অণিমা মুক্তি গমেজ। জন্ম ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ, হাসনাবাদ, নবাবগঞ্জ, ঢাকা। পিতা পিটার কিরণ গমেজ। মাতা আইরিন গমেজ। দুই ভাই, এক বোন। স্বামী রঞ্জিত চন্দ্র দাস। ক্রীড়াবিদ, বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশনের সদস্য।
প্রথম হাতে খড়ি ডনবস্কো স্কুলে। কেজি। এ স্কুলেই পঞ্চম শ্রেণি পাশ ক’রে ভর্তি হন ‘ফেন্ট ইউফ্রেজীস গার্লস হাইস্কুল’-এ। এখাইে এসএসসি পাশ করেন ১ম বিভাগে। অতঃপর ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ভর্তি হলেন লালমাটিয়া মহিলা কলেজে। তারপর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাশ করেন ইডেন কলেজ থেকে। আহসানউল্লাহ্ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে বি.এড. ও এম.এড. এবং পরে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা) থেকে সংগীতে স্নাতকোত্তর।
আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে জানতে পারি যে, তিনি যখন কথা বলতে শেখেন, তখন থেকেই কণ্ঠে গান তোলেন, এবং হাঁটি-হাঁটি পা-পা ক’রে চলতে শুরু করেন গানের জগতে। তবে ১০ বছর বয়স থেকেই নিজের অজান্তেই গানকে বেঁধে নেন প্রাণের সঙ্গে, যেন গানের সঙ্গেই গড়ে ওঠে তাঁর সরব সখ্য। শুরু হয় সুরের সাধনা।
জন্মের পর থেকেই বাবার পছন্দের ভারতীয় বাংলা গান তথা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার, শ্যামল মিত্র, জগন্ময় মিত্র, রবীন্দ্রসংগীতে সাগর সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়; নজরুলসংগীতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর নারী-শিল্পী বলতে লতা মঙ্গেশকার, আশা ভোঁসলে, আরতী মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, রবীন্দ্রসংগীতে সুচিত্রা মিত্রের গান। বাংলাদেশের আবদুল জব্বার, সৈয়দ আবদুল হাদী, সুবীর নন্দী, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা – এঁদের কালজয়ী গান শুনতেন। তাই ছোটবেলা থেকে শুনতে-শুনতে গানের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। তাছাড়া তাঁর মা-ও একজন সংগীতশিল্পী। সেই সুবাদে সংগীতের আবহে তাঁর বেড়ে-ওঠা এবং সংগীত নিজের কণ্ঠে ধারণ করা। এছাড়া গ্রামে ও স্কুলে ছিল সংগীতের পরিবেশ। শুরুতে ভারতীয় সিনেমার গান কণ্ঠে তোলেন। মামার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন প্রবলভাবে। সর্বপ্রথম স্কুলের মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েই শুরু হলো শিশুশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া। এরপর স্কুলের শিক্ষিকা এবং অত্র এলাকার স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী মায়া গাঙ্গুলির কাছে রবীন্দ্রসংগীতের তালিম নেন।
অণিমার আগ্রহ এবং ভালো লাগা-বোধ ছিল নানান আঙ্গিকের গানের প্রতি। তাই একে-একে কণ্ঠে তোলেন লালনগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, হাসনগীতি, রাধারমণের গান, ধামাইল, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, কাওয়ালি, শ্যামাসংগীত, বিচ্ছেদী, আধুনিক, কীর্তন, পূজাপার্বণসহ ইসলামি গান।
মানুষের কণ্ঠের কোমল মধুর ধ্বনি নিঃসরণের নানা রূপ ও ভাব প্রকাশের ওঠা-নামা থেকে সুরের বিকাশ। শিল্পীর কণ্ঠে সেই সুরের বিশুদ্ধ ও বিমূর্ত রূপই আমাদের আনন্দে উদ্ভাসিত করে। কণ্ঠের এমন ধ্বনি তথা সুরের মধ্য দিয়ে যখন মনের নানা ভাব ব্যক্ত হয়, তখনই সংগীতের সূচনা-পর্ব রচিত হয়। তাই বলা হয়, সংগীত মানুষের অনুভব জগতের কোমলতম ভাবমানস। একমাত্র সংগীতই পারে মানুষকে জাগ্রত করতে, বা সংগীতই মানুষের মনের খোড়াক। চিরকাল এটিই সত্য, এটিই শাশ্বত। গীতিকবির রচিত কোমল ও সূক্ষ্ম অনুভূতিজাত হৃদয়ের কথাগুলোই সুর এবং শিল্পীর কণ্ঠের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে সংগীত। এই সংগীত মানবমনে সুন্দর এক শৈল্পিক ভাবাবেগ জাগায়, যা শুভ চেতনার সহায়ক। আর শিল্পীর সুললিত কণ্ঠের ছোঁয়ায় পূর্ণরূপে পৌঁছে যায় মানুষের হৃদগহিনে। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, অন্যান্য গানের তুলনায় লোকসংগীতের আবেদন ও সুর সর্বস্তরের মানুষের মর্মস্পর্শ ক’রে নিতে পারে অতি সহজেই।
