জেলপাঠকের জবানবন্দি
রাস্তার শেষ প্রান্তে রাইফেল হাতে যে যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে; সে-ও তো দিনশেষে
ঘরে ফেরে, রাতশেষে ঘরে।
তারও তো ভয় হয়, যদি যুদ্ধের লালরঙ জ্বালিয়ে দেয় এই সংসার।
চেকপোস্টের সামনে কর্তব্যরত পুলিশ বোঝে রিকশাঅলার গানঘাম, বব ডিলান বোঝে না।
অদৃশ রমণী ও আমাদের সাধনা
অদৃশ রমণীর সাধনার মন্ত্র হতে চাই না
এর চেয়ে ঢের ভালো টানপাড়ার সবচেয়ে সন্তা যে নারী; তার হাতে এক গ্লাস জল
খেয়ে ফিরে যাবো।
এসেো, ছাতিমফুলের গন্ধে পবিত্র হই,
তারপর ইচ্ছে মতোন উপাসনা করো
শরীরটাকে মন্দির বানাই, রক্তে রক্তে।
রাতের অন্ধকারকে মাতালের হাতিয়ার
না ভেবে; মার্পেসার ঘনকালোচুল কিংবা
গণিকার কাঠপোড়া হাসি ভাবতে পারো।
যৌবনসূর্য কাঁটাতারের সীমান্ত চেনে না।
তোমার দিকেই নিক্ষেপ করছি, কবিতাবাণ
শিমুল— তোমার কিছু অংশ মাথার নিচে ভর করে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ছে কবিয়াল এনাম;
তুমি এর কিছুই জানলে না।
মেঘ টুকরোটাকে ভালোবাসার মতোই এখন তুমি পড়ছো এই কবিতা—মনে মনে
ভাবছো, এই বদমাস কবিটা আসলেই শয়তানের শয়তান।
শয়তান বলো কিংবা ভগবানই বলো
প্রেমই আমার প্রার্থনা, জেনো।
ক্ষমা করো মাথিন
ক্ষমা করো, মাথিন
আমি ধীরাজপ্রতিবিম্ব নয়
স্রষ্টার উৎস হতে উঠে আসা এক প্রার্থনালাজুক কবি আমি। যার চোখ প্রতি চৈত্রে-
সংক্রান্তিকালে খুঁজে ফেরে মগদেবী। পাহাড়ি হলুদফুল কিংবা ঝকমকে সেই পেতলের
কলসিও তোমার খবর জানে না—মাথিন।
কী সহজেই মীমাংসা হয়ে গেলো, পুলিশের প্রেম
প্রণয়দেবতা মদন কিংবা বকুলের ডালে বসা বসন্তের কোকিল যখন একের পর এক
পাঠ করে মাথিনপুরাণ, সব কবিতা তখন তোমার পায়ে এসে খুঁজে পায় আশ্রয়। তবুও,
জাদিমুরার সেই রক্তাক্ত মন্দিরে তুমি আছো বলে—মাথিন
গন্তব্যহীন বাসন্তীবাতাস বুদ্ধের পরিবর্তে তোমাকে দেয় সকল অর্চনা।
ধীরাজ একটা পলাতক শিরোনাম …ছি!
ওয়াংথিয়ানের শ্মশানে এখনও সন্ধ্যা আসে, চলে যায়। পাতকুয়োর পবিত্র রমণী—মাথিন,
তুমি আছো কবিতায় কবিতায়।
বিথী হাজং
হেমন্তের শুরুতেই মেয়েটি নতুন বউ হতে চাইলো। আমি দিতে চাইলাম কিছু নতুন বই।
সে বললো, পুরাণেও পাপ থাকে কবিয়াল
তুমি বরং কিনে আনো অফেরতযোগ্য ভালোবাসাময় দিন কিংবা মরণশূন্য রাত।
আমি তাকে গ্রিকবালিকা মার্পেসার কথা বললাম; যাকে উদ্দেশ্য করে দেবতারা গান
লিখতো প্রেমের।
হেমন্তের শেষে মার্পেসাও আমার প্রেমিকা হলো; বউ নয়।
ডারউইনের বিবর্তনবাদের রথে চড়ে মার্পেসা হয়ে ওঠলো বিথী হাজং,
ঈশ্বরীয় ধর্মের মতোন।
আমি একশত আটটি নীলবেশ্যারাজ্যে হয়ে গেলাম ইলিয়ডের একেকটি মৃতদেবতা।
এপিটাফ
ভালোবাসা পাবার পর যদি মরে যাই
এপিটাফে লিখে দিও বেচারা কবি ছিলো।
ভালোবাসা না পেয়ে যদি মরে যাই
এপিটাফে লিখে দিও বেচারা সৈনিক ছিলো।
আদিবাসী কবিতা
আপনার স্তন সুন্দর—বলতেই হেসে মরি মরি সাঁওতালবেশ্যা।
পাহাড়ের মতোন—যখনই বললাম,
ব্লাউজ ঠিক করতে করতে বায়না ফেরত দিয়ে দিলেন!
