শ্মশানে শম্ভুনাথ মল্লিকের শবদেহটা যেখানে রাখা ছিল তার খুব কাছেই একটা মরা হাঁস পড়ে থাকতে দেখলাম—পাশেই ফটকী নদী। হয়তো দু’দিন আগেও ‘কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে’ যতদূর মন যায় ভেসে যেত হাঁসটি…
শম্ভুনাথ স্যারের হেঁটে যাওয়ার ধরনটা ছিল ঠিক ওরকমই– ভেসে যাওয়ার মতো ৷ একটা ঢিলেঢালা প্যান্ট, অতি সাধারণ চটি ও হাতাকাটা জামা পরে, কখনো হাতে একটা লম্বা কালো ছাতা নিয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান শ্রী শম্ভুনাথ মল্লিক উদাস ভঙ্গিতে হাঁটতেন। খেয়াল করেছি, হাঁটার সময় তিনি মাঝে মাঝে আশেপাশে চলাচলকারী অনেকের মুখের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছেন, মৃদু হাসছেন— যে হাসি তাঁর ওষ্ঠের বা মুখাবয়বের কোনো পরিবর্তন ঘটাতো না। যতবার দেখেছি আমার মনে হয়েছে তিনি কোনো নির্দিষ্ট স্থানের উদ্দেশ্যে হাঁটছেন না, হাঁটার আনন্দের জন্যই হাঁটছেন–যেমন জীবনানন্দ আনমনে হেঁটে বেড়াতেন কীর্তনখোলা জাহাজঘাটার পাশ দিয়ে।
শবদেহের পাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্যগুলো অবাধ্য উড়ন্ত মেঘের মতো চোখের সামনে ভেসে আসছে। পাশে দাঁড়ানো শম্ভুনাথ মল্লিকের একজন বন্ধু কেঁদে কেঁদে তাঁর স্মৃতি আওড়ে চলেছেন । তিনি নাকি বলতেন, ‘শেষ দিন পর্যন্ত নিরাসক্ত জীবন কাটাতে চাই ‘। তাঁর এই নির্লোভ-সাধারণ-মোহহীন জীবন আকৃষ্ট করেছিল সেই বৈষ্ণব বন্ধুটিকেও। তিনি কাঁদতে কাঁদতে যা বলছিলেন তার সারকথা হলো, মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ- শরৎ-জীবনানন্দ পড়তে-পড়তে, পড়াতে-পড়াতে আর্থিক- সাংসারিক মোহ তাঁর অনেক আগেই কেটে গিয়েছিল। বাস্তব জগতে হাঁটাচলা করলেও তাঁর বিচরণ ছিল অন্য কোন এক অধরা জগতে, যেখানে রূঢ়- নির্দয়- লেনদেনসর্বস্ব এবং তথাকথিত আধুনিকতার অসহনীয় যন্ত্রণা নেই ।
আমরা এখনকার সময়ে অর্থাৎ শম্ভুনাথ মল্লিকের চলে যাওয়ার সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনের যে চিত্র পাচ্ছি তা এরকম – শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে, ক্লাসভর্তি ছেলেমেয়েদের হাতে ফোন, ভিডিও ক্লাস হচ্ছে, শিক্ষকগণের চলাচল- পোশাক- কথা বলা -পড়ানো কিছুই আর আগের মতো নেই। এ প্লাস বেড়েছে, পাশের হার বেড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে । সঙ্গে যদি আরও যুক্ত করি – অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের মধ্যে অনেকের ব্যাপকভাবে অনৈতিক ও অসৎ কাজে জড়িয়ে পড়া, ছাত্র-ছাত্রীদের শৃঙ্খলাহীন আচরণ- মাদকাসক্তি আরও অনেক কিছু৷ শ্রদ্ধা-সমীহবোধ ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। তাহলে সেই সাদামাটা পোশাক পরে সাইকেল চালিয়ে বা হেঁটে স্কুল-কলেজে আসা অভাবী শিক্ষকদের যুগ শেষ হবার পর আমরা যে ব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষাঙ্গন চালাচ্ছি বা চালাতে চেষ্টা করছি তাতে যে বিরাট অন্তঃসারশূন্যতা রয়ে গেছে একথা হয়তো কেউ অস্বীকার করবেন না । এমন নয় যে আগের সবকিছুই খুব সুন্দর-সুশৃঙ্খল-সুষ্ঠু ছিল। চোখে যতটুকু ধরা পড়ে তা যদি মিথ্যে না হয় তাহলে বলা যায়, আমাদের এই সময়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন-ল্যাপটপ, ডিসকভার-কালচারের উড়ন্ত গতিতে শেখার বা শেখানোর সেই আত্মনিবেদন, সেই ধৈর্য্য- উৎসাহ হারিয়ে গেছে।
