বিম্বিসার থেকে বঙ্গবন্ধু

রঞ্জনা বিশ্বাস

অধ্যায় : ১

যে-কোনো বিষয় পরিধি বলতে বোঝায় সেই বিষয়টি অধ্যয়ন করে কোন কোন বিষয় সম্পর্কে কত দূর অবধি জানা যায়। হাতের শ্রেষ্ঠ ঘটনা পঞ্জির মাধ্যমে ইতিহাস লেখক রাজা-বাদশার কাহিনি, যুদ্ধ ও বিদ্রোহ, রাষ্ট্রের উত্থান-পতন এবং কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা ঘটেছে যার মাধ্যমে সমাজ বর্তমান অবস্হায় এসে পৌঁছেছে তার হদিশ দিয়ে যান। এই প্রচলিত ইতিহাস আলোচনাকে পণ্ডিতগণ গুরুত্ব দিলেও এটা যে সাধারণের জ্ঞানের সীমা লোকসমষ্টির জ্ঞানের সীমাকে অতিক্রম করবে সেই বিশ্বাস তারা রাখেন না। আজ তাই ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়েছে নৃবিজ্ঞান, লোকসংস্কৃতি, যুক্তিবিদ্যার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।

সমাজ যেহেতু নানা প্রক্রিয়া, নিয়ম-নীতি, কর্তত্ব, পারস্পরিক সহায়তা, নানারকম গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ, বিভাজন ও স্বাধীনতা দানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটি পরিবর্তনশীল ব্যবস্হা তাই সমাজকে বুঝতে বিজ্ঞানিগণ `Royal Quartert’ অর্থাৎ-অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম ও আ্তীয়তার প্রসঙ্গে কথা বলেন। অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম ও আত্মীয়তার ভিন্ন ভিন্ন বিন্যাসের ফলে সমাজের গড়ন ও ধরনও ভিন্ন ভিন্ন হয়।

সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদানের যে সম্পর্ক তা সাধিত হয় ভাষা দ্বারা।

এদিকে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা তার বস্তুগত সংস্কৃতির ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।

বস্তুগত সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট যে সব ক্রিয়াশীলতা রয়েছে তার মধ্যে ভাষা-সংস্কৃতি অন্যতম। এভাবে সংস্কৃতি ও নৃবিজ্ঞান হাত ধরাধরি করে ইতিহাসে অবস্হান নেয় এবং একটি সমাজের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট করে পরিস্ফুট করে।

রবীন্দ্রনাথ প্রামাণ্যপঞ্জির ইতিহাসকে মেনে নিতে পারেন নি। কেননা প্রচলিত সেই ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে শাসকরাই ছিলো একমাত্র নায়ক। কিন্তু রঙ্গমঞ্চের নিচে যে বিশাল জনতা ছিল, তাদের সুখ-দুঃখ, যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় তাদের ব্যথা-বেদনা ও জ্বালা-যন্ত্রণার কথা কিছুই লিখিত হয়নি। এই জনপ্রবাহের ইতিহাসই রবীন্দ্রনাথের কাছে দেশের প্রকৃত ইতিহাস ছিলো।’

রবীন্দ্রনাথ বলেন-‘যে ইতিহাস দেশের জনপ্রবাহকে অবলম্বন করিয়া প্রস্তুত হইয়াছে, যাহার নানা লক্ষণ, নানা স্মৃতি আমাদের ঘরে-বাইরে নানা স্হানে প্রত্যক্ষ হইয়া আছে, তাহা আমরা আলোচনা করি না বলিয়া ইতিহাস যে কী জিনিস, তাহার উজ্জ্বল ধারণা আমাদের হয় না।’ বলা বাহুল্য, এই উজ্জ্বল ধারণার জন্য ঐতিহাসিককে লোকসংস্কৃতির দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। এদিকে নৃতত্ত্বে লোকসংস্কৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ মযহারুল ইসলাম বলেন, ‘সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ফোকলোর এমনকি সাহিত্যের অঙ্গন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে স্পর্শ করেছে নৃতত্ত্বের ভাবনা-চিন্তা ও ধ্যানধারণা।

নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান ব্যতিরেকে মানব সভ্যতার মূল্যায়ন আজ প্রায় অসম্ভব।’ তিনি জানতেন নৃবিজ্ঞান ব্যতীত লোকসংস্কৃতি সম্ভবপর নয়।

নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিথ, কিংবদন্তী, লোকগাথা-প্রবাদ-ধাঁধা, লোকছড়া-কবিতা-গান এসবকে-Verbal art বলা হয়। লোকসংস্কৃতিকে কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানী সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব আবার কেউ কেউ ‘কৃষিজীবীদের নৃতত্ত্ব’ বলেও অভিহিত করেছেন। পণ্ডিতগণ ফোক বলতে গ্রামীণ বা আদিবাসী সম্প্রদায়কে সনাক্ত করেছিলেন।  আদিবাসী গ্রামীণ সংস্কৃতিই হচ্ছে মূলত ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতি। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেন- “প্রামাণিক ঘটনা হইতেই ইতিহাসের আরম্ভ।… পিতামহের সময় হইতে আগত বিশ্বাসের মূল পরীক্ষা করিয়া যেই পুরাতন অট্টালিকাগুলি ক্রমাগত নির্মমভাবে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তাহাদের স্হানে নতুন নতুন গৃহ রচিত হইতেছে। সভ্যতা, সমাজ ও বিশ্বাসের বৃদ্ধি ও পরিবর্তন ইতিহাসের বিষয় মধ্যে বটে।”

ইতিহাস সময়ের দিক থেকে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করে যা নৃবিজ্ঞানকে ইতিহাসের কাছাকাছি নিয়ে আসে।  বিংশ শতকের প্রথমদিকে নৃবিজ্ঞানীরা মৌখিক ঐতিহ্য অর্থাৎ লোকসংস্কৃতি, ঐতিহাসিক অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্রিয়াগুলোকে নৃতত্ত্বে ঠাঁই দিতে আপত্তি প্রকাশ করে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাজ নৃবিজ্ঞানী বলেন-‘ইতিহাসের মহাপরীক্ষায় স্হান না পাওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় জড়িত প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি পর্যাপ্তভাবে বোঝা যায় না।’ তারা বলেন-‘যারা ইতিহাসকে উপেক্ষা করে তারা বর্তমানকে না জেনেই নিজেদের নিন্দা করে, কারণ বর্তমানের উপাদান তাদের নিজ নিজ সম্পর্ক পরিমাপ ও মূল্যায়ন করতে ঐতিহাসিক বিকাশ একাই আমাদের অনুমোদন দেয়।’ প্রচলিত ইতিহাস থেকে জনগণের প্রথাগত ইতিহাস অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা জীবন্ত মানুষের চিন্তার অংশ নিয়ে গঠিত। ঘটনার স্মৃতি দিয়ে জনসমষ্টির জীবনের ভূমিকা থেকে, মৌখিক ও লিখিত ঐতিহ্য থেকে অতীতের ইতিহাসকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ থেকে যায়। আবার বর্তমানের চিন্তার পরিবেশ দিয়ে যেহেতু অতীতের ইতিহাস ঢাকা থাকে একইভাবে বর্তমানের চিন্তার বিষয়াবলি বিশ্লেষণ করে একটি জাতি ও সমাজের মনস্তাত্ত্বিক গঠন অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করে যে বলেছিলেন-‘বাঙালির ইতিহাস নেই-’ সে কথাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।  ‘বাংলা সাহিত্যের দিক থেকে রাজনৈতিক অর্থে স্বদেশ চেতনার আবির্ভাব ঊনিবংশ শতকে।’ স্বদেশচেতনা মূলত রাষ্ট্রচেতনা বা জাতীয়তা বোধ থেকে উদ্ভূত।

দীর্ঘ আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ নামের যে সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তা বাঙালিকে জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিয়েছে।

