১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে লাকসামের ভুলুয়া খাঁ বাড়ি থেকে সিতারাকে পাক মিলিটারিরা জোরজবস্তি ধরে নিয়ে যায়। ওকে যখন টেনে হিচঁড়ে পিচ করা রাস্তায় দাঁড়ানো জিপে তোলা হয় তখনও লাকসামের লালমাই পাড়ার তার লালচে ঋজু সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আঠরালতা, স্বর্ণলতা আকুরি বিকুরি থাক্ থাক্ শুয়ে থাকে পাহাড়ের পা জড়িয়ে। সবুজ টিয়ার ঝাঁক পাকা বেত ফল খাওয়ার লোভে লাল অভ্যেশি ঠোটের কুজনে ব্যস্ত থাকে তখনও। সিতারার চোখের আওতায় একটু আগে বৃষ্টি হয়ে যাওয়া নমনীয় নীল আসমান। তবে এই সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও গুরুত্ব হারায় ওর কাছে। মুহূর্তে রোজ কেয়ামত নেমে আসে। সিতারার ভুবনে।
বাড়ির উঠানে বাবা, মাসহ আরো ৫/৬ জনের রক্তাক্ত লাশ। কোন রকম প্রতিবাদ করার আগেই নিরীহ মানুষগুলো হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে যায়। স্কুল ফেরত আট বছরের ছোট ভাইটা হতবাক হয়ে বোনকে টেনে নেয়ার দৃশ্য দেখে বগলদাবা করা বইপত্র ক্ষেতের আলে ফেলে দিয়ে দৌড়ে আসে-আন্নেরা আঁর বইনডারে কনে লয়া যান? ওর প্রশ্নের জবাবে আরেকটা গুলি খরচ হয়। সিতারার মাথাটা তখন থেকেই বিগড়ে যেতে শুরু করে।
হানাদার ক্যাম্পে বন্দি হওয়ার ঘন্টাকয়েক পর সিতারার সমস্ত সৌন্দর্য পাট পাট খুলে যেতে থাকে। তার সংরক্ষিত সযতন যৌবন আর সুরেলা রূপ আছড়ে পড়ে বন্ধ ঘরটার লম্বা বিছানায়। শ্লিলতাহানির চেষ্টায় এগিয়ে আসা পশুটা সম্ভবত অফিসার র্যাংকের কেউ ছিল। সিতারার আর্ত চিৎকারে বাঁধা দিয়ে— ডরাও মাত্ হাম তুমসে শাদী করলিয়েঙ্গে— বলতে বলতে সিতারার উপর হামলে পড়ে। সিতারা তীব্র প্রতিবাদ জানায়– মোঘল শাহ্জাদীদের শাদীর রিওয়াজ নাই, সে অপারগ। লোকটা পুরোপুরি জানোয়ার বনে যায়। সিতারার কারুকাজময় ঠোঁটে কামড় বসাতে বসাতে ঘষ্টানো স্বরে বলে;– ঠিক্ হ্যায়, শাদী জরুরাত নেতী তো নেহী, লেকিন তুমহারি যুয়ানী মুঝে বহুত পসন্দ। এরপর সিতারার একটানা সাতমাসের নরক বাস। রাতের অন্ধকারে কখনো দিনের ফর্সা আলোয় হায়েনাগুলোর কুৎসিত অকথ্য নির্যাতন।
লাকসামের ভুলুয়া খাঁ বাড়ি বিভিন্ন কারণে উল্লেখযোগ্য। বহু পুরুষ ধরে এ গ্রামে আছে এরা। এদের পূর্বপুরুষ রহমান খাঁ ছিলেন ভুলুয়ার একজন গুণী কারুশিল্পী। আর কী শুধু এ গায়ে! খোদ জাহাঙ্গীর নগরের বড় মস্জিদের প্রবাদ্য চাতালে পোড়ামাটির নকশা করে এসেছেন তিনি। পাথর খুদাই কাজেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত পটু আর দক্ষ। তার ছেলে মোবারক বে-তমিজের জন্য শাহ্সুজার হাতে প্রাণ হারায়। এতেই কী পার পেয়েছিল পরিবারটি?
