জুতোর গুঁতো

অনুপম ঘোষ

শ্রীরামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করেছিলেন – ‘ বঙ্কিম বাঁকা কেন? বঙ্কিমচন্দ্র উত্তর দিয়েছিলেন – সাহেবের জুতোর চোটে।’

বঙ্কিমচন্দ্র ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন তাই ‘সাহেবের জুতো’ কথাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীনতা না থাকলে একটি জাতি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারে না— একথা সেদিন বঙ্কিমচন্দ্র বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণকে। অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের যুগেই বিদ্যাসাগর শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলেছিলেন “ভারতবর্ষে এমন কোনো রাজা নাই যাকে চটিজুতোসুদ্ধ পায়ে লাথি মারতে না পারি… “। আবার বিদ্যাসাগর মশাই আবেগের বশে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় দেখতে গিয়ে মঞ্চের দিকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। ওদিকে শোনা যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেতে গেলে কুড়ি-পঁচিশজোড়া জুতো সঙ্গে নিতেন— সাহেবদের অনুষ্ঠানে যেতেন সোনার কাজ করানো জুতো পায়ে ! তাঁরই পৌত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজস্ব বজরায় বসে পা নাচানোর সময় জুতো নদীতে পড়ে গেলে সেই জুতো উদ্ধার করতে তিনি জলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন ।
এই গল্পগুলি আমাদের বাঙালি-চরিত্রের দৃঢ়তা-শিথিলতার, আবেগ-বিলাসিতার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে…

ব্রিটিশ শাসনামলেই সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে জুতো পরার অভ্যেস ক্রমাগত বাড়তে থাকে। পায়ের সুরক্ষার জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা দেখা যেত সে-সময়ে। কাঠের খড়মের যুগ পেরিয়ে চামড়ার জুতো-চটি, কাপড়ের জুতো, রবারের চটি বাঙালির শ্রীচরণে শোভা পেতে থাকে। আমুদে বাঙালি তখন জুতোর দোকানেরও নাম রাখতো “শ্রীচরণেshoe” । খড়মপেটার যুগের পর জুতোপেটার যুগ আসে…
পদমর্যাদা রক্ষার জন্য জুতো দিনে দিনে বাঙালির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বঙ্গসন্তানেরা সাহেবদের পোশাক, কোট-টাই অঙ্গে দেওয়ার পর থেকে পোশাকের বাহার অনুযায়ী জুতো না পেলে আর জাত থাকে না। অতএব বুঝতে কষ্ট হয় না আমাদের জাত একরকম জুতোয় এসে ঠেকেছে। আবার জুতোর বংশ-গোত্রও এক নয়, বেশ প্রভাবের সঙ্গে জুতোর আলাদা আলাদা জাত আছে — অফিশিয়াল জুতো, ইশকুল-কলেজের জুতো, বিকেলে খেলার জুতো, সকালে হাঁটার জুতো, শীতের জুতো, গরমের জুতো, পাহাড়ে ওঠা জুতো । বয়স অনুযায়ী ছেলে-বুড়োদের জুতো । আবার অনুষ্ঠান অনুযায়ী বিয়ের জুতো- গায়ে হলুদের জুতো ! যদি বিছানায় ঘুমোনোর জন্য আলাদা জুতোর প্রচলন হয় তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ অতএব জুতো ক্রমেই জাতে উঠছে…

বলে রাখা ভালো জুতো বিষয়ক সরস গল্প বা জুতোর প্রকারভেদ- ইতিহাস একত্র করে লেখাটির বহর বাড়ানো আমার উদ্দেশ্য নয়৷ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে দুটো কথা লিখতে বসেছি, কারণ জুতো আর পায়ে থাকছে না, মাথায়ও চড়ছে । ঘটনাটি সবারই জানা তবুও বলতে গেলে শুরু থেকে বলাই শ্রেয়।