প্রায় দশ লক্ষ থেকে পঁচিশ লক্ষ বছর পূর্বে প্লাওসিন যুগে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছিলো। যে যুগে মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো অর্থাৎ প্লাইস্টোসিন পর্বে সেই যুগের নরকঙ্কাল ভারতের মেদিনীপুর-এর রামগড় সিজুয়ায় পাওয়া গেছে যা প্রমাণ করে প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ বাংলাদেশে বাস করে এসেছে। নৃতত্ত্বের ভাষায় এ অঞ্চলের আদিবাসীরা ছিলেন আদি অস্ট্রাল, যাদের ভাষা অস্ট্রিক। সাহিত্যে এরা ‘নিষাদ’, হিন্দু সমাজে এরা অন্ত্যজ, বৈদিক ও বেদোত্তর সাহিত্যে ‘অসুর’, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ‘দস্যু’ বা বয়াংসি অর্থাৎ পাখি সদৃশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর্যরা ভারতে প্রবেশের পর প্রায় দু হাজার বছরের মধ্যে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি। এ কারণেই ক্ষুব্ধ আর্যরা বঙ্গজনপদবাসীকে ঘৃণ্য শত্রু হিসেবে তাদের রচনায় উপস্হাপন করে।

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ছিলো ঐতিহ্য ও সভ্যতার দিক থেকে এগিয়ে। বাংলাই ছিলো তাম্রাশ্ম সভ্যতার জন্মভূমি। বাংলাই ছিলো সে যুগের তামার প্রধান আড়ত।

এছাড়া ধানচাষ, হাতি পোষা ও যুদ্ধে হাতির ব্যবহার বাংলাতেই প্রথম শুরু হয়েছিলো। হাতি ছিলো একদা বাঙালির জাতীয় প্রতীক। কেননা পালিত পশু হাতির আদি নিবাস ছিলো বাংলাদেশ। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য ও খনিজ সম্পদে উন্নত ব্রাত্য জনপদের অনার্য সংস্কৃতি তথা অসুরদের সংস্কৃতিই হয়ে উঠেছিলো বিদেশিদের প্রধান আকর্ষণ। ফলে বাংলাই হয়ে ওঠে পূর্ব- ভারতীয় সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। জৈন, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব সহজিয়া, বাউল, প্রকৃত ও লোকায়তদর্শনের প্রভাবে এ অঞ্চলের জনমানস ছিলো চিরকালই সংস্কার মুক্ত।  ‘কিন্তু পরবর্তীকালে বর্ণবাদী ব্রাহ্মণদের আক্রমণ, মুসলিম, বিজয়াভিযান ও আগ্রাসনের মাধ্যমে এদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের অবশেষটুকুও নির্মমভাবে ধ্বংসের চেষ্টার ফলে আজ আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে এক নিদারুণ শূন্যতা। আর্য অভিযান ও পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য শাসন, মুসলিম অভিযানের পরবর্তী সময় বৌদ্ধবিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ধ্বংস সাধন, গ্রন্হাগারগুলিতে অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা, লুণ্ঠন, নারীধর্ষণের যে কলঙ্ক ও ধ্বংসের চিহ্ন এদেশের ললাটে লেপন করা হয়েছে। আজো তা থেকে আমাদের পরিত্রাণ ঘটেনি।’১০ যে বাঙালির হাতে একদা অখণ্ড ভারতবর্ষের অভ্যুদয় ঘটে, সে বাঙালি জাতিই আধুনিক ভারতীয় উপমহাদেশের জনক বা রূপকার১১ -সেই বাঙালির ভাগ্যাকাশে বারবার কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে কিন্তু শেষপর্যন্ত বাঙালিরাই প্রতিবার প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত বৈরী পরিস্হিতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শাসকের রক্তচক্ষু, অবহেলা, ষড়যন্ত্রীর কূটকৌশল মোকাবেলা করে এদেশের মানুষ বিস্ময়করভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।  মগধের বাঙালি সম্রাট বিম্বিসার থেকে আজকের বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত বাঙালির যে ইতিহাস তা কেবল ভারতবর্ষের ইতিহাস নয়-বাঙালির ইতিহাস।

