আমি করবী। রবীন্দ্রনাথের রক্ত করবী নয়। নই আমি শ্বেত কররী। আমি শুধু কররী। আমার প্রিয় মানুষটার কাছে আমি শুধু কররী। মুখোমুখি নয়, কানে কানে নয়। দূরাপলাপনীতে নয়, মুঠোফোনে নয়, ‘শুধু করব’ শুধু চিঠিতে। ইলেট্রনিক মেইল নয়, ফেইসবুকে নয়, হাতে লেখা চিঠিতে।
‘এ সব নাম বীজমন্ত্রের মতো, কারো কাছে ফাঁস করতে নেই। এ রইলো আমার মুখে আর তোমার কানে।’ রবি ঠাকুরের অমিতের মতো আমার কাছে এ নামটি ছিলো বীজমন্ত্রের মতো। কিন্তু এখন লাবণ্যর মতো আর ভয় পাচ্ছি না যে, এক কানের ধন পাঁচ কানে পাছে সস্তা হয়ে যায়। আবেগ অনুভূতি যখন ক্রমেই শিথীল হয়ে আসছে, হাতে লেখা চিঠির আবেদন যখন ফুরিয়ে আসছে, তখন অনেক যত্নের এ নাম বর্তমান যান্ত্রিক পৃথিবীর কঠিন আকাশে মৃদু আঘাত হেনে রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টির মতো কিছু আবেগের বৃষ্টি ঝরাতে পারবে বলে ক্ষীণ আশা করছি – তাগিদ অনুভব করছি।
আমার একটা টিনের বাক্স আছে. স্কুলজীবন থেকে। এখনও আছে। খুব যে যত্নে রেখেছি তা নয়। ঘরের এককোনে পরে আছে। তবে বাক্সের ভিতরে যা আছে তা অনেক যত্নে রেখেছি। বাঙালী মহিলারা যেমন সোনার গহনা. পুরুষ যেমন বাড়ির দলিল, গাড়ির দলিল যত্নে রাখে- আমি তেমনই যত্নে রেখেছি আমার সে মুল্যবান সম্পদ। আমাকে লেখা আমার প্রিয় মানুষটার চিঠি। অনেক অনেক চিঠি। দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠি। কী সুন্দর সে চিঠি। সুন্দর হাতের লেখায় কাব্যিক ছন্দে লেখা সে চিঠি। কখনো আবেগ, কখনো আকাঙ্ক্ষা কখনো ব্যক্তিগত কথা, কখনো পরিবারের কথা, কখনো শিল্প-সাহিত্যের কথা, কখনো সমাজের কথা, কখনো নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা। সব কিছুতে ভালোবাসার স্পর্শ। প্রাণের কথা, কাব্যিক ছন্দে অপরূপ সুন্দর হাতের লেখায়, এমনকি বৈচিত্রে ভরা কারুকার্যে। আমি সত্যিই অহংকারী আমার এ সম্পদে। আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনেকরি এত সুন্দর চিঠিগুলোর অধিকারী হতে পেরে। এ চিঠিগুলো সাহিত্যের দাবী রাখে বলেই আমি মনে করি। তাই এ চিঠিগুলো ব্যক্তিগত সীমা ছাড়িয়ে হাতে লেখা চিঠির বিলুপ্ত ঘোষণার বাধা সৃষ্টিতে কিছুটা আবেদন রাখতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।
”একদিন একটি বাজপাখীকে খুব কাছাকাছি দেখে বিস্ময়ে দুজনা দুজনার চোখে চোখ রেখেছিলাম আলগোছে সেই অবেলায় একলা ঘরের গোপন কপাটটি খুলে গেল বলে মনেহল বেলাজে শিহরিত নিকুঞ্জে তোমাকে আবিষ্কার করতে দেরী হয়নি বলে বড় বেশী ভালবেসেছিলাম তোমায় তবুও একদিন সব কিছু বলা হবে বলে অপেক্ষা করছি আমি তুমি অলিখিত সন্ধিতে।”