পল্লিগীতি বলতে জনশ্রুতিমূলক গানকেই আমরা বুঝি। লোকসংগীতের বিপুল সম্ভারে সমৃদ্ধ আমাদের বাংলাদেশ। আর সারা বিশ্বে বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় পরিচয় বহন করে এদেশের পল্লিগীতি। বরাবরই লোকসংগীতের সহজ ভাষা, সাবলীল সুর, ভাবব্যঞ্জনা ও শিল্পরস মানুষকে মুগ্ধ করে। তাই লোকসংগীতের হৃদয়-নিংড়ানো ভাব-বেদনা-আনন্দ আরো সৌন্দর্য ও মাধুর্যমণ্ডিত ক’রে-তোলার জন্য প্রয়োজন মধুকণ্ঠি শিল্পী।
এমনই এক মধুকণ্ঠি সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমায় ব্যাকুল ক’রে তোলে, যাঁর নাম অণিমা মুক্তি গমেজ। সংগীত যাঁর রক্তে, হৃদয়ে ও কণ্ঠে মিশে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও বহুমাত্রিক প্রতিভার সমন্বয়ে গড়ে-ওঠা একজন পূর্ণ মানুষ এবং সংগীতভুবনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র অণিমা মুক্তি গমেজ। তাঁর কণ্ঠে শ্রোতা বিমোহিত হয় কারণ-বিচ্ছেদী সুর এবং গায়কী দর্শক-শ্রোতার মনে গভীর রেখাপাত করে। তাঁর গাওয়ার মধ্য দিয়ে দর্শক মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করতে পারেন মরমি ভাবনা ও বিরহের আর্তি মিশ্রিত প্রভাবসমূহ। অবলীলায় তাঁর কণ্ঠে প্রকাশ পায় সুখানুভূতি ও প্রেমানুভূতিসম্পন্ন প্রেমের গানগুলো। এক কথায় আত্মমগ্ন শিল্পসাধনার পথে চলে তিনি সংগীত প্রতিভাকে লালন ও বিকশিত করেছেন অন্যতম আবেদনের বিশালতায়, আর নিজেকে উজার করেন লোকসংগীতের রাজ্যে।
যেখানেই লোকসংগীতের প্রসঙ্গ আসে, তখনই কিছু পরিচিত নাম, ও প্রিয় মুখ সংগীতপ্রেমীর স্মৃতির অ্যালবামে ভেসে বেড়ায়। যেমন-নীনা হামিদ, মীনা বড়ুয়া, মুস্তাফা জামান অব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান, কল্যাণী ঘোষ, দিলরুবা খান, কিরণচন্দ্র রায়, ফরিদা পারভীন, চন্দনা মজুমদার, আবুবকর সিদ্দিক প্রমুখ। তাঁদেরই উত্তরসূরি আরো একটি নাম লোকগানের রাজ্যে নিজের যোগ্যতায়, মানুষের ভালোবাসায়, স্থান ক’রে নিয়েছে। সেই নামটি হলো অণিমা মুক্তি গমেজ। তিনি এমনই একজন শিল্পী যে, নির্দিষ্ট কোনো ঘরানার গানে বা নির্দিষ্ট এলাকার গানে নিজেকে আবদ্ধ করেন নি। তাঁর মধুকণ্ঠ ছড়িয়ে দিয়েছেন শহর-কেন্দ্রিক আধুনিক সভ্যতায়, আবার সবুজ-শ্যামল বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নানান আঙ্গিকের গানে। এভাবেই সংগীতের প্রতিটি শাখায় খুঁজে বেড়িয়েছেন তাঁর অন্তর্তুষ্টি। অবশেষে সংগীতে পূর্ণ তৃপ্তি ও প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছেন লোকগানের মাধ্যমে, যা তিনি কণ্ঠে আঁকড়ে ধরেছেন, অন্তরে লালন করেছেন আর প্রেমের সুতায় গেঁথেছেন মাটির গানকে। তাইতো তাঁর গানে পাওয়া যায় বাংলার মাটির গন্ধ, পাখির কুজন, সবুজের স্নিগ্ধতা, ঝরনার শীতলতা। সর্বোপরি মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়া যায় অণিমা মুক্তির গানে।
