লোকসংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক ইতিহাস । [১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ খ্রি.]

রঞ্জনা বিশ্বাস

(গত কিস্তির পর)
অধ্যায় : ৩

প্রচলিত ইতিহাস বলতে যা বুঝায় তার শুরু প্রামাণিক ঘটনা থেকে। জনকাহিনি, লোকছড়া, লোকগান ইত্যাদি বিষয়ের মধ্যে ইতিহাস চর্চার যে মূল্যবান উপাদান ছড়িয়ে আছে তা প্রমাণের জন্য প্রচলিত প্রামাণিক ঘটনা থেকে শুরু করতে হবে। জনপ্রবাহের যে আবেগ তা লোকসংস্কৃতি যতটা সমৃদ্ধ করেছে ততটাই প্রচলিত ইতিহাসের ধারা ও ধারণাকে সুললিত ও সমৃদ্ধ করতে সক্ষম।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বার’শ মাইল১ ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিভক্ত দুটি পৃথক অঞ্চল পূর্ব-বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান। সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পূর্ব-বাংলায় বসবাস করলেও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের চূড়ান্ত ক্ষমতায় আসীন ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী যারা কোনোদিন পূর্ব-বাংলাকে তাদের দেশের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি। স্বাধীনতা লাভের পরপরই পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্না ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে বলেন, ‘But let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language.’ অর্থাৎ উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অন্য কোনো ভাষা নয়। তিনি আরো বলেন ‘And one who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan:’। এর আগে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু তা কণ্ঠ ভোটে নাকচ হয়ে যায়। ৪ এর পরপরই জিন্নার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষণ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬.৪০ ভাগ মানুষ ছিলো বাংলা ভাষী, অন্যদিকে শতকরা ৩.২৭ ভাগ ছিলো উর্দু ভাষী। ৫ এ পরিস্হিতিতে বাঙালির আশা-আকাঙক্ষা বিপর্যস্ত হয়। বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ব বাংলায় ইংরেজির স্হলে বাংলাকে সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব করলে তা কিছু সংশোধনীর পর পাস করা হয়। এ কারণে ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় ঘোষণা দেন-
‘পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।
এ ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট পালন করে এবং ৪, ১১ ও ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করে
ফলে ২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে পূর্ব-বাংলার সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে।
কিন্তু ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে এলে পুলিশ সেই মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় আবুল বরকত, রফিক, জাব্বার, আব্দুস সালাম, শফিউর, আহিউল্লাহসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ২২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে জনগণের দাবির নিকট সরকার নতি স্বীকার করে শাসন তন্ত্রে সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
একটি জাতির তথা সমাজের ভাষা সংস্কৃতিতে আঘাত করার যে হীন ও ঘৃণ্য স্পৃহা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী লালন করেছে তা বাঙালি নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। যে কাজটি করতে ১৯৪৬-এ আবুল হাশিম, ১৯৪৭-এ গণ আজাদী লীগ, ‘তমদ্দুন মজলিস : বার বার ব্যর্থ হয়েছে সেই কাজটি সমগ্র বাঙালি তাদের প্রাণের বিনিময়ে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রচলিত ইতিহাসে যাদের নাম লেখা নেই তারা গানে গানে ছড়িয়ে দিয়েছেন হদয়ের আবেগ। এমন একটি আলকাপ গানে সাধারণ মানুষের আবেগমাখা ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে এইভাবে-
‘আইউব খানের মার্শাল’ল
ইবলিশ বরাবর
৫২’র ভাষা আন্দোলন
জিন্নার গায়ে জ্বর।

ভাষা আন্দোলনের ভয়ে ভীত জিন্নার গায়ের জ্বর, ইবলিশ আইউবখানের মার্শাল’ল উপেক্ষা করে বাঙালিরা নেমে পড়ে রাজপথে। আন্দোলনকারীদের হুঙ্কারে ভীত হয়ে যান জিন্না, ভয়ে তার গায়ে জ্বর উঠে যায়, প্রেসার বাড়ে।
‘এসেম্বলিতে ধীরেন দত্ত
দিলেন এক ভাষণ
বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা
তাই বাঙালির পণ।
রাজপথ ফেটে পড়ে
মিছিলের ডাক,
ছাত্র নেতা আঁকে
বাংলা বর্ণের ছক।
নূরুল আমিন গুলি চালায়
মিছিলের’পরে
সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত
শহীদের কাতারে।

