মরমী দার্শনিক কবি হাসন রাজা। যার গান ও দর্শনে মিশে আছে বাংলার মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ। যার সাথে পরিচিত না হয়ে পারা যায় না। হাসন রাজার জীবন ও দর্শন গবেষণার সার্থে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ‘কবি কাজী রোজী’কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, ‘হাসন রাজার গান বাদ দিয়ে আমরা থাকতে পারি না। তার গান বুঝতে গেলে আগে তার চলনটা বুঝতে হবে। কোথায় তার বাস, তার এলাকাটা তার সম্পর্কে কি বলে, তার নদীটা তার সম্পর্কে কি বলে, সেখানকার গাছ-পাতা-পক্ষী কি বলে তা বুঝতে হবে। ’
হাসন রাজার দার্শনিকতার পরিচয় মেলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে। প্রভাত কুমার শর্মার হাত ঘুরে তিনি হাসন রাজার কিছু গানের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই গানগুলোর মাধ্যমেই কবিগুরু হাসন রাজাকে মূল্যয়ন করতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘পুর্ব বঙ্গের একটি গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই। সেটি এই যে, ব্যক্তি স্বরুপের সহিত সম্মন্ধ সূত্রেই বিশ্বসত্য। ’ ১৯২৫ সালে দর্শন কংগ্রেসের সভায় ও পরবর্তীকালে লন্ডন হিবার্ট বক্তৃতায় কবিগুরু হাসন রাজা সম্পর্কে এই বক্তব্য প্রদান করেন। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্ছিত একজন মরমী কবি তার সৃষ্টির মহিমায় দার্শনিক বনে গিয়েছেন। তাই হাসন রাজার নামের পূর্বে মরমী শব্দটির সাথে দার্শনিক শব্দটিও যুক্ত করতেও কোন বাধা নেই।
বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বে বাংলাভাষাভাষীদের মধ্যে সাহিত্য চর্চার যে উদ্যম, তার পেছনে বিশেষভাবে কাজ করে আঞ্চলিক ভাষার গান (লোক সঙ্গীত) এবং মরমী সঙ্গীত ভাণ্ডার। যা সৃষ্টির পেছনে বাউল সম্রাট লালন শাহ, শীতলং শাহ, আরকুম শাহ, রাধারমন দত্ত, শেখ ভানু সকলের অবদানের সঙ্গে হাসন রাজার অবদানও উল্লেখযোগ্য। হাসন রাজার গানের বিচিত্রতা লক্ষ্যনীয়। তিনি লিখেছেন প্রেমের গান- জাগতিক প্রেম, রূহানিক বা আধ্যাতিক প্রেম, জগৎ সংসারের প্রেম ইত্যাদি। তার পরেও তার গানের প্রধান বিষয়বস্তুটা অনেকটা এরকম যে, -এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন একটা স্বল্প সময়ের মাত্র। এখানে কেউই চিরস্হায়ী নয়। এবং মানবিক বোধকে তিনি উচ্চ স্তরে স্হান দিয়েছেন যেখানে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব সংহতি এবং সহনশীলতাবোধের গভীর দিকদর্শন রয়েছে।
হাসন রাজার আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহ দেব ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরিলীতে বাস করতেন। কথিত আছে রামচন্দ্র ছোট রাজ্যে এক শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করে রাজ্য পরিচালনা করছিলেন। এবং সে জন্যই তার নামটি পরবতর্ীকালে স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখা হয়েছে। রামচন্দ্রের অধস্হন কোন এক পুরুষ রায়বেরিলী থেকে অযোদ্যায় বসতি স্হাপন করে সেখানে কাল অতিক্রম করছিলেন। পরবর্তী কালে ষাড়শ শতাব্দির দিকে এই পরিবারেরই এক সদস্য রাজা বিজয় সিংহ দেব অযোদ্যা ত্যাগ করে এদেশে আগমন করেন এবং বর্তমান বাংলাদেশের যশোহর জেলার কাগদি বা কাগদিঘী গ্রামে প্রথম বসতি স্হাপন করেন। তাই এটা স্পষ্ট যে, হাসন রাজার পূর্ব পুরুষেরা অযোধ্যার অধিবাসী ছিলেন। জাতিতে ছিলেন আর্যগোষ্ঠীর ক্ষত্রিয় শাখার অন্তভরভূক্ত।