রহমত খাঁ’র পুত্রবধূ মোবারকের স্ত্রী সবেরার রূপের দিকেও নজর পরে খোদ নিন্দুস্হানের বাদশহ্র মনোনীত বাংলার সুবেদার সুলতান শাহ্সুজার। শাহ্সুজা ভুলুয়ার খাঁ বাড়িতে সবেরার রূপের টানে বার বার ফিরে এসেছে। তবে মোবারকের মৃত্যুর পর রহমত খাঁ সবাইকে জানাতে ভুল করে না যে সবেরা সন্তান সম্ভব। আর সে সন্তানের জনক তার মৃত পুত্র মোবারক। এছাড়া কারিগরের আর কী-ই বা করার ছিল! বিধনা হয়েও সবেরা তার পিত্রালয়ে ফিরে যায়নি। খাঁ বাড়িতেই তার প্রথম পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। জনান্তিকে এটাই প্রচরিত যে সবেরার ঔরসজাত পুত্রের উত্তরসূরিরাই ভুলুয়ার খা বাড়ির বর্তমান বংশধর। এই গল্প গাঁথা অবশ্য ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি। কিংবা এটা শ্রেফ গল্পই ছিল কী না কে জানে! খা বাড়ির পুরনো ভিটে হেঁজে যাওয়া দিঘীর শ্যাওলা পরা ঘাট বা সারি সারি বৃক্ষ রাজির গা থেকে কবে মরে গেছে এইসব হিজিবিজি ইতিহাস।
সিতারার বাবা শাহ নেওয়াজ খাঁ লাকসাম হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। কন্যাকে তিনি মেট্রিক, ইন্টার পাশ করিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান। যদিও গ্রামবাসীরা সাবালিকা হওয়ার পর সিতারাকে বোরখা ছাড়া কখনো বেরুতে দেখেনি। এমন কী ইউনিভার্সিটিতেও তার অনিন্দ সুন্দর অবয়ব নেকাবে ঢাকা থাকতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিতারা ‘ইতিহাস’ নিয়ে ভর্তি হয়। তখন সে কবিতাও লিখতো। তার দু/চারটে দৈনিক ইত্তেফাক’এর মহিলা অঙ্গনে ছাপাও হয়েছিল। কবি হওয়ার পেছনে পিত্রালয়ের কাছাকাছি লালমাই পাহাড়ের রুখু লালচে মাটির সৌন্দর্য, ভুলুয়া গ্রামের অপরূপ সুবজ আর …। নিশ্চয় পূর্ব পুরুষের কাব্যপ্রীতিই প্রাণিত করেছে বলে সিতারার ধারনা।
বহু পুরনো হয়ে যাওয়া জনশ্রুতি যা ভুলুয়ার বাতাসও বহন করতে অপারগ সেই বিস্মৃত অরিক কাহানির আবেশে ডুবে থাকতে ভালোবাসে সিতারা। সে জানে মোঘল ঘরানার জেনানাদের পর পুরুষের সামনে চেহারা দেখাতে নেই। বংশ গৌরবের জনশ্রুতিটা কখনোই ওর কাছে কোন অমূলক কাহিনী বলে মনে হয় না। সিতারা দৃঢ় সত্যে বিশ্বাস করে যে সে সুবে বাংলার সুবাদার মোঘল শাহজাদা সুজার একজন উত্তরসূরি।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে একটা পরিত্যক্ত বাংকার থেকে আরো জনা বারো নির্যাতিতাসহ সিতারাকে উদ্ধার করা হয়। তখনও পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন। ওর জগতে শুধু সত্যি হয়ে থাকে মোঘল ঐতিহ্যের ইতিহাস। তখন সে বাংলার সুবেদার শাহ্সুজার রক্তের উত্তরসূরী বনে যায়। নারী পুর্ণবাসন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে সিতারাকে সরাসরি পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বছর