লোকগানে তাঁর পরিচিতি থাকলেও রবীন্দ্রসংগীত-প্রেমীরা তাঁর গানে পায় পূর্ণ তৃপ্তি। আবার একইভাবে নজরুলগীতির দর্শক-শ্রোতা বিমুগ্ধ তাঁর গানে। আবার সেই একই কণ্ঠ মুগ্ধ করেছে রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের দর্শক-শ্রোতাদের। আর সিলেট অঞ্চলের বাউল, মুর্শিদী, ফকিরি, ভাটিয়ালি, সারিগান, ধামাইলসহ অসংখ্য সুফি সাধকের গান অতি যত্ন ও ভক্তি সহকারে গেয়ে মুগ্ধ করছেন বিদগ্ধ শ্রোতাদের। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হলো, তিনি যখন যে পরিবেশের, যে ঘরানার গান কণ্ঠে তোলেন, সেই গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে যান। পাশ্চাত্য সুরও তিনি অনায়াসে কণ্ঠে তোলেন। তাঁর গান শুনে আলাদা ক’রে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি নির্দিষ্ট একটি ঘরানা অন্তরে লালন করছেন। একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে এটিই তাঁর আলাদা বৈশিষ্ট্য।
নিজের পছন্দমতো গানগুলো কুড়িয়ে নিয়েছেন ঝুড়িতে। তাঁর কণ্ঠে যখন পরিবেশন হয় মরমি কবি হাসন রাজার ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে’ – এই কান্দন যেন শ্রোতার মর্মমূলে আঘাত করে, অশ্র্বজলে সিক্ত হয় আঁখিজোড়া। ‘ওকি গাড়ীয়াল ভাই’ – গাড়ীয়াল বন্ধুর বিরহে রমণীর দুঃখের প্রকাশ যখন তাঁর গলায় স্থান পায়, তখন শ্রোতা নিমিষেই হারিয়ে যায় সেই রংপুর অঞ্চলের ধুধু প্রান্তরে। যখন গেয়ে ওঠেন, ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’, `সাগর কূলের নাইয়া’, `আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি’, যোগী ভিক্ষা লয় না, কথা রে কয় না’, `মনের মানুষ ঘুমাইলে হয় যন্ত্রণা, আবার রাধারমণের দয়াময়ের দরশন লাভের ব্যাকুলতা তাঁর কণ্ঠে অসাধারণভাবে ফুঠে ওঠে, যখন গাইতে শুনি ‘আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়’।
মোদ্দা কথা হলো, সংগীতবোধ তাঁর মধ্যে এক্কেবারে পাকাপোক্ত। আর এই পাকা কণ্ঠে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন জেলার নানান আঙ্গিকের পল্লিগীতি। সিলেট অঞ্চলের গান গাওয়ার মতো কঠিন বিষয়টিতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। পল্লির মাটি-মানুষের হৃদয়ের কথা, চাওয়া-পাওয়ার কথা, হারানোর বেদনা, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা তিনি সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেন সুরের মাধ্যমে। নানান আঙ্গিকের গানের জন্যই প্রচুর ঘষামাজা ক’রে তিনি তৈরি করেছেন এই গলা। এছাড়া স্রষ্টার অমূল্য দান স্বীকার করতেই হবে।
দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলা লোকসাহিত্যে দক্ষতা ও অনন্য সংগীত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন অণিমা মুক্তি গমেজ। তাঁর ইচ্ছা, কঠোর অধ্যবসায়, সঠিক পরিচর্যা ও যত্নে তিনি সংগীতের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিজের আয়ত্তে এনেছেন। বাংলার পল্লিগীতি কণ্ঠে ফেরি ক’রে বিদেশের মাটিতে প্রচার ও প্রসারে নিরলস চেষ্টা ক’রে যাচ্ছেন এই শিল্পী। এক কথায় সুরের ‘ফেরিওয়ালা’ বলা যেতে পারে তাঁকে। কেননা শুধু পল্লিগীতি নয়, প্রত্যেকটি ঘরানাকে আত্মস্থ ক’রে তিনি হৃদয়ঙ্গম ক’রে তোলেন তাঁর পরিবেশনা ও সুন্দর উপস্থাপনার মাধ্যমে। কিন্তু পল্লিগীতিই তাঁর প্রাণের খোড়াক যুগিয়ে তাঁকে তুষ্ট করতে পারে। লোকগান তাঁর কণ্ঠে ঠাঁই পেয়ে যেন ধন্য হয়েছে, আর সার্থক হয়েছে অসংখ্য পীর-ফকির-সাধক-বাউলসহ আধুনিক গীতিকবিদের হৃদয়-নিংড়ানো কথা ও ব্যথার ডালি দিয়ে সাজানো গীতিকবিতাগুলো। এক্ষেত্রে লোকসংগীতে অনন্য অবদান রয়েছে তাঁর, এ যেন বাংলার পরম পাওয়া। ধন্য বাংলার মাটি, যে মাটিতে তিনি জন্মেছেন। ধন্য তাঁর পিতা-মাতা, যাঁরা তাঁকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। আর অফুরান কৃতজ্ঞতা মহান স্রষ্টার প্রতি, যিনি একসঙ্গে বহুগুণ অর্জন করার মতো মেধা ও ধৈর্য দিয়ে তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, প্রায়ই দেখা যায় পল্লিগীতির শিল্পী রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন না, বা অনেকেই বলেন, ‘ওরে বাবা রবীন্দ্রসংগীত? কিন্তু এই একজন ব্যক্তি, যে কোনো গানে তাঁর গলার সুরতরঙ্গে দর্শক-শ্রোতাকে দুলিয়েছেন। লালনের গানের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, কিন্তু খুব সহজে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তাঁর কণ্ঠে। রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়ার কথাই বলা যাক, ভাওয়াইয়া গানের মূল অর্থাৎ শিকড় হলো ভাঙা সুর আর দীর্ঘ টান, যা সকলের পক্ষে আয়ত্ত করা কঠিন। কিন্তু দিদির কণ্ঠে ‘ওকি গাড়ীয়াল ভা…ই’ – এই টান শ্রোতার অন্তরে আঘাত করে; এ আমার বিশ্বাস। রংপুর অঞ্চলের শিল্পী ব্যতীত ভাওয়াইয়া গানের ভাঙা সুর আয়ত্ত করা খুবই কষ্টকর। ‘আর কি কব দুষ্কের জ্বালা’ – এখানে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে গলা ভাঙার মতো যে কঠিন কাজটি রয়েছে, তা ঢাকার মেয়ে হয়ে দিদি কীভাবে আয়ত্তে আনলেন, একমাত্র তিনিই জানেন। তবে তাঁর কণ্ঠে উচ্চারণসহ ভাওয়াইয়া গান শুনলে যে কেউ মনে করবেন, তিনি রংপুর অঞ্চলের বাসিন্দা।
সিলেটের সাধক-ফকির-বাউল বা স্থানীয় গীতিকবিদের গানে আঞ্চলিকতার প্রাধান্য সর্বোর্ধে। তাঁদের রচিত সে-সকল গান সিলেটের শিল্পী যেভাবে আঞ্চলিক টোনে গাইতে পারেন, কিন্তু সিলেটের বাইরের শিল্পীর পক্ষে এ বিষয়টি আয়ত্তে আনা খুবই কঠিন। গান শুনলেই উচ্চারণের এই পার্থক্য অনুধাবন করা যায় অতি সহজে। চট্টগ্রামের গানের বেলায়ও একই রকম। কিন্তু একমাত্র অণিমা মুক্তি গমেজ আমাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছেন যে কোনো গানের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে। এক কথায় জলের মতোই তিনি গানের রঙের সঙ্গে নিজেকে রাঙাতে পারেন, এটি তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব।
পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ তথা সমগ্র বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোকগানগুলো কুড়িয়ে কণ্ঠে লালন করছেন নিজের আত্মবিশ্বাসের জোরে। কেননা অতীতে যাঁরা এই গানগুলো গেয়েছেন, একটি সময় তাঁরা থাকবেন না। মাঝে-মধ্যে হয়ত বেতারে, টেলিভিশনে প্রচার হবে, কিংবা জন্ম বা মৃত্যু দিবসেই তাঁদের স্মরণে প্রচার করা হবে নানা অনুষ্ঠান। তাই তাঁদের গায়কী-ঢঙ অনুসরণ ক’রেই নিজের কণ্ঠে তাঁদের বাঁচিয়ে-রাখার তাগিদ বহন করছেন তিনি। যেমন-তাঁর গানের শিক্ষিকা শ্রদ্ধেয়া নীনা হামিদের গাওয়া গান অণিমা মুক্তি যখন পরিবেশন করবেন, তখন সেই গানের মধ্যেই দর্শক-শ্রোতা নীনা হামিদকে খুঁজে পাবেন। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য হলেও নিজের গায়কীতে অতীতে ফিরে-যাওয়ার প্রয়াস করেন তিনি।
স্রষ্টার ইচ্ছায় ও নিজ প্রতিভাগুণে লোকসংগীতের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সঠিকভাবে আয়ত্ত করেন তিনি। আর সকল ঘরানার গানই সহজে মানিয়ে যায় এই তৈরি গলায়। তাঁর কণ্ঠে বিরহের গানগুলো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, আর সুখের গানে মানুষের অন্তরে তরঙ্গ নৃত্য করে, এক কথায় অপূর্ব তাঁর গায়নশৈলী। তাঁর এই অসাধারণ গায়কী শুধু মঞ্চে আর টেলিভিশনের পর্দায় সীমাবদ্ধ নয়, এই মধু কণ্ঠের জনপ্রিয় কিছু গান প্রকাশ হয়েছে সিডি আকারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিডি হলো-১. সাগর কুলের নাইয়া (২০০২), ২. বন্ধু দয়াময় (বাংলা সুর, ঢাকা, ২০১২), ৩. উজান দেশের মাঝি (বাংলা সুর, ঢাকা, ২০১৪), ৪. অপার হয়ে বসে আছি (বাংলা সুর, ঢাকা, ২০০১), ৫. এত রাতে কেন ডাক দিলি (ঢাকা, যৌথ, ২০০১), ৬. ইছামতীর তীরে (আবুবকর সিদ্দিকের সঙ্গে), ২০০১, ৭. মনের মানুষ (বিউটি কর্নার, ঢাকা, ২০০২) প্রভৃতি।
