আমাদের চারপাশে যে সব ঘটনা ঘটে তা শুনে ছি ছি না করে আমরা অনুসন্ধান করতে পারি এর পিছনের আসল রহস্য। যৌনতাকে ট্যাবু করে যে সব সমাজ পরিচালিত হচ্ছে তারা জীবন সম্পর্কে কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে সেটাও আমরা বিচার করতে পারি বিবর্তনীয় মনো-জৈববিজ্ঞানের আলোকে। এই বইটিতে নারী-পুরুষ সম্পর্কের একটি জৈববিজ্ঞানীয় ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে মাত্র।
বিজ্ঞান কেবল মাত্র তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সমাজ ও মানুষের প্যাটার্ন বা ধরন নিয়ে অনুসন্ধান করে। সামাজিক জীবনে এর প্রয়োগ কেমন হওয়া উচিৎ তার বিচারের রায় সে দেয় না। এমন কি প্রাণী জগতে কে শ্রেষ্ঠ তাও সে প্রমাণ করে না। এক সময় মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে সহিংস হয়েছে, গ্যাদারার হয়েছে, বহুগামী হয়েছে আজও সেই মানুষই তার নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়, অহিংসার বাণী শোনায়, একগামী সম্পর্কে আস্থাশীল হওয়ার চর্চা করে। বিবর্তনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে প্রকৃতিকে অনেকটাই নিজের নিয়ন্ত্রনে নিতে শিখে গেছে। এখন সে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে, বাল্য বিবাহকে না বলে, সমাজ ও রাষ্ট্র স্বীকৃত আইনের মাধ্যমে পরকীয়াকে পরিহার করে। কিন্তু মানব জিনের একমাত্র লক্ষ টিকে থাকা তাই মানুষের কাছে তার বেঁচে থাকাটাই জরুরী বলে মনে হয় আর এই বেঁচে থাকার জন্য সে হয় তার সমাজকে নিজের মতো করে গড়ে নেয়, না হয় সে সমাজের ইচ্ছে মাফিক নিজেকে বদলে নেয়। যে সব সংস্কারবাদীরা জেনেটিক্সের কান্ডকারখানা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন তাদের জন্য এপিজেনেটিক্স ও নিউরোপ্লাস্টিসিটির গবেষকগণ দারুণ আশার কথা বলছেন। জেনেটিসিস্ট জেমস ওয়াটসন যতই বলুন- ‘মানুষের ভাগ্য আকাশের তারায় লেখা নেই, তার ভাগ্য লেখা রয়েছে জিনে।’ এপিজেনেটিক্স এবং নিউরোপ্লাস্টিসিটি সেই জিনকেও সমঝে চলার শিক্ষা দিচ্ছে।
আধুনিক এপিজেনেটিক্স এর গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারছি পরিবেশ থেকে কিভাবে সংকেত নিয়ে মানুষের জিন তার আভ্যান্তরিণ প্রকাশ ভঙ্গিকে বদলে ফেলছে। বিজ্ঞানীরা এই ধরনের জিনকে চিহ্নিত করছেন নমনীয় জিন বা এজাইল জিন হিসেবে। ড. ডাওসন চার্চ তার The Genie in your Genes বইয়ে বলেন- বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে, আমাদের ক্রোমোজমের মধ্যে জিনের নির্দিষ্ট সেট থাকতে পারে, তবে সেই জিনগুলোর মধ্যে কোনটি সক্রিয় তা আমরা আমাদের বিষয় ভিত্তিক অভিজ্ঞতাগুলো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আর তাই বলাই বাহুল্য যে মানুষ সেই অভিজ্ঞতা পরিবেশ থেকেই লাভ করে। সেই রকম একটি গবেষণা করলেন অধ্যাপক জার্টেল। তিনি এগুটি ইদুর নিয়ে গবেষণা করেন। এগুটি নামের যে জিন মানুষের ওবিসিডি এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় সেই জিন এই ইদুরগুলোর মধ্যে রয়েছে। এদের গায়ের রং হলদেটে। এই জিনের কারণে এই ইদুরগুলো কেবল খেয়েই যায় আর ক্যান্সার আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে খুব তাড়াতাড়ি মারা যায়। অধ্যাপক জার্টেল এইরকম কিছু ইদুর আলাদা করলেন এবং ল্যাবে একটি কাচের জারে রেখে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করলেন। কিছু দিনের মধ্যে তিনি দেখলেন ইদুরের জেনেটিক প্রকাশ ভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। এমন কি এসব ইদুর থেকে যে সব বাচ্চা