আমার বঙ্গবন্ধু

করবী মালাকার

একদিন এক আড্ডায় আমার একজন শ্রদ্ধেয় দাদা খুব আবেগী হয়ে বলছিলেন – বঙ্গবন্ধুর কথা বললে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। আমি ফোড়ন কেটে বললাম, যখন জাসদ করতেন তখন তো বঙ্গবন্ধুকে এমন মহৎ নেতা ভাবতেন না। দাদা উত্তরে বললেন; -‘তখন আমাদের যেভাবে শেখানো হয়েছে। এখন তো উপলব্ধি করতে পারছি বঙ্গবন্ধু কত বড় নেতা ছিলেন।’ এবার আমি খুব গর্ব করে বললাম – আমি ছোট বেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। এবার দাদার বোন যে আমার বান্ধবীও বটে ফোড়ন কাটল;- ‘তাহলে তুই তো ছোট বেলা থেকে না বুঝেই বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়েছিস। নিশ্চয় তোর মা বাবার প্রভাবে। এটা  বঙ্গবন্ধুর প্রতি তোর উপলব্ধি নয়।’আমি তার যুক্তিতে একটু লজ্জা পেলাম।

বিষয়টি নিয়ে আমি এরপর থেকে ভাবতে শুরু করেছি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার এই যে আকর্ষণ এ কি কেবলই আমার বাবা মায়ের প্রভাব? এটা ঠিক আমার বাবা মা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। কিন্তু আমার শিশুকালে তারা তো তাঁর বিষয়ে আমাকে গল্প শোনাতেন না। কেননা  বাবা মায়েরা তখনও বঙ্গবন্ধু নিয়ে তাদের সন্তানদের গল্প বলা শুরু করেন নি। তবে তিনি তখনও অবিসংবাদিত নেতা। মুক্তিকামী জনতার এক মহান নেতা। তাঁর বজ্রকন্ঠ, উদাত্ত আহ্বান, বলিষ্ঠ নির্দেশনা তখন পূর্ব বাংলাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাঁর দীর্ঘ দেহ, সুদর্শন পৌরুষ্য, বজ্রকন্ঠ তখন প্রতিটি দেশপ্রেমী বাঙালীর হৃদয়ে।  নিশ্চয় আমার শিশু মনেও তার প্রভাব পড়েছিল।

১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার পরে প্রথম যে ভোট হয়েছিল তাতে মুসলিমলীগেরও প্রাথী  ছিল । আমাদের পাড়ার একজন আমার বাবাকে এসে বলতে লাগলেন মুসলিমলীগেও অনেক ভোট পড়ছে। অন্য রকম কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। আমি তখন বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি বলে উঠেছিলাম – না না  নৌকাই জিতবে। যখন ভোটে নৌকা জয়যুক্ত হলো তখন বাবা হেসে হেসে বললেন;- ‘আমার মেয়ের মুখ রক্ষা হয়েছে।’ আমার বয়স তখন ৯। তবু আমার স্মৃতিতে সে ঘটনাটা যথেষ্ট স্পষ্ট । তখন নৌকা মানে তো আসলে বঙ্গবন্ধু। এই যে তখন আমার ছোট হৃদয়ে এত দৃঢ়তা তা কি কেবল আমার বাবা মায়ের প্রভাব? নাকি তখন বাংলার আকাশে, বাতাসে, জলে স্থলে, মিছিলে মিটিংয়ে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনি আমার শিশু মনে প্রভাব পড়েছিল।

বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন আমাদের শহরে। শহর জুড়ে সেকি উন্মাদনা। কি সাজ সাজ রব। সর্ব স্তরের মানুষের প্রস্তুতি চলছে সমাবেশে যোগদানের জন্য। আমার শিক্ষিকা মাও গেলেন আমার থেকে এক বছরের বড় ভাইকে নিয়ে। আমাকে বললেন, ‘অনেক ভীড় হবে তোমাকে নেব না।’ সমাবেশ শেষে মা ঘরে এসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার ভাইয়ের অমনোযোগিতায় বিরক্ত হয়ে আমাকে বললেন;  ‘তুমি বঙ্গবন্ধুকে এত ভালবাস তোমাকেই নেয়া উচিৎ ছিল।’ আমার জীবনে আর কোনদিন সুযোগ হল না বঙ্গবন্ধুকে দেখার। আমৃত্যু আমার আফসোস থাকবে–কেন মা আমাকে সেদিন নিয়ে গেলেন না। 

আমার জন্ম, শৈশব, যৌবন কেটেছে বরিশাল শহরে। তখন আমাদের পরিবারগুলোতে নিত্য দিন বাজার হত। আমাদের মত পরিবারগুলোর ফ্রিজ কেনার সামর্থ্য ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। এমনকি অতিথি আপ্যায়নেও বিস্কুট, চানাচুরের স্টক থাকত না।অতিথি এলে আমাদের পাঠান হতো দোকানে। আমার পরিবারের এই কাজ এবং অন্যান্য প্রয়োজনে আমাকেই দোকানে যেতে হতো। আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট খুব সকালে দিয়াশলাই কেনার জন্য আমি দোকানে গিয়েছিলাম। দোকান থেকে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরে মাকে বলেছিলাম; ‘মা দোকানে সবাই বলছে বঙ্গবন্ধুকে নাকি হত্যা করা হয়েছে।’ বাবা সেদিন তার পেশাগত কাজে অন্য শহরে ছিল। এই যে আমার কিশোর হৃদয় বঙ্গবন্ধুর জন্য কেঁদে উঠেছিল; সে কি কেবল আমার বাবা মায়ের প্রভাব?! না, এ ছিল কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধুর প্রভাব। 

বড় বেলায় বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে যে উপলদ্ধি এসেছে তা অন্যান্য সকলের মতই;– যারা বঙ্গবন্ধুকে একজন মহান নেতা মনেকরে। তাই আমার বড় বেলায় বঙ্গবন্ধুকে যতটুকু জেনেছি — সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাচ্ছি না। কেননা সে ক্ষেত্রে আমার জ্ঞানের সীমা খুব সীমিত। আমার সাধ্য কি বঙ্গবন্ধুকে বিশ্লেষণ করার। আমার আকাঙ্খা বঙ্গবন্ধুকে দেখব নান্দনিকতায়, শিল্পীর বর্ণনায়। আমি মনেকরি নান্দনিকতা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনী এখনো লেখা হয়নি। কিছু কবিতা লেখা হয়েছে কেবল। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমারঅনুভূতি ব্যক্ত  করার ক্ষেত্রে কোন বইয়ের সাহায্যও নিতে পারছি না।

আমাদের জীবনে বিজ্ঞানকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না; তেমন রাজনীতিকেও নয়। তবু আমি রাজনীতি বিমুখ মানুষ। অনেক ভাল মানুষের রাজনীতিতে আসা আমি মেনে নিতে পারি না। কেননা রাজনীতিতে অনেক নেতিবাচক কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। নিজ দেশের কদর্য রাজনীতি পর্যবেক্ষনে মন তো বিষিয়ে আছেই। কিন্তু  আমার মনে হয় আমি যদি বঙ্গবন্ধুর সমযের হতাম তবে আমি রাজনীতিতে সক্রিয় না হয়ে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর সুদর্শন পৌরুষ্য, ব্যক্তিত্ব, সমুদ্রের মত কন্ঠ, জনগণ-দেশ-রাজনীতির প্রতি আকাশ সমান আবেগ, স্বাধীনতার উদত্ত আহ্বান,৭ই মার্চের অর্কেস্ট্রা  উপেক্ষা করে রাজনীতি বিমুখ থাকা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ত। সে রকম যখন হয়নি তখন আমার বড় বেলার বিশ্লেষণে নয়, আমি আমার ছেলেবেলার অনুভূতিতেই বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করে আছি আমার হৃদয়ে। তবে এই বড়বেলায় যা আমাকে হতবাক করে তা হচ্ছে;– বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ থাকার পরেও অক্ষর জ্ঞানহীন প্রান্তিক জনগণ বঙ্গবন্ধুকে একজন মহান নেতা হিসেবেই শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। কিন্তু আমি ভেবে পাইনা বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষিত, তথাকথিত সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষ বঙ্গবন্ধুর মত একজন মহান নেতাকে মর্যাদা দিতে শেখেন নি এখনও !

আমি বঙ্গবন্ধুকে আমার ছেলেবেলার অনুভূতি দিয়েই ভালবাসি । আর আমার বড় বেলার বিশ্লেষণ দিয়ে শ্রদ্ধা করি এবং জাতির পিতার মর্যাদা দেই।