বাউলিয়ানা বা বাউল-বোধ তাঁর অন্তরে বিঁধেছে কাঁটার মতো। কারণ বাউল গানে তাঁর আবেগ-তন্ময়তা শুধু গাওয়ার জন্যই নয়; প্রত্যেকটি গানের মর্ম উপলব্ধি ক’রে হৃদয়-নিংড়ানো ভাব এবং আবেগ আসে তাঁর ভেতর থেকে। তাঁর কণ্ঠে বাউল গান শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাউল গানের আসরে ভাবোন্মাদনায় অর্ধনৃত্যরত বাউল শিল্পী যেন গলা ছেড়ে গানটি গাইছে। ধামাইলের কথাই বলি, যখন গেয়ে ওঠেন, ‘আমি রব না, রব না গৃহে, বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’, তখন হারিয়ে যাই বৃহত্তর সিলেটের কোনো বাড়ির আঙিনায় মা-মাসি-দিদি-বৌদি চক্রাকারে ঘুরে-ঘুরে, ছন্দময় হাত তালির সঙ্গে পা ফেলে ধীর লয়ে শুরু ক’রে দ্রুত লয়ে পৌঁছনোর সেই মনোরম দৃশ্যে। দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যখন গাইতে শুনি, ‘ওকি গাড়ীয়াল ভাই’। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ টিনের চালে নৃত্য করে তাঁর গানে, ‘আষাঢ় মাসে বৃষ্টি রে, ঝমঝমাইয়া পড়ে রে, বন্ধু আমার রইল বৈদেশ গিয়া।’ যে রমণীর ঘরে বন্ধু নেই, অলংকার তার শোভা পায় না, তাই রাগে-অভিমানে রমণীর অলংকার ত্যাগের দৃশ্য দেখতে পাই, যখন তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘আমার গলার হার খুলে নে, ওগো ললিতে।’ আমার আম্মা খুব গাইতেন গানটি, তাছাড়া রেডিওতে ছোটবেলায় এই গানগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনতাম, নিজেও গাইতাম। দিদির কণ্ঠে পরিচিত এই গানগুলো যেন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ফেলে-আসা দিনগুলোতে। পরিচয়ের পর থেকেই অসাধারণ কণ্ঠ ও নানা প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটিকে আমি ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করি, তিনিও ছোট বোনের মতো আমাকে স্নেহ করেন।
মাটির গন্ধমাখা লোকগানগুলো তিনি অকৃত্রিমভাবে গেয়ে স্থান ক’রে নিয়েছেন মটির মানুষের হৃদকোঠায়। লোকগানের আদি এবং প্রকৃত রূপ, রং, গন্ধ ও বাঙালিয়ানার রস আস্বাদন করা যায় তাঁর গায়কীতে। সিলেটের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন গানগুলো তাঁর কণ্ঠে অসাধারণ। ভক্তিমূলক বা আল্লাহ্র বন্দনাসূচক গানগুলোও অনায়াসে গেয়ে চলেছেন। বিচ্ছেদের গানে চারপাশে বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে। আবার কীর্তনের সময় ভক্তি-ভালোবাসায় ভাবগাম্ভীর্যময় একটি পরিবেশ তৈরি হয়। আর সুখের গানে যেন শ্রোতার মনময়ূর পেখম তোলে। একই কণ্ঠে গেয়ে চলেছেন লালনগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, হাসনগীতি, রাধারমণের গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, কাওয়ালি, শ্যামাসংগীত, বিচ্ছেদী, আধুনিক, ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি, হামদ-নাত, কীর্তন, ধামাইল ও বড়দিনের গান। আর লোকসংগীতের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর অন্তর উজাড়-করা প্রেম-ভালো লাগা-ভালোবাসার তরিখানি। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও উপলব্ধির আলোকে তাঁকে মধুকণ্ঠী বললে হয়ত ভুল হবে না।
অসংখ্য গীতিকার ও সুরকারের গান পরিবেশন ক’রে তিনি দেশ-বিদেশে এত খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করেছেন, তাঁরা হলেন: লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, আরকুম শাহ, রামপ্রসাদ সেন, কদলীপা শাহ, দুরবীন শাহ, জালালউদ্দিন, উকিল মুন্সি, আশা নন্দ, সৈয়দ শাহনূর, আবদুল করিম, জসীমউদ্দীন, আবদুল লতিফ, যাদুবিন্দু, রজ্জব আলী দেওয়ান, আলেপচান দেওয়ান, পরান ফকির, পির নসিম আলী, কানাইলাল শীল, মোহাম্মদ ওসমান খান, মমতাজ আলী খান, কুটি মনসুর, রামকানাই দাশ, আবিদ আনোয়ার, হাসান মতিউর রহমান, আবু বকর সিদ্দিক, তপন বাগচী প্রমুখ।