জন্ম নিয়েছে তাদের অধিকাংশই এই রোগের ঝুঁকি মুক্ত। আবার তাদের বাচ্চাদের গায়ের রঙেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জেনেটিক কোডের কোনো বদল না ঘটিয়ে কেবল খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে এবং পরিবেশ বদল করে যে দেহজ বৈশিষ্ট্য বদল করা যায় তা প্রমাণ করলেন এপিজেনেটিক্স এর গবেষকগণ। ডাক্তাররা জানলেন জেনেটিক ভাবে হৃদরোগ ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি নিয়ে জন্মানোর পরেও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে, ব্যায়াম করে অনেকাংশেই রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
অধ্যাপক জার্টেল দেখলেন এগুটি ইদুরের জেনেটিক প্রকাশ ভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে।
এদিকে গবেষক মোজে সিজফ ও মাইকেল মেনিও ইঁদুর নিয়ে আর একটি গবেষণা করেন। তারা দুই ধরনের ইঁদুর তাদের গবেষণার জন্য বাছাই করলেন। এক ধরনের ইঁদুর নিলেন যাদের মা ইদুরেরা বাচ্চা জন্মানোর পর তাদের যত্ন নেয় না। আর এক ধরনের ইঁদুর নিলেন যাদের মা বাচ্চা জন্মানোর পর জিভ দিয়ে বাচ্চার গা চেটে দেয় এবং বিশেষ পরিচর্যা করে। দেখা গেছে, যে মা ইঁদুরেরা বাচ্চার যত্ন নেয় না সেই সব বাচ্চারা স্বভাবে অস্থির আর ভীতু হয়ে বেড়ে উঠেছে। তাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস নামের প্রত্যঙ্গটি সংকীর্ণ এবং ট্রেস হরমোন কর্টিসলের উপস্থিতি খুব বেশি। অন্য দিকে যে সব বাচ্চা মায়ের আদর পেয়ে বেড়ে উঠেছে তারা হয়েছে বেশ সাহসী আর বন্ধুভাবাপন্ন। তাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের প্রত্যঙ্গটি অনেক বর্ধিত এবং ট্রেস হরমোন কর্টিসলের উপস্থিতি অনেক কম। ড. সিজফ ভিতু ইঁদুরদের মস্তিষ্কে এমন একধরনের এনজাইম (এসিটাইল গ্রুপ) প্রবেশ করালেন যা কর্টিসলের উৎপাদনকে বাঁধা দেয়। আর সাহসী ইঁদুরদের মাথায় মিথাইল গ্রুপকে প্রবেশ করালেন। এর ফলে ভিতু ইদুরেরা হয়ে উঠলো সাহসী আর সাহসীরা হয়ে গেল ভিতু ও অস্থির। আর এই ঘটনার পর বিজ্ঞানীদ্বয় লিখে ফেললেন ‘ ডিএনএ ইজ নট ডেসটিনি’ নামের প্রবন্ধ।
মানুষের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যারা ট্রেসফুল জীবন যাপন করে তাদের অবস্থা হয় ভীতু আর অস্থির স্বভাবের ইঁদুরগুলোর মতোই। তাদের মস্তিষ্কে ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে যত্ন পাওয়া শিশুদের চেয়ে সমাজে অযত্নে বেড়ে ওঠা শিশুরাই হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। তাদের বড় একটি অংশ জড়িয়ে পড়ে অসামাজিক কাজকর্মে। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এরিক নেস্টলার দীর্ঘ দিন ধরে বিষন্নতায় ভোগা রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, তাদের মস্তিষ্কে হিপোক্যাম্পাসের আকার ও আয়তন স্বাভাবিকের চেয়ে সঙ্কীর্ণ এবং সেখানে তারা প্রোটিনের (হিস্টোন) মিথাইল গ্রুপের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। এখন ডাক্তারগণ জানেন বিষন্নতায় ভোগা রোগীদের কিভাবে সারাতে হয়। তারা মিথাইল গ্রুপের কাজকর্মকে বাঁধাগ্রস্থ করার জন্য ওষুধে এসিটাইল গ্রুপকে হিস্টোনের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। আর এতে বিষন্নতা দূর হয়, মন ফুরফুরে করে তোলে।