আমাদের মধ্যে যাদের স্বপ্ন শিক্ষকতা করা তাদের পক্ষে শম্ভুনাথ মল্লিকের জীবনধারা অনুসরণ করা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে তাঁর জীবন থেকে যে শিক্ষা আমরা পেতে পারি তা হলো —যিনি শিক্ষক, তিনি অষ্টপ্রহরই শিক্ষক। আচরণে-উচ্চারণে, ভাবে-অভাবে, চিন্তায়-কর্মে সর্বক্ষণ তাঁকে এই শিক্ষক সত্তা বহন করে যেতে হয়। শম্ভুনাথ মল্লিকের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যগুলো যদি বিবেচনায় আনি তাহলে নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায় চাকচিক্যসর্বস্ব-আড়ম্বরপূর্ণ-বিলাসী জীবন শিক্ষকতার পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। শম্ভুনাথ মল্লিক বা তাঁর মতো শিক্ষক-অধ্যাপকগণ যেদিন থেকে আমাদের দেশে বেমানান হতে শুরু করেছেন, মনে করতে হবে পতনের শুরু সেদিন থেকেই৷
ঘটনাক্রমে আমি সেই কলেজে (আড়পাড়া ডিগ্রী কলেজ) প্রায় বছর দুয়েক খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে ছিলাম —যেখানে শম্ভুনাথ মল্লিকের মতো শিক্ষক পড়াতেন। প্রথমদিকে উঁচু তক্তপোশের উপর উঠে অনুভব করতাম, যেখানে দাঁড়িয়ে শম্ভুনাথ মল্লিক পড়িয়েছেন সেখানে আমি কে? যে মানুষটাকে তখনও হাঁটাচলা করতে দেখা যেত এবং আমাদের অঞ্চলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে কারো কিছু জানার-বোঝার-প্রশ্ন করার দরকার পড়লে প্রথমেই যার নাম মনে আসতো তিনি আর কেউ নন, ওই অতি সাধারণভাবে আপন মনে হেঁটে চলা শম্ভুনাথ মল্লিক । কিশোর থেকে বৃদ্ধ যে কেউ চলতি পথে বা চায়ের দোকানে বসে কিছু জিজ্ঞেস করলেও তিনি অভাবনীয় ভঙ্গিতে জলের মতো সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। এমএ-বিএ- ডক্টরেট আমাদের চারদিকে অজস্র আছেন, কিন্তু আমাদের অঞ্চলে একজনই শম্ভুনাথ মল্লিক ছিলেন।
যেহেতু আমার স্বপ্ন ছিল কলেজে পড়ানো সেহেতু পড়িয়ে গেছি কিন্তু একটা ব্যাপার ক্রমেই বুঝতে পেরেছি যে, বাংলা সাহিত্যে অনার্স -মাস্টার্স (গালভরা বাংলায় যাকে বলে স্নাতক-স্নাতকোত্তর) শেষ করলেই বা প্রচুর পড়ালেখা করলেই বাংলা পড়ানো যায় না। নিজের অশেষ ত্রুটি খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছি আর অতি-উৎসাহে ভাবতাম শম্ভু স্যারের মতো হবো, কিন্তু ক্রমে বুঝেছি–যে পরিবেশ, যে নিষ্ঠা, যে নিবেদন দরকার তার থেকে আমি সহস্রক্রোশ দূরে।
আমাকে তিনি চিনতেন না, আমি তাঁর ক্লাসের ছাত্রও ছিলাম না। তবে দু’একবার নমস্কার করে কথা বলেছি। মুখের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবেন তিনি সাধারণ কেউ নন অথচ সারাজীবন তিনি সাধারণের ভিড়েই ছিলেন। এখনকার শিক্ষকদের মতো তাঁর দুরন্ত গতির মোটরবাইক ছিল না, স্মার্টফোন ছিল না, রঙ মেলানো পোশাক বা কোর্ট-টাই ছিল না। তবে শম্ভুনাথ মল্লিকের মধ্যে যা কিছু ছিল তা দেখানোর জিনিস নয়, সাধনার্জিত ঐশ্বর্য …
এই রূপসী বাংলা থেকে গত ১১ ই কার্তিক তিনি বিদায় নিয়েছেন। ‘হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’ তিনি আবার ফিরে আসবেন।