একটি জাতির মাতৃভাষা ধ্বংস হলে সে জাতির অস্তিত্ব যে বিপন্ন হয় তা গ্রাম-বাংলার দশম শ্রেণি পড়ুয়া লোককবিও
বুঝেছিলেন-বুঝিয়েছিলেন।
‘কোনো রাষ্ট্রে শুনিনারে ভাই এমন গণ্ডগোল।
জিন্না সাহেব প্রেসিডেন্ট হয়ে এদেশে দালালি করে
বাংলা ভাষা ধ্বংস করে উর্দু ভাষা করল মূল।
কোনো রাষ্ট্রে শুনি না রে ভাই এমন গণ্ডগোল।
শেখ মুজিব প্রতিবাদ করে স্হান পেল কারাগারে
ছাত্র দলে উদ্ধার করতে তারে হইয়াছে আকুল।
কোনো রাষ্ট্রে শুনি না রে ভাই এমন গণ্ডগোল।
ভাবিয়া হাসান বলে কইব কথা কোন কৌশলে
অধিক কিছু বলতে গেলে জেলখানা মোর হবে কুল।
কোন (অ.) রাষ্ট্রে শুনি না রে ভাই এমন গণ্ডগোল।

লোকসংস্কৃতিতে যে মৌখিক ঐতিহ্য ও উপাত্ত আছে তা কোনো ইতিহাসবিদের ধারালো যুক্তির চেয়ে কোনো অংশে কম যৌক্তিক নয়। বাঙালি জাতিকে একটি নিজস্ব ভূখণ্ড বা রাষ্ট্রগঠনের চেতনার দিকে ধাবিত করেছিলো ভাষা আন্দোলনের সাফল্য। এই তাত্ত্বিক বক্তব্যও আমরা লোককবির গানে দেখতে পাই-
‘একুশ শুধু দেয়নি ভাষা
স্বাধীনতার চেতনা,
একুশ মোদের বল্যা দিল
যুদ্ধ করার বুদ্ধি হলো
বাড়লো মোদের সাধনা।
পেলাম আমরা বাংলাদেশ
সব সহ্য বুকে পিঠে।
হে নানা বলব কেমনে হে
বলতে যে বুক ফাটে।
শহীদ হল বরকত ছালাম
কত জেলে মুটে।

মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য-
মানুষের জৈবিক অস্তিত্ব বর্জন করলে বাকি যা থাকে তা সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির একটি হলো বস্তুগত সংস্কৃতি। এর অন্তর্গত যে সব বিষয় নৃবিজ্ঞানে আলোচিত হয় তার মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্হান ইত্যাদি। আর মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা তার বস্তুগত সংস্কৃতিকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। বাঙালির যে সমাজব্যবস্হা তা কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল অর্থাৎ বাঙালি সমাজ কৃষিজীবী সমাজ কিন্তু সমাজ যে ধরনের হোক না কেন তাতে তিন ধরনের মূল অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ক্রিয়াশীল থাকে।
১. উৎপাদন (Production)
২. বণ্টন (Distiribution)
৩. ভোগ (Consumption)।
একটি সমাজে উৎপাদন ব্যবস্হাকে কেন্দ্র করে সামাজিক সম্পর্কের জাল তৈরি হয়। সেই সামাজিক সম্পর্কের জালটি সমাজব্যবস্হাকে গতিশীল রাখে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সমাজের স্বাভাবিক সম্পর্কের জালটি ছিন্ন করে ফেলে বিস্তার করে বৈষম্যের জাল।
পূর্ব-বাংলা ও পশ্চিম-পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এ দুই অঞ্চলের খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের পার্থক্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পূর্ব-বাংলায় প্রতি মণ গমের মূল্য নির্ধারিত ছিলো ৩৫ টাকা আর পশ্চিম-পাকিস্তানে ছিলো ১০টাকা। পূর্ব-বাংলায় প্রতি মণ চালের দাম ধার্য করা হয়ে ছিলো ৫০ টাকা আর পশ্চিম- পাকিস্তানে ১৮ টাকা।
বস্ত্রের জন্য কাঁচামাল পূর্ব-বাংলায় পর্যাপ্ত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পূর্ব-বাংলায় কোনো বস্ত্রকল স্হাপন করে নি। তারা পশ্চিম-পাকিস্তানে ৭টি বস্ত্রকল স্হাপন করে। এ ছাড়া কাপড়ের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা পূর্ব-বাংলায় জমজমাট ব্যবসা করে।
পূর্ব-বাংলা ভৌগোলিকভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের অঞ্চল হিসেবে গণ্য। এখানে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জনগণ গৃহহীন হয়ে পড়লেও পশ্চিম-পাকিস্তানের গৃহ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় মোট বাজেটের ৮৮% এবং পূর্ব-বাংলার জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ১২%।
এছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে, চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ করা যায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে পূর্ব-বাংলাকে নিজ দেশ বলে কখনই মেনে নেয় নি তা তারা অর্থনৈতিক কার্যকলাপেই প্রমাণ করেছে। শিল্পকারখানা স্হাপন, বার্ষিক বাজেট, আমদানি-রপ্তানি, চাকরি ও নিয়োগ সকল ক্ষেত্রে তারা নজিরবিহীন বৈষম্যের জাল বিস্তার করে ছিলো। পশ্চিমাদের এই শোষণের বিরুদ্ধে তাই জেগে উঠেছিলো এদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। বরেন্দ্র অঞ্চলে আলকাপগানে তাই বর্ণিত হয় পশ্চিমাদের সেই বৈষম্য ও শোষণের ইতিহাস-
‘ভোলা তুই
পালারে ভাই পালা
আল্লা তোকে সুমতি দিক
ছেড়ে যারে বাংলা।
তোর শাসন শোষণে হামরা
হইনু জর জর,
ধর্মের দোহাই পেড়ে দাগো
শোষণ হাতিয়ার।
হামার দ্যাশের পণ্য দিয়া
সোনা চান্দি আনো
পশ্চিম পাকিস্তানে সোনা
বসে বসে গোনো।
হামরা হইনু ষাট জন
তোমরা চল্লিশ
ভাগের দরে তোমরা আশি
হামরা দশ-বিশ।
তোমরা দ্যাশের কর্মকর্তা
আমরা চাকর-নফর
হামার দ্যাশের পাট-চামড়া-চা
হামার নাই খবর।

বুদ্ধিজীবীদের দেয় তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সারাদেশে যে প্রচার চালায়, জনগণকে তাদের বৈষম্য তুলে ধরার প্রয়াস পায় সেই তথ্য উপাত্তের চেয়ে লোককবির‘বৈষম্যের বর্ণনা কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব-বাংলার কৃষিজীবী জনগণ যে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিলো তা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, স্বৈরাচারী আচরণ নির্মূলের জন্য ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে গঠন হয় যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালে পূর্ব-বাংলার জনগণ ২১ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায় এবং যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। ইতিহাসের এই প্রসঙ্গটিও লোককবি দেওয়ান ফরিদউদ্দিন হায়দারের রচনায় বড় হৃদয়গ্রাহীভাবে বর্ণিত হয়েছে, এ ভাবে-

‘ফজলুল হক সাব জিন্দাবাদ, শেরে বাংলা জিন্দাবাদ
যা করেছ বাঙালাতে সবই তোমার ধন্যবাদ।
মজলুম গরিব তরে, বিলায়েছ আপনারে
তাই মোর মুক্ত কণ্ঠে জানাই তোমায় আশির্বাদ।
মুসলেম দরদি তুমি, নত শিরে তোমায় নামি
জালেম শাহী বিনাশিলে করে তুমি প্রতিবাদ।
প্রজাস্বত্ব আইন করে বাঁচায়েছ গরিবেরে
দীর্ঘজীবী হও তুমি, এই গো মোদের ফরিয়াদ।
সভাগঠন করে, একুশ দফা ওয়াদারে
পালন কর একে একে, নইলে হবে পরমাদ।
আমাদের এই মিনতি, হক-আতা-ভাসানীর প্রতি
নিজ হাতে খুইদো গো নূরুল আমিনের খাদ।

