অফিসের ট্যুরে গেছেন মিসেস রব্বানী। বাসার সবকিছুই ম্যানেজ করতে হয় তাকে। ছেলেকে স্কুলে আনা-নেয়া, রান্না, বাজার সবকিছুই তাকে করতে হয়। সেজন্য অফিসের কাজে বাইরে গেলে অনেক ঝামেলা করে যেতে হয়। বাসার যে সাহায্যকারী মেয়েটা, সে রান্না করতে পারে না, সেজন্য মিসেস রব্বানীকে একটু বেশি করে মাংস, মাছ, শবজি, ডাল রান্না করে যেতে হলো।
মেয়েটার নাম সালেহা। সালেহা তার বাসায় এসেছে দুই সপ্তাহ। মিসেস রব্বানীর চার দিনের ট্যুর। তৃতীয় দিনে বিকাল ছয়টার দিকে অফিসের কাজ শেষ করে গেস্ট হাউসে পৌঁছে বিছানায় শুয়ে চোখটা বন্ধ করে একটু রেস্ট নেবার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই ছেলে রুদ্র, বয়স নয় বছরের একটু বেশি হবে, টেলিফোন করে কাঁদছে, চিৎকার করে বলছে, মা, তুমি এখনই আস, এখনই আস, আমার একটুও ভালো লাগছে না, মা, তুমি এখনই আস। মা তো কিছুতেই ছেলের কান্না থামাতে পারছে না। বলছে তুমি যদি কান্না না থামাও, মা, তাহলে কীভাবে বুঝবে যে, তোমার কী হয়েছে।
অনেক কষ্টে ছেলের চিৎকার থামালেন, কিন্তু রুদ্র ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে আর বলছে, এখনই আস, মা, আমার ভালো লাগছে না, সালেহাকে বাবা যেন কী করেছে, এখন সালেহা কাঁদছে আর বলছে, আমি বাড়ি যাব তুমি তোমার মাকে ফোন করে বলো এখনই আসতে, আমি বাড়ি যাব, সালেহাও কাঁদে, রুদ্রও কাঁদে।
মিসেস রব্বানী বুঝতে পারছে না, কী করবে। এখন কি তার হাজব্যান্ডকে ফোন করে ঘটনা জানতে চাইবে, না-কি করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। মা ছেলেকে বললেন, সালেহাকে টেলিফোনটা দাও।
সালেহা ফোন ধরে কাঁদছে আর বলছে, ‘খালাম্মা আমাকে বাড়ি পাঠায় দেন, আমি এক মিনিটও থাকুম না।’ মিসেস রব্বানী বললেন, আমাকে খুলে বল, আমি সবকিছূ ব্যবস্হা করছি। সালেহা কেঁদেই চলছে আর বলছে, ‘খালু, অফিসে যাইবার আগে আমারে চুমা দিছে আর জড়িয়ে ধরছে, গতকালকে আমি ফ্রিজ খুলে খাবার বার করতাছি তখন পিছন থিক্যা আমার কোমর জড়িয়ে ধরছে, আমি ছাড়াইতে চেষ্টা করলে উনি আরো জোরে ধইরে কইছে আমাকে একটু ভালোবাসা দিতে পারিস না। আমি অনেক কষ্টে ছুইটা রান্না ঘরে গেছি। আইজকা রাতে আমি আর উনার হাত থেইক্যা বাঁচমু না, আপনি এখনই আসেন নাইলে আমি আপনার বাসা থেইক্যা পালাইয়া যামু।
মিসেস রব্বানী কী করবেন, কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না, তার দুই চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে, কিন্তু টের পাচ্ছে না যে, উনি কি কাঁদছেন না-কি রাগ হচ্ছেন, না-কি উনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। মিসেস রব্বানী রওয়ানাও দিতে পারছেন না, কারণ তার পরের দিন সেশনের শেষ দিন, অফিসের গাড়ি নিয়ে গেছে, চাইলেও রওনা দিতে পারছে না। কারণ তার সাথে আরো কলিগরা আছেন। অবশেষে, মিসেস রব্বানী তার বৃদ্ধা মাকে ফোন করে বলল, ‘মা, তুমি একটু আমার বাসায় গিয়ে থাক, রুদ্রর কেন যেন ভালো লাগছে না, বলছে।’ মা তো ফোন পেয়েই রওনা হলেন। রাতে তিনজনই রুদ্রর রুমে দরজা আটকে ঘুমাল। রুদ্র তার নানিকে কিছুই বলে নি, এমনকি সালেহাও কিছু বলে নি মিসেস রব্বানীর অনুরোধে। তার পরের দিন সেশন শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন মিসেস রব্বানী। সারাটা পথ সে ভেবেছে কী করবে সে। যাবার সময় একই পথ মনে হয়েছে খুবই কম রাস্তা, অথচ একই রাস্তা, কিন্তু মনে হচ্ছে পথ আর ফুরাচ্ছে না।
রাত আটটার দিকে বাসায় ফিরলেন। বাসায় ফেরার সাথে-সাথেই রুদ্র তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, মা তাকে যতই থামাবার চেষ্টা করছে সে ততই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাত এগারোটার দিকে মিসেস রব্বানীর হাজব্যান্ড বাসায় এলেন। মিসেস রব্বানী যেন কিছুই বলতে পারলেন না, শুধু বিছানায় শুয়ে-শুয়ে নীরব প্রতিবাদ করে কেঁদে-কেঁদে সারারাত পার করলেন। তার পরের দিন সালেহাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন আর বললেন, ‘সালেহা, তোর পায়ে ধরি একথা কাউকে যেন বলিস না।’