বড় দিনের তুষার ঝরা রাতে

মঈনুস সুলতান

রেমন্ড জুনিয়র কিছুতেই তার গাড়ি স্টার্ট করতে পারেন না। তিনি তীব্র তুষারপাতের ভেতর গাড়ির হুড তুলে ইঞ্জিন ফিক্স করার চেষ্টা করেন। আমি হীম শীতল আবহাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে তাকে টর্চের আলো দেখাই। তার পঞ্চাশের মডেলের রঙচটা ক্রাইসলার গাড়িটি আকারে দীর্ঘ, আয়তনে প্রশস্তও বটে, তবে তা বয়সের ভারে জরাজীর্ণ। তার ইঞ্জিন কেন জানি আজ একেবারে ডেড সাইলেন্ট হয়ে আছে। কিছুতেই রেসপন্স করছে না।

আজ পচিশে ডিসেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের আমহাস্ট শহরে বড় দিনের উৎসব চলছে। পরবের রাত বলে চারদিকে সুনসান নিরবতা। দু’বছর পর এবার এসেছে আকাঙখিত তুষারময় হোয়াইট ক্রিসমাস্‌। সারা চরাচর জুড়ে শ্বেত কপোতের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন পালকের মতো ঝরছে তুষার। পার্কিংলটে যে হালতে বরফ জমেছে তাতে আরো ঘন্টা কয়েকের মধ্যে হাঁটু অব্দি ডুবে যাবে। এখন রাত সাড়ে বারোটার কাছাকাছি। ব্রুক এপার্টমেন্ট কমপে­ক্সের পরিবারগুলো চার্চের ঈভিনিং সার্ভিস শেষ করে ফিরে এসেছে বাসায়। তাদের জানালায় ক্রিসমাস লাইটগুলো জ্বলছে। অনেকে হয়তো এখন ক্রিসমাস ট্রি’র পাশে বসে সুগারি ওয়ালনাট কুকির সাথে ডিকাফ কফি খাচ্ছে। কেউ বা কাল দুপুরে বড়দিনের ভোজের আগে পরিবেশন করার জন্য তৈরী করছে এগনক বলে একটি মাইল্ড ড্রিংকস্‌। কোন কোন হাউসওয়াইফ বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ার পর শেষবারের মতো ক্রিসমাস ট্রি’র পাশে সাজিয়ে রাখছে গিফ্‌টের সোনালি রূপালি রিবণ জড়ানো প্যাকেটগুলো। পাকিংলটে কোন গাড়ি স্টার্ট নেয়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। বরফ ঝড়ের জন্য আজ রাতে কেউ আর বাইরে যাবে বলে মনে হয় না।

রেমন্ড জুনিওরের ক্রাইসলার গাড়িটি আর স্টার্ট নিলো না। তিনি অনেক দূর থেকে ঘন্টা খানেক ড্রাইভ করে ব্রুকস এপার্টমেন্ট কমপে­ক্সে এসেছেন। পাবলিক ট্রান্সপোটেশনের বাসগুলোর চলাচল রাত বারোটার দিকে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বসবাস করেন বাস রুট থেকে মাইল খানেক দূরে। আমার নিজের কোন গাড়ি নেই যে তাকে লিফ্‌ট দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেবো। ঠিক বুঝতে পারি না-জুনিওর আজ ফিরবেন কিভাবে? তিনি আমাকে শীতের রাতে কনকনে তুষারপাতের মাঝে পার্কিংলটে দাঁড়িয়ে থেকে টর্চের আলো দেখানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘তোমার এপার্টম্যান্ট থেকে ট্যাক্সি কোম্পানিকে টেলিফোন করতে পারি কি?’

