শাহ আবদুল করিম বাউল সম্রাট। এই সম্রাটের সাম্রাজ্য এত বিশাল যে, আমাদের মতো ক্ষুদ্র নক্ষত্র করিম নামক আফতাবকে এক চক্কর প্রদক্ষিণ করা মানে দুঃসাহস! তবু হাল না ছেড়ে অন্ধ বাদুড়ের মতো ঝুলে থেকে, ঈগল পাখির মতো ঝাপসা চোখে বিভিন্ন জ্যামিতিক অথবা কিউবিক অবয়বে করিম সম্পর্কিত একটি নাবালকীয় সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি; বর্তমান চাপাতিকালের বিবেচনায় পেশ করা হলো। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে বিচার করুন করিমের অপরাধসমূহকে! আমাদের মনমহাজনই চূড়ান্ত বিচারে সুপ্রিম কোর্ট জানাচ্ছেন –
১. করিমের পলিটিক্যাল ডিসকোর্স
শোষিত বঞ্চিত যারা/কৃষক মজুর মেহনতিরা/কেউ হয়েছে সর্বহারা/একেবারে উপায় নাই
বাংলার ইতিহাস বনাম করিমের ইতিহাস – বহে চলে সমান্তরাল। ১৯১৬ সালে যখন করিমের জন্ম হয়, তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষণ-লুণ্ঠন কাল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর করিম দেখেছিলেন নতুন সূর্যের স্বপ্নে – মানে পাকিস্তানে। কিন্তু মোহভঙ্গ হতে সময় লাগে নি ভাটির পুরুষের। সেই স্ব-শিক্ষিত পুরুষোত্তম প্রথম গানের বই-ই প্রকাশ করেন ১৯৪৮ সালে। ‘‘আফতাব সংগীত’’। আফতাব নামের অর্থ হলো সূর্য। কিন্তু সে সূর্যের আলোর মধ্যে ছিল নয়া-সাম্রাজ্যবাদের শোষণের অন্ধকারময় হাত। ফলে, এই পাকি হাতের সাথে হাত না মিলিয়ে বরং হাতকে ভেঙে দেয়ার জন্য, হাত মেলান ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। গণের সাথে গানে-গানে। বস্তুত, মোটা দাগে যুক্তফ্রন্টকে ক্ষমতায় আনার পেছনে করিমের যে সাংসকৃতিক আন্দোলন, যা ছড়িয়েছে পথে-ঘাটে-মাঠে-ভাটিতে-জোয়ারে। ইতিহাস তাঁকে এজন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছিল। যেমন:
…এখন গান পরিবেশন করবেন শিল্পী আবদুল করিম। উপস্হাপকের ঘোষণা শুনেই সোহরাওয়ার্দী পুনরায় মঞ্চে বসে পড়েন এবং বলেন, ‘করিম আমার রাজনৈতিক সহকর্মী।তাঁর গান শুনে তারপর যাব। …করিম মোট দশটি গান গায়। …গান শোনার পর করিমের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন এবং বলেন, ‘আমাদের সরকারের আসার পেছনে তোমার অনেক অবদান, সেটা আমি ভালো করেই জানি। তুমি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে গিয়ে আমাদের পক্ষে গান গেয়েছ। তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না। তবে তোমার একটা ব্যবস্হা করে দেয়ার ব্যাপারে আমি আতাউর রহমানের সাথে আলাপ করবো।’
***
একটা ব্যবস্হা হবে – করিমের স্বপ্নে এটা ছিল না বরং মেহনতি জনতার ভাগ্যের পরিবর্তনে জড়িয়ে ছিলেন সমষ্টির মুক্তির লক্ষ্যে। মুজিবকে মেনে ছিলেন – ময়ুরপঙখি নাওয়ের মাঝি। ইতিহাসের পাঠ হলো –
…যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একটি সমাবেশে করিম গণসংগীত ও শেখ মুজিবকে নিয়ে তাৎক্ষণিক একটা গান পরিবেশন করেন। গান শুনে মুজিব কেঁদে ফেলেন। তিনি করিমকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘করিম ভাইকে যত দেখি, ততই মুগ্ধ হই। এই একটা মানুষকে কেন এত ভালবাসি ভালোবাসি, তা নিজেও জানি না’। আবেগাপ্লুত মুজিব করিমের হাতে একশ টাকা তুলে দেন।