লোককবির ইতিহাস চেতনা পর্যবেক্ষণ করলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে এই মৌখিক ঐতিহ্য কার কাছে ঋণী? লিখিত ইতিহাসের কাছে? নাকি লিখিত ইতিহাসই ঋণী মৌখিক ইতিহাসের কাছে?
চারণকবি রোকন উদ্দিন-এর ছেলে ডা. সাইফুল ইসলাম শাহীন তার বই ‘তখন চুয়ান্ন’তে জানান-চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় নির্বাচনী প্রচারণার সময় গোপালগঞ্জের জনসভায়-রোকনউদ্দিনের লেখা গান গাইতো চান মিয়া। বঙ্গবন্ধু রোকনউদ্দিনকে দেখলেই জানতে চাইতেন-গানটান কিছু লেখছোস?
কোটালীপাড়ার কুশলা খেলার মাঠে ’৫৪-এর জনসভা রোকনউদ্দিনের লেখা গান দিয়ে শুরু হয়। গান গায় লোকশিল্পী চানমিয়া।
‘হারে ও জালিম মুসলিম লীগ বেপারী
তুমি সোনার তরী ছেড়ে যাও
মুখে কালি লয়ে যাও বাড়ি।
তোমাকে সঁপিয়া তরী হলেম সর্বহারা
তুমি পুঁজিপাট্টা সব খোয়াইয়া
দাঁড় বৈঠা পাল সব হারাইয়া ভাইসা
গুড়া নায়ের চূড়া ফুটা করলি তরী।’

এভাবে গোপালগঞ্জ সদর কোর্ট ময়দান এর জনসভা, ঘাঘরবাজার, বালিয়াভাঙ্গা, কুরপালাসহ বিভিন্ন স্হানে জনসভায় মুসলিম লীগের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে লোকগানে। একইসঙ্গে নৌকা ও মুজিবে ভরসা রাখার কথাও বর্ণিত হয়েছে গানের কাহিনিতে।
১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে রোকনউদ্দিন-এর লেখা গানগুলোই লোকসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক প্রথম গান।

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারণায় লোকগান:

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে গোপালগঞ্জে আয়োজিত সব নির্বাচনী প্রচারণায় রোকনউদ্দিন-এর গান গাইতেন এ.কে.এম চাঁদ মিয়া (চাঁন মিয়া)। ‘বঙ্গবন্ধু’ গানগুলো দ্বারা এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগকে তিনি নির্দেশ দেন চারণ কবি রোকনউদ্দিনের বই ছাপানোর জন্য। গোপালগঞ্জের গোপাল ডাক্তারের পপুলার প্রেস থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ছাপা হয় ১৬ পৃষ্ঠার বা এক ফর্মার গানের বই। এই বইটি নির্বাচনী প্রচারপত্র হিসেবে প্রতিটি সভায় বিতরণ করা হয় বলে উল্লেখ করেন রোকনউদ্দিনের ছেলে ও ‘তখন চুয়ান্ন’ বই-এর লেখক ডা. শেখ সাইফুল ইসলাম শাহীন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রকাশিত বইটির কভার পেজ ছিল নিম্নরূপ-

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ১৯৫৪ ইং সাল
কথা-শেখ মুজিবুর রহমান, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।
গানের রূপ ও সুর : পল্লী কবি রোকনউদ্দিন, সাং-পবনারপাড়,
পোঃ কুশলা, থানা+কোটালীপাড়া. মহকুমা-গোপালগঞ্জ, জেলা : ফরিদপুর।
কণ্ঠ : চাঁদ মিয়া, পবনার পাড়, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ।
প্রচারে : গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগ।
মূল্য : ২৫ পয়সা
সৌজন্যে : ‘তখন চুয়ান্ন’-ডা. সাইফুল ইসলাম শাহীন।]

মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে লিখন পদ্ধতি বা পুঁথিগত শিক্ষার আবিষ্কার খুব বেশি দিনের ঘটনা নয়। এর সমস্ত সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক উপাদানের মানদণ্ড ছিলো অলিখিত মৌখিক ঐতিহ্যের মধ্যে। সেই ঐতিহ্যের কাছে তাই লিখিত ও পুঁথিগত ঐতিহ্য ব্যাপকভাবে ঋণী।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় এই কথাটি প্রযোজ্য ও প্রণিধানযোগ্য মনে হলেও লোকঐতিহ্যের মৌখিক উপাদান যেমন লোকছড়া, লোকগান, লোকগল্প বিশ্লেষণ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয় নি। এ নিয়ে গড়ে উঠতে পারে সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ সম্ভার। তাও খুব একটা নজরে আসে না। অথচ লোককবিদের মৌখিক ইতিহাস ও ঐ ঐতিহ্যে, মুক্তিযুদ্ধের দিকে বাঙালির ধারাবাহিক অভিযাত্রার যে বর্ণনা তা যে-কোনো গবেষকের কাছে বিস্ময়ের বিষয়।
নূরুল আমিনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সমাপ্ত হবার পর শুরু হয় খাজা নাজিমুদ্দিনের শাসন ও শোষণ। তামাক ও সুপারি বাগানেরও ট্যাক্স, অনুমতি ছাড়া পাট চাষে নিষেধাজ্ঞার মতো ঘটনা লোককবি দেওয়ান ফরিদ উদ্দিন হায়দারের বর্ণনায় উঠে এসেছে।

‘ট্যাক্সের কথা কইব কত, দুনিয়ার ট্যাক্স যত
ট্যাক্স ছাড়া কিছু নাই, আমরা যত খাই দাই।
সুপারির ট্যাক্স ধরে, না দিলে ওরেন্ট করে
তামাকের ট্যাক্স ভাই না দিলে তো নিস্তার নাই।

