(গত কিস্তির পর)
অধ্যায় : ৫
১৯৭০-এর নির্বাচনী ফলাফলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নাখোশ হয় ফলে ইয়াহিয়া-ভুট্টো নানারকম ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে। ২০ ডিসেম্বর এক ঘোষণায় ভুট্টো বলেন, “তার দলের সমর্থন ছাড়া কোনো সংবিধান প্রণয়ন করা বা সরকার গঠন করা যাবে না। জাতীয় রাজনীতির ব্যাপারে একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সবকিছু নয়।”
এভাবে ‘ইয়াহিয়া-ভুট্টো ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১-এর ১ মার্চ জাতীয় অধিবেশন স্হগিত ঘোষণার মাধ্যমে।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে ১ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে ক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন, ষড়যন্ত্রকারীদের সুবুদ্ধি ফিরে না এলে ইতিহাস তার আপন গতিতে চলবে। তিনি ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালনের ঘোষণা দেন।
তিনি ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্তৃক আয়োজিত জনসভায় লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা করেন। এ পটভূমিতেই রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন ৭ মার্চ যা সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নামে খ্যাত।
১৮ মিনিটের এই ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়। এ ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর এই অনানুষ্ঠানিকভাবে দেয়া ঘোষণাই জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙক্ষাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ফলে ২৬ মার্চের হান্নান সাহেবের কিংবা ২৭ মার্চে মেজর জিয়ার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর নামে পঠিত হলেও ৭ই মার্চের ঘোষণাটিই বাঙালি হৃদয়ে গেঁথে রেখেছিলো। আর তাই লোককবিরা বার বার গেয়ে ওঠেন-
‘শেখের ডাকে সারা দিয়্যা
মুক্তিযুদ্ধে গেনু…’
‘বাংলা’ নামক নৌকার মাঝি বঙ্গবন্ধু…
লোককবি কিন্তু সে কথাটি ভোলেন না-
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৌকার মাঝি হইল-
মুজিবের নৌকাখানি বাংলার বুকে ভাসিল।
তাই দেইখা ইয়াহিয়া খান যুদ্ধের ডিকলার দিল।’
‘৭ই মার্চের ভাষণ’ লোককবির কবিতায় যেভাবে বর্ণিত হতে দেখি তা পাঠ করলে পরিষ্কার হওয়া যায় যে সেই সময় বাঙালির চেতনার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা সমর্থক হয়ে গিয়েছিলো।
লোককবি দারোগ আলীর কবিতায় ৭ মার্চকে দেখি-
“বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলে সবাকারে।
শুন যত বঙ্গবাসী বলি তোমাদেরে।
খানের দলে মোদের সাথে করছে টালবাহানা।
জনগণের অধিকার সহজে দিবে না।
অসহযোগ আন্দোলন কর আজ হইতে।
দেখিব ক্ষমতায় কিসে থাকে মাওরা জাতে।
আমি যাহা বলি তাহা মানিবে তাবৎ।
মাওরা গোষ্ঠী তাড়াইতে করহ শপথ।।
খাজনা টেক্স যত আছে কিছু নাহি দিবে।
মিলের শ্রমিক কেহ কাজে নাহি যাবে।
দেশের যত চাকুরিয়া চাকরি ছেড়ে দাও।
খানের দলের বিরুদ্ধে সব রুখিয়া দাঁড়াও।।
স্কুল কলেজ যত আছে সব বন্ধ দিয়া।
সবে মিলে যাও তোমরা সংগ্রাম করিয়া।
বাংলাদেশে আছে যত শহর গেরাম
এক সমানে চালাও সবে জোরেতে সংগ্রাম।।
এবারের সংগ্রাম জেনো মুক্তির সংগ্রাম।