হাতে লেখা চিঠিগুলোর মধ্যে প্রথম দিকের চিঠি এটি—আমি এ চিঠিটিকে ভালোবাসার প্রথম চিঠি হিসেবে বিবেচনা করি: অলিখিত সন্ধির লিখিত প্রস্তাব। সব কথা কি বলা যায় ! বলা হয় ! সব বলে ফেলে কি শেষ করা যায়! তবুও অনেক অনেক কথা বলা হয়েছে চিঠি বিনিময়ে। চিঠি বিনিময়ে জীবনে সন্ধি হয়েছে। যদি মুখোমুখি বলা হতো, যদি দূরালাপনীতে বলা হতো, যদি মুঠোফোনে সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রেরণ প্রক্রিয়ায় বলা হতো, যদি ই-মেইলে বলা হতো, যদি ফেইসবুকে বলা হতো – রচিত হতো না আমার সম্পাদ। স্মৃতি রোমন্থন তীব্র হতো না। স্পর্শ করা যেতো না আমার সে স্মৃতি । দেখা হতো না সুন্দর মুখের মতো সুন্দর হাতের অক্ষর। আমার ভালোবাসার সম্পদে আমার স্মৃতিরোমন্থন আবেগ স্পর্শ পেতো না। হলুদ খামগুলি পুনরায় খুলে কাগজের খস খস শব্দে আমার ভালোবাসা ফিরে ফিরে আসতো না। হাতে লেখা চিঠি, হলুদ খাম, ডাক পিওন, ডাক-বাক্স, ডাক-ঘর, সংরক্ষিত কালো রংয়ের টিনের বাক্স – বড় রোমান্টিক মনে হয় শব্দগুলি, বিষয়গুলি। রাত জেগে মনের আবেগ, ভালোবাসা নিজের সুন্দর হাতের লেখায় কাগজে পূর্ণ করে, হলুদ খামে পুরে, ডাক-বাক্সে ফেলে দিতো আমার প্রিয় মানুষটি—সে চিঠি পৌচ্ছে দিয়ে যেতো আমার ডাক-পিওন। আমি অপেক্ষার প্রহর গুনতাম। সর্বদা মধ্যাহ্ন-বেলায় তিনি চিঠি নিয়ে আসতেন।আজও মনে আছে সেই ডাক-পিওনের কথা। আমার জীবনের সব থেকে রোমান্টিক সময়ে অধিকাংশ চিঠি যার হাত থেকে আমি পেয়েছিলাম। শীর্ন চেহাড়া, কোকড়ানো চুল, মেয়েলী কন্ঠস্বরের লোকটি অত্যন্তু দায়িত্ব নিয়ে ‘চিঠি’ বলে ডাক দিয়ে আমার হাতে পৌঁছে দিত সে চিঠি। লোকটি বুঝতে পেরেছিল কী ভালোবাসা আমার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। তাই কখনো আমার সে চিঠি বেহাত হতে দিতেন না। সর্বদাই আমার হাতে পৌছে দিতেন। আমি কিন্তু সুকান্তের রানারকে খুঁজে পেয়েছিলাম আমার সেই ডাক-পিয়নের মাঝে। আজ যখন আমাদের ভালোবাসার চিঠিগুলিতে আমার মমতার হাত রাখি খুব বেশী মনে পড়ে সেই সাধারণ ডাক-পিওনের কথা, তার কঠিন দায়িত্ব পালনের কথা। একটি যুবতীর ভালোবাসার প্রতি তার সহযোগিতার কথা, তার মমতার কথা। তিনি শুধু চিঠি বলেই ডাক ছাড়তেন, কখনো তার সঙ্গে আমার বাক্য বিনিময় হয় নি। তিনি আমার নামটি জানতেন। খামের উপরে অপরূপ সুন্দর হাতের লেখায় আমার নামটি লেখা থাকতো ‘করবী’। আমার ডাক-পিওনের নামটি আমার জানা হলো না।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক নাতীকে লিখেছিলেন, ‘তুমি পড় আর নাই পড় আমি লিখিয়া আনন্দ লাভ করিলাম। এ যেন আমিই আমাকে চিঠি লিখিলাম এবং পড়িয়া সম্পূর্ণ পরিতোষ প্রাপ্তি হইলাম।’ সত্যিই তাই। শুধু চিঠি প্রাপ্তি নয়। চিঠি লেখাতেও সমান আনন্দ। আমিও লিখেছি অনেক, প্রাণ ভরে লিখেছি। মুখে বলা কথার থেকে ঠের বেশী সুন্দর করে বলতে পারতাম চিঠিতে। আমার প্রিয় মানুষটা ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে আমি জীবন বেঁধেছি। এখন আমার আবেগের হাত যখন স্পর্শ করে তার চিঠিগুলিতে তখন সেও মুগ্ধ চোখে তা অবলোকন করে। তার চোখে, মুখোমন্ডলে আমি পরিতৃপ্তির আবেগ দেখতে পাই। যেন সে শিল্পীর হাতে শিল্প তৈরী করতে পেরেছিল।