দুয়েকের মধ্যে মোটামুটি সুস্হ হয় সিতারা। আবার শক্ত দু’পায়ে উটে দাঁড়ায়। অলিক কল্পনায় সে মানে যে, মোঘল রক্ত সব সময় তাগদ রাখে, হারতে জানে না। অসমাপ্ত অনার্সটা আবার নতুন উদ্যমে শুরু করে। অনার্স এবং মাস্টার্স সমাপ্ত করে। একটা ইন্টারন্যাশনাল সাহায্য সংস্হায় যোগদান করে। ভালো স্যালারী ও পদমর্যাদা। বড় চাচা সুপ্রিমকোর্টের জজ হলেও তার বাসায় ওঠে না। চাচা, চাচিসহ ভাইবোনরা ওর প্রতি আন্তরিক বলা যায়। মাঝে মাঝে অবশ্য যাওয়া আসা করে কিন্তু সাবলম্বি, স্বাধীন জীবন পছন্দ সিতারার– বেশ কিছু ভালো বিয়ের প্রস্তাবও আসে। কিন্তু সেগুলো প্রত্যাখ্যান করে সিতারা বেগম। পুরুষের পৌরষত্বের চেয়ে পশুত্ব দেখার কুৎসিত অভিজ্ঞতায় সে ক্ষতবিক্ষত। এছাড়া ওভাবে ধমনীতে আছে মোঘল রক্ত। মোঘল শাহজাদীরাতো বিয়ে করতে পারে না। উত্তরাধিকার জটিলতা সৃষ্টির ভয়ে স্বয়ং আকবর বাদশাহ আইন করেই মোঘল শাহজাদীদের নিকাহ্ করা নিষিদ্ধ করেছিলেন।
১৯৮১ সাল যুদ্ধের দশ বছর পর। সিতারা একটা আর্ন্তজাতিক এনজিওর কর্মকর্তা। কর্মস্হলে ঠিকমতো দায়িত্বপালন করলেও মাঝে দু’বার মানসিকভাবে অসুস্হ হলে সাহায্য সংস্হাটিই তাকে চিকিৎসা সেবার সুযোগ করে দিয়েছে। এখনও সে মাঝে মাঝে ভ্রমবিভ্রমে ঘোর স্বপ্নচারী হয়ে ওঠে। ওকে কখনো দেখা যায় কল্পনায় যমুনা নদীর বামতীরের জারাফশান বাগিচায় পায়চারি করতে– কখনো বা দেখা যায় আঙ্গুরি বাগের ফোয়ারার পাশে গোলাপ বা গন্ধরাজের সুবাসে মগ্ন হয়ে বসে থাকতে।
তবে স্বপ্নে বা কল্পনায় নয় এবার বাস্তব সত্যেই মোঘল সাম্রাজ্যে যাওয়ার আয়োজন করে সিতারা। চাচা, চাচি আর চাচাতো দু ভাইবোনকে নিয়ে একদিন দিল্লী যাওয়ার প্লেনে উঠে বসে। বিশাল শূন্যতায় ভাসতে ভাসতেই একসময় ওর কানে আসে-লেডিস এণ্ড জেন্টেসম্যান ইউদিন ফিউ টাইমস ইউ উইল ল্যান্ড ইন দিল্লী এয়ারপোর্ট …..। শিকারীর মতো গলা উচিয়ে প্লেনের জানালায় চোখ রাখে সিতারা। নিচে ঝলমলাচ্ছে ‘রাতের আলোকোজ্জ্বল দিল্লী। সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে ওর। রাতটা দিল্লীর এক হোটেলে থেকে পরদিন ভোরবেলায় আগ্রা যাত্রা।
জুনের বে-দরদী রোদ দিল্লী থেকে শুরু করে আগ্রা যাওয়ার সমস্ত রাস্তায়, গেহু ক্ষেতে, বৃক্ষের সবুজে দস্যুর মতো হামলে পড়েছে। গাড়ির কাচ ঘেরা কৃত্রিম ঠাণ্ডায় বসে সিতারা বাইরের তাতানো প্রকৃতি চোখের তারায় গেঁথে নিতে থাকে। ৮০ কিলোমিটার ছুটে চলা গতিও যেন পথের দুরত্ব টপকাতে পারছে না। স্হের্যহীন হয় সিতারা। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে – ভাইজি, আগ্রা কিত্না দূর হ্যায়? আওর কিত্না ওয়াক্ত লাগে গা। আগ্রার সান্নিধ্যে যাবার দুর্মর কাঙক্ষায় সিতারা উত্তর শোনার জন্য কান পেতে রাখে। দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং-এর বৃত্ত ঘোরাতে ঘোরাতেই উত্তর দেয় ড্রাইভার– আওর এক ঘন্টেমে হামলোক আগ্রা পৌঁছ যায়েঙে। চোখ বন্ধ করে সিতারা। দু ঠোঁটের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে ’র’ ফলার আধিক্যে উচ্চারণ করে – আগ্রা — আগ্রা। মসৃণ রাস্তায় ছুটে চলা গাড়িতে বসে সিতারা আবার স্বপ্নচারী হয়। রক্তের ভেতর মাতম টের পায়। — আহ্ আমার পূর্ব পুরুষের আগ্রা, সম্রাট বাবর যার ভিত্তিস্হাপন করেছিলেন তারপর বাদশাহ্ হুমায়ূন, বাদশাহ্ আকবর, বাদশাহ জাহাঙ্গীর আর বাদশাহ শাহজাহান যার গরিমা আর ঐতিহ্য উত্তরোত্তর জেল্লাদার করে তোলেন।
এক ঘন্টার কিছু আগেই সিতারাদের ল্যান্ডকুজার আগ্রায় প্রবেশ করে। সরু রাস্তা, পরিকল্পনাহীন ঘরবাড়ি সব মিলিয়ে নগরীর শ্রীহীনতায় সিতারা দমে যায়। এই-ই আগ্রা! কিছু সময়ের মধ্যে ইতিহাসের ছাত্রী সিতারা নিজেকে মেরামত করে নেয়। তাজমহলে যাবার আগে সিতারা তার চাচার কাছে আগ্রাফোর্ট পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই ফোর্টেই মোঘল বাদশাহ্ জাহাঙ্গীর সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, বাদশাহ্ শাহ্জাহান এর পুত্র আওরঙ্গজেব, দারাশুকো, মুরাদ, শাহ্ সুজা আর তাঁদের পরিবার, আমাত্যবর্গ কত জৌলুশ আর দাপটেই না জীবন-যাপন করেছে। কত হাসি, কান্না আর রক্তের ইতিহাস গাঁথা ক্ষয়িষ্ণু পাষানের পরতে পরতে।
চাচা এবং ভাইবোনরাও সিতারার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়। গাইড ইরফান শেখ পাঁচজনের পর্যটক দলটি নিয়ে আগ্রা ফোর্টের দিকেই এগোয়। ঠিক তখনই বুজরুগিটা শুরু হয়। আগ্রার তাতানো গরম হঠাৎ নমনীয় হয়ে ওঠে। রোদ মাখা তুতনীল আসমানে চিলের মতো কালো কালো জনার মেঘেরা উড়ে আসে। একটু আগের রোদ টান টান আকাশকে সাদা মেঘের ওজনে নতজানু আর পতনোন্মুখ দেখায়। কাঠফাটা গরম হঠাৎ আপোষকামী হয়ে ওঠে। সূর্য রোদের তলোয়ার অদৃশ্য খাপে ঢুকিয়ে ব্রহ্মচারী বাতাস আর ছায়ায় যোগসাজসে তপ্ত দুপুরটাকে আদুরে বিকেল করে তোলে।
হামলোক আব আগ্রা ফোর্ট কি দরওয়াজামে খাড়া হে, কুছ দেরমে আগ্রাফোর্টকে অন্দর যায়েঙ্গে …..। গাইডের গম্গমে গলার যন্ত্রবৎ উচ্চারণে বাস্তবে ফিরে আসে সিতারা, সম্বিৎ ফিরে পায় সে। কিছু সময় মাত্র তারপরই বিস্ময়ে বাকহীন হয়ে পড়ে। আম আতরফদের (সাধারণ জনগণ) সাধারণ প্রবেশদ্বার নয় বরং ওর আগমনে বিখ্যাত আকবরী দরওয়াজা খুলে দেয়া হয়েছে। যে দরওয়াজা দিয়ে কেবল সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, শাহ্জাদা, শাহ্জাদী, আমির ওমরাহ্গণ প্রবেশাধিকার পেতো। অভিভূত সিতারার কানে ভেসে আসে নক্করখানা থেক বাজানো সানাই, বাঁশি, ঢোল, মন্দিরা, আর দিগরের শ্রুতিমধুর শব্দ। মোহমুগ্ধ সিতারা ভেতরে প্রবেশের জন্য পা বাড়ায়। তখনো ওর জন্য আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল, ইয়া আল্লাহ্! সিতারা বিস্মিত চোখে দেখে প্রবেশ দ্বারে ওকে অভ্যর্থনা করার জন্য অনিন্দ সুন্দরী যে আওরত দাঁড়িয়ে তিনি তো খোদ্ শাহ্জাদী জাহানারা। তার পরনে গোলাবী আঙরাখা, মনিমুক্তা খচিত ডোরিয়া। মুক্তো বসানো চটি পায়ে তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি কী ঋজু আর তেজি। কিন্তু এখন তার চোখে মুখে সহজ অপরূপ হাসি। তিনি নিবিড় আন্তরিকতায় সিতারাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এই আলিঙ্গনের মধ্যেই নিজের বুজের ধুক্পুক শোনে সিতারা। আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে দ্রুত মাথা ঝুঁকিয়ে কোমরের খাঁজে ভাজ তৈরি করে তাঁকে কুর্ণিশ করে সিতারা। শাহ্জাদী ওর হাত দুটো ঝট করে ধরে ফেলেন – এ কীয়া হ্যায়, তুমি আমার বহিন। আমাদের গৌরবের তেজি নিশানা। নিজের মুলুকের আজাদীর জন্য বে-রহম পাকিস্তানি জানোয়ারদের কাছে জেনানার সবচাইতে কিম্তি সম্পদ ‘ইজ্জত’ দিয়েছো। তারপরও তুমি হিম্মত হারাওনি। আবার ওঠে দাঁড়িয়েছো। এ জন্য তোমাকে সাবাশি দেয়া উচিৎ। দীর্ঘ কথা শেষ করেও শাহ্জাদী সিতারার হাত ধরে থাকেন। একটু থেমে আবার শুরু করেন-তুমি হয়তো ভাবছো বাংলা মুলুকের সুবেদার থাকার সময় আমার ছোটা ভাই শাহ্জাদা সুজা কোন এক অখ্যাত গ্রামের সবেরা খাতুন নামের এক জেনানার ইশকে পড়েছিলে আর সে রক্তের উত্তরসূরী বলে আকবরী দরওয়াজায় এসে তোমাকে সোহাগাত জানাতে এসেছি তবে ভুল ভাবছো। মোঘল শাহজাহাদের ভোগ, লালসা, শাদী এসের গিনতি (গণনা) হয় না। তুমি ইতিহাসের ছাত্রী, জানো তো আমার সবচেয়ে পেয়ারা ভাই দারাশুকো স্রেফ একজন নাচনেওয়ালি ‘রানাদিল’ কে শাদী করেছিল। কোথায় হারিয়ে গেল রানদিল! মোঘল পুরুষদের জন্য সব জায়েজ ছিল। পেয়ার, শাদী জোবরদস্তি….। এসব শুনতে শুনতেই সিতারা শাহজাদীকে অনুসরন করছিল। শাহ্জাদীর শরীর থেকে সুন্দর সুবাস আসছে। নিশ্চয় এ গুর্জরী আতরের গন্ধ। জাহানারার প্রিয় সুগন্ধি। তার গোলাবী ওড়নার ঝালরে বাদাম ফুলের নকশা তোলা কাঞ্চনের চুমকি। গলায় হীরে আর পান্নার কারুকাজ করা হার। সিতারাকে অবাক করে শাহজাদী ওকে নিয়ে সোজা তার খাস মহলে প্রবেশ করেন। শাহজাদীর কামরা কিংখাব আর ভারি পর্দায় সুসজ্জিত। মখমলের পর্দা টান টান করে রেশমের দড়ি দিয়ে টানানো। ইরানী নরম গালিচায় পুরো মেঝে ঢাকা। তার উপর উঁচু উঁচু ফ্রানসিসি তাকিয়া বসানো। শাহজাদী সিতারাকে আসনে বসিয়ে তার কাছাকাছি বসেন। পরম মমতায় বলেন; সিতারা বহিন আমার, তুমি কতদূর বাংলা মুলুক থেকে এসেছো। মাসের পর মাস তোমার উপর যে না ইনসাফী চলেছে তারপরও তুমি কত সাহস নিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছো। তোমার