ওয়ানগালা আয় ফিরে আয়

সুদর্শন মানখিন

‘মেঘ দেখে তুই করিসনে ভয়
আড়ালে তার সূর্য হাসে।’

একুশ শতকের বুকে দাঁড়িয়ে আদিবাসী গারোদের উৎসব ওয়ানগালার ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের সকল ভাবনা যেন সঙ্কটের অলিগলিতে আটকা পড়ে আছে। প্রতারক সময় আর ক্ষমতার বলয় আমাদের মুল্যবোধকে বহুলাংশে বিনষ্ট করে ফেলেছে। আমাদের আদিবাসী মন-মানসিকতা, যুক্তিবোধ, আশা-আকাঙ্ক্ষাসমূহ খুব সহজেই হতাশায় পরিণত হয়। স্বপ্নময় সম্ভাবনার কথাগুলো ভুলে গিয়ে মনে জাগে ভয়-ভীতি। এই ভয়েরা আমাদের খুব সহজেই বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়। আদিবাসী হলেও গারোরা মানুষ। আর দশজন মানুষের মতোই সঙ্কট মোকাবিলা করেই ভবিষ্যতের পথচারীক্রমায় হাঁটিহাঁটি পা-পা করে এগিয়ে চলেছি।
ওয়ানগালা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই একদল আদিম মানুষ, যারা কৃতজ্ঞ চিত্তে তাদের কষ্টার্জিত ফসলের একটি অংশ সারিবদ্ধ হয়ে লাইন ধরে উৎসর্গ করছে – এই ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

দেওয়ান সিং রংমথু The Garo নামক বইয়ে গারোদের ওয়ানগালা উৎসব সম্পর্কে বলেছেন যে, প্রাচীনকালে গারোদের পূর্বপুরুষের নাম – আঃনি আফিলফা, গভীর জঙ্গলে বনের আলু স্থেং, আমপেং, থাজং খুঁজে না পেয়ে হতাশায় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মন নিয়ে একটি গাছের ছায়ায় বসে-বসে ঝিমুচ্ছিলেন। এমন সময় মিদ্ধি মিসি সালজং আঃনি আফিলফাকে দর্শন দেন এবং আঃনি আফিলফার দুঃখের কথা জানতে চান। আঃনি আফিলফা মিদ্ধি মিসি সালজংকে তার দুঃখের কাহিনী বলেন, এই গভীর জঙ্গলের প্রায় সমস্ত এলাকা তন্নতন্ন করে স্থেং, আমপেং, থাজং’ খুঁজে না পাওয়ার কাহিনী শোনালে মিদ্ধি মিসি সালজং আঃনি আফিলফার দুঃখে দুঃখিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, সে ধান চাষ করে কি-না।
উত্তরে আঃনি আফিলফা বলেন, সে ধানের বীজ দেখে নি। মিদ্ধি সালজং তৎক্ষণাৎ করুণাবশত তাকে কিছু ধানের বীজ দিয়ে ধানের চাষাবাদ পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। ধানের বীজ দেয়ার সময় মিদ্ধি মিসি সালজং একটি শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন আঃনি আফিলফাকে। সে যেন ধান উৎপাদনের পর নতুন ধানের কিছু অংশ তাকে স্মরণ করার জন্য উৎসর্গ করেন। আঃনি আফিলফা মিদ্ধি মিসি সালজংকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ ও ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। একটি চ্যাপ্টা পাথরের ওপরে নতুন ধানের কিছু অংশ দিয়ে মিদ্ধি মিসি সালজংকে উদ্দেশ্য করে ধন্যবাদের অনুষ্ঠান করেছিলেন। আঃনি আফিলফার এই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার অনুষ্ঠানকেই ওয়ানগালা উৎসব বলা হয়।
ওয়ানগালা উৎসব সাধারণত আশ্বিন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরম্ভ হয়। ওয়ানগালা উৎসবের মূল ভাবধারা হচ্ছে মিদ্ধিকে সন্তুষ্ট করা। ওয়ানগালার সময় গারোরা তাদের উৎপাদিত ধান, ভুট্টা, কাউন, আদা, হলুদ, মরিচ, বাঙ্গি, শশা, কুমড়া, পঞ্চমুখী কচু ইত্যাদি ফসলের একটি অংশ মিদ্ধির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে থাকে। ওয়ানগালা অনুষ্ঠান না করে অর্থাৎ মিদ্ধিকে উৎসর্গ করার পূর্বে গারোরা উৎপাদিত ফসল নিজেরা ভোগ করে না, অন্যকে বিলায় না, এমনকি বিক্রিও করে না। কারণ গারোরা বিশ্বাস করে যে, সমস্ত ফসলের মালিক হচ্ছেন বিধাতা মিদ্ধি। সুতরাং মালিক মিদ্ধিকে না দিয়ে নিজেরা আগে ভোগ করলে বা ব্যবহার করলে মহা অন্যায় ও ঘোর পাপ কাজ করা হয় বলে তারা বিশ্বাস করে। মিদ্ধির বিরুদ্ধে পাপ করলে মিদ্ধি ক্রুদ্ধ হন ও অন্যায়কারীর নিজের ও পরিবারের জানমালের ক্ষতি করে থাকেন। পরিবারের যেন কোনোরূপ ক্ষতি না হয়, অনিষ্ট না হয়, বরং পরিবারে যেন সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি বিরাজ করে – এই বিশ্বাসে গারোরা ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে।

বর্তমানে আধুনিক খ্রিষ্টান গারোদের কাছে মিদ্ধির গুরুত্ব না থাকার কারণেই পূর্বের মতো আর ওয়ানগালা অনুষ্ঠান করা হয় না। ওয়ানগালা অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে অনেক বাধা-বিপত্তি, বিধি-নিষেধ রয়েছে মণ্ডলীর দিক থেকে। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আমরা কেউ-কেউ ওয়ানগালা উৎসব পালন করছি, নিজেদের মতো করে, ঘরোয়াভাবে। ওয়ানগালা উৎসব গারোদের বড় উৎসবে পরিণত করার জন্য সকল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা আজ বড় প্রয়োজন।