স্বাধীন করিব এবার বাংলা তামাম।।
আরও বলি শুন সবে রাখিবেক মনে।
আমি যদি নাহি থাকি তোমাদের সনে।
তবে না ডরিবে কেহ পশ্চিমার ভয়ে।
হাতের কাছে যাহা পাও দাঁড়াবে তা লয়ে।
আজ হতে সমানে সংগ্রাম চালাও।
জয় বাংলা বলিয়া জাতির নিশান উড়াও।।
এত শুনি শপথ করে ছাত্র নেতাগণ
নূরে আলম সিদ্দিক আর কুদ্দছ মাখন।।
জয় ধ্বনি করে সবে যত লোকজন।
জয় বাংলা জয় বাংলা বলে কাঁপাবে গগন।।
স্বাধীন বাংলা বলে মজিব করিল ঘোষণা।
আল্লাতালা পুরাইবে মনের বাসনা।।
বঙ্গবাসী এক তালেতে চালাইল সংগ্রাম
শহর বন্দর বাজার বস্তি গেরাম।।’
লোককবির রচনায় ৭ই মার্চের যে বর্ণনা তাতে এটি পরিষ্কার যে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জন সাধারণ তাঁর ঐতিহাসিক এই ভাষণেই স্বাধীনতার যথার্থ আহ্বান টের পায়। এজন্যই লোক কবিরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার কথা বার বার উল্লেখ করেন।
এভাবে-
‘বঙ্গবন্ধুর ডাক পড়েছে শুনরে পাতি কান।
জয় বাংলা জয় বাংলা বলে উড়াও হে নিশান।।”
আর এক লোককবি আজিজুল হক তাঁর কবিতায় বলেন-
’৭১-এ শেখ মুজিব দিল বজ্রসাড়া
বাঙালিরা হইয়া উজ্জীব যুদ্ধে নামলো তারা।’
কিংবা–
‘মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়া বাঙালির সন্তান
মুক্তি ফৌজ হইল যাইয়া হিন্দুস্তান।’
অথবা–
‘স্বাধীনতার দাবি দিয়া শেখ মুজিবুর রহমান
তোদের করে বন্দি হইয়া সইল নির্যাতন।’
অতএব বলা যায় বাঙালির স্বাধীনতার অনিবার্য ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু লোককবির কাছে সমাদৃত হয়েছেন তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণের জন্যই। সেই ভাষণে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা না দিয়েও তিনি সমগ্র বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তির চূড়ান্ত সংগ্রামে। যে কারণে সাধারণ মানুষকে বলতে শুনি-
‘শেখের ডাকে সাড়া দিয়্যা
মুক্তিযুদ্ধে গেনু।’
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে-জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সর্বা্তক অসহযোগিতার নির্দেশ দিয়ে কোর্ট-কাচারি, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় জনগণের ট্যাক্স বা খাজনায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন-যে পর্যন্ত এদেশের মুক্তি না হচ্ছে ততদিন খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো।’ এভাবে তিনি তাঁর বক্তব্যে একজন সমাজপতির ভূমিকা পালন করেন। লোককবি তাই বলেন-
‘শেখ মুজিব আছে সজীব আছে সৈনিকগণ
শয়তান বেইমান হবে ধ্বংস জাগলো আন্দোলন।’
কিংবা–
‘মুজিব হলেন সল্লাহ পোরধান।’
মানুষের অধিকারের জন্য বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ ইতিহাসের বিরল এক ঘটনায় রূপান্তরিত হয়েছিলো কেবল এজন্যই নয় যে তিনি একজন সমাজবিজ্ঞানী, কিংবা দার্শনিক বা একজন জননেতা। বরং এ ভাষণটিতে রয়েছে বাংলার সাধারণ মানুষের üদয়স্পর্শী আকাঙক্ষার কথা যা তাদের ভাষায় তাদের üদয়তন্ত্রী স্পর্শ করতে পেরেছিলো। ফলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল শত সহস্র üদয়ের অগ্নিশিখা। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তাই আর ‘দাবায়ে’ রাখা গেল না।
