জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাতই মার্চের ভাষণে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন— “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তাঁর ঘোষণার পাটাতনে দাঁড়িয়েই বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছে। বঙ্গবন্ধু মুক্তির কথা বলেছিলেন; স্বাধীন রাষ্ট্রে সে মুক্তি কতোটুকু এসেছে— তা নিয়ে এখনও আলোচনা হয়, হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশ অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আজকের দিনে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীন দেশের জনগণকেও আন্দোলন করতে হয়েছে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এদেশে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ক্ষমতায় এসেছে, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক চিহ্নগুলো ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে। “বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন”— এই ধ্রুব সত্যকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছে, বিতর্ক তুলেছে মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে। বলাই বাহুল্য, একাত্তরের পরাজিত শক্তি প্রতিটি কাজ করেছে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে। মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েকটি প্রজন্ম বড়ো হয়েছে স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কিত মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে। এই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন আমাদের অগ্রজরা। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা যখন ক্ষমতায় এসে পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছে, সরকারি প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করেছে ভুল ইতিহাসের বিষ প্রজন্মের মগজে ঢুকিয়ে দেবার জন্য; তখন অগ্রজ লেখকদের পক্ষেও তার প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো। একদিকে ধর্মের মোড়ক পরানো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের বিপরীত পাকিস্তানি দর্শনের আধিপত্যবাদ— এ দুয়ের আগ্রাসনে কয়েকটি প্রজন্মের মগজে দ্বিধার দেয়াল তুলে দিতে পেরেছিলো তারা। এ দেয়াল আজও সম্পূর্ণ ধ্বসিয়ে দেয়া যায়নি। আজও সাম্প্রদায়িক বিষাক্রান্ত বহু প্রগতিশীল মানুষ আমরা চারপাশে দেখতে পাই। পরিস্থিতি এতোটাই জটিল যে, যেসব রাজনৈতিক-সামাজিক বা সাংস্কৃতিক শক্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাদপ্রতিম ভূমিকা পালন করেছিলো, তারাই যেনো আজ পথহারা। সময়ের বিবর্তনে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালন করা ব্যক্তিদেরও নির্মম আদর্শচ্যুতি আমরা দেখছি। গোটা সমাজ যেনো সাম্প্রদায়িকতার চোরাবালিতে আটকে আছে। তাকে টেনে তোলার সমস্ত শক্তি খরচ হয়ে যাচ্ছে, তার সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়াকে প্রতিহত করতে। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরও বাংলাদেশে আমরা এমন একটি শ্রেণির মুখোমুখি হয়েছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে যারা ভুল সুরে মানবতার গান গাওয়ার চেষ্টা করেছে, জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের যৌক্তিক দাবিকে তারা অযৌক্তিক ভাষায় সমালোচনা করেছে। এর পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণি সমাজে ক্রিয়াশীল, যারা পাঠ্যপুস্তকের নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। সরকারি মদদে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক উত্থানকে তারা দলদাসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। এই দুই শ্রেণি সমানভাবে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন বাস্তবায়নের পথে প্রবল বাধা। বুকপকেটে অসাম্প্রদায়িক দর্শন না থাকলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা যায় না— এ কথা আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনী পাঠ করলেই বুঝতে পারি। রাজনৈতিক কৌশল বঙ্গবন্ধুকেও অবলম্বন করতে হয়েছিলো নিশ্চিত, কিন্তু তিনি কোথাও আপোষ করেননি; তাহলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেতাম না।
এ কথা স্পষ্ট যে, দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে বাংলাদেশবিরোধী যে ষড়যন্ত্র করে আসছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, তা এখনও বিদ্যমান। বলা ভালো, প্রবলভাবে বিদ্যামান। স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতায়ন যেমন ঘটেছে, তেমনি বিপক্ষ শক্তিও ক্ষমতায় এসেছে। যাঁরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন, তাঁরা স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র রচনা করবেন— এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, তারা যদি স্বাধীন দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে— তবে এর চেয়ে আত্মঘাতী আর কিছুই হতে পারে না। এই আত্মঘাতী সময় বাংলাদেশ পার করে আসলেও রাজনীতির বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক নেতাদের জীবনী পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি, কী অসামান্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তাঁরা। আর আজকের যারা রাজনীতিবিদ রয়েছেন, তাদের অধিকাংশই সাবেক আমলা, সেনা-কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ি। তৃণমূল থেকে উঠে আসা বা তুখোড় ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের কণ্ঠস্বর-প্রতিম রাজনৈতিক নেতার সংখ্যা অল্প। ফলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যে রাজনৈতিক বৃত্ত দেশ স্বাধীন করেছিলো, জনগণকে বাদ দিয়ে আজ তা এক রাজনৈতিক উপবৃত্তে এসে ঠেকেছে। এর সঙ্গে এসে জুটেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অপশক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধেও আমাদের বিরোধীতা করেছিলো। সুতরাং ষড়যন্ত্র এখন ত্রিমুখী— এক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লেবাসধারী কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী, আদতে মনে ও মগজে যারা চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক; দুই, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, যারা এখনও রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল; তিন, আন্তর্জাতিক অপশক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর গণহত্যায় সমর্থন দিয়েছিলো এবং এখন নিজেদের অপরাধ ঢাকতে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে নানাবিধ বিভ্রান্তিকর বয়ান নির্মাণ করছে। এই তিন অপশক্তিকে মোকাবেলার জন্য আমাদের রাজপথের লড়াইয়ের মতোই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটিও অনিবার্য।
দুই
এ কথা ঠিক যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একটি বড়ো অংশ, যাঁরা মানবতা আর ন্যায়ের পক্ষে নিজেদের কাজ ও অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাঁরা আমাদের পক্ষে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ যে একটি সাম্য ও মানবিক মর্যাদার লড়াই ছিলো— এ কথা তাঁদের কাছে তুলে ধরতে পেরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম। তাঁদের কাজ, লেখা আর সৃষ্টি দিয়ে সারা পৃথিবীর কাছে তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন, তেইশ বছরে বাংলার মানুষের ওপর যে ভয়ানক নির্যাতন চলেছে, একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে যে নিকৃষ্টতম গণহত্যা চলেছে, তার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের সূর্যমুখী উদ্বোধন আসলে মানবিক লড়াই, মনুষ্যত্বের লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দীপ্র প্রতিবাদের লড়াই। এ কারণেই রবিশঙ্কর থেকে জর্জ হ্যারিসন, ইন্দিরা গান্ধী থেকে ব্রেজনেভ, সত্যেন বোস থেকে আন্দ্রেঁ মালরো বা ঋত্বিক ঘটক থেকে ইংমার বার্গম্যান পর্যন্ত সকলেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। গত ছেচল্লিশ বছরে বিশ্ব রাজনীতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, আমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে, সারা পৃথিবীতে আগ্রাসনবাদী রাজনীতির বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু আজও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস, মানবিকতার মিছিলে উজ্জ্বলতম ফেস্টুন। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের রাষ্ট্রযন্ত্র ও গোয়েন্দা সংস্থা যেসব ষড়যন্ত্র করছে, তা কেবল নিজেদের অপরাধ ঢাকতে তা-ই কেবল নয়; পৃথিবীব্যাপি মুক্তিকামী মানুষকে বিভ্রান্ত করাও তাদের একটি লক্ষ্য। ২০১১ সালে প্রকাশিত শর্মিলা বোসের ডেড রেকনিং ১৯৭১ বা সম্প্রতি প্রকাশিত জুনায়েদ আহমেদের ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ: মিথ এক্সপ্লোডেড ইত্যাদি বইসহ অন্তর্জালে ছড়িয়ে থাকা নানা ধরনের প্রবন্ধে-নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এসব বইপত্রের বয়ান পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বা তার এজেন্টদের বয়ানের সঙ্গে হুবুহু মিলে যাচ্ছে। এরকম কিছু বই ও লেখা পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এদের তথ্যসূত্রগুলোও মোটামুটি একই। সেসব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ তথ্যসূত্রই পাকিস্তানি ডিফেন্স আর্কাইভ ও সিআইএ’র কিছু ভাষ্য (সেগুলোর আবার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র নেই) এবং কিছু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার (যে ব্যক্তিবর্গ স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন বা এখন স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের রাজনীতিতে যুক্ত)। তার অর্থ দাঁড়ায়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করার জন্য এইসব অপশক্তি একটি নির্দিষ্ট তথ্য-ভল্ট পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহার করে। অথচ, আমাদের অগ্রজরা মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস নিয়ে নানা ধরনের কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন। আমরা তার সন্ধান করছি কতোটুকু?
মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের প্রেক্ষিতে বর্তমান সময়টি সুস্পষ্টভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের সময়। মুক্তিযুদ্ধের দর্শন নিয়ে আমাদের কাজ করার সময়। গবেষণা ও সৃষ্টিশীল নানা মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসটি তুলে ধরার সময় এবং তা যতোটা বাংলা ভাষায়, ততোটাই অন্যান্য ভাষায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ হচ্ছে। ইউটিউবের কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটো ছোটো প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা সম্ভব, যা সুনির্দিষ্টভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিভিন্ন বিকৃতির জবাব তুলে ধরবে।
মুক্তিযুদ্ধের দর্শন কেবল যে বাংলার মানুষকে প্রাণিত করেছিলো, তা-ই নয়; তৎকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সে দর্শন একটি অনন্য অসাম্প্রদায়িক দর্শন, যা আজও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে মুক্তির স্বপ্নে আলো যুগিয়ে যাচ্ছে। যে কোনো অপশক্তিকে মোকাবেলায় এর চেয়ে বড়ো অবলম্বন আমাদের কী হতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের দর্শন নিয়ে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটি শাণিত হলেই সেটি জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি স্বচ্ছ পথ নির্মাণ করবে। বাংলাদেশের রাজনীতি ফিরে আসবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অক্ষে।