বাঙালির সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস সুখ-দুঃখের ইতিহাস বাংলাদেশ পর্বে এসে, ১৯৭১ পর্বে এসে বাঙালির মূল মর্মস্হলটিকে সনাক্ত করে দেয়। ফলে বাঙালির ইতিহাসে যুক্ত হয় নতুন অধ্যায়-‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’।

এই পর্বে বাঙালির সমাজজীবনে রক্তসূত্রে আবদ্ধ হয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির সামগ্রিক ইতিহাসে স্বাদেশিকতার যে বোধ তা এইপর্বে এসে উজ্জ্বল রূপ পরিগ্রহ করে। শুধু ইতিহাসের বাঁকবদল হল তা নয় বাঁকবদল হল সাহিত্যেও। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নামেও একটি নতুন শাখার সৃষ্টি হল। চর্যাপদ থেকে শুরু করে প্রায় সাত’শ বছরের মধ্যে বাঙালির স্বদেশচেতনা-লব্ধ জ্ঞান সাহিত্যে দেখা যায় নি। ১৯৭১-এর সময় এবং যুদ্ধোত্তর পর্বে স্বদেশ প্রেম বা জাতীয়তা বোধের ধারাবাহিক উপস্হিতি আমরা লক্ষ করি আমাদের ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যে – এর মূল কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক। পরাধীনতার গ্লানি, দেশ বিপর্যয়ের কষ্ট বাঙালি জনমানসকে ক্লিষ্ট করে তুলেছিলো-যার ফলে উৎসারিত হয়েছিলো-প্রতিবাদের ভাষা – গানে, ছড়ায়, শ্লোগানে ও বক্তব্যে।

এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিলো জাতীয় জীবনের অনির্বচনীয় ঐক্যতত্ত্ব, যার প্রধান শক্তি যুগিয়েছিলো দেশের সাধারণ জনগণ। তাদের ভাবনা-চিন্তা, ধ্যান-ধারণাই দেশের মধ্যে সব ধরনের সামাজিক বিবর্তন ও বিপ্লব ঘটিয়েছিলো।

রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চিন্তার প্রধান কথাই ছিলো দেশের অশিক্ষিত লোকেরা ইতিহাসের জ্ঞান লাভ করুক।  কিন্তু সেই ইতিহাস প্রভেদের নয় – শাসকের একার নয় – জনপ্রবাহের দিক থেকে উচ্চারিত ইতিহাস যা ‘প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্হাপন’ করতে সমর্থ হয়। তেমন ইতিহাস চাই, যেখানে নিজের দেশের সাথে নিজের চিরন্তন সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়, এ ইতিহাস আমাদের দৃষ্টিকে আবৃত করে না, প্রসারিত করে, সহায়তা করে।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জন্য এক যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে এই নয় মাসের ঘটনাসমূহকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে সময় আর ঘটনা প্রবাহের দিক থেকে। বুদ্ধিজীবী মহল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা শোষণ, জুলুম, নির্যাতন ও বৈষম্যের চিত্র বাঙালির সামনে তুলে ধরেন। একইভাবে রাজনীতিবিদরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে। ইতিহাসে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা, তাদের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে রাজনীতিবিদরাও ইতিহাস রচনা করেছেন।  এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-অলি আহাদ, আমীর-উল-ইসলাম, কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেন, ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, মঈদুল হাসান, মহিউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ ব্যক্তির নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সামরিক অফিসারগণ তাদের নিজ নিজ পেশার বর্ণনা অপারেশনের বিবরণ, রণনীতি ও কৌশলের বর্ণনা দেবার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন- লে.কর্ণেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, লে. জেনা. জে. এফ আর জেকব, রফিকুল ইসলাম, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, কামরুল ইসলাম ভুঁইয়া, সাজ্জাদ আলী জহির প্রমুখ। একইভাবে সাংবাদিকরাও তার নিজ নিজ পেশার আলোকেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছেন। এদের মধ্যে-বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, এম. আর আকতার মুকুল, হারুন হাবীব, ফয়েজ আহমেদ, মুসা সাদিক, সিডনি শনবার্গ, হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ এর নাম উল্লেখযোগ্য। বুদ্ধিজীবীর রচনার মধ্যে আছেন-এএফএম সালাহ্‌দ্দীন আহমদ, আনিসুজ্জামান, এ. আর মল্লিক, গোলাম মুরশিদ, রেহমান সোবহান, শওকত ওসমান, হাশেম খান, মুনতাসীর মামুন, মেসবাহ কামাল, সুকুমার বিশ্বাস, আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ। এছাড়া আঞ্চলিক ইতিহাস যারা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে মাহবুবর রহমান, আবুল আহসান চৌধুরী, স্বরোচিষ সরকার, রফিকুর রশীদ, আমিনুর রহমান সুলতান, তপন বাগচী রীতা ভৌমিক, আব্রাহাম লিংকন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব রচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড চিত্র স্হান পেয়েছে। প্রতিটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সময়ের দিক থেকে রাজনৈতিকভাবে ক্রিয়াশীল প্রভাবকের দিক থেকে।  এখানে জনপ্রবাহের দিক থেকে ইতিহাস তার ঘটনার দিকে ধাবিত হয়নি। এবং এটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে লেখকের পেশাগত আচরণের ধারাবাহিকতায়। তবে প্রতিটি গ্রন্থেই বঙ্গবন্ধু অনিবার্যভাবে উঠে এসেছেন। কেননা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু একইসূত্রে গাঁথা।