ফোকলোরের যে কোনো উপকরণে একটি জাতির অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙক্ষা যেভাবে রূপায়িত হতে পারে তা আর কিছুতেই সম্ভব নয়। ফলে একটি বিশেষ জাতির চেতনাকে সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে তার গৌরব বৃদ্ধির চেষ্টাও লোককবিগণ করেন। লোককবির ভাষায় আমরা সেই চেতনাকে ছড়িয়ে যেতে দেখি অগ্নি শিখার মতো। মুক্তি সংগ্রামে বাঙালির ব্যাপক প্রেরণা যুগিয়েছে যে ৭ই মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধু জোরালো ভাষায় পাঠ করলেন যে কবিতা, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিলো লোকজীবনের সুর ও শব্দ যা বাঙালির ক্রন্দনকে স্পর্শ করে ‘জয় বাংলা’ শব্দে মুখর হয়ে উঠেছিলো। আর বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন ঐতিহাসিক শ্রমিক হারকিউলিস, প্রমিথিউস, টাইটন, মিকুলা সেলিয়া নিনোভিস-এর মতো প্রতিবাদ মুখর অবিস্মরণীয় লোকবীর।
লোককবিদের রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গানে কবিতায় বঙ্গবন্ধু পেয়েছেন লোকবীরের মর্যাদা যাতে বাঙালির জাতীয়তাবোধ শক্তিশালীরূপে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো এবং সেই শক্তিতেই অর্জিত হয়েছিলো আমাদের এক লক্ষ সাত চল্লিশ হাজার পাঁচশ সত্তর বর্গকিলোমিটারের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’।
‘বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা রাজনীতি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য পরিচালিত হয়নি, হয়েছে গণ-মানুষের জন্য।’
তাঁর ভাষণে তাই গণ-মানুষের আকাঙক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছিলো গণ-মানুষের কথায়, শব্দ ও সুরে। এটি একটি মন্ত্র ছিলো-যে মন্ত্র উচ্চারণ করে তিনি সারে সাত কোটি মানুষের শাপমোচন করে দিতে পেরেছিলেন। মন্ত্র একটি ঐন্দ্রজালিক শক্তি যা প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিহিত থাকে।
এর মধ্যে থাকে জাদু শক্তি যা ছড়া বা পদ্যের আঙ্গিকে রচিত। মন্ত্রের মধ্যে মন্ত্রাচারীর আকাঙক্ষাও থাকে-যে আকাঙক্ষাকে কেন্দ্র করে মন্ত্রচারী তাঁর অলৌকিক শক্তির কাছে আবেদন বা অনুরোধ জানান। ইচ্ছে সফল না হলে বা ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা থাকলে দেবতাকেই দেন হুমকি। একে Challenge বলে। ৭ই মার্চের ভাষণ তেমন একটি মন্ত্র যার মধ্যে নিহিত ছিল অসম্ভব জাদু শক্তি।
৭ই মার্চের মন্ত্রটির মন্ত্রচারী হলেন বঙ্গবন্ধু যার একান্ত অভিলাষ বা আকাঙক্ষা হলো-“আমার দেশের মানুষের অধিকার চাই।” এই আকাঙক্ষা বাস্তবায়নের জন্য তিনি কোর্ট-কাচারিসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর কাছে তাঁর দাবি ছিলো-“যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।”
কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তা না করে এসেম্বলির নামে টালবাহানা করতে থাকে এবং বারবার কথার বরখেলাপ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর আকাঙক্ষা ব্যর্থ হতে পারে এই ভয়ে তিনি অর্থাৎ মন্ত্রচারী ওঝা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকদের হুমকি দেন-“আমরা ভাতে মারব। পানিতে মারব।…রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিব এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।”
