বাঙালির অভিনয়-চেতনার অতি প্রাচীন আঙ্গিক যাত্রাগানের সঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) সংশ্লেষ ও সম্পর্ক ছিল পাঁচ রকমের। যাত্রাদলের পালাকার, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা হিসেবে প্রত্যক্ষ অবদানের পাশাপাশি যাত্রাপালার বিষয় হিসেবে নজরুলের জীবন ও কর্ম বিবেচিত হওয়ায় তাঁর পরোক্ষ অবদান চিহ্নিত হয়ে আছে।
নজরুলের শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ের মধ্যে। তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে, আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলা যায়, ‘বিদ্রোহী কবি’ হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক পরিবেশের প্রতিক্রিয়া বহমান ছিল। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শৈশবের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, বিশেষত লেটো-দলে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নজরুলের কবিমানস নির্মিত হয়, কালে তা বিকাশ লাভ করে।
প্রথম জীবনের ১১ বছর বয়স থেকে শুরু হয় লেটো-জীবন। ১৪ বছর (১৯১০-১৯১৩) ধরে লেটোর দলের জন্য তিনি রচনা করেছেন ১১টি পালা। লেটো প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ যাত্রাপালারই একটি জনপ্রিয় আঙ্গিক। লেটোর দলে পরিবেশিত পালার মধ্যে ‘সঙ’ এবং ‘প্রহসন’ও ছিল। নজরুল রচিত লেটো-যাত্রাপালা হলো – ১. চাষার সঙ, ২. শুকনি বধ, ৩. মেঘনাদ বধ, ৪. আকবর বাদশাহ, ৫. রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, ৬. দাতাকর্ণ, ৭. কবি কালিদাস, ৮. বিদ্যাভুতুম, ৯. রাজপুত্রের সঙ, ১০. ঠগপুরের সঙ, ১১. বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো, ১২. সতী, ১৩. হরিদাসী মেথরানী প্রভৃতি। যাত্রাধর্মী এই লোক-অভিনয়কলার পালাকার হিসেবে নজরুলের অবদান জানা গেলেও সকল লেটো-পালার পূর্ণাঙ্গ লেখ্যরূপ খুঁজে পাওয়া যায় না।
সমপ্রতি কিছু পালা খুঁজে পাওয়া গেছে, যা নজরুলের রচনা বলে অনুমান করা হচ্ছে। লেটো-যাত্রার শুরু হয় সখীদের আসর-বন্দনার মাধ্যমে। তারপর ‘বাই’ নাচ। এই ‘বাই’ নাচের গানও লিখেছেন কাজী নজরুল। এই গান একাধিক লেটো-পালায় গীত হয়। এই শ্রেণির একটি গান বর্ধমান এলাকা থেকে উদ্ধার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতি-গবেষক মহম্মদ আয়ুব হোসেন। গানটি এমন:
সে কেন আমারে মজাইল সই।
আমি যে তার বিয়ে করা বৌ যে না হই।
আমি লো সই পর নারী
আমি থাকি পরের বাড়ি
বাঁশির সুরে সে কে ডাকে মোরে সই।
লেটো-শিল্পীদের বরাত দিয়ে গবেষক জানিয়েছেন যে, এটি নজরুলের বয়ঃসন্ধিকালের রচনা।১ এছাড়া আসর-বন্দনার পরে বিচিত্র সাজের পুরুষের একক কণ্ঠের ধুয়াগানও নজরুল রচনা করেছিলেন। লেটো-শিল্পীদের ধারণা – ‘আমি করবো না আর বিয়ে’ গানটি নজরুলের।২ নজরুল যে অসংখ্য লেটো-পালা রচনা করেছেন – তা নিয়ে দ্বিমত নেই। সমপ্রতি ‘হরিদাসী মেথরানী’ নামের একটি প্রায়-পূর্ণাঙ্গ পালা উদ্ধার করা হয়েছে। মহম্মদ আয়ুব হোসেন মনে করেন, এটি নজরুলের লেটো-জীবনের শেষের দিকের রচনা। এটি বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার কেতুগ্রাম থানার খাসপুর গ্রামের প্রবীণ লেটো-শিল্পী কাজী আবদুস সুকুরের কণ্ঠ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। পালাটি এতদিন মুখে-মুখে প্রচলিত ছিল।৩ প্রায় ২১ পৃষ্ঠা দীর্ঘ পালায় ৯টি একক গান এবং ১টি হাস্যাত্মক ডুয়েট গান রয়েছে। প্রধান লেটো-শিল্পীদের বরাত দিয়ে মুহম্মদ আয়ুব হোসেন জানিয়েছেন যে, ‘বৌ-এর বিয়ে’, ‘আজব বিয়ে’ এবং ‘জেলে-জেলেনী’ পালাও কাজী নজরুল ইসলামের রচনা। কিন্তু এ বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়ার উপায় নেই।