মধ্যে যে আকত্ আমি দেখেছি বলতে শরম নাই তা হয়তো আমার নিজের মধ্যেও অনুপস্হিত। আমি সিরেফ একজনকে পসন্দ করেছিলাম, সে ছিল চৌহান রাজপুত ছত্রশাল। কিন্তু কখনো সাহস করে তার কথা আমার আব্বা হুজুরকে বলতে পারিনি। যতবার-ই বলবো ভেবেছি, ততোবারই তিনি আমার সামনে হয়ে উঠেছেন হিন্দুস্তানের বাদশাহ্ শাহজাহান। সিতারা এবার তার মুখ না খুলে পারে না– গোস্তাকি মাফ করবেন শাহজাদী, আমার ঘটনার সঙ্গে আপনার এই কাহানির সম্পর্ক অপ্রাসঙ্গিক নয় কী? শাহ্জাদী বিরক্ত হয় না– কথা তো এখানেই যুদ্ধের পর এতো নির্যাতন সওয়ার পরও তুমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছো।
শাদীর প্রস্তাব এসেছে অনেক, সেগুলোও স্পর্ধার সাথে নাকচ করে দিচ্ছো। আর আমরা মোঘল শাহ্জাদীরা শাদী করার রিওয়াজ নাই বলে মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছি, অথচ মুখ খুলে বলতেও পারিনি। সব হারিয়েও তুমি অনেক কিছু পাবার প্রস্তাব সাহসের সাথে প্রত্যাখ্যান করতে পারো। সিতারা জানে উত্তরাধিকার নির্বাচনের জটিলতা এড়াতে বলি দিতে হয়েছে শাহজাদীদের শাদীর রঙিন খোয়াব। জাহানারার ডাকে সিতারার তন্ময়তা কাটে — বহুত পথত পাড়ি দিয়ে এসেছো, এবার কিছু খাও।
শাহজাদীর খাস বাঁদী কোয়েল আবদারখানা থেকে অনেক খাবার সিতারার পেশে (জন্য) নিয়ে এসেছে। টাটকা গোস্তের কাবাব, ফুল ময়দার পেস্তা রুটি, ভেড়ার মাংসের সুসিদ্ধ মালখোবা, গরম গরম শিক কাবাব। রূপালি তবক মোড়া হালুয়া, তরমুজ, খোরমোজা, শরবত ….। এতো খাবার যে এক চিমটি করে নিলেও পেটে ধরবে না।
সিতারা শাহজাদীর সঘন-সান্নিধ্যে বিব্রতবোধ করলেও ধীরে ধীরে সহজ হতে থাকে। খেয়ে কিছুক্ষন বিশ্রামের পর শাহজাদী বলেন, আমরা এখন দেওয়ান-ই খাসে যাবো খুদ হিন্দুস্তানের বাদশাহ সম্রাট শাহজানের পেশে। সিতারা শাহজাদীর দিকে নজর করেও বেশীক্ষণ চোখ রাখতে পারে না। দৃষ্টি নামিয়ে বলে, কিন্তু যদ্দুর জানি ওখানে জেনানাদের প্রবেশের ইজাজাত নাই। শাহজাদী সম্মতি সূচক মাথা হেলান– ঠিকই শুনেছো, কিন্তু তুমি সব কিছুর উর্ধ্বে। স্বয়ং বাদশাহ্ আজ দেওয়াই ঘাসে তোমার পেমে এই রিওয়াজ মওকুফ করেছেন। শাহজাজী ওর হাত ধরেন– চলো। সিতারার পা থর থর করে কাঁপে। সিন্দুস্তানের বাদশাহ্র সামনে যেতে হিম্মত কাবু হয়ে আসে, কদম সরে না।
শাহ্জাদী দরবার পর্যন্ত আসেন না। এখানে সিতারা একা, দেওয়ান-ই খাস আজ গম গম গম করছে। উজির, আমির, মনসবদার আর শাহী মহলের মান্যগণ্য জনের উপস্হিতিতে দরবার কক্ষ ভরপুর।