আমরা জানি লোকসংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য উপকরণ মন্ত্র। আর মন্ত্রের মধ্যে থাকে চারটি উপাদান-সূচনা(Introduction), বিবরণ(description), প্রার্থনা(Prayer) ও দোহাই (Challenge)। ৭ই মার্চের ভাষণেও এই চারটি অংশ লক্ষ করা যায়। সূচনা পর্বে-“ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।”
এরপর বর্ণনা অংশে-ঘটনাটির বর্ণনা আমরা লক্ষ করি। প্রার্থনা অংশে বঙ্গবন্ধু বলছেন-‘এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন-মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যাকরা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’
এরপর দোহাই বা Challenge অংশ-এখানে দুটি রীতি আছে যা ওঝারা করে থাকেন। প্রথম রীতিতে দৈব শক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় আর অপর রীতিতে সেই দৈব শক্তিকে উপেক্ষা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যেটিকে আমি মন্ত্রশক্তির আঁধার বলছি সেখানে সর্বশেষ অংশে অনুসৃত হয়েছে উপেক্ষার রীতি। সেখানে হুমকি দেয়া হয়েছে। হুমকিতে কাজ না হলে রক্ত দিয়ে দেশ মুক্তির প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা হয়েছে শেষ পর্যন্ত। মন্ত্রবেত্তা শেষে এসে যে রকম ধুয়া দেন তেমনি বঙ্গবন্ধুও উচ্চারণ করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’, ‘এবারের সংগ্রাম ধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ এটি একটি ধ্বংসা্তক মন্ত্রের নমুনা যে মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে। লোককবি গেয়ে ওঠেন-
‘ঊনিশ’শ একাত্তর সনে ষোল ডিসেম্বর
আসলো মোদের স্বাধীনতা মুছলো মন্বন্তর।
রক্ত গেল ইজ্জত গেল পাইলাম স্বাধীন দেশখানিরে
ওরে দারুণ পাকিস্তানী।’
৭ই মার্চের ভাষণ ঐন্দ্রজালিক শক্তিসম্পন্ন মন্ত্র হিসেবে বিবেচিত তার আর একটি কারণ এর লোকশব্দের ব্যবহার।
মন্ত্র মাত্রই Folk লোকসংস্কৃতির সকল ভাষিক উপাদানের ভেতরই লোক শব্দের উপস্হিতি অনিবার্য যা এক ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তিতে প্রেরণযোগ্য মনের সকল প্রবণাতাকে দ্রুত চালিত করতে পারে।
বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৭ই মার্চের ভাষণে সেই প্রবণতা লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে লোক বিজ্ঞানী ড. শামসুজ্জামান খান বলেন-
“বঙ্গবন্ধু তাঁর আপসহীনতা ও চারিত্রিক দার্ঢ্যের পরিচয় মুদ্রিত করেছেন লৌকিক ভাবভঙ্গির বিশিষ্ট বুলির সংযোজন। প্রাকৃত জনের ব্যবহৃত এই সব মণিমুক্তা সদৃশ কিছু শব্দ বাঙালির ব্যবহারিক জীবন থেকে নেয়া। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর শিকড় সম্পৃক্ত বুলি সমৃদ্ধ এরকম একটি লাইন হল: “সাড়ে সাত কোটি মানুষেরে দাবায়ে রাখতে পারবানা। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবানা।”
‘লোকভাষা অর্থাৎ Folk LanguageÕ কোনো বিশেষ অঞ্চলের উপ-ভাষা নয়। ‘নাগরিক ভাষার সঙ্গে…বিরোধে যে ভাষা গ্রাম্য বলে চিহ্নিত হতে পারে তাই লোকভাষা।’
পবিত্র সরকার বলেন-“…অনেকে মনে করেছেন গ্রামীণ অঞ্চল বিশেষের উপ-ভাষাই লোকভাষা। তা হওয়া উচিত নয়। ভাষায় সাধারণভাবে গ্রামীণতার যে লক্ষণগুলোকে শহরের লোক আলাদা করে চিহ্নিত করে সেগুলোই লোকভাষা বা গ্রাম্য ভাষার নির্ণায়ক।”
