নির্মাল্য কুমার মুখোপাধ্যায়’র কবিতা

লেখক পরিচিতি

পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাট শহরে জন্ম-১৯৬৫ সালে। বাবা মধ্যসত্বাধিকারী। মা সরকারি আধিকারিক। লেখাপড়া কলকাতা ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি, বিএড।
পেশায়-ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক।
নেশা-সাহিত্য সঙ্গীত ভ্রমণ রান্না ফটোগ্রাফি।
প্রকাশিত কবিতা-দেশ, আবহমান, প্রজন্ম, প্রান্তিক-সহ নানা লিটল ম্যাগাজিন।
প্রকাশিত গল্প-সাপ্তাহিক বর্তমান, কুঠার, অন্য প্রমা, গল্প সরণি-সহ আরো নানা ম্যাগাজিনে।
প্রবন্ধ-ভূমিবার্তা, গাঙচিল, প্রমা-সহ নানা পত্রিকায়।
উপন্যাস-প্রেসে গেছে।


মাত্রা

খুব মনযোগ দিয়ে তুমি রান্না করছ তোমার প্রিয়জনের জন্য কোন এক বিশেষ পদ
ঝুঁকে আছ ওভেনের ওপর
চামচ করে মুখে তুলে দেখে নিচ্ছ স্বাদ গন্ধ ঠিক হয়েছে কিনা
আমি নিঃশব্দে এসে পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছি তোমার মনযোগের ভঙ্গিটুকু
একতরফা প্রেমিক হিসেবে আমার
মনে মনে খুব ইচ্ছে করছে তোমার অপার্থিব কোমর জড়িয়ে ধরতে...
নাহ্‌, থাক।
তাহলে এই ছন্দময় কবিতার শেষ লাইনে একটা দুটো মাত্রা কম বেশি হয়ে যেতে পারে—

কোমল বিষাদ

হয়ত তোমার চুলের ভেতর বৃষ্টির ছাঁট
হয়ত এখন তোমার কোলে রবীন্দ্রনাথ
পায়ের কাছে গুটিয়ে শুয়ে মিষ্টি বেড়াল
স্টিরিওফোনে ভীমসেনজি গাইছে খেয়াল ।
হয়ত তোমার পড়ছে মনে কি-পড়ছেনা
সেলফোনে গান শুনিয়েছিলেম আজ শ্রাবণের
আমন্ত্রণের কফির কাপে ঝাপসা কাচে
মুখোমুখি, ভাব জমানর নরম দেওয়াল।
মাঝে মধ্যে দিচ্ছিলে চুল মাথায় ঠেলে
চশমা নেমে যাচ্ছিল ঠিক নাকের ডগায়
আমার আঙুল নিশপিশিয়ে মরছে কেবল
মুছিয়ে দিতে ঠোঁটের পাশে দুষ্টু পেঁয়াজ ।
হয়ত আবার বাজ পড়বে কোথাও জোরে
বাজের আওয়াজ ভর করে খুব তোমার ভেতর
স্পষ্ট আমি দেখতে পাচ্ছি থরথরিয়ে
কাঁপছে নরম বুকের ভেতর কোমল নিষাদ।
মাঝ রাত্তির বৃষ্টি আবার আসছে চেপে
জানলা দিয়ে ঘরের ভেতর চোর ডাকাতি
হয়ত তুমি গায়ের ওপর চাদর টেনে
আমার পাশে কুঁকড়ে শুয়ে চরম বিষাদ।

দ্বিধা

তোর গায়ের গন্ধ আলাদা
ওর টক
তোর হালকা ঝাঁজ
বসবার ভঙ্গি মেলে না
তোর শ্যাম
ওর রাধা ভাঁজ।
ওর টোল
তোর গজদাঁত
হেসে ঝুঁকে পড়িস যখন
গভীর
গভীরতর খাঁজ।
ওর গায়ে হালকা বরফ
তোর গায়ে
রেশমের কাজ
ও কখনও ভুল ক'রতো না
তুই হলি
ডাঁহা ফাঁকিবাজ।
ও টান
তুইও টানটান
দুজনার দুরকম ঘাই
আমিও যে ঘরপোড়া ছাই.....
এখন আমি কোনদিকে যে
যাই!

মঙ্গল কাব্য

উঠছে নামছে হাতুড়ি শাবল
গায়ের জোরে গাঁইতি
মস্ত বড় সাইন বোর্ডে
দক্ষিণ খোলা বেডরুম
উধাও হয়েছে কৃষ্ণচূড়া
মিলিয়ে গিয়েছে ঘাসফুল
চতুর্দিকে টিনের বেড়া
চুরচুর শুধু ভাঙচুর
সমস্ত রাত লরির শব্দ
গ্যাস কাটারের চিৎকার
ধুলোয় ধুলোয় সব কিচকিচ
বিল্ডার আর বোল্ডার
আকাশ ছুঁচ্ছে ইস্পাত থাম
নামিয়ে দিচ্ছে মশলা
সারারাত জেগে বাতাস কাটছে
অতিকায় ব্লক বাস্টার

হেমন্তের সন্ধ্যা

একটাই ঘর একটি জানলা
কবি বসে বসে লিখত
বন্ধ কপাট বাইরে জগত
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত
একদিন কবি উন্মাদ প্রায়
খুলে দিল উঠে জানলা
সামনে দাঁড়িয়ে বহুতল গাছ
থাকে থাকে ওঠা আলনা
কোন কোন তাকে শিশুদের মুখ
কোন তাকে মেলা নীল জিন্স
তার ঠিক নিচে অন্তর্বাস
পাশেই উড়ছে লুঙ্গি
আরেকটা তাকে কাঁচাপাকা চুল
ব্রাশ দিয়ে সাদা ঢাকছে
অন্য তাকের আবছা ছায়ায়
ঠোঁটে ঠোঁট টেনে আনছে
কোন কোন তাক সদাই বন্ধ
কেউ কেউ  নির্বান্ধব
একটা তাকে একটা চড়ুই
দিনভর বসে অন্ধ
মাঝরাত্তিরে উন্মাদ স্নান
রতিসুখ সারা যুবতির 
কোন জানলায় আগমনী সুর
রাত জাগা কোন প্রসুতি
কোন তাকে নাচে চাবুকের দাগ
কাচ ফাটা ভাঙা চিৎকার
কোন জানলায় মাথা রাখা কাঁধে
কোন রাতে চাপা শীৎকার
কোন ব্যাল্কনি সাদা চুলে সাদা
একা ফেলে রাখা মা বাবা
কোন জানলায় নাতি নাতনিকে
পাখি চেনাচ্ছে ঠাকুমা
যদি চলে যেতেই হয়
হেমন্তের সন্ধ্যা সেই উৎকৃষ্ট সময়।
এমন অনবদ্য বিষন্ন সন্ধ্যা 
আর কখন পাব।
নিঃসঙ্গ পাহাড় চূড়ায় উঠে
একটি বার ঝাঁপ খাব।
যাইইই,....
শব্দে হেসে উঠবে মেঘ
ঘরে ফেরত পাখিরা ভাববে
সবই অভিনয়। 
ভালই হবে
অভিনয় ভেবে
হাততালি কিংবা শোকাশ্রু বিসর্জন দিতে
কিছু সময় পাবে।
সেই অবকাশে 
শেষ শ্বাস মিলিয়ে যাবে
হেমন্তের শীতল বাতাসে।
যদি চলে যেতেই হয়
হেমন্তের সন্ধ্যা সেই উৎকৃষ্ট সময়।