***
যুক্তফ্রন্ট, একাত্তর এবং শেখ হাসিনা ও এমন কোনো প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রাম নেই, যেখানে করিম নেই। এক উদার মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল করিমের স্বপ্ন। যেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতির মধ্যে বাস করবে।
পাঠ করি:
‘‘জয় জয় বলে এগিয়ে চলো হাতে লয়ে সবুজ নিশান/ জাগো রে মজুর কৃষাণ”। …ওই সভায় করিম অনেকগুলি গণসংগীত পরিবেশন করেন। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাবা যাঁর ভক্ত ছিলেন, আমি তাঁকে অবশ্যই উপযুক্ত সম্মান দেব।’
ক্ষমতার উচ্চাসনে বসে কিছু সংখ্যক মানুষ দুর্নীতি করে টাকা আয় করছে, অন্যদিকে গরিব মানুষ একবেলা খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বিষয়টি করিমকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। নির্মম এই বাস্তবতার বর্ণনা করিম গেয়েছেন এভাবে, ‘‘ভাঙ্গা ঘর, চালে ছানি নাই, কাঁদে প্রাণপাখি/আকাশের তারা দেখা যায়, শুয়ে শুয়ে দেখি।”
কিন্তু করিমের মোহ ও হতাশা কাটতে বেশি দেরি হয় নি। নিজের চোখে দেখে-শুনে-বুঝে গণমানুষের মূল শত্রু যে সাম্রজ্যবাদ – তা চিহ্নিত করতে রাজনৈতিক পাঠ পড়ার জন্য রাশিয়া বা চীনে যেতে হয় নি। “গরিবের দুঃখের কথা/কেউ শোনে না/অরণ্যে রোদন বৃথা/বুঝিয়াছি তার নমুনা”। কে শুনবে, কেন শুনবে? করিম বুঝেছিলেন, আশার বাগানে ফুল ফোটাতে হলে – সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। করিম বলে, “বড় শয়তান সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন ফন্দি আঁটে/মধ্যম শয়তান পুঁজিবাদ বসে বসে মজা লোটে/সামন্তবাদ জালিম বটে দয়া নাই তাহার মনে/তিন শয়তানের লীলাভূমি শ্যামল মাটি সোনার বাংলার/গরিবের বুকের রক্ত রঙ্গিন হলো বারে বার/সোনার বাংলা করল ছাড়খাড় সাম্রাজ্যবাদ শয়তানে”। ভাবতে অবাক লাগে, ভাটির যোগাযোগ বিড়ম্বিত এক প্রত্যন্ত গ্রাম উজানধলে বসে একজন “অশিক্ষিত” মানুষ কীভাবে সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে এত গভীর ধারণা রাখতে পারেন। কীভাবেই তাঁর চেতনাগত অবস্হান আর গানের বাণী মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস-লেনিন-মাওদের মতবাদের সাথে মিলে যায়। একই প্রশ্ন করেছেন যতীন সরকার – ‘‘আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক বিদ্যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ না করেও, একজন মানুষ কী করে প্রাক-আধুনিক লৌকিক বস্তুবাদী দর্শনের ধোঁয়াশা ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিজের চিন্তাকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী দর্শনের তটলগ্ন করে দিতে পারেন।”
প্রয়োজন পড়ে নি করিমের যেমন, তেমন পড়ে নি বরিশালের আরজ আলী মাতুব্বরের। আরজ আলীর স্ব-মুক্তিবুদ্ধির চর্চার বিকিরণ ছড়াতে সময় লেগেছে, কিন্তু করিম তাঁর জীবন থেকে নেয়া তাত্ত্বিক শিক্ষা ছড়িয়েছেন দাবানলের মতো। করিম বলছেন, ‘আমি অমুক দল-তমুক দলের রাজনীতি-টাজনীতি সমর্থন দেই না। আসল কথা হলো, মানুষের পক্ষে কথা কওয়া। গরিব, শ্রমিক ও দিনমজুর মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সারা জীবন কথা বলেছি, গান গেয়েছি। শোষণের বিরুদ্ধে আমি শোষিতের গান গাই/আপসহীন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে চাই। বিপ্লব আর সংগ্রাম আমার গানের মূল চেতনা। আমার রাজনীতিও তাই। যেখানে অন্যায়, সেখানে প্রতিবাদ, সেটা গান ও কথায় দুভাবেই করে যাচ্ছি।’
