কীর্তনখোলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত শ্যামসন বুড়ন-এর প্রথম গল্পগ্রন্থ
‘জোনটানে’ ।
লেখক সাহিত্যে বাস্তবতায় বিশ্বাসী। বাস্তব চরিত্রের সাথে মিথষ্ক্রিয়া সংমিশ্রণে গল্প নির্মাণ করেন – এই গল্পকার। ভাটির জীবন, সীমান্তজীবন, প্রান্তজীবন, নগরের ঘিঞ্জি-বাস্তুহারা জীবন থেকে মুক্তিযুদ্ধ;- এমনকি বাদ যায় না ম্যাজিক রিয়ালিজম বা মেটামরফসিস-একবিংশ !!! তার দর্শন, জীবনবোধ, পর্যবেক্ষণ এবং ব্যতিক্রমী চর্চার মধ্য দিয়ে লেখক ক্রমশই হয়ে ওঠেন উত্তর আধুনিক। লেখকের রচনাশৈলীর মুন্সিয়ানায় গল্প গ্রন্হের ১১টি গল্পের একটি অন্যটি থেকে তাই ব্যতিক্রম। নিশ্চিত পাঠক বিমোহিত না হয়ে পারবেন না।
লেখক পরিচিতি
শ্যামসন বুড়ন
জনপদ ভেদ করে নদী যেমন বয়ে চলে সাপের মতন, তেমন করে পায়ের সাথে পা মিলিয়ে পায়ে মেখেছি কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত বহুপথের ধুলিকনা – আসলে উজান থেকে ভাটির মাটির মুক্তো। সেইসব মুক্তোগুলি জোড়া লাগিয়ে গেঁথেছি জনমানুষের নকশিকাঁথা -এটাই শখ।
এই শখটুকুর হাতেখড়ি শিক্ষিকা মায়ের কাছে; অ আ থেকে দেবদাস অবধি।
পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়াশুনার পাশাপাশি পাশে বসে দেখেছি; আরজ আলি মাতুব্বর কী এত পড়েন? পড়তে পড়তেই স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এবং প্রতিচ্ছায়া পরেছে প্রথম কবিতাপত্র উচ্চারণে।
বাবা সুধাংশু দাস, মা সুপ্তা দাস। তারা পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বহুকষ্টে আমাকে আলোর দেশে এনেছিলেন। সাং, কীর্তনখোলার পাড়, চাঁদমারী, বরিশাল। তাই, ১২ ডিসেম্বর এলেই মনে মনে বলি; আমিতো আসতে চাইনি!
জোনটানে গল্পগন্থের কয়েকটি গল্প থেকে কিছু কিছু অংশ …
(১)
নায়করাজ রাজ্জাকের পলায়নপর্ব
যে রাতে বীর্যবান পুরুষরা সার্থক অথবা ব্যর্থ সঙ্গমশেষে, বৌকে কোলবালিশ বানিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন, সেই মধ্যরাতে নায়করাজ রাজ্জাক স্পষ্ট উচ্চারণে পাঠ করে শোনান উপস্হিত পাঠচক্রের সদস্যবৃন্দকে। এই পাঠচক্রের মধ্যে সে-ই-ই সবচেয়ে সুন্দর সুপুরুষ, স্বাস্হ্যবান ও সমর্থ দলনেতা। দলনেতা পাঠ করছেন: ‘জমি যদিও জোতদারের, কিন্তু লাঙ্গল, গরু, চাষ, নিড়ান ও পরিশ্রম সবই আধিয়ারের। সুতরাং দখলের তিন ভাগের দুই ভাগ ন্যায্য দাবি। শাসকগোষ্ঠীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে অতি সংগোপনে এই আন্দোলন আধিয়ার ও বর্গা-কৃষকদের মধ্যে প্রসার লাভ করল। বিশেষভাবে এ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হলো নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমান দরিদ্র কৃষক, আদিবাসী, উপজাতি সমপ্রদায়। তথাকথিত ফাঁকা স্লোগান উচ্চারণ শ্রবণ করার পরিবর্তে খেয়ে ও পরে সামান্য বাঁচার মতো কিছুটা আশাবাদ এই মতবাদের অন্তরে নিহিত থাকায় নিম্নশ্রেণির নাগরিকরাই এই মতবাদের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। চিরবঞ্চিত সর্বহারাসহ অন্যান্য সব বঞ্চিত শ্রেণির লোক এই মতবাদের প্রতি স্বাভাবিক প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে বেশি। ’ ……
(২)
জোনটানে
– তোমার লগে সাহস দেখানোর কাম নাই। তুমি কেডা আমার?