এপিজেনেটিক্স ছাড়াও মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটি নিয়ে গবেষণা করছেন গবেষকগণ। এক সময় মনে করা হতো, মানুষের মস্তিষ্কের বদল ঘটানো সম্ভব নয়। এমন ধারণাকে বদলে দিয়েছে নিউরোপ্লাস্টিসিটি। গবেষকগণ বলছেন, পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে মানুষের মস্তিষ্ক নিজেকে বদলে ফেলতে পারে। স্ট্রোক করা রোগীরা যেমন পুনরায় কথা বলা শিখেছে তেমনি ভাবে অর্ধমস্তিষ্ক নিয়ে জন্মগ্রহণ করা নারীও নিজেকে পুরোপুরি তৈরি করে ফেলেছেন নিজের জন্য। আমরা যদি আমাদের মস্তিষ্কের দিকে লক্ষ রাখি দেখবো ব্রেইন বিকল্প পথে একেবারে স্থায়ী ভাবে নিজেকে বদলে দেয় আর বদলে দেয় মানব প্রকৃতি ও মানব সম্ভাবনাকে। বিখ্যাত নিউরোপ্লাস্টিসিটিস্ট ড. নরম্যান দাইস তার বিখ্যাত বই ‘দ্য ব্রেইন চেঞ্জ ইটসেল্ফ’ এর চতুর্থ অধ্যায় দেখান যে, নিউরোপ্লাস্টিসিটি আমাদের ভালোবাসা ও যৌনতার আচরণে কিভাবে শিক্ষা দেয়। তিনি বলেন, প্রেমের বেদনাগুলির একটি রসায়ন রয়েছে। যখন খুব বেশি দিনের জন্য প্রেমিকযুগলকে আলাদা করা হয় তখন তারা তাদের বেদনার অভিজ্ঞতার কথাগুলি ভুলে যায়। তারা তখন উদ্বিগ্ন হয়, পরস্পরকে সন্দেহ করে এক পর্যায়ে হতাশ না হয়ে রান ডাউন বোধ করে। নিজেদের একটু ঠিকঠাক করার মতো যদি তারা ফুরসৎ পায় যেমন- প্রিয়জনের কাছ থেকে যদি চিঠি, ই মেইল বা একটি টেলিফোন বার্তা পায় তাহলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে উজ্জিবীত হবার মতো শক্তি ফিরে পায়। এভাবেই প্রেমিক প্রেমিকার উপস্থিতি অনুপস্থিতিতে আমাদের মস্তিষ্কের কাঠামোগত প্লাস্টিক পরিবর্তনের বিষয়গত লক্ষণগুলি এডাপ্ট করে নেয়। ডোপামিনের এমন অভিনবত্ব রয়েছে যা মনোগামী জুটিকে একে অপরের প্রতি সহনশীল করে এবং এটা তাদের শরীরে ইনজেক্টিং এর মাধ্যমে তাদের সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে ও উজ্জিবীত করতে পারে। আবার কোনো জুটি যদি মধুচন্দ্রিমায় যায় বা আচার আচরণে অভিনবত্ব আনে অথবা নতুন পোশাক পরে অথবা একে অপরকে বিস্মিত করার চেষ্টা করে তা হলেও তারা আনন্দ খুঁজে পেতে পারে যা তাদের মস্তিষ্কেকে নতুন প্রেরণা পেতে সাহায্য করবে এবং সেই ভাবে তাদের মস্তিষ্ক বিকশিত হবে। প্লাস্টিসিটি প্রতিযোগিতা মুলক। যখন কোনো ব্যক্তির নিউরাল নেটওয়ার্ক বিকশিত হয় তখন তা অভ্যাস মতো আরো বেশি কর্মক্ষম ও স্বাবলম্বী হয়। এটা খুব দ্রুত কোনো কিছু মুছে ফেলতে বা পরিবর্তন করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে অজনা বিষয়ের তুলনায় জানা বিষয়গুলোর ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন রসায়নগুলো সংশ্লিষ্ট থাকে। আমরা জানি জিনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেঁচে থাকা বা টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা। অতএব পরিবেশের কোনো পাঠ থেকে যদি সে জেনে নিতে পারে যে বিষয়টি তার বেঁচে থাকার জন্য হুমকী স্বরূপ তা হলে সে তার প্রকাশ ভঙ্গিকে বদলে ফেলবে। এপিজেনেটিক্স ও নিউরোপ্লাস্টিসিটি গবেষকগণ আমাদের আশ্বস্ত করেন যে, জিনের অভ্যন্তরস্থ জিনগত যে প্রকাশভঙ্গি তার অনেক কিছুই পরিবেশের উপর ভিত্তি করে বদলানো সম্ভব। মানব প্রকৃতি গঠনে জিন যেমন ভূমিকা রাখে তেমনি ভূমিকা রাখে পরিবেশ। প্রকৃতিকে পরিবেশ থেকে আলাদা করা যায় না। আর একারণে ম্যাট রিডলী তার ‘এজাইল জিন’ বইয়ে বলেন, ‘আমি মনে করি, মানুষের ব্যাবহার বিশ্লেষণে প্রকৃতি ও পরিবেশে দুটোকেই ধর্তব্যের মধ্যে রাখা উচিৎ। ম্যাট রিডলী বলেন, বিষয়টা আর প্রকৃতি বনাম পরিবেশের নয় বরং পরিবেশ দিয়ে প্রকৃতির।’ অতএব বিজ্ঞান দিয়ে মানব প্রকৃতি জানা উচিৎ এবং উপযুক্ত পরিবেশ দিয়ে বাঞ্ছিতের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সৃষ্টির চেষ্টা করা উচিৎ। তা হলেই জিনের ওপর শত ভাগ না হলেও কমপক্ষে ৪৫% প্রভাব বিস্তার করতে পারবে মানুষ।
— শেষ —