আমি বহুদিন পরে ‘আমি কি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি’–বিষয়টি নিয়ে যখন চিন্তা করছিলাম, তখনই হঠাৎ করে আমাকে লিখতে অনুরোধ জানানো হলো। লিখতে ভালোই লাগছে একদিকে যেমন অন্যদিকে তেমন স্পষ্ট জানি যে, এ বিষয়ে কোন দৃঢ় উত্তর দিতে পারবো না–তাই খারাপ লাগছে।
প্রশ্নটি বা ইস্যুটিতে বহু কিছু জড়িয়ে আছে। প্রথমটি- ‘আমি’ দ্বিতীয়টি ‘সিদ্ধান্ত’ ইত্যাদি। এগুলো নিয়েই একটু আলোচনা করা যাক। ‘আমি’ বলতে আমরা কি বুঝি? আমি মানে আমার নাম, আমার পছন্দ-অপছন্দ, আমার শিক্ষা/কুশিক্ষা/অশিক্ষা। আমার অতীত, আমার বর্তমান ও ভবিষ্যত সমন্ধে আমার ধারণা ও সম্পর্ক ইত্যাদি। আবার ‘আমি’ শব্দের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিস্বতন্ত্রবাদ গড়ে উঠেছে এটা ভুললে চলবে না। ‘আমার ইচ্ছা’ ‘আমার পছন্দ’ আমার ভালোলাগা’ ইত্যাদি এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো। আমরা পশ্চিম দেশে গেলে দেখতে পাবো এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রসার ও ব্যবহার। বাবা জানে না ছেলে বা মেয়ে কোথায থাকে, কি পড়ে, কাকে বিয়ে করবে, কি চাকরী করবে ইত্যাদি। কারণ এটি সন্তানের অধিকার। এই আর একটি শব্দ এসে গেল। আমি মানে আমার অধিকার। আমরা অনেক শুনছি এ শব্দটা – শিশুর অধিকার, নারীর অধিকার। এর সবই সুন্দর, প্রযোজ্য, শক্তিশালী ও উপযুক্ত।
‘আমি’ মানে বলতে যদি আমরা এই বুঝি, তাহলে এর সঙ্গে সঙ্গে দেখতে হবে এই ধারণার পিছনে বা সঙ্গে কোন পয়সার উল্টো দিক আছে কিনা।
এ বিষয়ে প্রাচ্য, এশীয়, আমাদের ধারণা কি? ‘আমি’ বলতে কোন পৃথক শব্দ নেই। আমি একটি বিরাট শব্দ বা ধারণা। এর মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ছোট্ট ধারণার মত ক্ষুদ্রতা নেই। আমি যদি আমার নামে কোন দরখাস্ত দিতে চাই, আমার বাবার নাম লিখতে হবে, আমার বর্তমান ঠিকানা তো দিতেই হবে, সেই সঙ্গে আমার স্থায়ী ঠিকানাও দিতে হবে। এ দ্বারা আমি বোঝাতে চাইছি যে, আমি মানে আমি তো বটেই, কিন্তু তার সঙ্গে আমার বাবা, মা পরিবারও জড়িয়ে আছে। আমি কোন পরিবারের লোক সেই পরিবারের ইতিহাস, আমার ইতিহাস, সেই পরিবারের সবার পছন্দ অপছন্দ আমার পছন্দ অপছন্দ, তাদের শিক্ষা কুশিক্ষা আমার শিক্ষা কুশিক্ষা, তাদের সভ্যতা ভদ্রতা আমার সভ্যতা ভদ্রতা, জ্ঞান, তাদের মান সম্মান, আমার মান সম্মান – সে জন্যেই বোধ হয় কোন কোন জায়গায় পরিবার ও পরিবারের ইতিহাস দেখে চাকরিতে নিয়োগ করা ‘হতো’ বা হয়। শুধু পরিবার বা পিতা-মাতা, ভাই-বোন, কাকা, জ্যাঠা, আত্মীয়-স্বজন নয়, স্থায়ী ঠিকানাও আমার পরিচয়। যে গ্রামে বাস করেছি বা করি, যে পাড়ায় থাকি বা থেকেছি, যেখানে বড় হয়েছি, যাদের সঙ্গে মেলা-মেশা করেছি, সেই মাঠ, ঘাট, এলাকা, বাজার, লোকজন আমার অস্তিত্বের মধ্যে জড়িত। তাদের স্বপ্ন, ইচ্ছা, স্বভাব, ভাললাগা আমারই স্বপ্ন ও স্বভাব। হাজার মাইলর দূরে গেলেও তাদের সঙ্গে জড়িত থাকবো চিরদিন। ঐ গ্রাম ও পাড়ার কথা বললে চিরদিন বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠবে। ঘুরে ফিরে সেখানেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে।
শুধু কি আমার গ্রাম? আমার দেশ আমার মা। এই মায়ের জন্য রক্ত দিতে কুণ্ঠাবোধ হয় না। আপনি লক্ষ্য করেছেন-বা পরীক্ষা করে দেখুন-একটা যোগ বা বিয়োগ বা গুণের অংক কষুন। ইংরেজীতে সংখ্যাগুলো লিখুন। এবং ইংরেজীতেই আপনাকে উত্তর দিতে হবে। এবার অংকটি কষুন। তবে একটি শর্ত, মনে মনে যে হিসাব করবেন তা ইংরেজীতেই করতে হবে। কষুন তো। কি হলো। কষ্ট হচ্ছে না। যে ভাষাতেই কথা বলুন, যে পোষাকই পরুন, বাংলার কাছে ফিরে ফিরে আসতে হবে। কারণ বাংলা আমার মা। খুব সংক্ষেপে এই যদি ‘আমি’ হই, তাহলে আসুন পরের শব্দ ‘সিদ্ধান্ত’ নিয়ে একটু আলোচনা করি।