সিতারা ভয় কম্পিত পায়ে দরবার কক্ষে ঢোকে। কুর্ণিশ জানিয়ে বিণয় বিগলিত স্বরে বলে, জিল্লেএলাহী, হিন্দুস্তানের প্রাণ, মহামান্য সম্রাট আমার মতো এক আম জেনানাকে এখানে প্রবেশের অনুমতিদানের জন্য শুকরিয়া। যেন সপ্ত আসমান ভেদ করে ভেসে আসে ডমরুর আওয়াজ এমন স্পষ্ট ও দৃঢ় স্বরে কথা বলেন সম্রাট– সিতারা বেগম তুমি কোন আম আতরফ নও, নও কোন সামন্য জেনানা। তুমি বীরাঙ্গনা। আপন মুলুকের জন্য শহীদরা জান কোরবান দেয় একবার। কিন্তু তুমি সাত মাসে কত হাজারবার কোরবান দিয়েছো তোমার সম্ভ্রম, ইজ্জত? তারপরও তুমি কত তাকত আর হিম্মত রাখো। এ জন্য সবার তরফ থেকে তোমাকে জানাই সাবাশি আর সাধুবাদ। অভিভূত সিতারা বিনীত দৃষ্টিতে সম্রাটের দিকে তাকায়– বন্দেগান, আপনার এই স্তুতি আমার কাছে মাহমূল্যাবান তোফা। এ বাঁদী সব সময় এই দান মনে রাখবে। বাদশাহ্ স্বয়ং সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়াতেই পুরো খাস দেওয়ান উঠে দাঁড়ায়। সিতারার করতল নিজের হাতে তুলে স্লেহে চুম্বন করেন তিনি; হাত রাখেন ওর মাথায় — তুমি আমার কন্যা সম, তুমি কেবল বাংলাদেশের নও সারা হিন্দুস্তানের গর্ব………।
ইয়ে দেওয়ান-ই খাস হ্যায়, এহাপার বৈঠকে সেলিম জাহাঙ্গীর রচা তুজুক-ই জাহাঙ্গীর। ইয়ে শাহী শানদার তখ্তপর বৈঠ্কে হি মোঘল সম্রাটেবনে হিন্দুস্তান কী এহেম ফ্যাস্লা লিতা হ্যায় …। গাইডের মুন্সিয়ানা বয়ান সিতারা বাস্তবের জমিনে ফিরে আসে। আগ্রা ফোর্টের খোরা চত্বরে সিতারার ধোঁয়াসে স্বপ্নচারিতা মিলিয়ে যায়। পর্যটক্দের কৌতূহলী বিচরণে আজও দেওয়ান-ই খাস সরব আর মুখর। সিতারা খিলানের কাছে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকেই দূরের তাজমহল দেখা যায়। পর্যটকদের কৌতুহলী বিচরণে আজও দেওয়ান-ই খাস সরব আর মুখর। সিতারা খিলানের কাছে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকেই দূরের তাজমহল দেখা যায়। আকাশে সঘন মেঘের বিচরণ। স্হৈর্যহীন বেদু্ইন বাতাসে ঢেউ এ শুকিয়ে যাওয়া যমুনায় ঢেউ না উঠলেও যাযাবর এই বাতাসের দাপটে সিতারার নেকাব খুলে যায়। হাওয়ারাও থম্কে দাঁড়ায়, আহ্ যেন ভোরের নরম আলোয় ফুটে থাকা জুঁই। সাফেদ ও সুরেলা সৌন্দর্যে স্রোতহীন যমুনাতেও তির তির করে ঢেউ ওঠে যেন। জৌলুসহীন দেওয়ানই-খাসে গোলাবের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে ফোটে সিতারার অনিন্দসুন্দর ফর্সা অবয়ব। কী রূপের জৌলুস! রোদ আর মেঘের আলোছায়া যাদুকরি এ সৌন্দর্যকে আরো শানদার করে তোলে। ভ্রমণপ্রিয় পর্যটকের দল কিছুক্ষণ স্হবির না দাঁড়িয়ে পারে না। তাদের রূপকাতর দৃষ্টি দেখে- প্রাসাদের খিলাপে হেলান দিয়ে দূরের তাজমহলের দিকে তাকিয়ে আছেন এক অপরূপ শাহ্জাদী। অঙ্গুরী বাগ থেকে উড়ে আসা বাতাস, আগ্রা দুর্গ টপ্কে যমুনা ডিঙ্গিয়ে তাজমহলের দিকে ধাবমান হলে দুর্গের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল বৃক্ষরাজি তাদের সবুজ শাখা প্রশাখা ঝুঁকিয়ে কুর্ণিশ জানায় নতুন এই শাহ্জাদীকে। – ০১৭২০৫৬১৬৮৯