কথা বলা রাত

শ্যামসন বুড়ন

এই উপন্যাসের গাঁথুনির ভিত্তি ছয় দফা, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধিনতা।  চরিত্রগুলো কাল্পনিক।  ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদীর পাড়ে আওরাবুনিয়া গ্রামকে কেন্দ্র করে চরিত্রগুলো আঁকা হয়েছে।  উপন্যাসের লিয়াকত ওরফে লেকত কথায়-“ওই রাইতের মইদ্দেই আমি থাহি।  রাইতগুলো আমার মইদ্দ্যে যে কী পাইছে, কইতে পারি না।  ওই রাইতগুলা আমারে খালি জাগায়া রাহে, পতে পতে আডায়-ডাইন দিকেরতা বাঁও দিকে আর বাঁও দিকেরতা পিছনদিকে।  ডাইনেও আডায় না, সামনেও না।  একবার কয়না-একটু বহো, একটু জিরাইয়া লও”।

পাশের বাড়ির আমেনার সাথে লেকতের মন দেয়া-নেয়া ছিল বিষখালী নদীর ভরা জোয়ারের মত উপচে পড়া যেমন উপচে পড়া জোয়ার ছিল-ছয় দফার জন্য, সত্তর-র নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য এবং চুড়ান্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য।

এই অর্জনের কথা বয়ান হয়েছে, “রাতগুলো একবারও বসতে বলেনি” উপন্যাসে।  ড. মেথিউ সরোজের প্রথম উপন্যাসটি বুনন হয়েছে বরিশালের আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষায়।  কথায়-কথায় যা বলা হচ্ছে-তা আমাদের গৌরবজ্জল ইতিহাস, ইতিহাসের ইতিউতি।

ইতিহাস নিয়ে গল্প বললে, সাধারণত ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত্বের ভারে পাঠক একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হতে পারেন।  কিন্তু লেখক সচেতনভাবে তার নির্মিত চরিত্রের মধ্য দিয়ে যে গল্প নির্মাণ করেছেন-তা আমাদের গ্রামীন জীবনেরই গল্প।  যে কাহিনীতে গাও-গেরামের মানুষের প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের কথামালার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে আমাদের গণমানুষের কথ্য ইতিহাস যা পাঠককে আরও মনযোগী করে পাঠে-পুনঃপাঠে-বিশ্লেষনে।  যেমন, উপন্যাসের শুরুতেই পাঠক শুনছেন-

“এই যে, শুনছেন? পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, অগ্নি, বায়ু, ইশান, নৈশাত, নৈঙ্কিত, উর্দ্ধ,অধঃ, এই দশ দিকের লোক আপনারা, শুনছেন? একটু দাঁড়ান।  কথা আছে।  আপনাদেরকে বলবো বলে আমার কিছু কথা আছে।  দশ দিকের লোকেরা ফিরে তাকায়।  পথচলা থামিয়ে দাঁড়ায়। ”

এই যে দশদিকের মানুষ, এরা কারা? কী এদের পরিচয়? এবং যে কথা বলছে এই দশদিকের মানুষদের কাছে, তার নাম? লেখকের ভাষায়, “আমি কে? আর আমার নাম? আমি সময়। ” সময় ও এই দশদিকের মানুষদের নিয়ে যায় উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র “লেকতের” কাছে।  বস্তুত লেকতের সংলাপে ফুটে ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতি-রাজনীতি-আন্দোলন-সংগ্রাম-প্রেমের প্রকৃত চিত্র।  পাঠক আশ্চর্য হবেন, তৎকালিন সময়ের পাকিস্তানের রাজনীতি কীভাবে তৃনমূলের কাছে তথা কৃষক-শ্রমিক-জেলে সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল? সংবাদপত্র-টেলিভিশন-মোবাইল ছিল না।  ভরসা শুধু রাষ্ট্রিয় “রেডিও পাকিস্তান”।  তাহলে, এত খবর গ্রাম-বাংলার মানুষ জেনেছিল কীভাবে? বস্তুত, তৎকালিন সময়ের দর্শন ও শোষণ প্রক্রিয়া, তাই বাধ্য করেছিল রাজনীতির সামাজীকিকরনের মাধ্যম্যে গণমানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে। “মানুষে-মানুষে”-যোগাযোগের চেয়ে আর বড় যোগাযোগ কী আছে? সেই যোগাযোগই বাধ্য করেছিল “বাংলাদেশ” গঠনের জন্য এক অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধের এবং এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা লেকতের প্রেমিকা ধর্ষিতা হবে না; এটা আমরা আশা করতে পারি না!

দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে চলতি ও বরিশালের কথ্য ভাষায় কাহিনীর বর্ণনা এগিয়ে চলে কিন্তু পাঠক বিরক্ত না হয়ে আরও মনোযোগী হবে পাঠে।  তবে, বির্তক উঠতে পারে “মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু”-শব্দদুটির উচ্চারণগত আঞ্চলিক বানানের ব্যবহার দেখে।  উপন্যাসটি পড়লে, রাতগুলি পাঠকদের বসতে বলবে, পড়তে বলবে, ভাবতে শেখাবে, নতুন চিন্তার বীজ রোপিত হবে – এখানেই লেখক মেথিউ সরোজের জয়জয়াকার!

বইটি প্রকাশ করেছে: শ্রাবণ প্রকাশনী
১৩২ আজিজ সুপার মার্কেট (২য় তলা), শাহবাগ, ঢাকা।

মূল্য : ২০০ টাকা

লেখক পরিচিতি :
মেথিউ সরোজ। জন্ম : ১৪ জানুয়ারী ১৯৫৯। কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে বরিশাল শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
বরিশাল ব্যাপ্টিষ্ট মিশন স্কুল থেকে এসএসসি,
ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল থেকে এইচএসসি ও স্নাতক সম্মান (রাষ্ট্রবিজ্ঞান),
স্নাতকোত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৭ম বিসিএস-এর মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএস থেকে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচ. ডি. ডিগ্রী অর্জন।

———————————————————–

প্রকাশিত বই
স্নাতক ও মাস্টার্স পর্যায়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিনটি।
প্রকাশিত কাব্যগ্রহ্ন : ‘স্টেশনে কোনো বাস নেই’, ‘কোনো দ্রৌপদীর বসন্ত হতে পারবো না’ এবং
উপন্যাস : ‘রাতগুলো একবারও বসতে বলেনি’।