করিমের রাজনীতি সামাজিকীকরণে তাঁর বিপ্লবী গান শেখাচ্ছে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে-সমাজ বিনিমার্ণে। গণসংগীতের যে পেডাগজি, তার মুল লক্ষ্য ছিল – প্রান্তিক পর্যায়ে অপ্রেসডদের জন্য। ইতিহাসের নির্মম সত্য বলে,
ভাটি এলাকার মানুষের আশা-আকাঙক্ষা, স্বপ্ন-হতাশার কথাই ভাটির গান বইটির অন্তর্ভুক্ত গানগুলির মূল উপজীব্য। গরিব-মেহনতি-মজুরের প্রতি শোষক শ্রেণির অত্যাচার-নিপীড়নের চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে এসব গানে। তবে, তারই পাশাপাশি অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদের আহ্বানও রয়েছে। হতাশা কাটিয়ে কীভাবে দুঃখ নিরোধের পথ সন্ধান করা যায় – সে পথনির্দেশও আছে তাঁর গানগুলিতে। সব মিলিয়ে ভাটির করিমকে গণজাগরণের সূত্রধর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রাবন্ধিক যতিন সরকারের মূল্যায়ন – ‘‘বুদ্ধ থেকে মার্কস-এঙ্গেলস বা লেনিন-স্তালিন-মাওয়ের রচনা পাঠ করে বিপ্লবী তত্ত্বজ্ঞানী হয়ে শাহ আবদুল করিম দুঃখনিরোধের পথের সন্ধান করেন নি। দুঃখের ভেতরেই তিনি জন্মেছেন। বেড়ে উঠেছেন, দুঃখের ভেতরে থেকেই তিনি অবলোকন করেছেন দুঃখের সব কারণ। শুধু তা-ই নয়, দুঃখনিরোধের জন্য জনগণ যেসব আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, সে সবের সাথে তিনি নিজেকে সক্রিয়তার সাথে যুক্ত করেছেন। সে রকম যুক্ততার মধ্য দিয়েই তিনি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন, সংঘের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন। এবং এ সবের মধ্য দিয়েই তিনি তার নিজের যুগ ও পারিপার্শ্বকে আদ্যোপান্ত বুঝে নিয়েছেন”।
***
শোষিতের সুখ ও সম্পদের সুষম বণ্টনে করিমের বিশ্বাস নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পাবে না জানি, কারণ করিমের মহত্ব ও বিশালত্বের তুলনায় আমরা তো নিছক অপরাজনীতির বিষাক্ত মাজরা পোকা মাত্র! কেন? মানুষকে ভালোবেসে আজীবন “মানুষের গান” গেয়ে বেড়িয়েছেন। ১৯৯৭ সালে বলেছিলেন, ‘আমি বেহেস্ত চাই না, দোজগ চাই না, জীবিত অবস্হায় আমার ভাটি অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের সুখ দেখতে চাই। এই মানুষগুলোর সুখ যারা কেড়ে নিয়েছে, আমার লড়াই তাদের বিরুদ্ধে। একদা তত্ত্বের সাধনা করতাম, এখন দেখি তত্ত্ব নয়, নিঃস্ব বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব আর সোনার বাংলা, সোনার মানুষ বললে হবে না। লোভী, শোষক, পাপাত্মাদের আঘাত করতে হবে।’
২. করিমের ধর্মবিশ্বাস
আল্লার বাড়ি মক্কাশরিফ/বোঝে না মন পগলে/ব্যক্তি নয় সে শক্তি বটে/আছে আকাশ-পাতালে
করিম শব্দটি আল্লাহ-র অপর নাম। করিম নিজেও ইসলাম ধর্ম পালন করতো। তবে, প্রথাগত অর্থে যে প্রাত্যহিক চর্চা ও সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে যে ধারণা, আমাদের মনোজগতে হিমালয়ের মতো চেপে বসে আছে; তাকে করিম চ্যালেঞ্জ করেছেন। নিজের সাথে নিজের তর্ক, তত্ত্ব ও দিয়েছেন-বানিয়েছেন গান-বিশ্বাসও করতেন সে গানকে। সময় বলছে,
আল্লার বাড়ি মক্কাশরিফ/ বোঝে না মন পাগলে/ ব্যক্তি নয় সে শক্তি বটে/ আছে আকাশে-পাতালে।