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি লোকসমাজে আদৃত হয়ে ওঠার পেছনে লোকভাষা বা গ্রাম্য ভাষার প্রভাব রয়েছে। ভাষণটি তাই বাংলার সকল শ্রেণির মানুষের কাছে সমানভাবে গৃহীত হয়েছে মুক্তির দলিল রূপে।
* নিচে ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে লোকভাষার কতগুলো উদাহরণ নির্দেশ করা হল :
ক. আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না
খ. আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।
গ. তোমাদের উপরকার কাছে আমার অনুরোধ রইল। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
ঘ. তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।
ঙ. সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।
চ. ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে।
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে আমরা যে সব শব্দ সনাক্ত করেছি সেই সব শব্দ শহরে বা নাগরিক ভাষায় ব্যবহার কম। এসব শব্দ গ্রাম্য ভাষার বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত।
আবার এই গ্রাম্য শব্দগুলো একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষের স্বাভাবিক ভাষায় ব্যবহৃত হয়। ‘বঙ্গবন্ধু’ ভাষণে যেসব গ্রাম্য শব্দ ব্যবহার করেছেন তা মূলত বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের অধিবাসীদের আঞ্চলিক উপ-ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ। বঙ্গবন্ধু জন্মের পর তাঁর শৈশব-কৈশরে বেড়ে ওঠার যে পরিবেশ তা বরিশাল-খুলনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সংযোগ স্হলে অবস্হিত। ফলে তাঁর মধ্যে ফরিদপুর-বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের কিছু শব্দের সমন্বয় থাকা অস্বাভাবিক নয়।
যেমন-ফরিদপুর-বরিশালে দেবার নেবার শব্দগুলো বিশেষ প্রচলিত, খুলনায়, সোজাসুজি, পড়া দিয়ে, শব্দ বিশেষ পরিচিত।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যে আঞ্চলিক শব্দ সনাক্ত করা যায় তার আধিক্যানুযায়ী এটাকে ফরিদপুর-গোপালগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে সনাক্ত করতে চেয়ে কবি পরিতোষ হালদার বলেন-‘স্বাধীনতার ভাষা আমাদের গোপালগঞ্জের ভাষা’ আঞ্চলিক শব্দের আধিক্য ও টোনাল’ বৈচিত্র্যের বিশিষ্টতা এই ভাষণটিকে দিয়েছে বিশেষ মর্যাদা।
তবে ভাষা বিজ্ঞানের সংজ্ঞানুযায়ী-ভাষণটিতে যে আঞ্চলিক শব্দের আধিক্য আমরা লক্ষ করি তাকে ফরিদপুর বা বরিশালের উপ-ভাষা বলা যায় না। বরং ফরিদপুর তথা গোপালগঞ্জের লোকদের আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহৃত এই শব্দগুলো শিক্ষিত ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাগরিক ভাষায় আশ্রয় লাভ করে গ্রাম্য ভাষা বা Substandard ভাষারূপে সনাক্ত হয়েছে।
এ ভাষণে গোপালগঞ্জ অঞ্চলের উপ-ভাষার যে প্রাধান্য তা পুরোপুরি আঞ্চলিকতাকে ছাড়িয়ে পুরোপুরি মান্য ভাষার অন্তর্গত না হয়ে একটি বিশেষ মাত্রায় গৃহীত হয়েছে। ফলে এটি সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা হিসেবে, সমগ্র বাঙালির কাছে আদরণীয় হয়ে উঠেছে।
(চলবে)
[সম্পূর্ণ বইটি পেতে যোগাযোগ করুন : রোদেলা প্রকাশনী
যোগাযোগ: ০১৭১১৭৮৯১২৫। মূল্য: ২৫০টাকা।]