আমার এক কামরার এপার্টম্যান্টে এসে তিনি ডাইরেক্টরী দেখে নানা জায়গায় টেলিফোন করেন। ক্রিসমাস উপলক্ষে হলিডে চলছে, আমহার্স্ট শহরের ট্যাক্সি সার্ভিসগুলো রাতের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ তার টেলিফোন তুলে না। আমার এপার্টম্যন্টে গেস্টের জন্য কোন স্পেশ্‌ বা খাট ফানিচারও নেই। জুনিওর নিকটবর্তী বড় শহর সপ্রিংফিল্ডের ট্যাক্সি কোম্পানিগুলোকে ফোন করতে শুরু করেন।

আমি কফি মেকারে জল চাপিয়ে দিয়ে ভাবি-বেচারা রেমন্ড জুনিওরের ক্রিসমাস সেলিব্রেশনের রাতটা কি মাটি করলাম? আজ রাতে আমিই তাকে টেলিফোন করে ব্রুকস এপার্টমেন্ট কমপে­ক্সে ডেকে এনেছি। তবে নিজের প্রয়োজনে নয়, তার সহায়তার জরুরি দরকার পড়েছিল আমার পাশের এপার্টম্যান্টের এল সালভেদর থেকে সদ্য আগত নতুন অভিবাসিদের।

এল সাদভেদরের তিন বাচ্চার এ পরিবার মাত্র মাস দেড়েক হয় আমহার্স্ট শহরে এসেছে। হিস্পানিক এ ফ্যামিলি স্প্যানিশ ভিন্ন অন্য কোন ভাষায় কথা বলতে পারে না। এ শহরের কোথায় কি ফ্যাসিলিটি আছে তাও তারা অবগত নয়। ক্রিসমাসের রাতে খুব সুন্দর জামা কাপড় পরে তারা চার্চের ঈভিনিং সার্ভিসে গিয়েছিল। রাত নটার দিকে এপার্টমেন্টে ফিরে এসে দেখে যে- কিভাবে যেন তারা লকআইট হয়ে গেছে। মনে হয় বড়দিনের উৎসবের এক্সাইটমেন্টে ভুল করে চাবি ভেতরে রেখে দরোজা লক করে তারা চার্চের সার্ভিসে গিয়েছিল। পরিবারের কর্তা ভদ্রলোক সার্ভিসের পর রিসেপশন থেকে বিস্তর ওয়াইন কিংবা পান্স পান করে এসেছেন। তিনি ঠিক মনেও করতে পারেন না, কোথায় তাদের ঘরের ডুপ্লি­কেট চাবিটি আছে।

বেচারারা তিনটি ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে তুষারপাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। টেম্পারেচার ফ্রিজিং পয়েন্টের নিচে। আমি তাদের ডেকে আমার এপান্টমেন্টে তুলি। আমার ঘরে পুরো একটি ফ্যামিলিকে শেল্টার দেয়ার মতো স্পেশ নেই। বাচ্চারা তাদের ঘরে ঢুকতে না পারলে ক্রিসমাস ট্রির পাশে রাখা গিফ্‌টগুলোর মুড়োক খুলতে পারবে না বলে কান্নাকাটি শুরু করে। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য শীতে ঠিরঠিরিয়ে কাঁপছে। তাদের মা বুকে এুশ চিহ্ন এঁকে আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকান।  যিশাশ ক্রাইস্ট! এতো মহা মুশকিলে পড়া গেল।

খানিক ভেবেচিনে্ত আমি পুলিশকে ফোন করি। ক্রিসমাসের রাতে কোন লকস্মিতকে ডেকে তালা ভাঙ্গা বা ডুপ্লি­কেট চাবি তৈরী করানো যে যাবে না সেটা আমিও যেমন জানি, তেমনি মফস্বল শহরের পুলিশও সমান ভাবে অবগত। তারা আমাকে মিনিট পনেরো পরে আবার টেলিফোনে ফলোআপ করতে বলে। আমি দ্বিতীয়বার রিং করতেই তারা আমাকে রেমন্ড জুনিওরের নম্বর দিয়ে তাকে ফোন করতে বলে।

পেশায় রেমন্ড জুনিওর লকস্মিত না। মাঝ বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ এ আফ্রিকান-আমেরিকান ভদ্রলোক ছোটখাট একটি কোম্পানিতে একাউন্টটেন্টের কাজ করেন। তালা খোলার কলাকৌশল নাকি তার জানা আছে। ক্রিসমাসের রাতে অনেক পরিবারেই লকআউটের সমস্যা হয়। রেমন্ড জুনিওর তাদের বিনা মূল্যে সার্ভিস দিয়ে থাকেন। আমার টেলিফোন পেয়ে তিনি ঘন্টা খানেকের মধ্যে তার পুরানো ক্রাইসলার চালিয়ে চলে আসেন। মিনিট পনেরো মধ্যে খুলে দেন আমার এল সালভেদরীওন প্রতিবেশীদের দরোজা।