পেটে পাথর বাঁধবো—তবুও,
স্তনপাহাড় শিয়াল-কুত্তাদের দখল করতে দেবো না, বাপু।
মানুষ
আমাকে হত্যা করার জন্যে এককোটি স্বর্ণমুদ্রায় হন্তারক নিয়োগ করা হলো আমাকেই।
কী দিয়ে ‘আমাকে’ দ্রুত মারবো ভাবছি,
ভাবছি, ‘আমাকে’ হত্যার পর পুরস্কারের এককোটি স্বর্ণমুদ্রা কী কী কাজে ব্যবহার করবো।
পিরিতি আমরার মতন কাইল্যা মাইসের লাইগ্যা না
মুকরাঙা পিরিতি কতোই দেকছি এদিক হেদিক; সুন্দরের লগে সুন্দরের ঘষামাঝা
অখন চাই মনরাঙা পিরিতি
কইতরের জোড়া, কইতরের জোড়া।
আমার যা চেরা!
কাওয়া-অ আগে না তাতে শরমে
আসি দিলে কুত্তাও নাকি গাঙে গিয়া পড়ে
পালপাড়ার হরিমোহন ডাকতরের ছোড মাইয়াডা তো হেইদিন হয়তানের লগে তুলনা
দিছে আমারে
যদিঅ হয়তান কোনদিন দেখি নাই; কালা না ধলা তা-ও জানি না
পারানের গহীনের ভিত্তে নাকি কেডা কাফরের নোমাল উড়ায়
কোন কুবি বলে কইয়া গ্যাছে তার কোন কুবিতায়?
কিতা জানি কয় কুবিরা কুছতাই বুঝি না
আমি হুদা বুঝি—পিরিতি আমরার মতন কাইল্যা মাইনসের লাইগ্যা না।
বাংলাদেশ
বিথী হাজং, তোমার পুরানো ব্রেসিয়ারের মতোন অজ্ঞাত—ছিঁড়ে গেছে এদেশের মন-মুণ্ডু-শরীর।
আমাদের প্রথম সঙ্গমকালে মাটিতে হামাগুড়ি দিতে দিতে খুঁজে পেয়েছিলাম
মুক্তিযোদ্ধার পুরোনো রাইফেল, মনে আছে? সেটাও ভেঙে গেছে—েএদেশটার মতোন
এদেশটার যে কী হলো!
আজকাল বড্ডো বেশি চোখ লাল!
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল
গতকাল রাত থেকে রাইফেলটাকে ভায়োলিন বানিয়ে বাজাচ্ছি তো বাজাচ্ছিই!
ভয় পাচ্ছো?
ভালোবাসতে জানি না বলে ট্রেনিঙে শেখানো হয়েছে বারবার—
‘ফিংগার আউট অফ ট্রিগার’
‘ফিংগার আউট অব ট্রিগার’—যদিও, মন আঙুলের দাস নয়
মানুষ জানে—সৈনিক মরে গেলে বসন্তের পাখিরা একরাত একঘরে শুয়ে শুয়ে কেঁদে
ফেরে নীড়ে কোনো কোনো পাখি শ্মশানে, কোনো কোনো পাখি কবরে
যে নারী একদা সৈনিকের চিঠিগুলো জমাতে জমাতে বরফ হয়ে উঠেছিলো, সে ফেরে না
যে নারী একদা সন্তান সন্তান করে সারাদিন সারারাত চিৎকার করতো, সে ফেরে না
সৈনিকঘরে চিরন্তন কেউই ফেরে না
যে ফেরে, সে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল—দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প।
পতাকা
প্রধানমন্ত্রী বহনকারী বাংলাদেশ বিমানটি মাঝআকাশে থামিয়ে দেয়ার মতোন আমাদের
প্রেমগুলো আপাতত এখানেই থামিয়ে দিই, চলো।
প্রত্যেকটি বিল্ডিংয়ে, বারান্দায় পতাকা উড়ছে মা বোনের শরীর ছুঁয়ে
লাল লাল।
যদিও, সব পতাকায় স্বাধীনতা থাকে না,
থাকে না মুক্তকণ্ঠে চিৎকার শিৎকার।
ওরে সমুদ্রজল!
মানুষ ভাসতে জানিস,
মানচিত্র ভাসতে জানিস না?