পল্লিগীতির জনপ্রিয় এই শিল্পীর সংগীত পরিবেশন করার সুয়োগ হয়েছে বহু প্রতিষ্ঠানে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (নারায়ণগঞ্জ), ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, বনানী দুর্গামন্দির, লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, ভোলানন্দ গিরি আশ্রম, কলাবাগান সার্বজনীন দুর্গামন্দির, রমনা শ্রীশ্রীআনন্দময়ী কালীমন্দির, বাংলাদেশ লোকসংগীত পরিষদসহ দেশের সকল জেলা সদরে এবং গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।
সরকারি দলের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন বহুবার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল ফিলিপাইন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, উজবেকিস্তান, ইতালি, মিশর, সৌদি আরব, দিল্লি প্রভৃতি দেশে।
বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তিনি বিশেষ গ্রেডের পল্লিগীতি শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত। তাঁর গানে আছে ভেজা মাটির গন্ধ, হাওর জলের কলকল ছলছল শব্দ, কোকিলের কুহুতান, ধূপ আর আগর বাতির গন্ধ। দেখা যায়, আঁধার রাতের জোনাকির আলো, কানে বাজে ঝিঁঝি পোকার ডাক। কখনে ঘুমন্ত শহরের সোডিয়ামের আলোর নিচে মায়ের বুকে ঘুমিয়ে-থাকা অবুঝ শিশুটির গন্ধ নাক ছুঁয়ে যায়। প্রকৃতির রূপ-বৈচিত্র্য ফুটে ওঠে তাঁর গায়কীতে। এর ফলস্বরূপ তাঁর কণ্ঠের মোহনীয় সুর এবং গায়কী তাঁকে এনে দিয়েছে অসংখ্য স্বীকৃতি ও পুরস্কার। লোকসংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে সংগীতচর্চায় ২৫ বছরের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পদক, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ত্রিপুরা ফোকলোর একাডেমি প্রদত্ত ‘লোকসংগীত অনন্যা’ উপাধি, অনন্যা শীর্ষদশ সম্মাননা, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী পদক, জয়যাত্রা অপেরা গুণীজন সংবর্ধনা প্রভৃতি।
তাঁর এই বহুমাত্রিক প্রতিভায় কাছের বা দূরের সকল মানুষ মুগ্ধ। তাঁকে যদি শুধু সংগীতশিল্পী হিসেবেই বলা হয়, তবে বলবো বেশ নন্দিত শিল্পী তিনি। কারণ একটি গলায় বিভিন্ন ঘরানার গান আর চর্চিত কণ্ঠের সুরসুধায় অসংখ্য সংগীতপ্রেমীর হৃদয় জয় করতে শুধু অণিমা মুক্তিই পারেন। বাংলাদেশে এতগুলো গুণের সমন্বয়ে একজন শিল্পী খুঁজে-পাওয়া বিরল বটে। তাঁর এই পথচলা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে – এটি আমার বিশ্বাস।
বিচারক হিসেবেও তিনি লোকসংগীতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যেমন: মাছরাঙা টেলিভিশনে ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা’র বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে তাঁকে যেতে হয়েছে।
তাঁর জাদুকরি কণ্ঠে যে কোনো গান শ্রুতিমধুর; দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে থাকা সংগীতপ্রেমীর অন্তর ছুঁয়ে যায়, যেন এক লোকসংগীতের মাঝি তাঁর সুরের তরি বেয়ে চলেছেন দর্শক-শ্রোতার প্রাণের জোয়ারে। আবার অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন রাধারমণের ধামাইলে, যখন তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘আমি রব না, রব না গৃহে’, বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’, কখনো ‘আসবে শ্যাম কালিয়া, কুঞ্জ সাজাও গিয়া’। অণিমা মুক্তি একাধারে কণ্ঠশিল্পী, সংগীতশিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কবি, গবেষক এবং একজন সুগৃহিণী। একজন মানুষের এত সকল গুণের মধ্যে কোন পরিচয়ে তাঁকে চিহ্নিত করবো? কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি বেশ নন্দিত। একজন সুদক্ষ প্রশিক্ষক। একজন সংগ্রাহক, গবেষক ও সংগঠক। এক কথায়, অণিমা মুক্তি নিজেই যেন একটি প্রতিষ্ঠান। কেননা একসঙ্গে এতসব গুণে গুণান্বিত মানুষ বিরলই বটে।
