সব ধরনের মানবীয় উপলব্দির কিংবা ঘনিষ্ট সম্পর্কের নিশ্চয়তা ধারণ করে ভাষা। যে কোনো মানবগোষ্ঠীর সাধারণ প্রবনতাকে বিশেষ সংঘের আওতায় আনার কোনো পথই খোলা থাকে না ভাষা ছাড়া। ধর্ম, আইন, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিকতা, সমাজিক-প্রথা প্রভৃতি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে যদি ঐ মানবগোষ্ঠীর ভাষাাই না থাকে। তাই বলা যায় ভাষা হলো জাতীয়তাবাদের প্রাণশক্তি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ এই প্রাণ শক্তিতেই উজ্জীবিত হয়েছিল। তাই ঐতিহাসিকেরা বলেন, বাহান্ন থেকেই বাঙালি স্বাধীনতার বীজমন্ত্র গ্রহণ করেছিল। মাতৃভাষা রক্ষার দাবীতে ১৯৫২ সালে পৃথিবীতে প্রথম যে জাতি রক্ত দেয় তারা বাংলাদেশের বাঙালি। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পর তারাই প্রথম উপলব্দি করে ভাষা হলো জীবনের এক বিশেষ আশীর্বাদ। এই উপলব্দিবোধের জন্য তারা জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বের হয়ে এসেছিলো মিছিলে। শহিদ হন রফিক, শফিক, বরকত, সালাম, জব্বার, অহিউল্লাহ। পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয় এক মহান নজির, ভাষা-প্রেমের নজির। সেদিন তারা লড়াই করেছিল উর্দু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
১৯৬১ সালের মে মাসে হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জীবন দিয়েছিল আসামের বাঙালি ভাষা প্রেমীরা। এইদিন শীলচর রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের জমায়েতে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন এগারো জন ভাষা প্রেমী। এরা হলেন, হিতেন বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, তরনী দেবনাথ, চন্ডিচরণ সূত্রধর, কানাই নিয়োগী, কুমারী কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র শীল, সুনীল সরকার, সুকুমার পুরকায়স্থ, ও কুমুদ দাস। ভারত উপমহাদেশে বাঙালিই একমাত্র জাতি নয় যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে তামিল ও বিষ্ণুপ্রিয়া- মণিপুরীর মানুষ। তবে তামিলভাষীরা একেবারেই ব্যতিক্রম। তারা কমিটেড সুইসাইডাল পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানায়। তারা প্রমাণ করে ভাষার অধিক জীবন নয়। ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই তামিলদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় হিন্দি ভাষা। এর প্রতিবাদে জেলে যায় থালামুথু ও নটরাজন। জেলেই পুলিশি নির্যাতনের ফলে মৃত্যুবরণ করেন তারা। ১৯৬৩ সালে চেন্নাস্বামী নামের এক যুবক মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন তামিল ভাষা রক্ষার জন্য। কিন্তু মন্ত্রীর নির্দেশে তাঁকে বন্দি করা হয়।এই সময় যুবকটি চিৎকার করে শ্লোগান দিতে থাকে “তামিল ভালগা, হিন্দি ওলিগা” অর্থাৎ তামিল দীর্ঘজীবী হোক, হিন্দি নিপাত যাক। ১৯৬৪ সালের ২৫জানুয়ারি চেন্নাস্বামী ভাষার জন্য আত্মাহুতি দেন। ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি কোদামবাক্কাম শিবলিঙ্গম নামের এক যুবক কালো পতাকা হাতে নিয়ে রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন এবং সেখানে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহনন করেন। বীরুবাক্কাম অরঙ্গনাথন নামে এক তরুণ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে প্রতিবাদলিপি পাঠান এবং ১৯৬৫ সালের ২৭ জানুয়ারি নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেন। পিলামেডু দন্ডপাণি নামের একজন ছাত্র ভাষার জন্য বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। ১৯৬৫ সালের ফেব্রয়ারি মাসে সত্যমঙ্গলম মুথু, কেরানু মুথু ও বীরালি মালায় ভাষার জন্য শরীরে আগুন লাগিয়ে এবং বিষ পান করে আত্মহনন করেন। অয়ামপালয়ম বীরাপ্পান হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে হিন্দি বিরোধী মিছিল করেন এবং রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ভকতবৎসালম ও লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রমুখকে তামিলভাষা রক্ষার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন। ১৯৬৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঘুমের ওষুধ খেয়ে গায়ে কেরোসিন ভেজা কম্বল জড়িয়ে আগুন জ্বেলে আত্মহত্যা করেন। এভাবে ভাষা প্রেমীদের জীবনের বিনিময়ে একদিন তামিলভাষীরা অর্জন করে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার।