রেমন্ড আমাকে ‘মেরী ক্রিসমাস’ বলে অবশেষে সুখবর দেন। সপ্রিংফিল্ডের এক ট্যাক্সি কোম্পানি রাজি হয়েছে গাড়ি পাঠাতে। তবে ড্রাইভারকে জাগিয়ে তুলে এ বরফ ঝড়ের রাতে ব্রুক এপার্টমেন্টে ট্যাক্সি পাঠাতে ঘন্টা দুয়েক লেগে যেতে পারে।

আমি ফায়ার প্লে­সের আগুন উস্কে দিয়ে তার হাতে কফির পেয়ালা ধরিয়ে দেই।  তিনি চারদিকে তাকিয়ে ঘরে ক্রিসমাসের আয়োজন নেই দেখে বিষ্মিত হন। আমার পরিবারের সাথে খৃষ্টীয় ঐতিহ্যের কোন যোগসূত্র নেই জানালে তিনি সাদা দাঁতে হেসে বলেন, ‘বাট টু নাইট ইউ আর সেলিব্রেটিং ক্রিসমাস উইথ মি।’ বলে তিনি দিলখোলা হেসে পরিবেশে হাল্কা করেন।

মাঝরাতে কাঁচাপাকা খানিক সুঁচালো চুলের কালো মানুষটির সঙ্গ আমার ভালোই লাগে। আমি দুঃখ করে বলি,‘ স্যরি, টেলিফোনে ডেকে এনে তোমার ক্রিসমাস নাইট মাটি করলাম। তোমার ফ্যামিলি..।’ ‘ডোন্ট ওয়ারী এবাইট ইট্‌। আমার ফ্যামিলি বলতে আমি একাই। আমার রেপুটেশনের জন্য নো ওয়োম্যান ইয়েট এগ্রি টু লিভ উইথ মি।’

রেপুটেশনের বিষয়টি আমি বুঝতে না পেরে জানতে চাই, ‘রেমন্ড, তালা খোলার কাজ তুমি শিখলে কোথায়?’ জুনিওর হো হো করে হেসে বলেন,‘ ইউ আর নট্‌ এ্য ক্রিশ্চিয়ান, বাট আই এাম শিওর ইউ এক্সপেক্ট এ ক্রিশ্চিয়ান টু টেল ইউ দ্যা ট্রুথ টু নাইট?’ আমি মাথা দুলিয়ে সায় জানালে তিনি বলেন, ‘‘ওয়েল, আই ওয়াজ এ্য বার্গলার। টিনএজার হিসাবে আমার শিক্ষা বা আয় উপার্জন কিছু ছিল না। তাই তালা ভেঙ্গে অন্যদের ঘরে ঢুকে এটা সেটা হাতিয়ে তা দিয়ে জীবন যাপন করতাম।  জেলও খেটেছি বার কয়েক। পরে অবশ্য নানা গ্যাঙ্গ আমাকে রীতিমতো ফি দিয়ে ভাড়া করতো তালা ভাঙ্গার কাজে।’

‘ডু ইউ ওয়ান্ট টু হিয়ার মোর?’ আমি খানিক চিন্তা করে বলি, ‘তোমার লাইফ স্টাইল বদলালো কিভাবে, তা যদি একটু কাইন্ডিলি বলো?’ “ওয়েল, ইট ইজ্‌ বাইবেল।  জেলে এক মিনিস্টার বা পুরহিত আসতেন বাইবেল স্টাডীর ক্লাশ করাতে। মনে হলো- চাইলে আমিও নিজেকে চেঞ্জ করতে পারি। জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে একাউন্টটেন্সির কোর্সে পাশ করলাম।” ‘তা সমাজে পূর্ণবাসিত হতে তোমার সমস্যা কিছু হয় নি?’ “প্রিজনের এক জেলার হেল্প মি এ লট্‌। এ জেলারের সাথে একই চার্চের কনগ্রিগেসনে আমি উপাসনা করি। আমি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জন্য এখন কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ করি। তালা খুলতে তাদের সমস্যা হলে তারা আমাকে ডাকে। চাকুরী পেতে প্রথম দিকে খুব ঝামেলা হয়, তবে জেলার টেলিফোন করে বলে দিলে একটি ছোট্ট কোম্পানি আমাকে অবশেষে হায়ার করে।”

