খুব জোরে, বেশ জোরেই কৃপার কান্না শোনা যাচ্ছে। এ কান্নার সাথে আশেপাশের বাড়ির লোকজন, গ্রামবাসী আর পথচারীরা পরিচিত। কৃপা গঙ্গাধর দাশের ছোট মেয়ে। বড় দুই মেয়ের অনেক আগেই বিয়ে হয়েছে। বড়মেয়েটার চিলমারী আর মেজোটার বিয়ে হয়েছে ভুরুঙ্গামারী। দুই ছেলে, ছেলে বউ, নাতি-নাতনি, স্ত্রী অমলা আর ছোট মেয়ে কৃপাকে নিয়ে গঙ্গাধরের এজমালি সংসার। ভাগ-বাটোয়ারার প্রশ্ন এখনো উঠে নি, উঠবেই বা কেন? কিছু থাকলে তো উঠবে। ছোট্ট একটা ভিটা আর দুটো হাত ছাড়া গঙ্গাধরের তো আর কিছু নেই। ছেলে গোবিন্দ আর আনন্দ বাপ-দাদার পেশাতেই আছে। আগের মত আর নদীতে মাছ নেই। শুধু নদীর মাছ ধরে সংসার চলে না। গ্রামে বড় বড় পুকুরগুলোতে এখন নানান জাতের দেশী-বিদেশী মাছের চাষ হচ্ছে। সেই পুকুরে বড়-বড়-জাল ফেলে মাছ ধরে, মাছের সেবা যত্ন করার কাজে ওদের ডাক পড়ে। এছাড়াও মুস্তফির হাটের মাছের আড়তে গোবিন্দ আর আনন্দ কাজ করেও বেশ আয় করে। অবস্হা বুঝে কখনও কখনও পাল্লা-পাথর নিয়ে খুচরা মাছ বিক্রির কাজেও লেগে যায়। সব মিলিয়ে গঙ্গাধরের সংসারে দুবেলা দুমুঠো ভাতের সংস্থান ঠিকই হয়ে যায়। তবে ইদানিং সংসারে সবচেয়ে বড় অশান্তি দেখা দিয়েছে ছোট মেয়ে কৃপাকে নিয়ে। শ্যামলা গড়নের কৃপার বয়স গড়িয়ে যেতে যেতে তিরিশ ছুঁইছুঁই করছে। বিয়ে আর হচ্ছে না। স্ত্রী অমলার দুঃখের যেন শেষ নেই। অনেক ছেলেই দেখে যাচ্ছে, কিন্তু দেখে যাবার পর পছন্দ করছে না কেউ। প্রতিবারের মত এবারও খবর এসেছে, ছেলেপক্ষ কৃপাকে পছন্দ করেনি। আর এজন্যই কৃপা কাঁদছে। দুই বৌদির সাথে কৃপার কথাবার্তা অনেক দিন থেকেই বন্ধ। দুই বৌদিও কৃপাকে পছন্দ করে না। গোবিন্দ আর আনন্দ বাড়িতে এলেই দুই বউ ভালোমন্দ মিশেল করে নানান কথা তাদের কানে দেয়। বউয়ের দশ কথার মধ্যে দুএকটাতো বিশ্বাস করতে হয়। আর এভাবেই কৃপা দিন দিন ভাইদের কাছেও মস্ত যন্ত্রণা হয়ে দেখা দিয়েছে।
উঠানের মাঝে পা ছড়িয়ে অমলা কাঁদছে আর বলছে, অভাগী, তর মরণ হয় না কেন? তর নাম তো কৃপা, ভগবান কি কৃপা করে তোরে যমদুয়ারে পাঠাইতে পারে না।
মায়ের কথায় কৃপার কান্নার পারদও ঊর্ধ্বমুখী হয়। অমলার কথা শেষ হয় না।
-আর ভগবানেরই বা দোষ কী? তার তো অনেক কাজ থাকে। তুইও তো গলায় কলসি বেঁধে মরতে পারিস।
কৃপার মাঝে-মাঝেই মরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মা-বাবা আর ভাইদের কথা মনে করে সে আর মরতে পারে না। মাঝে-মাঝে কৃপার ইচ্ছে করে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। কিন্তু রাস্তায় বেরুলে শকুনের মতো তাকিয়ে থাকা পুরুষগুলোর কথা মনে পড়লে ওর সে ইচ্ছাটাও নষ্ট হয়ে যায়। মা ভগবানের কাছে এত কিছু বলে, কিন্তু তার মেয়ে হয়ে জন্মানোর কথা কেন বলে না। তাকে পুরুষ করে জন্ম দিলে ভগবানের কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত। এভাবেই দিন যায়, মাস যায় অনেকেই কৃপাকে দেখে যায়, তারপর চলে কৃপার কান্না।
গত সপ্তাহে চৌধুরানী থেকে এক ছেলে আত্নীয়স্বজন নিয়ে কৃপাকে দেখে গিয়ে পছন্দ করেছে। তারা মেয়ে পক্ষকে তাদের বাড়িতে ডেকেছে। গোবিন্দ আর আনন্দ কিছুক্ষণ আগে চৌধুরানী থেকে ফিরেছে। তারা সুখবর এনেছে। কৃপার বিয়ে ঠিক করে এসেছে। খবরটা শোনার পর থেকে চলছে তৃপার কান্না। এবারের কান্না আগের কান্নার চেয়েও যেন বেশি। প্রতিবেশী, পথচারী জানে এবারও হয়ত কৃপাকে ওরা পছন্দ করে নি। কিন্তু আসলে তা নয়, কৃপা এবার কাঁদছে তার বাবা, মা আর ভাই-বৌদিদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য অন্যের বাড়িতে চলে যাবার চিন্তায়। অর্থাৎ, এ-কান্নাও সুখের কান্না নয়। কৃপাকে আরও কাঁদতে হবে। আশীর্বাদের দিন কাঁদতে হবে। এরপর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কাঁদতে হবে। শাশুড়ি-ননদের কথায় কাঁদতে হবে, স্বামীর কথায় কাঁদতে হবে। তারপর বাবার বাড়িতে আসার কথা বলার সময় কাঁদতে হবে, বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবার সময় কাঁদতে হবে। অর্থাৎ, কৃপাকে ততদিন কাঁদতে হবে, যতদিন সে বেঁচে থাকবে।