একজন ভালো মানুষের দৃষ্টি দিয়ে যদি দেখি, তবে তিনি শান্ত স্বভাবের – সদালাপী, বিনয়ী, নিরহংকার, মিষ্টভাষী, ভদ্র। দরিদ্র-ধনী, ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত – সকল শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে-যাওয়ার জন্য যে গুণাবলি প্রয়োজন, তার সবই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। তাঁকে যতটা জেনেছি, খুব কাছ থেকে যতটা দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয়, কণ্ঠশিল্পী অণিমা মুক্তি গমেজ শুধু একজন কণ্ঠশিল্পীই নন, তাঁর মধ্যে সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা প্রতিনিয়ত কাজ করে। নতুন কিছু করার ভাবনা তাঁকে তাড়া করে সব সময়। সাম্প্রদায়িকতা তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্রও নেই। আর এই মহৎ গুণটি কাজে লাগিয়েই তিনি আজকের পর্যায়ে এসে নিজের স্থানটি দখল ক’রে নিয়েছেন নিজের অজান্তেই। তিনি মনে করেন, ‘মসজিদ, মন্দির, গির্জা – সকল স্থানই পবিত্র। যার ভক্তি-বিশ্বাস আছে, সে-ই এমন পবিত্র স্থানগুলোতে গিয়ে নিজের মনের প্রশান্তি খোঁজেন, কারণ ধর্মীয় স্থানগুলোতে গেলে হৃদয়ে ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হয়। তাই শুধু নিজের ধর্ম নয়, সকল ধর্মের প্রতি ভক্তি আর বিশ্বাসটাই রাখতে হবে। আল্লাহ্, ঈশ্বর, গড, ভগবান – যা-ই বলি, সকলের আরাধ্য তো একজনই। জাতিতে-জাতিতে বৈষম্য-হানাহানি-ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কথা কোনো ধর্মে উল্লেখ নেই।’ তাই তিনি ভক্তি ও শ্রদ্ধাভরে অসংখ্য পীর-দরবেশের মাজার ও মন্দিরে গিয়েছেন বহুবার।
অনেকের ধারণা যে, শিল্পী-সাহিত্যিকদের সংসার হয় না। এ ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছেন অণিমা মুক্তি। ঘরকন্যা হিসেবে দেখতে গেলে তিনি প্রচণ্ড পরিশ্রমী আর ধৈর্যশীল। দিব্যি স্বামী-সংসার সামলাচ্ছেন বিশ্বাস আর ভালোবাসার খুঁটিটি মজবুত ক’রে। নিজ হাতে বাজার করছেন, রান্নাবান্নাসহ হাতের কাজ থেকে শুরু ক’রে গৃহস্থালি নানা বিষয়ে তিনি পারদর্শী। অতিথি আপ্যায়ন থেকে সংসারের নানা খুঁটিনাটি তো রয়েছেই, তবু এত ব্যস্ততার ফাঁকে সুঁই-সুতার কাজও তাঁর হাতের ছোঁয়া থেকে রেহাই পায় নি। আঁকিয়ে হিসেবেও তাঁর রয়েছে পরিচিতি। এক কথায় বলতে হয় ‘চণ্ডীপাঠ থেকে জুতা সেলাই’। সংসারে একজন আদর্শ গৃহিণীর প্রত্যেকটি গুণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। ঘরকন্যার সকল কাজেই তাঁর হাত পাকা।
আরো একটি গুণ হলো, দক্ষতার সাথে একেবারে পাকা কণ্ঠে, সাবলীল ও পরিষ্কার উচ্চারণে ক’রে যাচ্ছেন উপস্থাপনার মতো কঠিন কর্মটিও। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলাদেশ বেতারের ধারা বর্ণনাসহ নিজস্ব অনুষ্ঠানের তালিকাভুক্ত উপস্থাপক তিনি। এছাড়াও দেশ-বিদেশের অজস্র অনুষ্ঠানে সফল উপস্থাপক হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তাঁর।