গ্রামীণ লোকনাট্যের পাশাপাশি নজরুল আধুনিক যাত্রাপালার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। স্বদেশী যাত্রার রূপকার চারণ কবি মুকুন্দ দাসের যাত্রাপালায় নজরুল একাধারে গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। মুকুন্দ দাসের ‘পল্লীসেবা’ (রচনাকাল ১৯২৫) যাত্রাপালায় নজরুলের ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’ এবং ‘ঘোর ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর’ গান ব্যবüত হয়। প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের দেয়া তথ্য থেকে অনুপম হায়াৎ (জ. ১৯৫০) জানিয়েছেন:
‘মুকুন্দ দাস তাঁর যাত্রামঞ্চে নজরুলকে বিপ্লবী গান গাওয়ারও আমন্ত্রণ জানান। নজরুল সে আমন্ত্রণ রক্ষা করে কলকাতার কেয়া বাজারের বারোয়ারি তলায় যাত্রামঞ্চে আবির্ভূত হন মুকুন্দ দাসের মতো গেরুয়া রঙের জামা-পাগড়ী পরে। সেদিন বিপুল দর্শকের উপস্হিতিতে যাত্রামঞ্চে নজরুল উপস্হিত হয়ে, গান গেয়ে যে উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিলেন তা বর্ণনাতীত বলে প্রত্যক্ষদশর্ীরা লিখেছেন।৪
মুকুন্দ দাসের বিখ্যাত যাত্রাপালা ‘মাতৃপূজা’ ১৯০৫ সালে রচিত হলেও এটি তিনি আমৃত্যু পরিবেশন করে গেছেন। এ পালায় উদ্দীপনামূলক বেশ কিছু গান ছিল। শেষদিকে তিনি নজরুলের গানও এই পালায় সংযোজন করেন। নাট্যকার মন্মথ রায়ের (১৮৯৯-১৯৮৮) ‘মহুয়া’ নাটক ১৯২৯ সালে কলকাতার মনোমোহন থিয়েটারে অভিনীত হয়। এই নাটকে নজরুলের লেখা ১৬টি গান স্হান পায়।৫ ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র কাহিনী-নির্ভর ‘মহুয়া’ নাটকটি থিয়েটারি মঞ্চ ছেড়ে যাত্রামঞ্চেও ছড়িয়ে পড়েছে। পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে’র (১৯০৭-১৯৭৬) ‘মহুয়া’ যাত্রাপালায়ও নজরুলের গান ব্যবüত হয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত ‘মহুয়া’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘বেদের মেয়ে মহুয়া’, ‘মহুয়া সুন্দরী’ প্রভৃতি যাত্রাপালায়ও ‘কে দিল খোঁপাতে ধুতরা ফুল লো’, ‘বউ কথা কও, বউ কথা কও’, ‘মহুয়া গাছে ফুটিছে ফুল’, ‘কোথা চাঁদ ও আমার’ প্রভৃতি গান পরিবেশিত হয়ে চলেছে।
শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের (১৮৯২-১৯৬১) নাটক ‘সিরাজউদ্দৌলা’ এদেশের যাত্রামঞ্চের একটি জনপ্রিয় পালা। ‘পথ হারা পাখী কেঁদে ফিরে একা’, ‘নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে’ প্রভৃতি গান এ যাত্রায় বেশ জনপ্রিয়। গানগুলো নজরুলের। যাত্রামঞ্চে ‘লাইলী মজনু’ পালায় নজরুলের ‘লায়লী তোমার এসেছে ফিরিয়া’ গানটি অপরিহার্যরূপে ব্যবüত হয়ে আসছে।
যাত্রাপালায় নজরুলের পরোক্ষ অবদান রয়েছে বিষয়রূপে। পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে’র ‘বিদ্রোহী নজরুল’ পালাটি ১৯৭৮ সালে গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হলেও এটি রচিত হয় ১৯৭৪ সালে। নব আম্বিকা নাট্য কোম্পানিতে অভিনীত এই পালা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। মৌসুমের শেষদিকে কলকাতার রবীন্দ্রকাননের যাত্রা-উৎসবে আসরস্হ হলে কবি মোহিতলাল মজুমদারকে (১৮৮৮-১৯৫২) হেয় করা হয়েছে – এমন অভিযোগ উত্থাপন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর শিশিরকুমার দে, মোহিতলাল-পুত্র অধ্যাপক মনসিজ মজুমদার, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ প্রমুখ বুদ্ধিজীবী। আনন্দবাজার পত্রিকায় চিঠি লিখে পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে’র বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়। ‘বিদ্রোহী নজরুল’ পালার পক্ষে সাংবাদিক প্রবোধবন্ধু অধিকারীর একটি চিঠি ছাপা হয়।
পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে লিখিত তিনটি পত্রের একটিও ছাপা হয় নি। আলেখ্য পত্রিকায় লেখা দ্বিজেন্দ্রলাল নাথের বক্তব্যের প্রতিবাদও করেছিলেন ব্রজেন্দ্রকুমার – সেটিও ছাপা হয় নি। ব্রজেন্দ্রকুমার ‘বিদ্রোহী নজরুল’ লিখে শুধু সংবাদপত্রের মাধ্যমে আক্রমণের শিকার-ই হন নি, মোহিতলাল-পুত্র মনসিজ মজুমদারের দায়ের করা মামলার আসামীও হয়েছিলেন। মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্রজেন্দ্রকুমার যে বক্তব্য প্রস্তুত করেন – আদালতে তা উত্থাপন করার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ এবং ২২ মার্চ ১৯৭৫ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় ডক্টর অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রকুমার দে লিখেছিলেন:
‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত ‘যাত্রায় মোহিতলাল’ শীর্ষক পত্রপাঠ করে বিস্মিত হয়েছি। পত্রলেখক অরুণ মুখোপাধ্যায় মোহিতলাল চরিত্র, যা মৎ রচিত ‘বিদ্রোহী নজরুল’ পালার অন্তর্গত, সম্পর্কে কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছেন। মোহিতলালের মুখে তিনি ‘আমি মোহিতলাল মজুমদার বিএ’ ঐ পালায় কবি মোহিতলাল একবারই বলেছেন, যখন তিনি তাঁর ‘আমি’ প্রবন্ধ পাঠ কচ্ছিলেন। প্রবন্ধটি তো ‘মানসী’ পত্রিকাতে ঐভাবেই মুদ্রিত হয়েছিল।’৬
ব্রজেন্দ্রকুমার প্রতিটি অভিযোগেরই জবাব প্রস্তুত করেছিলেন এবং তথ্যপ্রমাণ-যোগে অভিযোগগুলি খণ্ডন করে তিনি লিখেছেন:
এই ‘বিদ্রোহী নজরুল’ পালা প্রসঙ্গে কিছু অধ্যাপক আমার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছেন। ডা. অরুণ মুখোপাধ্যায়, ডা. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশির দে, মনসিজ মজুমদার, দ্বিজেন্দ্রনাথ, ডা. ভবতোষ দত্ত এঁদের অগ্রগণ্য। আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যেকেই যে অভিযোগ তুলেছেন, তা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। নামকরা অধ্যাপকেরা যদি এমন হন, তাহলে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়া বোধহয় সম্ভব নয়।’৭
পালাটি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকাহিনী-নির্ভর হলেও মোহিতলাল চরিত্রের কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়। এ পালায় আরো কিছু উজ্জ্বল চরিত্র হলো শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, খান মুহম্মদ মঈনউদ্দিন, মুজফফর আহমদ, আলী আকবর খান, আব্বাসউদ্দিন, প্রমীলা ও নার্গিস। যাত্রায় নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্যেই হয়ত পালাকার নজরুল-জীবনীর প্রকৃত তথ্য থেকে কিছুটা সরেও এসেছেন। যেমন নন্দিতা ভট্টাচার্য লিখেছেন:
মোহিতলালের সঙ্গে নজরুলের ১৯২৪ সালের পরে কোন সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায় না। কিন্তু পালাসম্রাটের পালায় দেখা যায় মোহিতলাল নজরুলের দারিদ্র্যে ব্যথিত হয়ে তাঁর গান রেকর্ড করতে চাইছেন, প্রমীলাকে গোপনে করেছেন অর্থসাহায্য। আবার নজরুলের অসুখ সারানোর জন্য নিয়ে আসছেন মাদুলী।
নজরুল-নার্গিস বিয়ে সম্পর্কে নানা মতভেদ রয়েছে। বিয়ের রাতে নজরুলের পালিয়ে আসার কাহিনীও রয়ে গেছে রহস্যময়। এ বিষয়টি পালাসম্রাট এঁকেছেন এভাবে:
নজরুল। চিরদিন নিজের ইচ্ছেতেই আমি চলেছি।
নার্গিস। আর তা চলবে না মিঞা। নিজের ইচ্ছায় তুমি শুধু কলম চালাবে, চলবে আমার নির্দেশে। ঘর-জামাইয়ের
স্বাধীন ইচ্ছা থাকতে নেই।
নজরুল। কে ঘর-জামাই?
