রিকশা পেইন্টিং

তানজীব হোসাইন তন্ময়

লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি রঙের প্রতিকৃতি, মানুষের মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বনের পশু-পাখি, বিশেষ ধরনের লতা-পাতা-ফুল-পাখির নকশা কিংবা বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সিনেমার কাহিনী, বীরত্বগাঁথা, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মীয় কাহিনী, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আঁকা ছবি দেখা যায় রিকশা চিত্রে। এনামেল রং দিয়ে আঁকা এই চিত্রকর্মগুলোর প্রতি একেকজন মানুষের একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কারো কাছে এগুলো খুব পছন্দের। কারো কাছে আবার এগুলোকেই ‘‘খ্যাত’’ আনাড়ি কিংবা হাস্যকর বলে মনে হয়। তবে রিকশা চিত্র যেমনই হোক, এই সব চিত্রকর্মে প্রাথমিক রঙের ব্যবহার এবং সরল অংকন-রীতি হাজার বছরের বাংলাদেশ এবং এদেশের সাধারণ মানুষকে তুলে ধরে। এই রংগুলো একান্তই আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির রং। এই অংকন-রীতি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মতোই সরল এবং প্রাণবন্ত।

এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার বিলুপ্ত-হয়ে-যাওয়া অন্যান্য সব কারুশিল্পের মতো এই কারুশিল্পও এখন তার শেষ সময়টা পার করছে। কয়েক দশক পরে হয়ত বাংলাদেশে হাতে আঁকা আর কোনো রিকশা পেইন্টিং অবশিষ্ট থাকবে না। বাজারে এখন রিকশা পেইন্টিং-এর সস্তা প্রিন্টেড কপি কিনতে পাওয়া যায়। ওই সস্তা প্রিন্টের কারণে অপেক্ষাকৃত বেশি দামি হাতে আঁকা রিকশা চিত্রের চাহিদা কমে গেছে রিকশা মিস্ত্রিদের কাছে। এ কারণে অনেক রিকশা পেইন্টার এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা আর নতুন করে শিষ্য তৈরি করছেন না, যার ফলে চমৎকার এই শিল্পধারা পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনো যে অল্প সংখ্যক রিকশা পেইন্টার রিকশা পেইন্টিং করে যাচ্ছেন, তাঁদের কাজে আর আগের মতো বৈচিত্র্য দেখা যায় না। এখন যে অল্প সংখ্যক রিকশা পেইন্টিং দেখা যায়, তার বেশির ভাগেই দেখা যায় যে, প্রায় একই পেইন্টিং বার বার কপি করা হচ্ছে। অল্প কয়েকজন রিকশা পেইন্টার আছেন, যারা বিদেশীদের কাছে শিল্পকর্ম হিসেবে রিকশা পেইন্টিং বিক্রি করে চলেন। আমাদের দেশের রিকশা পেইন্টিংকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে রিকশা পেইন্টারদের টিকিয়ে রাখতে হবে। এজন্য তাঁদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করা প্রয়োজন।

অনন্য এই শিল্পধারা সংরক্ষণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন:

– রিকশা পেইন্টারদের কাছ থেকে পেইন্টিং কিনতে হবে।
– বাংলাদেশের শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রিকশা পেইন্টিং বিভাগ চালু করে সেখানে শিক্ষক হিসেবে রিকশা
পেইন্টারদের নিয়োগ দিয়ে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।
– একটি জাদুঘর স্হাপন করা যেতে পারে, যেখানে রিকশা পেইন্টারদের পেইন্টিংগুলো সংরক্ষণ করা
– রিকশা পেইন্টারদের শিল্পকর্ম নিয়ে নিয়মিত প্রদর্শনীর ব্যবস্হা করতে হবে।
– আমাদের দেশের বিভিন্ন ধরনের উৎসব, অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা রিকশা পেইন্টিং-এর ধারায় করা যেতে পারে।
– বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রচার-প্রকাশনা, যেমন – সাময়িকী, ক্যালেন্ডার ইত্যাদিতে রিকশা পেইন্টিং
ব্যবহার করা যেতে পারে।
– বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মোড়কে রিকশা পেইন্টিং ব্যবহার করা যেতে পারে।
– বাংলাদেশের কাগুজে নোটে রিকশা পেইন্টিং ব্যবহার করা যেতে পারে।

রিকশা পেইন্টিং সংরক্ষণের জন্য আমাদের এখনোই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের হারিয়ে-যাওয়া সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং, বেবি ট্যাক্সি পেইন্টিং, ফটো স্টুডিও ব্যাকড্রপ পেইন্টিং, স্টিীার পেইন্টিং, ট্রাক পেইন্টিং কিংবা অন্যান্য সব কারুশিল্পের মতো এই শিল্পও হারিয়ে যাবে চিরতরে।