– আমি তোমার সাপ! বলেই আবারও সেই রহস্যময় হাসি, হাসতে-হাসতে শাড়ির অাঁচল অবলীলায় পড়ে যায় বুক থেকে। মুসা চোখ সরিয়ে নেয়। তাকায় তালগাছটির দিকে। শকুনটি লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রসের বাইদানির বুকের দিকে। ঠোক্কর মারবে না-কি শকুনে? মনে-মনে এই বদদোয়া করা কালীন ডুবসাঁতারু কালু মিয়া একটা প্যাকেট নিয়ে আসে বাসায়। বলে, মুসা, ওগো লইয়া রওনা দাও এক্ষুনি। বাইদানি দুইজন প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দেয়। মুসা রেডি হয়ে ঘরের বাইরে আসে। একটু পরেই ওরা তিনজন কলারোয়ার উদ্দেশ্যে ভ্যান ভাড়া করার সময় এক বিশ্রী স্বরে শকুনটি খ্যাকখ্যাক করে উঠে। মুসা চমকে উঠে এ ডাকে। সামনে কি কোনো বিপদ আসছে না-কি? মাথার উপর শকুন, ডানে-বাঁয়ে জ্যান্ত সাপ। দুই নাকফুলওয়ালী তো সাপের চেয়েও বেশি বিষধর। ….
(৩)
মাটির মানুষ
– মাগি, কার লগে পিরিতির কথা কস?
যাকে কথাটা বলে হাজেরা বেওয়া, সে এসব আলতু-ফালতু কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। নিত্য তিরিশ দিনের যত ঘ্যানর-ঘ্যানর – তা ওই চুলোর নিচে কবরের মধ্যে জাউল্ল হরদার মানে জালাল সরদারের সাথে। বাকি সব খোদেজার সাথে। হরদার মারা যাবার পর হাজেরা বেওয়ার কথা মাত্র জীবিত ও মৃত দুই জনের সাথে।
অভিশপ্ত জাউল্লা পাড়ার হরদার বাড়ি মাছের রাণী খোদেজার যখন বিয়ে হয়, তখন তার বয়স ষোল। হাজেরার একমাত্র পোলা আলামিনকে নিয়ে ভাঙা ঘরের মাটির বিছানায় ঘুমায় যখন হাজেরা-আলামিন, তখন তাদের নিচে কবরের মধ্যে ঘুমায় আলামিনের দাদা-দাদি। হলতা নদীর পার্শ্ববর্তী এ পাড়ায় হাজার দুই জাউল্লা মানুষের বসবাস মৃতের সাথে। ঘরের মধ্যে কবর। বাইরে কবর। ডোয়ার পাশে, চুলার নিচে, এমনকি পায়খানার নিচেও আছে চৌদ্দ পুরুষের কবর।
কাঁঠালিয়া উপজেলার হলতায় মাছ ধরে যে আলামিন, তার গায়ের রং মা কালীর মতো। খোজেদা পাড়ার মাইয়া হলেও – তার বয়স যখন পনেরো, তখন পার্শ্ববর্তী বিষখালি নদীতে গোপনে মাছ ধরা শেখায় আলামিন। কোন জায়গায় কারেন্ট জাল ফেলতে হবে, জোয়ারে না ভাটায়, অমাবশ্যা না পূর্ণিমার জোবায়; খোদেজা-আলামিনের রং-ঢং-ভং বাড়ে মাছে-পানিতে-জালে। খোদেজার জালে মাছ পড়ে প্রচুর। চিংড়ি, বায়লা, ভাটা, ঝাটকা, কাঁকড়া, রুইমাছ। আলামিনের কপালে মাছ নেই, আছে শুধু শামুক। নিয়ে আসে বাসায় হাঁসের জন্য। রাগে-হিংসায় আলামিনের গা পুড়ে যায়। পূর্ণিমার ভাঁটিতে যখন খোদেজা মাছ মেরে ছোট্ট ডিঙি নৌকা ভরে ফেললো; তখন আলামিন চাঁদ দেখে। চাঁদের আলো ও নয়া মাসিক-রোগ আক্রান্ত খোদেজাকে দেখে দুচোখ ভরে! যক্ষ্মা রোগীর কাশির মতো, ফস্ফস করে বুকের পাঁজর ভেঙে বের হয়ে যায়;
– ওই ছেমরী, তুই তো মাছের রাণী হয়ে গেলি রে! …..