ইতিহাস
হোয়াংহোর তীর হতে তিতাসের মালোপাড়া অবধি
প্রতিটি পুরুষ নারীকেই ভালোবেসে জ্বালিয়েছে বারবার, মা বলতেন—বিশ্বাস করিনি
মেরীর গর্ভে মনিবের সুখফল, আয়ণের গৃহিনী ভগবানের কামানলে পুড়ে পুড়ে
আসতীগোলাপ।
প্রশ্ন
কতোটা কাঙাল হলে,
ছুটা আমার হবে তুমি।
কতোটা আকাশ হলে,
ঘুড়িটা উড়ে যাবে নিরবধি।
কতোটা জোয়ার, ভাটায় পড়লে,
আমরা হবো শোকপাখি।
কতোটা ভাটায়-জোয়ার আসলে,
তুমি আমি মাখামাখি।
কতোটা আর বাকি আছে পথ,
যতোটা দিয়েছি পাড়ি।
কতোটা তুমি কতোটা আমি,
যোগফল কেউ না জানি।
কবিতা ভাবনা
কবির দেখা আর লেখার যে রসময় রহস্যময় সংমিশ্রণ, সেটাই হলো কবিতা।
কবিতা কোনো ঐশ্বরিক বিষয় নয় – যদিও বেশির ভাগ কবিই কবিতাকে নাযিল হওয়ার বিষয় বলে থাকেন। আবার কবিতা লেখা সহজ কাজও নয়। একজন কবি লেখেন, এজন্য তাকে পরিশ্রম করতে হয়। কোনো কোনো কবি শব্দের পর শব্দ বসিয়ে কবিতায় দারুন পরিশ্রম করে। পরিশেষে, পাঠক তাঁদের কবিতাকে দূর্বোধ্য তকমা দেন। কিন্তু আমার কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন – আমার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে বা ঘটে? আমি আগে দেখি, তারপর লিখি। সাহিত্যে যাকে বলে কল্পনা। একজন কবি তাকে বহু বিস্তারিত করতে চান। আমিও এর বাইরে নই। ওই যে প্রথমেই বলেছি, আমি দেখি তারপর লিখি। এই দেখা আর লেখার যে রসময়-রহস্যময় সংমিশ্রণ, সেটাই হলো কবিতা।
আবার, কবিতা আমার কাছে সংস্কৃতির একটা বিরাট অংশও বটে। পাঠক মাত্রই জানেন যে, যাঁরা কবিতা লেখেন, একটি বিষয়ে তাঁরা সচেতন, সেটা হলো- মিলটা কোথায়। সংস্কৃতির নানান বিষয়ের সাথে মিল খোঁজেন তাঁরা। এই মিল খোঁজার প্রভাব কবিতার উপর যেমন পড়ে, তেমনি সংস্কৃতির উপরো পড়ে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, সংস্কৃতির সাথে কবিতার আবার মিল কোথায়? আমি বলি – সংস্কৃতির কোথায় কবিতা নেই? একজন মা যখন মাটির উনুনে ভাত রান্না করেন, তখন সেখানে কবিতা থাকে। কৃষকের ফসল ফলানোতে কবিতা থাকে। জেলেরা গহীন সমুদ্রে মাছ ধরে, সেখানেও কবিতা থাকে। একজন বোন যখন ঘর গোছান, একজন মানুষ যখন সুন্দর করে চিন্তা করেন, সেখানেও কবিতা আছে। কেউ যখন একটা সিনেমা দেখেন সেখানেও কবিতা থাকে। ইরানি চলচ্চিত্রকার “আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমায় তো কবিতা থই থই করে। যে মানুষ কবিতাকে প্রাধান্য দেয় না, তার জীবনেও কবিতা আছে।
অনেক দিন আগে আমাকে একজন প্রশ্ন করেছিলেন যে, কী এমন আছে কবিতার মধ্যে যে কারণে বারবার কবিতার কাছে ফেরে মানুষ? উত্তরটা আমি এভাবে দিয়েছিলাম- শিক্ষণীয় বলে মানুষ কবিতার কাছে ফেরে, বারবার ফেরে। কবিতা ছন্দ দেয়, গন্ধ দেয়, প্রেম দেয়। সত্যি বলতে কী, কবিতা মানুষকে চলতে শেখায়। সব সময়ই মানুষকে কিছু না কিছু শিক্ষা দেয় কবিতা। আমি আমার কবিতায় এ বিষয়টিই ধরে রাখতে চেষ্টা করি এবং কতোটুকু পেরেছি আমার পাঠকই ভালো জানেন।
কবিতার কাছে মানুষ বারবার ফেরে, এর আরেকটা বড়ো কারণ হলো – বলার বাইরেও মানুষের অনেক কথা থাকে। হয়তো দেখা যায়, যে কথা একজন বলতে চেয়েছিলো কিন্তু কোনো কারণে বলতে পারেনি – সেই কথাই কোনো কবি বলেছেন তাঁর কবিতায়। এজন্যই মানুষ কবিতার কাছে ফেরে, বারবার ফেরে। মানুষ সমুদ্রের কাছে যায়, পাহাড়ের কাছে যায়, জঙ্গলেও যায়। সরাসরি কি কিছু পায়? একই ভাবে কবিতার কাছে যায় মানুষ পরোক্ষভাবে কিছু পাওয়ার লোভে; ওই পাওয়াটাই হলো শিক্ষা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার মতোন কোনো প্রচলিত শিক্ষা নয়।
এজন্যই একজন কবিকে ভাষাটা ও ভাষার ভেতরের বোধটা উত্তমরূপে জানতে হয়। ভাষা ও মানুষের জীবন-ঘনিষ্ট সম্পর্ক না জানলে মানুষের যাপিত জীবনটাকে কবিতা বানিয়ে, কবিতার ভেতরটা পাঠকের সামনে উন্মোচিত হবে কী করে? হবে না তো!
সৈয়দ এনামুল তাজ