এই খণ্ড রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা বিজয় সিংহ দেবের অধস্তন পুরুষ রাজা রনজিৎসিংহ দেব পারিবারিক কলহহেতু কনিষ্ঠ সহোদরের শত্রুতায় বাধ্য হয়ে সিলেট জেলার সদর মহকুমার অন্তর্গত এলাকাধীন কুনাউড়া পরগণায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার বংশধর রাজা রঞ্জিত রায় রামপাশা গ্রামের পত্তন করে দৌলতখানা স্হাপন করেন।
তার অধস্তন পুরুষে জন্মগ্রহণ করেন বানারসী রাম সিংহ দেব। বানারসী রামের একমাত্র পুত্র বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহ দেব তথা বাবু রায় পরবতর্ীতে ধর্মান্তরিত হয়ে বাবু খা উপাধি লাভ করেন। তার সন্তান দেওয়ান আনোয়ার খা চৌধুরীর পুত্র দেওয়ান আলী রাজা কয়েক পুরুষ পর রামপাশা হতে সুনামগঞ্জের নিকটবর্তী লক্ষণশ্রী গ্রামে বাসস্হান প্রতিষ্ঠা করেন। সেই লক্ষণশ্রীতেই ১৮৫৪ সালে দেওয়ান হাসন রাজার জন্ম হয়। শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই লক্ষণশ্রীই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। তাইতো তিনি গেয়েছেন- “কতদিন থাকিবায় লক্ষণছিরিরে হাসন রাজা/ ও রাজা কতদিন থাকিবায় লক্ষণছিরি। /আখেরাতে যাইতে হইবে, একদিন মরিবে। / হাসন রাজা কতদিন থাকিবে লক্ষণছিরি। ”
লক্ষনীয় যে, হাসন রাজার শিশুকাল এক আনন্দ ঘন পরিবেশ ছিল। প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা হাসন রাজা খেলার সময়টা ছিল বনে বাদারে ঘুরে এবং পশু পাখি সংরক্ষণ করা। হাওড় বিল এবং নদী নালায় চড়ে বেড়ানো। এমনি নিশ্চিন্ত অবাদ এক জীবন যাত্রায় হাসন রাজা ছিল অফুরন্ত আনন্দ ও তৃপ্তি। হাসন রাজার ৭৮ টি কোড়া, ৮০ টি ঘোড়া এবং ৮টি হাতি যার প্রত্যেকটির এক একটি নাম ছিল। হাসন রাজার উল্লেখযোগ্য শখের মধ্যে ছিল- গান রচনা ও গানের আসর জমানো, গায়কি দল নিয়ে নৌকা ভ্রমণ, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌঁড়, কোড়া ও অন্যান্য পাখি শিকার ও পালন, হাতির সোয়ারী হওয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। হাসন রাজার আর এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট ছেলেমেদের জড়ো করে রুপোর টাকা ছড়িয়ে দেওয়া। বাচ্চারা যখন হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত তা দেখে তিনি খুব মজা পেতেন।
