লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ- রঞ্জনা বিশ্বাস

কীর্তনখোলা@নদীডটকম

কবি রঞ্জনা বিশ্বাস

কবি পরিচিতি

রঞ্জনা বিশ্বাস। এই শতাব্দীর প্রথম দশকের কবি। ১০ ডিসেম্বর, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার রাধাগঞ্জ ইউনিয়নের খাগবাড়ি গ্রামে একটি খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নির্মল বিশ্বাস ও মাতা পরিমলা বিশ্বাস। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএসএস।

‘ভুলস্বপ্নে ডুবে থাক আদিবাসী মন’ (২০০৯) ও ‘আমি তিনবেলা বৃষ্টিতে ভিজি’ (২০১০) তাঁর কবিতার বই।

কবিতা ও ফোকলোর তাঁর আগ্রহের বিষয়। কবিতাচর্চার পাশাপাশি ফোকলোরচর্চাকেও তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছেন।

কোটালীপাড়া এলাকার রূপকথার সংগ্রহ বেরিয়েছে ‘জয়নাল বাদশা ও রাজপুত্র তাজেম’ (২০১১) নামে। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম ‘বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা’ (২০১১)।

বাংলাদেশের পালকি ও পালকিবাহক: নৃ-তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ধারা (২০১৫)। বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় (২০১৫)। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ: কাবুলিওয়ালা, সুভা ও দালিয়া’ (২০১২)।

এই বছর বেরিয়েছে তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘সাহিত্যে বেদে সম্প্রদায়’ ও বাংলা একাডেমির ‘তরুণ লেখক প্রকল্প’, ‘লোকজ সংস্কৃতির বিকাশ প্রকল্পে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের পালকি ও পালকিবাহক’ বইটির জন্য তিনি ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার-২০১৫’ লাভ করেন।


ভূমিকা

বাংলার লোকসংস্কৃতি হচ্ছে বঙ্গজনপদবাসীর নিজস্ব জীবনের আন্তরিক ভাষ্য। একটি জাতির সামগ্রিক চিন্তার পরিচয় প্রকাশ পায় নিজ লোকসংস্কৃতির মধ্যে। লোকসংস্কৃতির নানা উপাদানের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে সেই জাতির মর্মের কথাটি। আর সেই কথাটি লোককবিরা তাদের দরদি ভাষায়, আবেগে আর যত্নে প্রচার করেন, প্রকাশ করেন। জনপ্রবাহের দিক থেকে লোক ইতিহাসের সেই কথাটি আজো প্রচারের আলোয় আসে নি। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধের রাজনৈতিক বিষয়আশয় ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত অসংখ্য লোকগান, ছড়া ও কবিতা সেই সময় জাতীয় চেতনা জাগ্রত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এসব গানের যেমন ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি এর ভেতরের ইতিহাসও প্রচলিত ইতিহাসের প্রামাণিকতা বিচারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে এগুলো প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পাবার দাবি রাখে। ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু’বা ‘বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা’লোকচেতনায় যে কতটা অভিন্ন, তার পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় সকল লোককবির গানে। তাইতো বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম গেয়ে ওঠেন:

“সোনার বাংলার ঘরে ঘরে
সকলে মিলিয়া জয় বাংলা বলিয়া
আনন্দে হাসিয়া ঢলিয়া পড়ে।”

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়ে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ফলে ‘যুদ্ধজয় মানে এক অর্থে শেখ মুজিবের মুক্তি। তাই প্রায় গানে বাংলার মুক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি একই সূত্রে গাঁথা হয়েছিলো।’

জনপ্রবাহের দিক থেকে অর্থাৎ গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের দিক থেকে ইতিহাস তৈরি হয় না; যা তৈরি হয় তা মৌখিক ঐতিহ্য, লিখিত দলিল থাকে না এ-সবের। একেই বিজ্ঞানীরা কেউ বলেন, ফোকলোর, কেউ বলেন, কৃষিজীবীর নৃতত্ত্ব। জনগণের এই Verbal art বা মৌখিক শিল্পই তার নিজস্ব ইতিহাস, যার সাথে সে নিজে একাত্মতা অনুভব করে। যেমন শেখ মুজিব নিজেই লিখেছেন, “পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাস উদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।”লোকসংস্কৃতির একটি অংশ লোকসাহিত্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে লোকসংগীতে যেসব ধারা বিদ্যমান, তার মধ্যে আছে, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, আলকাপ, গম্ভীরা, মারফতি, মুর্শিদি, জারি, সারি, বাউল, নীলের গান, ভাষার গান, দেশের গান, স্বরাজের গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধের গান, কীর্তন গান, যাত্রাগান, পালাগান, ধুয়াগান ইত্যাদি। এসব লোকগানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি আঙ্গিক হলো দেশের গান। শাসক-গোষ্ঠীর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের মধ্যে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে, তাতে উজ্জীবিত হয়ে লোকমানসে সৃষ্টি হয় দেশপ্রেমমূলক লোকসংগীত। এই ধারার গানগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বরাজের গান, ভাষার গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধের গান ইত্যাদি। এসব লোকগানের রচয়িতা লোককবি বা লোকশিল্পীগণ। অজ্ঞাতনামা এ সকল লোককবির গানে আবহমান বাংলার লোকসমাজ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতার পরিচয় আমরা পেয়ে যাই। বাংলাদেশের ইতিহাস যেমন নানাভাবে তার প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে তেমনি লোকগানের মধ্যেও সেই ইতিহাসের প্রাণপ্রবাহটি সঞ্চারিত হতে দেখতে পাই। যুগ-যুগ ধরে একটি দেশ বা জাতি তার শোষণের নির্যাতন-নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তাদের গানে তাই নীল বিদ্রোহ, পলাশীর যুদ্ধ স্মৃতি, তে-ভাগা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনের কথা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া ভাষা আন্দোলন, এগারো-দফা, ছয়-দফাসহ মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ লোক গানে ধরা পড়ে যায়।

এভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লোকছড়া গণ-চেতনায় রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বলতে ইতিহাস-টুঙ্গিপাড়া বা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরকে শনাক্ত করলেও লোককবির কাছে তা নয়। লোককবির কাছে শেখ মুজিবের বাড়ি মানে সারা বাংলাদেশ। নির্লজ্জ বেহায়া টিক্কা খান এখানে ভিক্ষা করতে আসে। লোক-ছড়ায়:

“ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা
বোয়াল মাছের দাড়ি
টিক্কাখান ভিক্ষা করে
শেখ মুজিবের বাড়ি।”

বাংলাদেশ তথা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু একটি অনিবার্য নাম। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর বাংলাদেশের ইতিহাস পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়েছে নানা রকম নৈরাজ্য। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কালিমা লেপন, তাঁর নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে নানান রকম মনগড়া কাহিনী। ১৯৭৫-এর পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘ সময় স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় থাকার ফলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে নানান অপপ্রচার প্রসার লাভ করে, ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি।

‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই’- এই ভ্রাতৃত্ববোধ, এই অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের চেতনা সমাজ তথা রাজনীতি থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে দীর্ঘদিনের মিথ্যাচার ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্য বিকৃতির কারণে। এই অবক্ষয় রোধ করতে পারে একমাত্র বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস-চর্চা তারই এক অংশ আজকের এই গবেষণা।

– কবি রঞ্জনা বিশ্বাসের এই মূল্যবান পরিশ্রমলব্ধ কাজটি সম্পর্কে প্রিয় পাঠক জানতে পারবেন কীর্তনখোলার পাতায়। প্রতি সপ্তাহে। ধারাবাহিক পাঠচক্রে আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রত্যাশায় নিবেদন করছি।