জনপ্রবাহের দিক থেকে অর্থাৎ গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের দিক থেকে ইতিহাস তৈরি হয় না; যা তৈরি হয় তা মৌখিক ঐতিহ্য, লিখিত দলিল থাকে না এসবের। একেই বিজ্ঞানীরা কেউ বলেন-ফোকলোর, কেউ বলেন- কৃষিজীবীর নৃতত্ত্ব। জনগণের এই Verbal art বা মৌখিক শিল্পই তার নিজস্ব ইতিহাস-যার সাথে সে নিজে একা্ততা অনুভব করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে- এই প্রসঙ্গে ড. সুকুমার বিশ্বাসের একাধিক গবেষণা ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা নজরে পড়ে না – মামুন তরফদারের ‘লোকসংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ’ ও হাসান ইকবালের -‘ভাট কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’ ব্যতীত। এ বই দুটিতে বঙ্গবন্ধুর অবস্হান ব্যাখ্যা করা হয়নি বরং খুব সংক্ষিপ্তভাবে লোকগান ও কবিতাগুলো সনাক্ত করা হয়েছে যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু উঠে এসেছেন।

তথ্যসূত্র :

১.  ড. সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা-২০০৯,পৃ:২৯।
২.  ড. অতুল সুর, বাঙালা ও বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতি, সাহিত্যালোক, কলকাতা-২য় সংস্করণ-২০১৪, পৃ: ৯।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ:৯।
৪.  ড. সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত,পৃ:২১।
৫.  প্রাগুক্ত,পৃ: ২৬।
৬. ই.ই. ইভান্স প্রিচার্ড, সমাজ নৃবিজ্ঞান, অনু-সাদাত উল্লাহ খান, বাংলা একাডেমি,ঢাকা-২০০৯, পৃ: ১২৯।
৭.  আবদুশ শাকুর, বাঙালির মুক্তির গান, মাওলা ব্রাদার্স,ঢাকা-২০০৭,পৃ: ৯।
৮. ড. অতুল সুর, প্রাগুক্ত, পৃ: ১২।
৯.  ড. অতুল সুর, ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, সাহিত্যালোক, কলকাতা, ৩য় সংসকরণ-২০০৮, পৃ: ৭৮।
১০. মোহম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, প্রাচীন বাংলার রাষ্ট্র ও প্রশাসন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা-২০১২, পৃ: ৮৬।
১১.  প্রাগুক্ত, পৃ: ৯০।

(চলবে)

[সম্পূর্ণ বইটি পেতে যোগাযোগ করুন : রোদেলা প্রকাশনী
যোগাযোগ: ০১৭১১৭৮৯১২৫। মূল্য: ২৫০টাকা।]