বংশের নিয়মানুসারে তিনি প্রথমে আরবী এবং পরে বাংলা ভাষায় পাঠ শুরু করেন। হাসন রাজা যে যুগে জন্মেছিলেন, সে যুগে মুসলমান সমাজে ইংরেজী শিক্ষার তত প্রচলন না থাকায় বিদ্যালয়ের পড়াশোনায় তিনি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেন নি। নিজে আধুনিক শিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর হতে না পারলেও শিক্ষা প্রসারে তিনি উদার হাতে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতেন। সুনামগঞ্জের প্রধান ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্টান প্রতিষ্ঠাকল্পে তাঁর অফুরন্ত দান ছিলো। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠানের জন্যে জায়গা প্রদান উল্লেখযোগ্য।
হাসন রাজা সত্যিকার অর্থে সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর উঁচু দেহ, দীর্ঘ বাহু, ধারালো নাক এবং কোঁকড়ানো চুল প্রাচীন আর্যদের চেহারা স্মরণ করিয়ে দেয়। সামগ্রিক ভাবে তাঁর পোষাক-পরিচ্ছদে ছিল আভিজাত্যের পরিচয়। তিনি মখমলের চোগা, চাপকান ও জরির পাগড়ি ছাড়া বাইরে বের হতেন না। তাছাড়া লুঙ্গির মত করে পেচিয়ে ধুতি ও হাতাওয়ালা গেঞ্জি নিয়মিত পরতেন।
জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মতে তিনি প্রায় ৫ লক্ষ ২৭ হাজার বিঘা জুড়ে জমির অধিকারী ছিলেন। সিলেট ও সুনামগঞ্জের উল্লেখযোগ্য পরগণা: (পরগণা= এখনকার তিন থেকে চারটি ইউনিয়নের সমান প্রায়) লক্ষণশ্রী (বর্তমান সুনামগঞ্জ শহর ও আসেপাশের কয়েকটি এলাকা) মহারাম, অচিন্তপুর, লাউড়, পাগলা, পলাশ, বেতাল, চামতলা, কৌড়িয়া, কুরুয়া ইত্যাদি পরগণা।
ইতিমধ্যে হাসন রাজার আধ্যাত্বিক জীবনে প্রদার্পন নিয়ে কিছু বিভ্রন্তিকর তথ্যের সমাগম হয়েছে। কিছু গবেষক একটু ভিন্নভাবে হাসন রাজার মরমী জীবনে প্রদার্পনের গল্প ছড়িয়ে দিচ্ছেন যা তার মরমী সাধনা, সহনশীলতা এবং দানশীলতার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি বলতে চাই হাসন রাজার গানেই তার আধ্যাতিকতায় পরিবর্তনের নিশানা পাওয়া যায়। যদিও বর্তমান কিছু নাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা তাকে নিয়ে একটা স্বস্তা কাহিনী নির্মান করেছেন বাণিজ্যিক সফলতা পাবার জন্য। আজকে আমি তাই হাসন রাজার আধ্যাত্বিক বিবর্তনের একটা তত্ত্ব প্রদান করতে চাই আপনাদের সম্মুখে।
হাসন রাজার বয়স যখন ৭ বছর ঠিক সে সময়, তাকে এই সংবাদ দেওয়া হয় যে, তাঁর ২২ বছর উর্দ্ধ বয়স্ক বড় ভাই দেওয়ান উবায়দুর রাজা বাবার সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র অধিকারী হতে যাচ্ছেন। এমন সংবাদে শিশু হাসনের অনুভূতিতে কিছু অস্পষ্ট জিজ্ঞাসার সূত্রপাত ঘটে। হাসন রাজার এই শিশুমনে তাই একটি প্রশ্নে অবতারণা হয়েছে যে, ‘বাবা আমাকে তার সম্পত্তি দেবেন না কেন, কেনই বা কম দেবেন? আমিতো ছোট। ’ এমনি অস্পষ্ট মন নিয়ে হাসন রাজা যখন কয়েক বছর অতিক্রম করে ১৪ বছর বয়সে পা দিলেন ঠিক তখনই তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। বড়ভাই ওবায়দুর রাজা এবং ঠিক ৪০ দিন পরপরই বাবা আলী রাজাও ইহলোক ত্যাগ করেন। হাসন রাজার জীবনের এই সন্ধিক্ষণে নিজেকে ক্ষুব এবং তিথিক্ষার সঙ্গে প্রশ্ন করলেন ৭ বছরের সেই সংবাদের প্রেক্ষাপটে বাবা আমাকে কোথায় ঠকালেন। কেনই বা বড় ভাই ওবায়দুর রাজা সমস্ত সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্ছিত হলেন। এত তাড়াতারি সমস্ত কিছুর অবসান ঘটলো কেন? সত্যিকার অর্থে তাৎক্ষণিক এই বিয়োগান্তিক ঘটনাই হাসন রাজাকে মরমী হয়ে উঠতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