(৪)
মেটামরফোসিস
রাশেদ বুদ্ধি পাকাঁয়। কাল পরীক্ষা দিতে হলে, তাড়াতাড়ি চেম্বারের কাজ শেষ করে বাসায় যেতে হবে। পড়তে হবে। না পড়লে ডাহা ফেল। সে তিনটা রিপোর্ট, তিনটা রোগী পর পর পাঠাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরই আবার স্যারের টুটাং, টুটাং। অন্যদিকে পকেটে নীনারই দেয়া মোবাইলে নীনারই ছবি ভেসে ওঠে। ঘরঘধ ঈধষষরহম। রাশেদ ঝটপট স্যারের রুমে ঢুকে পড়ে। মোবাইলে গান বাজচ্ছে, “তুমি বরুনা হলে আমি সুনীল”………..
-রাশেদ, বরুনার ফোনটা ধর।
-স্যার, রোগী কি আরও বেশী করে দেব? রাশেদ লজ্জায় আসল কথার উত্তর না দিয়ে, রোগী সংক্রান্ত আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কথা বলে মাথা নিচু করে।
-রাশেদ, গ্রেগরী তাহলে পোকা হয়ে গেছে?
-জ্বী স্যার।
-তারপর?
-তারপর স্যার… … … রাশেদ আবারও তীব্র উত্তেজনায় চকচকে চোখে বলতে শুরু করে। সে ঘামছে- কাঁপছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। রাশেদ অনবরত বলে যাচ্ছে। স্যার অবাক হয়ে শুনছেন।
গ্রেগরী পোকা হয়ে গেছে দেখে, আতঙ্কে সবাই চিৎকার চেচাঁমেচি শুরু করে দেয়। গ্রেগরীর গলার স্বর নীচু করে, ধীরে ধীরে সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে; সে গ্রেগরী। ঘুম ভেঙ্গে দেখে সে পোকা হয়ে গেছে। এতে তার দোষ কী? ভীষণ ভয়তে সবাই পালায়। ফ্লাটের অন্য ভাড়াটিয়ারা এ বীভৎস্য দৃশ্য দেখে চলে যেতে পারে; এ ভয়ে গ্রেগরীর বাবা রুমে তালা দিয়ে গ্রেগরীকে আটকে রাখে। গ্রেটা সকালের নাস্তা রুটি, গ্রেগরীকে দিয়ে আবারও বাইরে থেকে রুম তালা মেরে দেয়।
-তাহলে, তুমি বলছো, গ্রেগরী শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি পোকা হয়ে গেছে?
-স্যার আমি বলিনি। কাফকা লিখেছেন।
-ওই একই কথা। যাহা রাশেদ, তাহাই কাফকা। হাঁ হাঁ হাঁ হাঁ … …. স্যারের অট্টহাসিতে অপেক্ষমান রোগীরাও নড়ে চড়ে বসে।
-যাও তাড়াতাড়ি রোগী পাঠাও। বাকী গল্পটা খুব তাড়াতাড়ি শুনতে হবে।
রাশেদ চেম্বার থেকে বের হয়ে চারটা চারটা রোগী এক সাথে পাঠায়। এর পর পাঁচটা পাঁচটা। রোগী যাচ্ছে-আসছে-যাচ্ছে-আসছে। একটু একটু করে ফাঁকা হতে থাকে চেম্বার। রাত ৮টা। আবারও টু টাং, সাথে সাথেই নীনা ফোন করে। রাশেদ জানে নীনা কেন ফোন করছে। ফোন ধরলেই বলবে এক্ষুণি তুমি মেসে গিয়ে পড়তে বস। কথা বাড়ালেই- ঝাড়ি। রাশেদ ফোন না ধরে, স্যারের রুমে ঢুকে পড়ে।
-তো রাশেদ, তারপর?