এ রকম বৈষম্য, শাসকগোষ্ঠীর হৃদয়হীন আচরণ পাকিস্তানের ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করে। পূর্ব-বাংলার জনগণ তীব্র রোষে ফেটে পড়লে ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮-এর আগস্ট পর্যন্ত পূর্ব-বাংলার মন্ত্রিসভায় ৭ বার ও গভর্নর পদে ৩ বার রদবদল হয়। ১৯৫৮ সালের বাজেট পেশ করাকে কেন্দ্র করে মন্ত্রিসভায় মোট ৪ বার রদবদল হয়। প্রশাসনিক এই দুর্বলতার কারণে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়। দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। তিনি প্রেসিডেন্সি ক্ষমতা বলে নিজেই শাসনতন্ত্র রচনা করেন।
এ শাসনতন্ত্র বালিতের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ১৫ মার্চ ধর্মঘট পালন করে এবং ২৪ মার্চ থেকে ছাত্ররা নতুন শাসনতন্ত্র বাতিল, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সকল রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেয়।
শেষ পর্যন্ত ছাত্র-আন্দোলন সামরিক সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিতে সমর্থ হয় এবং সামরিক সরকার ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য হয়। এদিকে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের বিরূপ ফলাফলের মধ্য দিয়ে পূর্ব-বাংলা লাভ করে এক নতুন অভিজ্ঞতা। অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য এবং পূর্ব- বাংলার জনগণের অসহায়ত্ব ও নিরাপত্তাহীনতার কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন-‘পূর্ববঙ্গকে সর্ববিষয়ে, স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে।’
এ লক্ষ্যে তিনি উত্থাপন করেন ছয়-দফা কর্মসূচি। ১৯৬৬ সালে লাহোরের এক কনভেশনে শেখ মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ছয়-দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। ছয়-দফার সমর্থনে তিনি কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ একটি পুস্তিকা বের করেন এবং গ্রাম থেকে গ্রামে প্রচারের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ছয়-দফা কর্মসূচি প্রচারকালে ১৯৬৬ সালের মে মাসে পাক-সরকার শেখ মুজিবসহ আরো অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। ছয়-দফা বাস্তবায়ন ও নেতা-কর্মীদের মুক্তির জন্য ৭ জুন সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। আন্দোলন স্তিমিত করতে পাক-সরকার প্রায় সাড়ে নয় হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। ছয়-দফা কর্মসূচি বানচাল করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নামে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয়। এজন্য তিনি ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কারা ভোগ করেন। অবশেষে তাকে পূর্ববর্তী মামলাগুলো থেকে মুক্তি দেয়া হলেও ১৭ তারিখ মুক্তির দিনে কারাগারের দরজায় আবার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দায়ে গ্রেফতার করা হয়। এ দিকে পূর্ব-বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব গ্রেফতারের ঘটনায় পূর্ব-বাংলার জনগণ শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনে আসাদুজ্জামান নামে এক ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হলে গণ-আন্দোলন দ্রুত গণ-অভ্যুত্থানে রূপ লাভ করে।
পাক-বাহিনীর অত্যাচারে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সেনা হেফাজতে সার্জেন্ট জহরুল হক শাহাদাত বরণ করলে এর প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক হাজার হাজার মানুষ সান্ধ্য-আইন ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। এ সময় পাকিস্তানি মিলিটারিরা অজস্র লোককে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় আয়ুবখান পরিস্হিতি অাঁচ করতে পেরে ১৯ ফেব্রুয়ারি সান্ধ্য-আইন প্রত্যাহার করেন ও গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানান। কিন্তু পূর্ব-বাংলার ছাত্র-জনতা শেখ মুজিব ছাড়া গোলটেবিল বৈঠক করার ক্ষেত্রে অস্বীকৃতি প্রদান করে। এতে ১৭ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিলে বসার আহ্বান জানান। কিন্তু তিনি এভাবে মুক্তি নিতে অস্বীকার করেন। ফলে গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। অবশেষে পাকিস্তান সরকার গণ-অভ্যুত্থানের কাছে মাথা নত করে এবং ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মী মুক্তি লাভ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে গণ-সংবর্ধনা দেয়ার সময় জনগণের পক্ষ থেকে তোফায়েল আহমদ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদানের প্রস্তাব রাখলে লক্ষ লক্ষ জনতা করতালির মাধ্যমে তা সমর্থন করে। সেই থেকে শেখ মুজিব বাংলা ও বাঙালির সাথে বন্ধুপূর্ণ সম্পর্কের দ্বারা আ্তীয়তার সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যান।
লোককবি দারোগ আলীর বর্ণনায় ঐতিহাসিক ছয়-দফা ও বঙ্গবন্ধুর অবস্হানও প্রকাশ পেয়েছে আবেগঘন ভাষায়-
‘ধীরে ধীরে গুজারিয়া গেল তিন মাস
মাওরাদলের চিন্তা শুধু বাংলার সর্বনাশ।
মার্চ মাসের তিন তারিখে সর্দার ইয়াহিয়া।
বেতার মারফতে আবার দিল জানাইয়া।
ছয়-দফা দাবি ছাড় শেখ মজিবর।
ক্ষমতা বকসিব আমি তোমার উপর।
প্রধান উজির হও তুমি গদিনশীল হইয়া
ছয়-দফা এগার-দফা সব দিবা ছাড়িয়া।
এত শুনি বঙ্গবন্ধু বলে এহিয়ারে
এসব প্রলাপ কথা না বল আমারে।
শেখ মজিব বলে শুন মাওরাহারাম জাদা
দেশের জনগণে আমি দিয়াছি ওয়াদা।
ওয়াদার খেলাপ আমি করিতে না পারিব
দফা-দাবি-দাওয়া কভু না ছাড়িব।

মধ্যযুগীয় গীতি কবিতার ঢং-এ রচিত কবিতায় ইতিহাসের উপকরণ লোক ঐহিত্যের নিজস্ব সাঁচে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে। এভাবেই ইতিহাসের নিরস উপাদানকে লোককবির উপস্হাপনায় সরস ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে দেখি বারবার।

(চলবে)

 সম্পূর্ণ বইটি পেতে যোগাযোগ করুন : রোদেলা প্রকাশনী
যোগাযোগ: ০১৭১১৭৮৯১২৫।
মূল্য: ২৫০টাকা।