আমরা বলি যে, হাসনের মরমী দর্শনের সূত্রপাত এখানেই ঘটে। এবং তার ঘষামাজা কয়েক বছর ব্যাপী প্রসারিত হয়। ১৮৯৮ সালে যখন অত্র এলাকায় ৭ দিন যাবত ভূমিকম্পনের এক লীলা খেলা হয়ে যায় ঐ সময় হাসন স্বচক্ষে দেখেছিলেন ধ্বংসের তান্ডবলীলা। চারদিকে মানুষ ও জন্তু জানোয়ারের ছুটাছুটি। মানুষের হাহাকার এবং ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তুপ। এরই মাঝে হাসন রাজার প্রিয় কতগুলো জানোয়ার আর মানুষের মৃত্যু তাকে ভীষণ ভাবে আঘাত করে। হাসন রাজা দেখেছেন নিমিষে জীবনের এই পাঞ্জর এবং আত্নার বিদায়। এই প্রেক্ষপটে তিনি লিখেছেন- ভৈষালের বৎসরে বন্ধে দরশন দিলরে,/ দয়া করিয়া আমার সঙ্গে কথাবার্তা কইলরে। / তুমি আমার, আমি তোমার বন্ধে যে বলিলরে,/ আমার দুঃখের কথা শুনিয়া বন্ধের দয়া হইলরে।
এতে করে দেখা যায় যে, হাসন রাজা প্রাত্যহিক জীবন ও চিন্তা চেতনার মধ্যে যথেষ্ট প্রাকৃতিক দুযের্াগের প্রভাব রয়েছে। এবং এই অনুধাবন থেকে জীবনবোধ এবং মানবতাবোধকে অতিকাছে থেকে তাঁর চেতনার মধ্যে জায়গা করে দিয়েছেন। যা তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে তা প্রতিফলিত।
স্হায়ী বা পাকাঘর হাসন রাজার পছন্দ ছিল না। তাই অস্হায়ী কাচাঘরে বা কুড়ে ঘরে নির্ভরতা ও স্বস্তির নি:শ্বাস তাঁর দর্শনের সাথে একটা মিল বন্ধন তৈরি করে দিয়েছে। তিনি দেখেছেন শূন্যের মাঝে প্রাসাদের কোন মূল্য নেই। আর গেয়ে উঠেছেন- কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার/ লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ী বালা না আমার।
এ পৃথিবী ছেড়ে যে চলে যেতে হবে সেই আভাস হাসন রাজা পূর্বেই পেয়েছিলেন। একজন দার্শনিক এবং জীবন সম্পর্কে সত্যিকারের সচেতন গবেষকই সাধারণত তার মৃত্যুর সময় সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। তাইতো হাসন গেয়েছেন- আমি যাইমু রে যাইমু আল্লার সঙ্গে/ হাসন রাজা আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।
গানের মতই চিরদিনের গন্তব্য অনন্ত মিলনের উদ্দেশ্যে হাসন রাজা এই জগৎ সংসার ত্যাগ করেন ১৩২৯ বাংলা সনের ২২ অগ্রাহায়ন (১৯ নভেম্বর ১৯২২)।
বর্তমানে হাসন রাজার প্রতি বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলের কৌতুহল উদ্দীপনার প্রেক্ষিতে অনেকেই হাসন রাজার পূর্ণ জীবনী লেখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। কেবল হাসন রাজার গানই নয় বা হাসন রাজাই নন। বাংলাদেশের যত লোকশিল্পী-সাহিত্যিক রয়েছেন সকলের সৃষ্টিকেই মূল্যয়ন, সম্মান এবং প্রদর্শনের সময় আমাদের এসেছে। কারণ এগুলো আমাদের মাটি ও মানুষের।
আহ্মেদ ফয়েজ
কবি ও প্রাবন্ধিক
মিরপুর-১, ঢাকা- ১২১৬।
মোবাইল: ০১৭২০৪৪৬২৬১
ই-মেইল: showpnopur@gmail.com