রেমন্ড ধুমপানের জন্য বাইরে যেতে চাইলে আমি তাকে ঘরেই স্মোক করতে বলি।  তিনি পাইপ জ্বালিয়ে বলেন, “আই এ্যাম ডুয়িং আল রাইট নাও। বাট, এ্য লিটল লোনলি। জেলে অনেক বছর কাটানোর ফলে আমার বয়সের কোন মহিলাকে ডেট্‌ করার জন্য পাই না। আর যাদের সাথে দেখা হয় তারা আমার রেপুটেশন শুনে প্রথম সাক্ষাতেই পিটটান দেয়। নট্‌ এ্য হৌল লট্‌ আই কুড্‌ ডু এবাউট দিস।”

ট্যাক্সির আসতে এখনো ঘন্টা খানেক লেট্‌ আছে। তাই আলাপ আরেকটু জমানোর জন্য বলি, ‘টেল মি এ লিটল মোর এবাউট ইয়োর বাইবেল স্টাডী এক্সপিরিয়েন্স?’ রেমন্ড পকেট থেকে ছোট্ট একটি বাইবেল বের করে বলেন,‘আই হোপ ইউ আর নট্‌ অফেনডেড্‌ ইফ আই রিড্‌ ফ্রম বাইবেল ইন্‌ ইয়োর হাউস?’ আমি তাকে উৎসাহিত করে টেবিল ল্যাম্প এগিয়ে দিলে তিনি পড়েন, “দিস্‌ থিংকস্‌ আই হ্যাভ স্পোকেন টু ইউ, সো দ্যাট্‌ ইন মি ইউ মে হ্যাভ্‌ পিস্‌। ইন দ্যা ওয়াল্ড ইউ হ্যাভ্‌ ট্রিবুলেশন, বাট্‌ টেইক ক্যারেজ; আই হ্যাভ অভারকাম দ্যা ওয়াল্ড।” (আমি তোমাকে এ বিষয়গুলো বলছি যাতে তুমি আমার মধ্যে শানি্ত খুঁজে পাও। জগৎ সংসারে দূর্যোগ ও যন্ত্রণা আছে, কিন্তু সঞ্চয় করো সাহস; আমি অতিক্রম করেছি বিশ্ব।-জন:৩৩)

রেমন্ড একটু পজ্‌ নিয়ে বলেন, “নিউ টেস্টামেন্টের কিং জেইমস্‌ ভার্সনে ট্রিবুলেশন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বার কয়েক। এ শব্দের যে তর্জমা আমার মনে আসে তা হচ্ছে- দূর্যোগপূর্ণ সময় ও যন্ত্রণা। যন্ত্রণা আমার মনে জমা ছিল। আমি সাহস করে নিজেকে বদলালাম। এবং এতে ফায়দা হলো যে- আমি তাঁর মধ্যে খুঁজে পেয়েছি শানি্ত। দ্যাটস্‌ অল।”

সপ্রিংফিল্ডের ট্যাক্সি কোম্পানি থেকে ফোন আসে। তারা দুঃখ প্রকাশ করে বলে যে- এত রাতে তারা কোন ড্রাইভারকে পাচ্ছে না। কেউ রাজি হচ্ছে না বরফ ভেঙ্গে রেমন্ড জুনিওরকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার। আমি কম্বল বের করে তাকে আমার কাউচে শুয়ে বাকি রাত কাটিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করি। তিনি হেসে বলেন, ‘মেরি ক্রিসমাস, ইউ সি, ইটস্‌ লডস্‌ উইশ দ্যাট্‌ আই সেলিব্রেট ক্রিসমাস নাইট্‌ উইথ ইউ।’