আজ বিশ্বজুড়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু এর মৌলিক উদ্দেশ্য কী? বর্তমানে ধনতন্ত্রের যে বিকাশ, বিশ্বায়নের নামে যে নৈরাজ্য তার প্রথম আঁচ এসে লাগছে ভাষা সংস্কৃতির শরীরে। একদা মাটি দখলের যে আকাঙ্খা ছিল আজ সেই আকাঙ্খার রূপ বদলে গেছে। এখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর বাজার দখলের জন্য উন্নত বিশ্ব কতগুলি ফর্মুলা নিয়ে হাজির হচ্ছে তাদের কাছে। যেমন-GATS(General Agreement on trade in service), IMF(International Monetary fund), MC(Multinational Corporation), SA(Structure Adjustment) ইত্যাদি। এসব প্রকল্পের নীতিসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভাষা হলো প্রধান সংযোগ স্থাপনকারী মাধ্যম।আর এই ফাঁদের বড় অনুপ্রেরণাদানকারী ব্যক্তিটি হলেন মার্শাল ম্যাকলুহান। তিনি Global Village এর কনসেপ্ট থ্রি ফোল্ড মেনুকার্ড এর ডিজাইন করেন। অনুন্নত বিশ্বের টার্গেট বাজারে প্রবেশর জন্য পুঁজিপতিরা শুরুতেই তাদের মতো করে ভাষাকে বাগে আনতে সচেষ্ট হন। শুরু হয় ভাষার আগ্রাসন – জোর করে চাপিয়ে দেবার পরিবর্তে আত্মঘাতি বটিকা সেবনে উদ্বুদ্ধকরণই এপ্রক্রিয়ার কৌশল। অর্থই যখন তাদের একমাত্র কাম্য তখন সেখানে কী করে থাকবে মানবিকতা, সুন্দরের চর্চা আর মূল্যবোধ? যান্ত্রিকতা, প্রাণহীন, শান্তিহীন ভোগের হিসেব নিকেশে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে প্রেম-ভালোবাসার মত মানুষের হৃদয়জাত যাবতীয় উপলব্দিবোধ। একটি ভাষাকে শেষ করে দিতে পারলেই শোষকের সাফল্য আর জয় হাতের মুঠোয়!
পুঁজিবাদের নিয়মে সব কিছুই পণ্য, সব কিছুই অর্থ। ফলে পুঁজিপতি কেন কাঁদবেন যদি বাঙালি, তামিল বা মণিপুরীরা ধ্বংস হয়? একদিন যে বাঙালি রুখে দিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ সেই একই বাঙালি আজ তার ভাষা সংস্কৃতির প্রতি উন্নাসিক। সে চর্চা করে বাংলা ইংলিশের জগাখিচুড়ি মিশ্রণ, চর্চা করে ইংলিশ টিউনে বাংলা বলার কৌশল! অথচ তামিলরা মনে রেখেছে তাদের রীর শহিদদের। তারা সহজে হিন্দি বলে না, ইংরেজি বলে না। তারা তাদের ভাষায় সৃষ্টি করছে কালজয়ী চলচ্চিত্র। তাদের সংস্কৃতি নিয়ে তারা গর্ব করে, তাদের প্রদেশে নিজের দেশের চ্যানেলগুলোকেও অনুমোদন দেয় না প্রবেশের! আর আমরা? কত সহজে ভুলে যাচ্ছি আমাদের অর্জন! কেন? আজও আমরা বুঝতে পাররছি না “বিভক্ত করো ও শাসন করো” এই বিভেদের রাজনীতি আমাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছ। ওটা হিন্দুর ভাষা ওটা বলা যাবে না, ওটা মুসলমানের ভাষা ওটা শোনা যাবে না। এই চর্চার করুণ পরিনতি যে আমাদের বাংলা তা তো বলাই বাহুল্য। সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষকগণ বাচ্চাদের পড়ান আঞ্চলিক ভাষায়। ফলে ইদানিং প্রমিত ভাষাবিদ্বষীদের দেখাও মিলছে ফেসবুকে। আইন করে আর যাই করা যাক প্রেম সৃষ্টি করা যায় না, বোধ সৃষ্টি করা যায় না। এর জন্য চাই শিক্ষা। উপযুক্ত জ্ঞান। সেটিও বুঝি এদেশে সুদূরপরাহত একটি বিষয়! আজ উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই; তারা মাতৃভাষার সাথে আপোষ করেন না। জার্মান, ইতালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের মানুষ ভাষার ব্যাপারে সিরিয়াস। আজ আমাদের একট একটি নৃগোষ্ঠীর ধ্বংস ঠেকাতে চাইলে ভাষা সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধার বিকল্প নেই। আমার টিকে থাকা মানে তো জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা নয়! আমার টিকে থাকা মানে বংশপরাম্পরায় আমার জাতিসত্ত্বা পরিচয় নিয়ে টিকে থাকা। তাই যে অভিপ্রায়ে রফিক, শফিক, বরকত,সালাম প্রাণ দিয়েছিলেন, যে অভিপ্রায়ে আসামের হিতেন বীরেনরা জীবন দিয়েছিলেন, যে অভিপ্রায়ে ১৯৯৬-এর মার্চ মাসে বিষ্ণুপ্রিয় মণিপুরীভাষার সুদেষ্ণা সিংহ বুলু শহিদ হয়েছিলেন সেই একই অভিপ্রায় নিয়ে আজ বিশ্ব ভাষা দিবসে সকল মানবগোষ্ঠী তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষার জন্য উজ্জীবিত হয়ে উঠুক এই কামনা করি। মাতৃভাষার জয় হোক আগ্রাসন নিপাত যাক।