সারা বাংলাদেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা বাউল-মরমি-বিচ্ছেদ-ধামাইল-মুর্শিদি-কীর্তন ও আল্লাহ্-রাসুলের বন্দনাসূচক গানগুলো সংগ্রহ ক’রে নিজের কণ্ঠে তুলেছেন তিনি। শুধু কণ্ঠে তুলেই ক্ষান্ত হন নি; প্রত্যেকটি গানের সঙ্গে-সঙ্গে গীতিকার-সুরকার ও শিল্পীর নামও সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া সম্প্রতি তিনি বৃহত্তর সিলেট জেলার ধামাইল গান সংগ্রহ করছেন। ধামাইল বলতেই যে নামটি মনের আয়নায় ভেসে আসে, তা হলো বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত। ধামাইল গীতের স্রষ্টা রাধারমণ দত্ত। ধামাইল গীত কণ্ঠে তোলার পাশাপাশি রাধারমণ-প্রীতি তাঁকে ধামাইলের ওপর গবেষণা করায় আগ্রহী ক’রে তোলে।
নির্জনতা খুব পছন্দ করেন তিনি। কিছু সময় একা থাকলেই মনের কথাগুলো যখন ডানা মেলে, তখন তিনি হয়ে ওঠেন কবি। সেই ইচ্ছে ডানায় ভর ক’রে ভেসে বেড়ান মেঘের ভেলায়, আর গেঁথে ফেলেন কথার মালা। বিভিন্ন পালা-পার্বন, প্রেম-বিরহসহ ছোটদের নানা বিষয়ে অসংখ্য মজার-মজার কবিতা-ছড়া লেখেন তিনি। ইতোমধ্যে নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশের অপেক্ষায়।
যারা তাঁর নিকটজন, তারা জানেন যে, সম্প্রতি তিনি গবেষণায় মনোনিবেশ করেছেন। উচ্ছ্বসিত প্রাণ এই লেখক শুধু সংসার, গান গাওয়া, গান সংগ্রহে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে নিযুক্ত হলেন গবেষণার মতো কঠিন কর্মে। লোকসংগীতের ওপর বেশ কয়েকটি কাজ তিনি ইতোমধ্যে করেছেন। সর্বপ্রথম শুরু করেছেন রাধারমণের গানের ওপর গবেষণা। তারপর ভাওয়াইয়া গান। তাঁর নজর ও কলমের আঁচড় বাদ পড়ে নি কবি জসিমউদ্দিন ও কবি নজরুলের গান থেকেও। ধামাইল নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি লিখেছেন অসংখ্য গবেষণা-প্রবন্ধ। বর্তমানে তিনি ‘সুরস্রষ্টা সমর দাস’ নিয়ে গবেষণা করছেন।
‘শিক্ষক’, যাঁকে বলে মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষিত সবাই হতে পারলেও শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা সবার নেই। কারণ শিক্ষক হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন ধৈর্য ও মেধা। এক্ষেত্রে অণিমা মুক্তি শুধু গৃহিণী, শিল্পী, সংগ্রাহক, গবেষক পরিচয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। তাঁর যোগ্যতা-মেধার প্রসার ঘটিয়েছেন শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। নিজের হাতে অতি যত্নসহকারে ছাত্র-ছাত্রীদের সংগীত প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
তিনি একজন গুণী শিল্পী, একজন আদর্শ স্ত্রী। কিন্তু গান গাইতে বাইরে যাওয়া এবং স্ত্রী হিসেবে চার দেয়ালের গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে পারেন নি। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত রয়েছেন। একজন নারী বা একজন স্ত্রী হয়ে এই স্বাধীনতাটুকু শ্বশুরবাড়ির প্রতিটি সদস্য এবং স্বামীর কাছ থেকে নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেছেন। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে কজন নারী এই অসাধ্য কর্মটি সাধন করতে পারেন? হাতে-গোনা দু-এক জন। অণিমা মুক্তি তাদেরই একজন। এক কথায় তিনি আমাদের নারীদের আইডল। তাঁর অনুসরণ আমাদের আলোর পথ দেখাবে, মুক্তির পথ দেখাবে, ভালো মানুষ হয়ে বাঁচতে শেখাবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
তাঁর এই বহুমাত্রিক প্রতিভায় কাছের বা দূরের সকল মানুষ মুগ্ধ। তাঁকে যদি শুধু সংগীতশিল্পী হিসেবেই বলা হয়, তবে বলবো, বেশ নন্দিত শিল্পী তিনি। কারণ একটি গলায় বিভিন্ন ঘরানার গান আর চর্চিত কণ্ঠের সুরসুধায় অসংখ্য সংগীতপ্রেমীর হৃদয় জয় করতে শুধু অণিমা মুক্তিই পারেন। বাংলাদেশে এতগুলো গুণের সমন্বয়ে একজন শিল্পী খুঁজে-পাওয়া বিরল বটে। তাঁর এই পথচলা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে – এটি আমার বিশ্বাস।