বাঙলার প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ অভিনয়জীবনের অবসান ঘটিয়ে গত ২৭শে কার্তিক ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বলা বাহুল্য, তাঁর বিদায়ের পরের দিন কলকাতার ও বাংলাদেশের সবগুলি দৈনিক কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছে। অবশ্য তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ পাওয়ার পরপরই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তারপরও পরদিন সকালের খবুরে কাগজটির জন্য অনেকে তাকিয়ে ছিলেন— তাঁর সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত জানার জন্য। আমিও ব্যতিক্রম নই। শোকের আবহের মধ্যে চমকে ওঠার মতো একটি ছবি দেখা যায় কলকাতার ‘গণশক্তি’ পত্রিকার প্রথম পাতায়—সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবির উপরে (বলা ভালো মাথার উপরে) আড়াআড়ি করে দেওয়া জুতোর বিজ্ঞাপন। ছবিটা অনেককে স্তব্ধ করে দিয়েছে— অনেকে ছিঃ ছিঃ করেছেন ৷ আবার অনেকের বক্তব্য ‘পুরোনো চিন্তাভাবনা ছাড়ুন মশাই, জুতোর বিজ্ঞাপন দিয়েছে বলেই ছোট করা হলো কীভাবে?’ আবার অনেকের বক্তব্য — ‘অসাবধানতাবশত একটা ভুল হতেই পারে, তা নিয়ে চিৎকার করার কী আছে?’

এবার আমরা যদি এই দুটি বক্তব্যের যৌক্তিকতা বিচার করতে বসি তাহলে হয়তো এর পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব হবে না। এ বিষয়ের সমাধান খুঁজতে গেলে তাকাতে হবে আমাদের বর্তমান জীবনাচরণের কয়েকটি চিত্রের দিকে। অনেকে বলতে পারেন একটি সামান্য বিষয় নিয়ে এতো ফেনিয়ে বলার কী আছে? আসলে তেমন কিছু বলার নেই…

আমাদের দেশে একটি কথার প্রচলন আছে যে, ‘পায়ের জুতো মাথায় তুলতে নেই’— এই কথটি সমাজের উঁচু-নিচু শ্রেণির বিভেদ বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়; এখানে জুতো মানে পয়সাকড়ি-বংশ-সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে নিচুস্তরের লোক। স্পষ্টতই প্রবাদটি আক্ষরিক অর্থে নয় কিন্তু এবার সত্যি সত্যি পায়ের জুতো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কৃতি বাঙালির মাথার উপরে স্থান পেয়েছে। এইদিনে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হলেও হয়তো একই ঘটনা ঘটতো — তাই এই বিষয়টি একটু নেড়েচেড়ে দেখা দরকার ।

বাঙালিসমাজে জুতো পায়ে দিয়ে বিশেষ বিশেষ স্থানে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু প্রথার প্রচলন আছে, যেমন ; জুতো পায়ে দিয়ে মন্দির-মসজিদসহ প্রার্থনাগৃহে কেউ প্রবেশ করে না। এছাড়াও শহীদমিনার, স্মৃতিস্তম্ভ, ও স্মৃতিরক্ষার্থে নির্দিষ্ট স্থানসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে জুতো পায়ে ওঠা নিন্দনীয় কাজ বলে বিবেচিত — এগুলো বাঙালিসমাজের চিরন্তন প্রথার অংশ। যুক্তি দিয়ে এসবের কারণ নির্ধারণ করতে যাওয়া বোকামি ৷ তবে এখন অনেকে এগুলোর বিপক্ষে বলা শুরু করেছেন, তাদের বক্তব্য এরকম – “জুতো কেন খুলতে হব? , জুতো পায়ে দিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলে ক্ষতি কী? অমুক দেশে তো জুতো নিয়ে এরকম বাঁধা নেই… ইত্যাদি ইত্যাদি… ”

আমাদের বঙ্গদেশে তথাকথিত কিছু যুক্তিবাদী আছেন যারা অজস্র অযৌক্তিক আচার আনুষ্ঠানিকতা পালন করার পরেও শুধু এই প্রথাগুলোর বিপক্ষে খুব সরব ৷ তারা প্রথানুযায়ী জন্মদিনে কেক কাটেন, বিয়ে দিবস, প্রেম দিবস, চকোলেট দিবস, গোলাপ দিবস পালন করেন। প্রথা মেনেই বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে বিশেষ বিশেষ পোশাক ব্যবহার করেন অথচ যে নিয়মগুলোর সঙ্গে আমাদের জাতির শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতাবোধ-নম্রতার সৌন্দর্য জড়িত তারা সেগুলো বাতিল করতে চান৷

অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম প্রথাবিরোধী মানুষ ছিলেন,
ধর্মে-ঈশ্বরে, প্রথাগত সামাজিক নিয়ম-রীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তবুও একটি পুরোনো ছবিতে দেখা যায়— তিনি জুতো খুলেই ‘ অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছেন। শোনা যায়, অল্প দু’একজন যারা জুতো খুলে অপরাজেয় বাংলায় উঠতেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ একজন। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গিয়ে দেখলাম ঘুরে ঘুরে বই কিনে ক্লান্ত হয়ে আমাদের বিদ্বান-বিদুষীগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অপরাজেয় বাংলা’র উপরে জুতো পায়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন ।

এখন বাঙালি আবার দুই ভাগে বিভক্ত — পূবের বাঙালি ও পশ্চিমের বাঙালি। স্খলন ঘটেছে দু’দিকেই। বাঙালিরা এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাঙালিত্ব দেখানোর ব্যাপারে যতোটা সরব বাঙালির চিরন্তন আবেগ-অনুভূতি হৃদয়ে ধারণ করার ব্যাপারে ততোটা নন। তবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ছিলেন সেহেতু ঘটনাটির কারণ নির্ধারণ করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি আমাদের বিবেচনায় আনা দরকার। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বোধে, নিয়ম-প্রথা পালনের দিক থেকে কিছু পার্থক্য রয়েছে। একসময়ে কলকাতা বঙ্গের শিল্প- সাহিত্যের রাজধানী হিসেবে খ্যাত ছিল। কিন্তু কলকাতার অধিকাংশ মানুষের আচরণ-উচ্চারণ বর্তমানে ব্যাপকভাবে বিকৃত হয়েছে । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – ‘‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।” ‘কলকাতার সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ’ কথাটি উল্লেখযোগ্য।

বাঙালি ভাষাভিত্তিক জাতি অতএব যেখানে বাংলাভাষার মধ্যে দূষণ ঘটেছে সেখানে সবকিছু দূষিত হতে বাধ্য, নষ্ট হতে বাধ্য । কলকাতার শিক্ষা-সংস্কৃতি, নাটক-সিনেমা, ব্যবসা-বাণিজ্যে অবাঙালিদের বিরাট আধিপত্য রয়েছে এবং সেখানকার শিক্ষিত বাঙালিদের বেশিরভাগের মধ্যে নিজেদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য কোনো আগ্রহ নেই ৷ কলকাতার বাঙালিদের হিন্দিপ্রীতি অবাক করার মতো এবং বাংলা ভাষায় কথা বলার সময় হিন্দি/ইংরেজি বাক্যাংশের ব্যবহারও বাড়ছে । বাংলাদেশের মানুষও এখন একই পথে হাঁটছে, তবু বাংলাদেশে অন্তত অবাঙালিদের দাপট নেই । সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘ ভূতের নয়, ভবিষ্যতের’ গ্রন্থে লিখেছিলেন— ‘কলকাতায় মাড়োয়াড়ি দোকানির কাছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের মাহাত্ম্য শুনতে হয়, এবং তার দোকানের বাঙালী কর্মচারী নীরব মুখে ক্যাসেটটি এগিয়ে দেন ’।

অতএব ক্ষতটা অনেক গভীরের। তাই এসময়ের কলকাতায় কোনো কিছুই বিচিত্র নয়।
একটি গল্প বলে শেষ করতে চাই— একদিন দুপুরবেলা পার্ক স্ট্রীট ধরে হাঁটছিলাম। একটি দামি পান-সিগারেটের দোকানের সামনে একজন ভিখারী এসেছেন, অবাঙালি দোকানদার তাঁকে হিন্দি ভাষায় গালাগাল তো করলেনই, বাঙালি জাতির চৌদ্দ-পুরুষ উদ্ধার করতে বাদ রাখলেন না৷ তার চেয়ে অবাক করা বিষয় হলো পাশেই কিছু বাঙালি দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন… তারাও নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে শুনলেন।

বাঙালির শহরে দাঁড়িয়ে অবাঙালিরা যদি বাঙালিদের অপমান করতে পারে তাহলে প্রয়াত বাঙালি শিল্পীর মাথার উপরে অবাঙালিদের কোম্পানির জুতোর ছবি থাকলে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই । গভীরের ক্ষত নিরাময় না করা গেলে উপরের ছোট্ট ফুসকুড়ি দেখে চিৎকার করা সমীচীন হবে না।