লোকসংস্কৃতিই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি

রঞ্জনা বিশ্বাস

(গত সংখ্যার পর)
অধ্যায় : ২

লোকসংস্কৃতি বা ফোকলোর হল লোকসমাজের যাবতীয় বস্তুগত ও অবস্তুগত বা মৌখিক শিল্প বা আর্ট। ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতি সেই সব উপকরণ বা ঐতিহ্যের মাধ্যমে আমাদের কাছে ধরা দেয়-মুখে মুখে, আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে। এর মধ্যে লোকসংগীত, লোককাহিনী, লোকছড়া, লোককবিতা এসব কিছুই তার ভাষা প্রতীকের মাধ্যমে বিধৃত ও প্রচলিত হয় এবং সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করে।

বাককেন্দ্রিক এই সংস্কৃতি তার সমাজের বিশ্বাস ও অনুভূতির গতিপ্রকৃতিকে যেমন ঐতিহ্যগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি প্রভাবিতও করে।

১৯৭১ সালের পাকবাহিনীর শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ও ঘৃণা তা এই বাককেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে বা Verbal art-এর মাধ্যমে মুসলিম সমাজ থেকে, হিন্দু সমাজ, খ্রিস্টান-বৌদ্ধ এবং অসংখ্য আদিবাসী সমাজকে প্রভাবিত করেছিলো। যার ফলে-ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্ত বাঙালি শেষপর্যন্ত ধর্মীয় সমাজ হিসেবে নয়, সংঘবদ্ধ হয়েছিলো বাঙালি হিসেবে, বাংলাদেশি হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিলো তা লোকসংস্কৃতির ভিত্তিতেই ঘটেছিলো।

লোকসংস্কৃতিতে জাতীয়তাবাদমূলক মতবাদের মাধ্যমে লোকবিদরা একটি দেশের ঐতিহ্য, দেশের গৌরব প্রতিষ্ঠায় তৎপর হন। ‘জাতীয়তাবাদী ফোকলোরবিদ একটি লোককাহিনি, লোকগীতিকা বা ফোকলোর এর যে কোনো উপকরণে তাঁর জাতির অনুভূতি চিন্তাভাবনা ও আশা-নিরাশা কিভাবে রূপায়িত হয়েছে সে কথা প্রমাণে একান্ত উৎসাহী।’

সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যবাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ পণ্ডিতগণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে লোকসংস্কৃতির চর্চা শুরু করার পর জানতে পারলেন যে মেহনতী মানুষের সৃষ্টিমুখী আবেদনই ফোকলোরের প্রাণ। তাদের কাহিনি, কর্মসংগীত ও গীতিকার মধ্যে গবেষকগণ শ্রেণি সংগ্রামের চেতনা খুঁজে পেলেন। খুঁজে পেলেন স্বার্থানেষী ভূস্বামীর নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা, নীচ মনোবৃত্তিসম্পন্ন যাজকের মুখোশ, অত্যাচারী জার, সৈনিকের অমানুষিকতা এবং অর্থ-পিশাচ মিলমালিকের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা।’-আর এভাবে গবেষকগণ সামাজিক, ঐতিহাসিকতা বিচারে ফোকলোর তথা লোকসংস্কৃতির অস্তিত্ব ও গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেন।

মার্কসপন্থী গবেষক ওয়াই এম. সকোলভ বলেন, ‘ফোকলোর যেমন অতীতের প্রতিধ্বনি তেমনি বর্তমানেরও কণ্ঠস্বর, ফোকলোর অতীতে এবং বর্তমানে শ্রেণি-সংগ্রামের ছায়ায় পুষ্ট এবং চিরদিন ফোকলোর শ্রেণি সংগ্রামের একটি বিশিষ্ট হাতিয়ার হিসেবে বিচার্য।’ রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ রাশিয়ায় যে চেতনা একসময় প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো তার আলোকে সেখানে ফোকলোর একটি সংগ্রাম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং এই প্রবণতাও সেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু সংগ্রাম কেবল-সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক বা বুদ্ধিজীবীর মধ্যে নয় এটি সাধারণ জনগণের যে মৌখিক ঐতিহ্য তার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই লোকঐতিহ্যের মাধ্যমে আবহমানকাল থেকে- মেহনতী মানুষ, চাষী, মজুর, মুটে, কুলি, জনতা, শাসক, শোষক ও পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

‘আই.জি. প্রিঝোভ সেকালের ফোকলোর এর মধ্যে জার, ধর্মযাজক ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের সংগ্রাম আবিষ্কার করে প্রোলেতারিয়েত সমাজের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথানত করেন। আই এ খডিয়াকোভ ঐতিহাসিক লোকসংগীতে এবং জনপ্রিয় লোককাহিনিতে শ্রেণি বিদ্বেষকেই যে কিভাবে চপল হাস্য রসিকতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার সার্থক বিশ্লেষণ পণ্ডিত সমাজে তুলে ধরলেন।’

এছাড়া কয়লাখনির শ্রমিকদের গানে, কিংবদন্তীতে এবং অন্যান্য উপকরণে মালিক ও স্বার্থবাদী মানুষদের বিরুদ্ধে কি ধরনের আক্রোশ প্রকাশ পেয়েছে তার প্রচার ও প্রকাশ করে দেন ভি.পি. বির্ষুকোভ।