-তারপর স্যার………. রাশেদ শুরু করে। ….
(৫)
গলাকাটা বাদশা
বাদশা পালাচ্ছে। পালাচ্ছে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি। সৈয়দ বাড়ি থেকে চৌধুরী-তালুকদার-খাঁনদের বাড়ি হয়ে পাল-দাস-ভট্টাচার্যিদের বাড়ি হয়ে পুকুরপাড়, খালপাড়, নদীরপাড়। ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল-আমগাছ-তুলশিগাছ-ধানক্ষেত-পাটক্ষেত মাড়িয়ে মাড়িয়ে পাগলা কুত্তার মতো পালাচ্ছে। আধা কাটা গলা দিয়ে ঝড়ছে লাল লাল রক্তের স্রোতধারা। প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে লাল লাল রক্ত, যেমন একদিন মিসরেও ঘটেছিল। ভট্টাচার্যিদের বাড়িতে সোরগোল ওঠে-
-হায় রাম, হায় রাম! হায় ঠাকুর! এ যবনদের হাত থেকে বাঁচাও আমাদের। বলেই গঙ্গাজল দিয়ে ঘর-বাড়ি ধুতে ধুতে, গোবর দিয়ে লেপা শুরু করে বিধবা হরিবালা ভট্টাচার্য্যি। কিন্তু এ পুন্যের কাজটুকু শেষ হওয়ার আগেই আবারও এসে পরে বাদশা। শিং-এর গুতোয় তুলশি গাছটাকে উপরে ফেলে ছুটে পালায়। হরিবালা ঠাকুর ঠাকুর বলেই অজ্ঞান হয়ে পরে। বাদশার পিছন পিছন ছুটছে চাপাতি হাতে কালু কশাই সাথে মাদ্রাসার সব ছাত্রগণ। ছুটছে গ্রামবাসী। পাল বাড়ির মাটির হাড়ি-পাতিল ভেংগেচুড়ে তছনছ করে, ছুটে যায় মসজিদ কাম মাদ্রাসার দিকে। ওখানে ভাংচুর করে ছুটে যায় সৈয়দের কাছারির দিকে। কাছারির মধ্যে টাকা-পয়সা, হিসাবের টালিখাতা রক্তে রক্তে সয়লাব হয়ে পরে। শিং-এর গুতোয় সৈয়দের আরামের কোলবালিশ ফেটে যায়। সাদা সাদা শিমুল তুলা লাল রক্তে সাদা-লাল হয়ে ভেসে বেড়ায় এবাড়ি-ওবাড়ি। বালিশ থেকে তুলার সাথে বেড়িয়ে পরে আসল পুরুষের এক প্যাকেট কনডম! মুহর্ূতেই হিন্দু মহিলাটি চোখে চোখ পরে সৈয়দের চোখে। চোখে চোখে কথা হয়। সৈয়দা বেগমের চোখে এ প্যাকেট পরার আগেই ছোঁ মেরে তুলে নেয় সে। সেকেন্ডের মধ্যেই চালান হয়ে যায় ব্লাউজের ভিতরে! …
নিশ্চিত জোনটানে গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো পাঠকের ভালো লাগবে … শেষ
গল্পবইটি পাবেন :
বইটির মূল্য ২৫০ টাকা। কমপক্ষে ২৫% ছাড়ে বইটি কিনতে পারবেন।
– একুশে বইমেলায় – অবধূত বইঘর ১০১/১০২ এবং সাহিত্যমালা প্রকাশনী ১৫৮, ১৫৯, ১৬০ নং ষ্টলে।
– রকমারীডটকম-এ আজই অর্ডার করতে পারবেন। <https://www.rokomari.com/search?term=%E0%A6%9C%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87>
– বিকাশের মাধ্যমে বইটি কিনতে পারবেন।
– অন্যান্য জেলার লাইব্রেরিতেও বইটি পাওয়া যাবে।