ঈশ্বরকে আমি মনে করি একটা পেঁয়াজ, খোসা ছিলতে গেলে নিরন্তর তা ছিলা যায় এবং হঠাৎ একসময় দেখি তা শূন্য হয়ে গেছে। আমি ঈশ্বরকে আল্লাকে বিশাল শক্তি হিসাবে গণ্য করি, ব্যক্তি হিসাবে নয়। ব্যক্তি কখনো একই সময়ে বিভিন্ন স্হানে বিভিন্ন রূপে অবস্হান করতে পারে না, শক্তি তা পারে। বৈদ্যুতিক শক্তির কথাই ধরুন, একই সাথে কোথাও বা ফ্যান ঘুরছে, কোথাও বাতি জ্বালাচ্ছে, কোথাও ইন্ডাষ্ট্রি চালাচ্ছে। “আপনাকে ভালবাসি/ বিশ্বাস করে হও সাহসী/ আপন ঘরে মক্কা-কাশী/ আছে গোপনে”।
কিন্তু ধর্মের নামে যে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বাণিজ্যিক ধারায় যে ধর্ম পালন, সে সম্পর্কে করিম ছিল সদা সোচ্চার। উদাহরণ দিচ্ছি –
ধর্মকে পুঁজি করে ধান্দাবাজ ব্যবসা-বাণিজ্যে করছে। এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। কিছু মোল্লা-মুনসি-পুরোহিত ধর্মের দোকান খুলেছে। নিজেদের স্বার্থের জন্য এরা কথায় কথায় বিভেদ সৃষ্টি করে। আর আমাদের বাংলাদেশ তো হিন্দু-মুসলমানের দেশ। মানুষে মানুষে কত সম্প্রীতি ও বন্ধন ছিল। আজ তা হারিয়ে যাচ্ছে, বড়ই আপসোস হয়।
তবে, দায়িত্ব নিয়েই বলছি, করিম যদি আজ বেঁচে থাকতো, তবে চাপাতির কোপে খুন হতেন বহু আগেই। কেন? “পাগল আবদুল করিম বলে দয়া করো আমারে/ নতশিরে করজোড়ে বলি তোমার দরবারে/ভক্তের অধীন হও চিরদিন থাকো ভক্তের অন্তরে”। খুবই সাংঘাতিক কথা! প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে করিম বলছেন, ভক্তের অধীন হও, চিরদিন থাকো ভক্তের অন্তরে। তার মানে গুরু-শিষ্যের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব ঘোচাতেই শুধু নয়, উভয়ের মধ্যে উঁচু-নিচু ভেদ দূর করে শুনি – “তন্ত্র-মন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই/শাস্ত্রগ্রন্হ পড়ি যত আরো দূরে সরে যাই”।
নিচের কথাগুলি আরো ভয়াবহ –
“মসজিদ-মাদ্রাসা হয়েছে জানি না কী হবে পাছে/ ধর্মীয় অধিকার আছে মাইকযোগে আযান দিতে/ হয়ত কেউ দিবেন গালি আসল কথা যদি বলি/ চলিতেছে দলাদলি মসজিদ-মাদ্রাসাতে”।
৩. করিম ও কর্পোরেট
কী যাদু করিয়া বন্ধে/মায়া লাগাইছে/পিরিতি শিখাইছে/দেওয়ানা বানাইছে
করিম ভাটির পল্লির মানুষ। পল্লিগীতি তো এলিট ও তাদের প্রজন্মগণ শোনে না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। যেমন করেছিল হূমায়ুন আহমেদ! হূমায়ুন আহমেদ শিল্প-সাহিত্যের বাজার-বিপণন-ও বাণিজ্যের কারবারীদের দলভুক্ত ছিলেন, যে গুনটা ছিল না করিমের। ফলে, শহরের এলিট শিল্পীদের কাছে “করিমের পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি” পরা গান শুরু হলে, চ্যানেল পাল্টে হিন্দি গানের উত্তাপ উপভোগ করাটাই যখন নিয়ম, তখনই যুব সমাজের মানসপটে করিমের ছবি এঁকে দেয় দলছুটের সঞ্জিবদা ও বাপ্পাদা। “গাড়ি চলে না, চলে না চলে না রে….”। সারা বাংলাদেশ কেঁপে ওঠে এ গানে – নতুন ধারায়-নতুন অর্থে-সহজ-সরল নতুন বিশ্লেষণে। পুতু পুতু প্রেমের গানের বিপরীতে এই গানটি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় চলমান বাংলাদেশেরই ক্ষয়িষ্ণু প্রতিচ্ছবি। এরপর বাকি কোনো ইতিহাস থাকে না…।
