃষ্টির জন্য ভালো কাজ করলে üদয় উৎফুল্ল হয়, হৃদয় ‘শান্ত’ থাকে।

মানুষ নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে ও উপভোগে আগ্রহী। যখন একজন পুরুষ বা নারী প্রতিনিয়ত ব্যবহার্য নারী বা পুরুষের সঙ্গ ও সাহচর্যে একঘেয়েমিতে ভোগে তখন সে অন্য পুরুষ বা নারীর সান্নিধ্যে আসতে চায়। যখনই দুই আগ্রহী মনের মিলন হয়, তখন কেউ সামাজিক বা শারীরিক কোনো বাধা-নিষেধ, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, দুঃখ-কষ্ট গ্রাহ্য না করে এই কাজে ব্রতী হয়। যখন একজন পুরুষ বা নারী লুকিয়ে ছাপিয়ে নিজের বৈধ জিনিস বাদে দুরুদুরু বক্ষে অন্য কোনো অবৈধ জিনিস ভোগের সুযোগ পায় তখনই তা তার কাছে পরকীয়া মধুর বলে অনুভুত হয়। আমাদের রক্ষণশীল সমাজে যখন পরনারী পুরুষের সান্নিধ্য পেতে বা ভোগ করতে বাধা আসে বা বিপত্তি ঘটে তখনই তার কাছে পরকীয়া অম্ল বলে মনে হয়।