বাসে বাজে বায়া

শ্যামা রহমান

কুমারখালীর হরিনাথ কাঙ্গালের লাল লাল ইটের ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস ফেলে, উঠে পরি কুষ্টিয়া যাওয়ার লোকাল বাসে। গাড়ি ছাড়ার আগ মূহুর্তে জিন্স ও মুজিবকোট পরা, গলায় গেরুয়া ওড়না পেচানো দুই মায়াময় অদ্ভুদ মানুষ উঠে পরে বাসে। একজনের হাতে একতারা, গলায় বেল্টের সাথে বাঁধা বায়া। অন্যজনের লম্বা চুল, হাতে চকচকে মিনি করতাল।

#

গাড়ি চলছে গরুর গাড়ির মত। এমন সময় লম্বা চুল দাড়ায়। বাসে দাড়িয়ে থাকা যাত্রী সাধারণের উদ্দেশ্যে বলে-

-জয় গুরু। ভদ্রলোকগণ। আমরা দুই ফকির লালনের গান গাই। প্রথমে আমরা গাব। এরপর আপনাদের অনুরোধে, আপনাদের ভালবাসার গান গাব। যেহেতু কুমারখালি থেকে শুরু করেছি, সেহেতু কাঙ্গাল হরিনাথ দিয়েই শুরু করচি। জয় গুরু।

একতারা টুং টাং করে, করতাল টুং টাং করে, বায়া তাল মিলায়। “হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে….”। দরদ দিয়ে গাইছে একতারা। করুণ সুরে টুং টুং করছে করতাল। গান শেষ হয়। এবার লালনের গান।

#

শুরু হয়- জাত গেল ভাই জাত গেল, একি আজব কারখানা…। আজব কারখানা শেষ হলে, শুরু হয়; এই খানে তোর বারামখানা, এই খানে তোর বারামখানা…। বারামখানা থেকে বেড়িয়ে আসে করতাল। খুক খুক করে কাশে। কাশতে কাশতে বলে-

-এবার বারামখানার অনুরোধের আসর। আপনাদের কোন ভাললাগার গান থাকলে বলবেন। এক সাদা শাড়ি পরা বৃদ্ধ হাত তোলে।

-কিছু কচ্চেন, মা জননী?
-আশা পূর্ন হল না….বাবারা গাইবা?

#

দুই ফকির গান ধরে। আশা পূর্ন হল না….। গান শোনার জন্য গাড়ির ইঞ্জিনও কান পাতে। ড্রাইভার স্টিয়ারিং হুলই-র উপর হাত রেখে তাল দেয়। দীর্ঘ রাত্রির মত বেদনা শেষ হওয়ার মত এক সময় গানও শেষ হয়।

#

-ভদ্রলোকগণ, আমরা লালনের মাজারের কাছাকাছি চলে এইচি। এবার পুরস্কারের পালা। আমাদের একতারার মধ্যে আপনাদের পুরস্কার বাউলকে দেবেন। জয় গুরু।

করতাল বাউল একতারা হাতে বারামখানার যাত্রীদের কাছে যায়। কেউ দশ-বিশ পুরস্কার দেয়। কেউ দেয় না! পালা এবার আমার। একতারা আমার দিকে বাড়িয়ে দিতেই-আমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করার চেষ্টা করছি; আর বার বার তাতের শাড়ির আচঁল দিয়ে….।

– লাগবে না, মা জননী। আমরা আপনার পুরুস্কার পেয়ে গেছি।
-মানে?

-আমাদের একতারার মধ্যে আপনার চোখের জল পড়ছে। মা জননী, এর চে বড় পুরুস্কার আর কী হতে পারে?

#

আমি তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ ভাল করে মুছি। বুকের বাঝে বায়াটি গেয়ে ওঠে, আশা পূর্ন হল না………..!!!