ই-মেইল এসেছে আমাদের দুয়ারে অনেক সুবিধা নিয়ে। ই-মেইল সুবিধায় যোগাযোগ বেড়েছে অনেকগুণ। ই-মেইল যোগাযোগে তেমন কোন ঝঁক্কি-ঝামেলা নেই বললেই চলে। ই-মেইলে গোপনীয়তা রক্ষা পায় শতভাগ। ই-মেইল প্রাপ্তিতে নিশ্চয়তাও প্রায় শতভাগ। ই-মেইলেও প্রাণ ভরে লেখা যায়। ই-মেইল পড়তেও সমান আনন্দ অনুভূত হয়। রোমান্টিকতা সেখানেও বিরাজমান। পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। ই-মেইলের বিদ্যুৎগতি এর সর্বাধিক উৎকৃষ্ট সুবিধা। হাতে লেখা চিঠির গতি খুব ধীর। অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয়। কখনো কখনো ভালোবাসার চিঠি হারিয়ে যায়। এই ব্যস্ত পৃথিবীতে হাতে লিখে চিঠি খামে পুড়ে ঠিকানা লিখে, ডাকঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে যে চিঠি, সে চিঠি পৌঁছে দিয়ে আসবে ডাক-হরকরা, এমন সময়ের অপব্যবহার আর কে করতে চায় – ই-মেইল সুবিধায়। রোম্য লেখকরা নিশ্চয়ই লিখতো রাগে, দু:খে, অপমানে কুঁচি কুঁচি করে চিঠি ছিড়ে ফেলায় যে স্বস্তি পাওয়া যায়, তা কী ই-মেইল ডিলিট করে পাওয়া যায় ! হাতে লেখা চিঠির কাটাকুটিতে যে অব্যক্ত, আরও বেশী না বলা কথা, বিমূর্ত ছবি আঁকা রয়ে যায়—তা কী ইমেইলের ভালোবাসার চিঠিতে পাওয়া যায়!
জীবনের বিদ্যুৎ-গতিই কী আনন্দ ! সব প্রাপ্তির আনন্দে কী হতাশা ছায়া ফেলে না ! আবারও অমিতের মতোই বলতে হয়, “ইচ্ছাকৃত বাধা দিয়েই কবি ছন্দের সৃষ্টি করে। মিলনকেও সুন্দর করতে হয় ইচ্ছাকৃত বাঁধায়। চাইলেই পাওয়া যায়, দামী জিনিসকে এতো সস্তা করা নিজেকেই ঠকানো। কেননা শক্ত করে দাম দেয়ার আনন্দ বড় কম নয়।” হাতের স্পর্শে শিল্পী যে শিল্প সৃষ্টি করে তার সৌন্দর্য, একটি ভিন্ন মাত্রার আবেদন লালন করতে পারার মধ্যেই যেন জীবনের আবেগ উপলব্ধি করা যায়। ফটোগ্রাফি এবং শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মধ্যে যে পার্থক্য ই-মেইল এবং হাতে লেখা চিঠির পার্থক্য খানিকটা সেরকমই মনে হয়। আবেগহীন জীবন সব প্রাপ্তির আনন্দে দিশাহারা হয়ে কখনো কখনো ভেঙে চুড়মার হয়ে যায়। অথবা কিছুই না পাওয়ার হতাশায় মরে যায়। হাতের স্পর্শের মাঝে আমরা পাই অপরূপ সৌন্দর্য, ভালোবাসা, আবেগ, স্নেহ, মমতা, আকাংখা এমনকি শৃংখলা, স্থীরতা। জীবন যে নদী সে নদী সব সময়েই যদি শুধু উত্তাল বেগে চলতে থাকে, তবে ভেঙে পড়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। কাগজের ফুলের মতো গন্ধহীন হয়ে থাকে। জীবনের কোন এ্যারোমা থাকে না। রোমান্টিকতার অবসর মেলে না। জীবন হয়ে পড়ে যান্ত্রিক। মলিন হয়ে যায় জীবন। জীবন আমারও মলিন প্রায়। হাতে লেখা চিঠি আর আসে না। চিঠির ভূবনটা বিলুপ্ত প্রায়, কথামালাও যেন স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। তবুও আমার প্রাণটা যেন একটু কেঁদে কেঁদে ওঠে চিঠির জন্য – তাই তো কান পাতি গানে ;
‘প্রিয়ার প্রেমের লিপি লেখনি তরে, হে বলাকা
সুদূর দিগন্ত হতে ফেলে দাও একখানা সাদা ঝড়া পাথা।”