বড় মাপের কাজ করেন সুরকার হাবিব। করিমের বিরহের গানগুলি রিমিক্স করে বাজারে আসার সাথে-সাথেই বাজার মাত। লুফে নেয় নতুন প্রজন্ম। মুখে-মুখে মোবাইলের রিং টোনে কনসার্টে-চ্যানেলে-চ্যানেলে। কর্পোরেটদের চোখ শকুনের মতো! তারা ইতোমধ্যেই বুঝে ফেলেছেন, তাদের পণ্য বিক্রিতে কীভাবে করিমকে রান্না বা রোস্ট করে ক্রেতাকে ভরপেট খাওয়াতে হবে। ২০০৮ সালে বাংলালিংক করিমকে সম্মাননা পদক দেয়। এরপরই পেপারে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় – তা প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য এক ভ্যালেন্টাইন গানের দু’লাইন – “কেন পিরিতি বাড়াইলি রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি…”। অথচ করিম এ গানটি সৃজন করেছেন, দেহতত্ত্বিক, মুর্শিদি মনমহাজনের সাথে মিলিত হবে – সেই বিরহে ভক্তরা কাঁদছেন। কিন্তু কর্পোরেটগণ এ গানটিকে পণ্যায়ন করেছে, শুধুই তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। করিম কি কোনো রয়্যালিটি পেয়েছে? করিমের যখন সংসার চলে না, তখন করিমকে নিয়ে ব্যবসায় ছেয়ে যায় সমগ্র বাংলাদেশের মননে। “এত সংর্বধনা, সন্মান দিয়ে আমার কী হবে? সংর্বধনা বিক্রি করে দিরাই বাজারে এক সের চালও কেনা যায় না। পেটে যদি ভাত না থাকে, করিম মেডেল গলায় দিয়ে কী করবে? মননের ব্যবসায় সবচে সফল হলো, তাদেরই উৎপাদিত রিমিক্স। “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম….”। এ প্রসঙ্গে…আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম… একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো গান। একই দীর্ঘশ্বাস টের পান শিল্পি মৌসুমী ভৌমিক। বলছেন, “কেমন ছিল সেই দিন? কী ছিল তাতে যা আজ আর নেই?
হিন্দু-মুসলমানের যে হাজার বছরের সম্প্রীতি তা যে থাকবে না, করিম তা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। সময়ের পূর্বেই সময়কে ধরে ছিলেন গানে-গানে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যে আরো ক্ষয়ে যাবে, বেঁচে থাকাটা যে আরো কঠিন হবে, তা করিম বুঝেছিলেন, “দিন হতে দিন আসে যে কঠিন/ করিম দীনহীন/ কোনপথে যাইতাম।” পণ্যায়নের নতুন কৌশল, শিল্পীকে সেলিব্রেটি বানানো, পদক দেয়া, সম্বর্ধনা দেয়া এবং তাঁকে দিয়েই তাঁর ছবি-সৃষ্টিকে ব্যবহারের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনটি করিয়ে নেয়া। “পদকের আশায় কোনো দিন গান গাই নি। গান গাইছি মনের টানে। মানুষ ভালো পাইয়া সম্মান দিছে। তবে, এই সবের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। এমনও ঘটনা আছে-পদক আনতে শহরে গেছি, আইবার কালে পকেটে টাকা নাই। এই পদক-টদকের কোনো দাম নাই। মানুষ আমারে ভালো পায়, সেটাই আসল কথা”। এবং একাজে তারা হয়েছেও সফল কিন্তু করিম হয়েছে দুর্বল। এটাই চিরায়ত নিয়ম নয় কি? তাইতো করিমের মতো একজন স্ব-সুশিক্ষিত জাতশিল্পী হূমায়ুন আহমেদকে স্পষ্ট ভাষায় বলতে পেরেছিলেন, হূমায়ুন আহমেদ একজন ‘মরা গরুর হাড্ডির কারবারি’। মূলত মানুষের কাছে মানুষের মূলটাই আসল। “আর আমি জানি, যে করিম এখন না খেয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে, একদিন সে করিমকে নিয়েই ব্যবসা হবে, বাণিজ্য হবে। মরা করিমের হাড্ডি নিয়ে টানাটানি হবে, দর কষাকষি হবে।”
শাহ আবদুল করিম সম্পর্কে তাত্ত্বিক তপোধীর ভট্টাচার্যের মূল্যায়ন – “শাহ আবদুল করিমের রচনাসমগ্র প্রত্যেকের কাছেই অমূল্য সাংস্কৃতিক চিহ্নায়ক হিসাবে গণ্য হবে। কেননা আত্মবিস্মৃতির অন্ধকার প্রহরে ঐতিহ্যের বাতিঘরই আমাদের চূড়ান্ত আশ্রয়।”
কিংবদন্তি একজন বাউল করিম মূলত বাংলাদেশের গণমানুষের সংগীতের ‘চে’!
•তথ্য সংগ্রহ: ইন্টারনেট, করিমের রচনা সমগ্র, সুমন কুমার দাশ সম্পাদিত “করিমের জীবন ও গান”।