আমরা সবাই জানি সিদ্ধান্ত মানে এমন একটি কাজ যা দ্বারা জীবনের পরিবর্তন, বা অপরিবর্তন, হ্যাঁ বা না ইত্যাদি সমন্ধে আমরা কাজ করি। সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা জীবনের নিজের বা পরের পরিবর্তন সমন্ধে এগিয়ে যাই। কি বাজার করবো, কি কাপড় পরবো, কি বই পড়বো, কোন স্কুলে যাবো, কোন চাকরি করবো, কাকে বিয়ে করবো, কি করবো সমন্ধে আমরা মানসিকভাবে এগিয়ে যাই। সিদ্ধান্তটি মানসিক। কিন্তু কাজ দিয়ে এই অনুসারে এগোতে হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না। এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেই এগোতে পারি কি না। আমি মানে যদি ইনডিভিজুয়াল আমি হই তাতে অসুবিধা নেই। আমার যা ইচ্ছা, সেই অনুসারে ভেবে চিন্তে আমিই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাতে যা ফল হয়, তা আমি ভোগ করবো।
কিন্তু আমি যদি প্রাচ্যের আমি হই, তাহলে অনেক সময় এই সিদ্ধান্তের ফলে কি হয়—আমার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই আমাকে বের করে দেওয়া হয়। তখন আমার ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যায়।
ধর্মগতভাবে বারবার বলা হয়েছে এবং ঈশ্বর পরিবারগত ভাবে তার পরিত্রাণ প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশেও আমরা যখন আমাদের সমাজের বাইরে প্রচার করি, তখন যেন এ বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখি। সাধারন জীবনের সাধারণ সিদ্ধান্ত আমরা কিভাবে নিই। এখনও আমাদের পরিচয় কি? আমি যদি আমি, আমার পরিবার ও সমাজ হই তাহলে দেখতে হবে যেন আমার সিদ্ধান্ত দ্বারা এই বিরাট আমি ক্ষতিগ্রস্থ না হই।
আমাদের দেশে খুব সুন্দর একটি কথা চালু আছে, ‘আপ রুচি মে খানা, পর রুচি মে পরনা।’ আমার জামা কাপড়ও পরের রুচির উপর নির্ভর। নিজের খানা তৈরী করতে গেলে আমি বাজার থেকে আমার সমস্ত পরিবারের রুচির কথা চিন্তা করে বাজার করি।
ব্যক্তিগত আমার কিছু বা কাউকে ভাললাগতে পারে। কোন ইচ্ছা বা অনিচ্ছা জাগতেও পারে, কিন্তু এখানে আলাপ-আলোচনা, সমঝোতা, কাউন্সিলিং ইত্যাদির বিরাট ক্ষেত্র আছে। আমার পরিবেশ পাল্টে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে হয়তো এই আমিই সংকীর্ণ হয়ে আসতে চাইবে-কিন্ত আমাদের একটা বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমির মধ্যে কোন সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব নয়। যা হয়েছে পাশ্চাত্যে।
তার ফলে পরিবার হারিয়ে যাচ্ছে, সমাজ ভেঙ্গে যাচ্ছে। কেউ কারো কাছে দায়ী নয়। কেউ কাউকে সম্মান করতে ভুলে যাবে। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে—সম্পর্কহীন, দায়িত্বহীন, সম্মানহীন এক অবস্থা সৃষ্টি হবে। হয়তো সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাপে পড়ে আমাদের সেদিকে এগিয়ে যেতে হতে পারে।
এই ছোট্ট প্রয়াস বা লেখা সে জন্যই। যত ব্যস্তই হই, যত অর্থনৈতিক ভাবে চিন্তিত হই, পরিবারের সম্পর্ক যেন না ভাঙ্গি। আমার সিদ্ধান্ত নিতে হলে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আলাপ করতে পারি। দায়িত্বহীন এক অবস্থার সৃষ্টি না করি। আমি যদি আমার সমাজের দিকে না তাকিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিই, আমার ছেলে মেয়েরাও আমার দিকে তাকাবে না। আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে সকল সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।