সেই সময় জাতীয়তাবাদীর ঐতিহ্য অনুসন্ধী দৃষ্টিও নিবদ্ধ হয়েছিলো লোকবীরদের দিকে যাঁরা কিংবদন্তীর নায়ক হিসেবে ফোকলোরে প্রতিষ্ঠা পান-হারকিউলিস-এর মতো। কখনো কখনো ঐতিহাসিক চরিত্রও হয়ে ওঠেন লোকবীর বা লোকনায়ক। প্রচলিত ইতিহাসকে লোককবিরা নিজেদের সাঁচে ফেলে তার কাহিনিতে যে জীবনচিত্র বিধৃত করেন, জনপ্রবাহের যে চেতনার ছায়ায় তা লালিত ও পরিবর্ধিত করেন তা জাতীয় শক্তি ও ঐতিহ্যের বিপুল বিস্ময়।

১৯৭১-এ পাক-সরকারের শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলার সাধারণ জনগণ ফোকলোরকে আশ্রয় করেই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছিলো।

সেই সব লোকগান ও লোকছড়া কাহিনিতে আজো তা বিধৃত হয়ে আছে। এসব উপাদান থেকে কৃষিজীবী বাঙালি জনগণের সংগ্রামী মনোভাবেরও জোরালো দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ মেলে। যার ফলে প্রচলিত ইতিহাসের সমর্থনে গবেষকগণ বিশেষ দৃষ্টি দিতে চেষ্টা করতে পারেন। লোকসঙ্গীতের এমন কতগুলো সুর রয়েছে যা দেশবাসীকে স্বদেশ চেতনায় উজ্জীবিত করে। প্রেরণা বা চেতনার মধ্যে এটি হল একটি বিশেষ ও শক্তিশালী দিক যা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে ও প্রভাবিত হতে সাহায্য করে। এজন্য পণ্ডিতরা ফোকলোর- এর নানা উপকরণ সংগ্রহ করে মার্কসবাদী দৃষ্টিতে সেগুলোকে নতুনভাবে সৃষ্টি বা রদবদল করে মেহনতী জনতার মধ্যে বিতরণ করার পক্ষে। এবং এ লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে উৎসাহ ছড়িয়ে দিতে চায় যাতে তারা বিপ্লবী সাম্যবাদী সরকারের প্রশংসা কীর্তণের জন্য রচনা করে লোকসংগীত, লোককাহিনি বা ফোকলোরের অন্য সব উপাদান বা উপকরণ। তারা বিশ্বাস করেন এভাবেই সারা দেশের জন্য মার্কসবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সৃষ্টি হবে নতুন প্রোলেতারিয়েত ফোকলোর। গবেষকরা জেনে গেছেন জাতীয়তাবাদী চেতনার মূল অংশে রয়েছে ফোকলোর। গোকর্ী দ্বার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে-‘পরিশ্রমী মানুষের ক্রন্দনে সব দেশে ফোকলোর চিরদিন মুখর।’ আর এ কারণে-“লোকসংস্কৃতিকে আন্দোলনের কাজে সবচেয়ে সার্থকভাবে ব্যবহার শুরু করেন কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুদ্ধ শিল্পীরা…”

জাতীয়তাবাদী চেতনায় ফোকলোরের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার ফলেই মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করতে রচিত হয়েছিল প্রচুর লোকগান। লোকগানের প্রভাব সঞ্চারকারী ক্ষমতার জন্য লোক সুরে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে গীত হয়েছিল অসংখ্য গান। গীতিকারগণও লোকসুর মাথায় রেখে সেই সময় রচনা করেছিলেন অসংখ্য মুক্তির গান যা যোদ্ধাদের প্রেরণা, শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত ফোকলোরের এমন সব উপাদান নিয়েও রচিত হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের ফোকলোর যা বাঙালির জাতীয়তাবাদের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হবে। লৌকিক জীবনের দিকে দৃষ্টি রেখে এর পঠন পাঠন ও চর্চা করা গেলে বাঙালির অগাধ ঐশ্বর্যের সন্ধান আমরা যেমন পাব তেমনি লোক সমাজের আঙ্গিকগত যে দিকটি রয়েছে তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালির সংগ্রাম, আদর্শ বিচ্যুতি বা অর্থনৈতিক মুক্তির আকুতি কিভাবে ও কেন কাজ করেছে তা বুঝতে সক্ষম হব।

ফোকলোর সম্পর্কে জাতীয়তাবাদমূলক আলোচনার যে সূত্রপাত হয় তা হয় হিটলারের জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রচেষ্টায়। ১৯২০-এর দশকে নাৎসী মতবাদের সমর্থনে ফোকলোর সম্পর্কিত প্রচুর গ্রন্হ ও পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। আর এভাবে ফোকলোরের মাধ্যমে জার্মানির জাতীয় ঐতিহ্যের গৌরব ঘোষণা করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় সাবেক সোভিয়েত রাশিয়াতে ফোকলোরকে কম্যুনিস্ট প্রচারণার বিশিষ্ট হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এভাবে ফোকলোরকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী চিন্তা বা মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা কম-বেশি প্রায় সব দেশেই হয়েছে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক ডক্টর মযহারুল ইসলাম বলেন-“এ যাবৎকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে ও ভারতে ফোকলোর সম্পর্কে যে চেতনার বিকাশ হয়েছে তা মূলত এই জাতীয়তাবাদমূলক চিন্তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। …স্বাধীন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের উৎস সন্ধানে ফোকলোরকে আমরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করব এবং আমাদের জাতীয়তাবাদমূলক চেতনা থেকে সেগুলো বিচারে আমরা প্রবৃত্ত হব।

তবে একথা একান্তভাবেই স্বীকার্য যে বাঙালির লোকসংস্কৃতিই শেষ পর্যন্ত তাকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো।

(চলবে)

 সম্পূর্ণ বইটি পেতে যোগাযোগ করুন : রোদেলা প্রকাশনী
যোগাযোগ: ০১৭১১৭৮৯১২৫। মূল্য: ২৫০টাকা।]