নার্গিস। কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুল। কে বলেছে?
নার্গিস। এই দলিল বলেছে। পড়।
নজরুল। [দলিল দেখিয়া] বুঝেছি, বনের পাখীকে পিঞ্জরে বাঁধবার জন্যে তোমরা মামা-ভাগ্নী মিলে ফাঁদ পেতেছিলে।
নার্গিস। তুমি এমন কিছু লোভনীয় চিড়িয়া নও যে তোমার জন্যে আমি ফাঁদ পেতে বসে থাকব। সাদী করে তুমি আমায় অনুগ্রহ করনি, অনুগ্রহ করেছি আমি তোমার মতো কপর্দকহীন, নিষ্কর্মা অমানুষকে বরণ করে।
নজরুল। নার্গিস!
নার্গিস। আগে যদি জানতুম, তোমার চালচুলো কিছুই নেই, তাহলে মামার কথায় তোমার মতো মাকাল ফলকে আমি
মাথায় তুলে নিতুম না।
নজরুল। বিবাহ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, মাকাল ফলকে এখনো ছুঁড়ে ফেলতে পারো।
নার্গিস। বংশের সম্ভ্রমে বাধে, নইলে – থাক।
বিদ্রোহী নজরুল গ্রন্হটি ইতিহাস কিংবা প্রামাণ্য জীবনী নয়, তাই হয়ত ইতিহাসের সত্য সর্বত্র ধারণ করে নি। এটি যেহেতু অভিনয়ের উদ্দেশ্যে রচিত, তাই দর্শক-শ্রোতাদের কাছে রসঘন ও উপভোগ্য করে তোলার দিকেই পালাসম্রাটের মনোযোগ ছিল পুরোপুরি। সহানুভূতির দিক দিয়ে বিবেচনা করলে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, নজরুলের জীবন-বীক্ষার কোনো বিকৃত প্রকাশ নেই।
নজরুলের বিদ্রোহী হয়ে ওঠা, এবং কারা-নির্যাতন ভোগের বীররসের আখ্যান গড়ে উঠলেও বুলবুলের মৃত্যু এবং নজরুলের বাকহীনতার করুণ রসের মাধ্যমে যাত্রাপালার সমাপ্তি টানা হয়েছে। এ পালার মাধ্যমে মানুষ নজরুলকে জানতে পারে, নজরুলের দ্রোহ-প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হতে পারে আবার তাঁর করুণ পরিণতি দেখে বেদনায় আর্দ্র হতে পারে। এভাবে নজরুলকে গ্রামে-গঞ্জের অশিক্ষিত নিরক্ষর তথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে ব্রজেন্দ্রকুমার দে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখলেন। বিদ্রোহী নজরুল যাত্রাপালা হিসেবে সফল এবং প্রভাবসঞ্চারী। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই – বাংলাদেশের একাধিক যাত্রাদল এই পালা এখনো আড়ম্বরের সঙ্গে আসরস্হ করে চলছে।
* ড. তপন বাগচী: কবি-প্রাবন্ধিক-ফোকলোরবিদ; উপপরিচালক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
১. মহম্মদ আয়ুব হোসেন, ‘গ্রামীণ লোকনাট্য : লেটো’; সনৎকুমার মিত্র (সম্পা.) বাঙলা গ্রামীণ
কনাটক, লোকসংস্কৃতি গবেষণা পরিষদ, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ৮৯